রাজনীতি-এটা অবশ্যই সুনজির নয় by বদিউর রহমান
ওবায়দুল কাদের নিজের বেতন থেকে এরশাদের লংমার্চের গাড়ির টোল দেওয়া সুনজির হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না। প্রচলিত বিধিবিধান প্রতিপালনের মধ্যেই রাজনৈতিক ভব্যতা নিহিত, এটা ভঙ্গ করার মধ্যে নয়। মন্ত্রীর উচিত ছিল জাতীয় পার্টিকে গাড়ির টোল দেওয়ার জন্য চিঠি দেওয়া এবং তা আদায়ের ব্যবস্থা করা। এরশাদ একদিন সাইকেলে চড়ে অফিসে গিয়ে, জিয়া নিজ হাতে খাল কেটে সস্তা বাহবা নিতে চেয়েছিলেন, ওবায়দুল কাদের কি একই পথ অনুসরণ
করতে চেয়েছেন? রাজনীতিকদেরও নিয়মনীতি মানতে আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে, টোল দেওয়াও তার অংশ। অতএব এ ক্ষেত্রে যোগাযোগমন্ত্রীর নিয়মনীতিতে অগ্রসর হওয়াই কাম্য ছিল, ফাও কথিত উদারতা দেখানো নয়
পত্রপত্রিকায় আমরা অনেক সময়ে আজব, অদ্ভুত, বিরল ও নজিরবিহীন খবর পেয়ে থাকি। এর কোনো কোনোটি আবার আমাদের নাড়া দেয়, ভাবিয়ে তোলে; কোনোটি আবার অবাক করে দেয়, প্রশ্ন জাগে এও কি সম্ভব? কোনো কোনো খবর সত্যিই ভেতরটাকে মুচড়ে দেয়, সৃষ্টির অপরিসীম উদারতায় মনটা ভরে যায়। এক প্রাণী-মা তার শত্রু-শ্রেণীর আরেক মাতৃহীন সাবককে যখন তার বাচ্চার সঙ্গে নিজ দুগ্ধ পান করায় তখন এক শ্বাশত মাতৃস্নেহের স্বরূপ আমরা দেখি; আবার শত শত কলাগাছের কাটা ছবি যখন দেখি তখন মানুষের নির্দয় শত্রুতার এক বীভৎস রূপ ফুটে ওঠে চোখের সামনে। শতকোটি আলোকবর্ষ দূরের গ্রহের খবরে সৃষ্টির বিশালত্বের অসামান্য প্রমাণ যখন নিজেকে নগণ্য ক্ষুদ্রতায় নিয়ে যায়, তখনই আবার মানুষের চন্দ্র-মঙ্গল অভিযানে বিজ্ঞানের জয়যাত্রায় বুক ফুলে যায়। এমনি কত কত আজব, অদ্ভুত, বিরল আর নজিরবিহীন খবর যে আমরা পেয়ে থাকি। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সরকারের সিদ্ধান্ত আর রাজনৈতিক নেতাদের কিছু কর্মকাণ্ডও অবাক করা বটে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-আখাউড়া সড়কের একপাশে তিতাস রেল ব্রিজ, অন্যপাশে সড়ক ব্রিজ, আর মাঝখানে ভারতীয় পণ্য পরিবহনের জন্য আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে তৈরি বাইপাস তিতাস নদীকে হত্যা করেছে দেখলে যেমন বুক ফেটে যায়, তেমনি তার বিপরীতে এরশাদের লংমার্চের ২৫৭ গাড়ির টোল দিয়েছেন যোগাযোগমন্ত্রী_ শুনলে প্রথমে বুকটা ভরে যায়। কী রাজনৈতিক ভব্যতা, কী মহানুভবতা মন্ত্রীর, কী নীতিপরায়ণতা সরকারি পাওনা নিয়ে। এটা অবশ্যই একটা নজির বটে। তবে সুনজির, না কুনজির_ তাই হলো বিবেচ্য। যা-ই হোক না কেন, খবরটা কিন্তু চমক সৃষ্টিকারী, খবরটা কিন্তু অভিনব, অন্তত আমাদের রাজনৈতিক-রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতিতে।
রাষ্ট্রের বা অন্যের পাওনা মেরে দেওয়ায় আমরা ওস্তাদ, এটাই বেশি আমরা জানতাম এবং জানি। পেশিশক্তি, ক্ষমতার দাপট, রাজনৈতিক হুঙ্কার সব ন্যায়নীতিকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে সফলতায় নিয়ে যায় অনেককে। এক এমপি অফিসারকে ঠেঙ্গাবেন, আরেক এমপি ওসিকে তার অফিসে নিয়ে মারবেন, আরেক এমপি ট্রাফিক সার্জেন্টকে হেনস্তা করবেন, আরেক এমপির পিস্তলের গুলিতে দলীয় কর্মী নিহত হবেন, বিরোধী দলের কেউ প্রকাশ্যে রাস্তায় খুন হবেন। কিবরিয়া হত্যা, আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যা, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা, এন্তার এন্তার সবকিছুই হচ্ছে রাজনৈতিক দুরাচার, নির্লজ্জতা। নির্লজ্জ রাজনীতি আর বেশরম রাজনীতিকদের জন্যই এ দেশে এমপিদের জন্য সংবিধান লঙ্ঘন করে শুল্কমুক্ত গাড়িও দেওয়া হয়। এরশাদ তার রাজনীতিকে আরও মজবুত করার জন্য শুল্কমুক্ত গাড়ির 'ঘুষ' চালু করেন, আর সব দলের সাংসদরা নির্লজ্জভাবে নিজেরাই এর সুবিধা গ্রহণ করেন। সেই এরশাদের লংমার্চেই ভৈরব সেতু পারে দেওয়া হয়নি টোল! অনেক রাজনীতিক, মন্ত্রী-এমপি, আমলা সার্কিট হাউসে অবস্থান করে অনেক সময় ভাড়া দেন না, খাবারের বিল পরিশোধ করেন না_ এটা আমরা জানি। সরকারি কাজে না হলেও অনেকে এ সামান্য ভাড়া দিতেও কুণ্ঠাবোধ করেন; এরা জাতে বড় নয়, পদে কিংবা ক্ষমতায় যত বড়ই হোন না কেন। এরশাদের কিংবা জাতীয় পার্টির কি টোল দেওয়ার সামর্থ্য নেই? কত ঢঙের কথা, যানজট এড়ানোর জন্য তখন দেওয়া হয়নি, পরে দেওয়া হয়েছে! কত গাড়ি যাবে তার হিসাব করে আগে কেন অগ্রিম টোল দিয়ে রাখা হলো না? সঠিক সংখ্যা না হলেও আনুমানিক সংখ্যার টোল দিয়েও তো প্রকৃত পাওনা সমন্বয় করে দেওয়া হবে বলে অগ্রিম পরিশোধ করে রাখা যেত, তাও করা হয়নি কেন? আমরাও মহাজোটের অংশীদার বলার 'মাস্তানি'ই-বা গ্রহণযোগ্য হবে কেন?
টোল না দিয়ে টিপাইমুখের লংমার্চ কেমনতর দেশসেবা? টোল কর্তৃপক্ষকে হুমকি-ধমকি দেওয়াই-বা কেমন রাজনীতি? পরে খবর হলো, বেতন পেয়ে যোগাযোগমন্ত্রী তা পরিশোধ করে দিয়েছেন; তারপর আবার খবর হলো, জাতীয় পার্টি টাকা দিয়ে দিয়েছে, যোগাযোগমন্ত্রীর দেওয়া অর্থ তাকে ফেরত দেওয়া হয়েছে। তবুও ভালো যে টোল দেওয়া হলো, যোগাযোগমন্ত্রীও তার টাকা ফেরত পেলেন।
আওয়ামী লীগের নব্য দুই মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এবং ওবায়দুল কাদের মন্ত্রী হওয়ার আগে বেশ কিছুদিন আওয়ামী লীগের এবং সরকারের কড়া কড়া সমালোচনা করেছিলেন কিছু ইস্যুতে। সুরঞ্জিত বাবু তার নিজস্ব ভঙ্গিতে মুখ বাঁকিয়ে, ঠোঁট বাঁকিয়ে বলতেন, বলতেন ভালোই, মানুষ উপভোগ করত। আর ওবায়দুল কাদের বলতেন কিছুটা কাব্যিক ছন্দে, তার নিজস্ব স্টাইলে, তিনিও বলতেন ভালো, তার অমৃত বচনও আমরা উপভোগ করতাম। এসব বলায় দু'জনের মুখ বন্ধ করার জন্য শেখ হাসিনা তাদের মন্ত্রী করে তবে নিস্তার পেলেন। কিন্তু দফতর বণ্টনে কয়েকদিন দেরি হলো, কত মন্ত্রী, কোথায় দেবেন তাদের! শেষ পর্যন্ত দুই মন্ত্রণালয় করে একজনকে যোগাযোগ, আরেকজনকে রেল। তাহলে মানেটা কী দাঁড়াল? মানেটা হলো, আবুল হোসেন একা তিন বছর যে বড় মন্ত্রণালয় চালাতে পেরেছেন এখন নতুন যোগ্যতায় তার অর্ধেকের যোগ্য সুরঞ্জিত আর বাকি অর্ধেকের যোগ্য ওবায়দুল। ভালোই হলো, আবুল হোসেনকে সরিয়ে দেওয়া হলেও তার বড়ত্ব স্বীকৃত থাকল, তিনি বলতে পারবেন_ এক আবুল হোসেন সমান এক ওবায়দুল যোগ এক সুরঞ্জিত, তাই নয় কি? অবশ্য এ দু'জনও বলতে পারবেন, নতুন দায়িত্বে আবুল হোসেনও এখন অর্ধেক, আগের বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দু'ভাগের এক ভাগ। আগের আমলে ড. মইনকে তথ্য থেকে সরাতে গিয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের গালভরা নাম করে তাকে তথ্যের স্বাদে কিছুটা রাখার জন্য তার ইচ্ছাতেই বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় করা হয়েছিল। কত কাতুসিরিরে! আগের রেলের আলাদা বাজেটও হতো, এবার যদি সুরঞ্জিত তা করতে পারেন তাহলে তার সম্মান আরও বাড়তে পারে। অর্থাৎ জাতীয় সংসদে আগের মতো যদি রেলের আলাদা বাজেট পেশ হয় আর কি! ওবায়দুল কাদেরের গত মেয়াদ থেকে এবার পদোন্নতি হলো বলা চলে, প্রতিমন্ত্রী থেকে মন্ত্রী, কাগুজে ভাষায় হাফ থেকে ফুল; আর সুরঞ্জিতের মন্ত্রীর ইতিহাসে নাম উঠানো, কয়েক প্রজন্মের জন্য ঠিকানা হলো। সবাই ভালো, তারা ভালো করবেন এ আশা আমি করব। কিন্তু ওবায়দুল কাদের কেন টোল দিতে গেলেন? এটা কি চমকের জন্য, না জাতীয় পার্টি তথা এরশাদকে একটা 'চড়' মারার জন্য করবেন তিনি? তিনি কি একটা নজির সৃষ্টির জন্য এ স্টান্টবাজি করলেন? তাহলে কি সুরঞ্জিত বাবু এবার বিনা ভাড়ায় ট্রেনে চলা যাত্রীর ভাড়া দিয়ে দেবেন?
ওবায়দুল কাদের নিজের বেতন থেকে এরশাদের লংমার্চের গাড়ির টোল দেওয়া সুনজির হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না। প্রচলিত বিধিবিধান প্রতিপালনের মধ্যেই রাজনৈতিক ভব্যতা নিহিত, এটা ভঙ্গ করার মধ্যে নয়। মন্ত্রীর উচিত ছিল জাতীয় পার্টিকে গাড়ির টোল দেওয়ার জন্য চিঠি দেওয়া এবং তা আদায়ের ব্যবস্থা করা। এরশাদ একদিন সাইকেলে চড়ে অফিসে গিয়ে, জিয়া নিজ হাতে খাল কেটে সস্তা বাহবা নিতে চেয়েছিলেন, ওবায়দুল কাদের কি একই পথ অনুসরণ করতে চেয়েছেন? রাজনীতিকদেরও নিয়মনীতি মানতে আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে, টোল দেওয়াও তার অংশ। অতএব এ ক্ষেত্রে যোগাযোগমন্ত্রীর নিয়মনীতিতে অগ্রসর হওয়াই কাম্য ছিল, ফাও কথিত উদারতা দেখানো নয়। তিনি ক'বার এভাবে টোল দেবেন? অন্তত ওবায়দুল কাদের, সুরঞ্জিত বাবুদের মতো ব্যক্তিত্বের কাছে আমরা এমন সস্তা জনপ্রিয়তা পাওয়ার 'বাজে' নজির স্থাপনের প্রত্যাশা করি না; আমরা তাদের কাছে নিয়মনীতি প্রতিষ্ঠায় বলিষ্ঠ ভূমিকা চাই। শেখ হাসিনা বিএনপির রোডমার্চের গাড়ির নম্বর নিয়েছেন বলেছেন, গাড়ির উৎস দেখবেন বলেছেন, আমরা নিয়ম অনুসারে তার বাস্তবায়ন চাই, কোনো স্টান্টবাজি চাই না।
বদিউর রহমান :সাবেক চেয়ারম্যান, এনবিআর
পত্রপত্রিকায় আমরা অনেক সময়ে আজব, অদ্ভুত, বিরল ও নজিরবিহীন খবর পেয়ে থাকি। এর কোনো কোনোটি আবার আমাদের নাড়া দেয়, ভাবিয়ে তোলে; কোনোটি আবার অবাক করে দেয়, প্রশ্ন জাগে এও কি সম্ভব? কোনো কোনো খবর সত্যিই ভেতরটাকে মুচড়ে দেয়, সৃষ্টির অপরিসীম উদারতায় মনটা ভরে যায়। এক প্রাণী-মা তার শত্রু-শ্রেণীর আরেক মাতৃহীন সাবককে যখন তার বাচ্চার সঙ্গে নিজ দুগ্ধ পান করায় তখন এক শ্বাশত মাতৃস্নেহের স্বরূপ আমরা দেখি; আবার শত শত কলাগাছের কাটা ছবি যখন দেখি তখন মানুষের নির্দয় শত্রুতার এক বীভৎস রূপ ফুটে ওঠে চোখের সামনে। শতকোটি আলোকবর্ষ দূরের গ্রহের খবরে সৃষ্টির বিশালত্বের অসামান্য প্রমাণ যখন নিজেকে নগণ্য ক্ষুদ্রতায় নিয়ে যায়, তখনই আবার মানুষের চন্দ্র-মঙ্গল অভিযানে বিজ্ঞানের জয়যাত্রায় বুক ফুলে যায়। এমনি কত কত আজব, অদ্ভুত, বিরল আর নজিরবিহীন খবর যে আমরা পেয়ে থাকি। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সরকারের সিদ্ধান্ত আর রাজনৈতিক নেতাদের কিছু কর্মকাণ্ডও অবাক করা বটে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-আখাউড়া সড়কের একপাশে তিতাস রেল ব্রিজ, অন্যপাশে সড়ক ব্রিজ, আর মাঝখানে ভারতীয় পণ্য পরিবহনের জন্য আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে তৈরি বাইপাস তিতাস নদীকে হত্যা করেছে দেখলে যেমন বুক ফেটে যায়, তেমনি তার বিপরীতে এরশাদের লংমার্চের ২৫৭ গাড়ির টোল দিয়েছেন যোগাযোগমন্ত্রী_ শুনলে প্রথমে বুকটা ভরে যায়। কী রাজনৈতিক ভব্যতা, কী মহানুভবতা মন্ত্রীর, কী নীতিপরায়ণতা সরকারি পাওনা নিয়ে। এটা অবশ্যই একটা নজির বটে। তবে সুনজির, না কুনজির_ তাই হলো বিবেচ্য। যা-ই হোক না কেন, খবরটা কিন্তু চমক সৃষ্টিকারী, খবরটা কিন্তু অভিনব, অন্তত আমাদের রাজনৈতিক-রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতিতে।
রাষ্ট্রের বা অন্যের পাওনা মেরে দেওয়ায় আমরা ওস্তাদ, এটাই বেশি আমরা জানতাম এবং জানি। পেশিশক্তি, ক্ষমতার দাপট, রাজনৈতিক হুঙ্কার সব ন্যায়নীতিকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে সফলতায় নিয়ে যায় অনেককে। এক এমপি অফিসারকে ঠেঙ্গাবেন, আরেক এমপি ওসিকে তার অফিসে নিয়ে মারবেন, আরেক এমপি ট্রাফিক সার্জেন্টকে হেনস্তা করবেন, আরেক এমপির পিস্তলের গুলিতে দলীয় কর্মী নিহত হবেন, বিরোধী দলের কেউ প্রকাশ্যে রাস্তায় খুন হবেন। কিবরিয়া হত্যা, আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যা, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা, এন্তার এন্তার সবকিছুই হচ্ছে রাজনৈতিক দুরাচার, নির্লজ্জতা। নির্লজ্জ রাজনীতি আর বেশরম রাজনীতিকদের জন্যই এ দেশে এমপিদের জন্য সংবিধান লঙ্ঘন করে শুল্কমুক্ত গাড়িও দেওয়া হয়। এরশাদ তার রাজনীতিকে আরও মজবুত করার জন্য শুল্কমুক্ত গাড়ির 'ঘুষ' চালু করেন, আর সব দলের সাংসদরা নির্লজ্জভাবে নিজেরাই এর সুবিধা গ্রহণ করেন। সেই এরশাদের লংমার্চেই ভৈরব সেতু পারে দেওয়া হয়নি টোল! অনেক রাজনীতিক, মন্ত্রী-এমপি, আমলা সার্কিট হাউসে অবস্থান করে অনেক সময় ভাড়া দেন না, খাবারের বিল পরিশোধ করেন না_ এটা আমরা জানি। সরকারি কাজে না হলেও অনেকে এ সামান্য ভাড়া দিতেও কুণ্ঠাবোধ করেন; এরা জাতে বড় নয়, পদে কিংবা ক্ষমতায় যত বড়ই হোন না কেন। এরশাদের কিংবা জাতীয় পার্টির কি টোল দেওয়ার সামর্থ্য নেই? কত ঢঙের কথা, যানজট এড়ানোর জন্য তখন দেওয়া হয়নি, পরে দেওয়া হয়েছে! কত গাড়ি যাবে তার হিসাব করে আগে কেন অগ্রিম টোল দিয়ে রাখা হলো না? সঠিক সংখ্যা না হলেও আনুমানিক সংখ্যার টোল দিয়েও তো প্রকৃত পাওনা সমন্বয় করে দেওয়া হবে বলে অগ্রিম পরিশোধ করে রাখা যেত, তাও করা হয়নি কেন? আমরাও মহাজোটের অংশীদার বলার 'মাস্তানি'ই-বা গ্রহণযোগ্য হবে কেন?
টোল না দিয়ে টিপাইমুখের লংমার্চ কেমনতর দেশসেবা? টোল কর্তৃপক্ষকে হুমকি-ধমকি দেওয়াই-বা কেমন রাজনীতি? পরে খবর হলো, বেতন পেয়ে যোগাযোগমন্ত্রী তা পরিশোধ করে দিয়েছেন; তারপর আবার খবর হলো, জাতীয় পার্টি টাকা দিয়ে দিয়েছে, যোগাযোগমন্ত্রীর দেওয়া অর্থ তাকে ফেরত দেওয়া হয়েছে। তবুও ভালো যে টোল দেওয়া হলো, যোগাযোগমন্ত্রীও তার টাকা ফেরত পেলেন।
আওয়ামী লীগের নব্য দুই মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এবং ওবায়দুল কাদের মন্ত্রী হওয়ার আগে বেশ কিছুদিন আওয়ামী লীগের এবং সরকারের কড়া কড়া সমালোচনা করেছিলেন কিছু ইস্যুতে। সুরঞ্জিত বাবু তার নিজস্ব ভঙ্গিতে মুখ বাঁকিয়ে, ঠোঁট বাঁকিয়ে বলতেন, বলতেন ভালোই, মানুষ উপভোগ করত। আর ওবায়দুল কাদের বলতেন কিছুটা কাব্যিক ছন্দে, তার নিজস্ব স্টাইলে, তিনিও বলতেন ভালো, তার অমৃত বচনও আমরা উপভোগ করতাম। এসব বলায় দু'জনের মুখ বন্ধ করার জন্য শেখ হাসিনা তাদের মন্ত্রী করে তবে নিস্তার পেলেন। কিন্তু দফতর বণ্টনে কয়েকদিন দেরি হলো, কত মন্ত্রী, কোথায় দেবেন তাদের! শেষ পর্যন্ত দুই মন্ত্রণালয় করে একজনকে যোগাযোগ, আরেকজনকে রেল। তাহলে মানেটা কী দাঁড়াল? মানেটা হলো, আবুল হোসেন একা তিন বছর যে বড় মন্ত্রণালয় চালাতে পেরেছেন এখন নতুন যোগ্যতায় তার অর্ধেকের যোগ্য সুরঞ্জিত আর বাকি অর্ধেকের যোগ্য ওবায়দুল। ভালোই হলো, আবুল হোসেনকে সরিয়ে দেওয়া হলেও তার বড়ত্ব স্বীকৃত থাকল, তিনি বলতে পারবেন_ এক আবুল হোসেন সমান এক ওবায়দুল যোগ এক সুরঞ্জিত, তাই নয় কি? অবশ্য এ দু'জনও বলতে পারবেন, নতুন দায়িত্বে আবুল হোসেনও এখন অর্ধেক, আগের বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দু'ভাগের এক ভাগ। আগের আমলে ড. মইনকে তথ্য থেকে সরাতে গিয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের গালভরা নাম করে তাকে তথ্যের স্বাদে কিছুটা রাখার জন্য তার ইচ্ছাতেই বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় করা হয়েছিল। কত কাতুসিরিরে! আগের রেলের আলাদা বাজেটও হতো, এবার যদি সুরঞ্জিত তা করতে পারেন তাহলে তার সম্মান আরও বাড়তে পারে। অর্থাৎ জাতীয় সংসদে আগের মতো যদি রেলের আলাদা বাজেট পেশ হয় আর কি! ওবায়দুল কাদেরের গত মেয়াদ থেকে এবার পদোন্নতি হলো বলা চলে, প্রতিমন্ত্রী থেকে মন্ত্রী, কাগুজে ভাষায় হাফ থেকে ফুল; আর সুরঞ্জিতের মন্ত্রীর ইতিহাসে নাম উঠানো, কয়েক প্রজন্মের জন্য ঠিকানা হলো। সবাই ভালো, তারা ভালো করবেন এ আশা আমি করব। কিন্তু ওবায়দুল কাদের কেন টোল দিতে গেলেন? এটা কি চমকের জন্য, না জাতীয় পার্টি তথা এরশাদকে একটা 'চড়' মারার জন্য করবেন তিনি? তিনি কি একটা নজির সৃষ্টির জন্য এ স্টান্টবাজি করলেন? তাহলে কি সুরঞ্জিত বাবু এবার বিনা ভাড়ায় ট্রেনে চলা যাত্রীর ভাড়া দিয়ে দেবেন?
ওবায়দুল কাদের নিজের বেতন থেকে এরশাদের লংমার্চের গাড়ির টোল দেওয়া সুনজির হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না। প্রচলিত বিধিবিধান প্রতিপালনের মধ্যেই রাজনৈতিক ভব্যতা নিহিত, এটা ভঙ্গ করার মধ্যে নয়। মন্ত্রীর উচিত ছিল জাতীয় পার্টিকে গাড়ির টোল দেওয়ার জন্য চিঠি দেওয়া এবং তা আদায়ের ব্যবস্থা করা। এরশাদ একদিন সাইকেলে চড়ে অফিসে গিয়ে, জিয়া নিজ হাতে খাল কেটে সস্তা বাহবা নিতে চেয়েছিলেন, ওবায়দুল কাদের কি একই পথ অনুসরণ করতে চেয়েছেন? রাজনীতিকদেরও নিয়মনীতি মানতে আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে, টোল দেওয়াও তার অংশ। অতএব এ ক্ষেত্রে যোগাযোগমন্ত্রীর নিয়মনীতিতে অগ্রসর হওয়াই কাম্য ছিল, ফাও কথিত উদারতা দেখানো নয়। তিনি ক'বার এভাবে টোল দেবেন? অন্তত ওবায়দুল কাদের, সুরঞ্জিত বাবুদের মতো ব্যক্তিত্বের কাছে আমরা এমন সস্তা জনপ্রিয়তা পাওয়ার 'বাজে' নজির স্থাপনের প্রত্যাশা করি না; আমরা তাদের কাছে নিয়মনীতি প্রতিষ্ঠায় বলিষ্ঠ ভূমিকা চাই। শেখ হাসিনা বিএনপির রোডমার্চের গাড়ির নম্বর নিয়েছেন বলেছেন, গাড়ির উৎস দেখবেন বলেছেন, আমরা নিয়ম অনুসারে তার বাস্তবায়ন চাই, কোনো স্টান্টবাজি চাই না।
বদিউর রহমান :সাবেক চেয়ারম্যান, এনবিআর
No comments