এক ভুবনে দুই বাসিন্দা by সামীউর রহমান

কিছু কৌশল জানা থাকলে খুব সহজেই উতরে যাওয়া যায় জলে-জঙ্গলের বহু বিপদ। সেসব কৌশল সাধারণ মানুষকে জানাতে ডিসকভারি চ্যানেলে চলছে তিনটি 'সারভাইভাল রিয়ালিটি শো'। অনুষ্ঠান তিনটির তিন সঞ্চালককে নিয়ে ধারাবাহিক আয়োজনের তৃতীয় ও শেষ পর্বে আজ থাকছে সাবেক মার্কিন সেনা ডেভ ক্যান্টারবুরি ও প্রকৃতিপ্রেমী কোডি লুন্ডিনকে নিয়ে ফিচার। এই দুজনের অভিযানের কাহিনী নিয়ে প্রতিদিন বিকেল সাড়ে ৪টায় প্রচারিত হচ্ছে


'ডুয়াল সারভাইভাল'। তাদের নিয়ে লিখেছেন সামীউর রহমান পুরনো সেই গল্পটা দিয়েই শুরু করা যাক। ওই যে, দুই বন্ধুর গল্প। যারা বনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, এক ভালুক হঠাৎ তাড়া করল তাদের...। গল্পের সারমর্ম হচ্ছে বিপদের বন্ধুই প্রকৃত বন্ধু। সেই দুই বন্ধু যদি ডেভ আর কোডি হতেন, তাহলে গল্পটা হয়তো অন্যরকম হতো। দুজনেই বুনো পশুপাখির গতিপ্রকৃতি সমপর্কে দারুণ অভিজ্ঞ, তাই ভালুকের চলার পথে হয়তো পা-ই মাড়াতেন না। আর সামনে পড়ে গেলেও সঙ্গীকে ফেলে অন্তত কেউ গাছে উঠে যেতেন না, কিংবা মরার ভান করতেন না, তা নিশ্চিত।
বাংলাদেশে তেমন জনপ্রিয় না হলেও, বহু দেশে ক্যাম্পিং খুব জনপ্রিয়। ছুটির সময়ে শহরের কোলাহল থেকে দূরে গিয়ে প্রকৃতির কোলে কদিনের জন্য থাকাটা অনেক দেশেই গরমকালের একটা চালু রেওয়াজ। যারা কিছুটা বাড়তি রোমাঞ্চের সন্ধান করে, তাদের অনেকেই হয়তো চলে যায় প্রকৃতির অনেক গভীরে। যেখান থেকে তারা হারিয়ে ফেলে লোকালয়ে ফিরে আসার রাস্তা, শেষ হতে থাকে খাবার, পানীয় জলসহ নৈমিত্তিক চাহিদার সবকিছু। মূলত তাদের জন্যই কোডি এবং ডেভের এই প্রচেষ্টা। তাঁদের উদ্দেশ্য, ডুয়াল সারভাইভালের মাধ্যমে মানুষের শেখানো, কিভাবে প্রকৃতির বিরুদ্ধে না গিয়ে প্রকৃতি থেকেই বেঁচে থাকার রসদ জোগাড় করে নেওয়া যায়। কখনো এ জন্যে ডেভ বেছে নেন সামরিক কায়দা, কখনো কোডি অনুসরণ করেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আদিবাসী 'রেড-ইন্ডিয়ান'দের ব্যবহার করা প্রাচীন কৌশল। কখনো কখনো ডেভ সন্দিহান হয়ে ওঠেন কোডির পদ্ধতির ওপর, আবার উল্টোটাও হয়। অবশেষে, আধুনিক এবং প্রাচীন পদ্ধতির সমন্বয়ে বেঁচে থাকার কার্যকর কৌশল বের করেন দুজনে।
কোডি এবং ডেভ, দুজন একেবারে দুই মেরুর মানুষ। ডেভ ১৭ বছর বয়সে যোগ দিয়েছিলেন সেনাবাহিনীতে। চৌকস নিশানাবাজ (স্নাইপার) হিসেবে সপেশাল রি-অ্যাকশন টিম অর্থাৎ যেকোনো জরুরি অবস্থায় দ্রুত ঘটনাস্থলে যাদের পেঁৗছতে হয়, সেনাবাহিনীর এমন একটি দলের সদস্য ছিলেন লম্বা সময়। এরপর সেই দলের প্রশিক্ষণে কাজ করেছেন প্রশিক্ষক হিসেবে। শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই নয়, দক্ষিণ কোরিয়ার সেনাবাহিনীর বিশেষ দলকেও প্রশিক্ষণ দিয়েছেন ডেভ। কোডির চেয়ে আকারে বেশ বড়সড় তিনি, বেশি শক্তির প্রয়োজন হয় এমন সব কাজে তাঁকেই দেখা যায়।
অন্যদিকে কোডি মানুষটা বেশ ছোটখাট, তবে মাথায় সোনালি চুলের বহরটা ফেট্টির নিচে বেণি হয়ে নেমেছে বুক পর্যন্ত। কোডি একজন ন্যুনবাদী, অর্থাৎ যতটুকু প্রয়োজন কোনো কিছুই তাঁর চেয়ে বেশি খরচ করে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট করতে চান না তিনি। প্রকৃতিপ্রেমী মানুষটি জুতা পরেন না প্রায় ২০ বছর! এমনকি লম্বা প্যান্টও পরেন না! তাঁর কথায়, খালি পায়ে হাঁটলে প্রকৃতির সঙ্গে যোগসূত্র তৈরি হয়। কোডির বড় হওয়াটা নর্থ ডাকোটায়, যেখানে তাঁর খেলার সঙ্গী, প্রতিবেশীদের মধ্যে অনেকেই ছিল অনেক রেড ইন্ডিয়ান। তাদের কাউকে সঙ্গে নিয়ে, কখনো একা একাই কোডি হারিয়ে যেতেন জঙ্গলে, আবার ফিরে আসতেন। একটু বড় হতেই একটা ছুরি আর মাছ ধরার সরঞ্জাম সম্বল করে প্রকৃতির কোলে হারিয়ে যেতে ভালোবাসতেন তিনি। হাই স্কুল শেষ হতেই পশ্চিমমুখো একটা বাসে উঠে বেরিয়ে গিয়েছিলেন দেশ দেখতে। সঙ্গী বলতে কাঁধে একটা ব্যাগ, আর হাতে গিটার। এভাবেই কোডি ঘুরে বেড়িয়েছেন, দেখেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য। কখনো ঘুমিয়েছেন রাস্তার পাশে, কখনো একা জঙ্গলে, কখনো মেঙ্কিান সীমান্তে উপজাতিদের গ্রামে। এভাবেই জীবন থেকে শিখেছেন কোডি। এখন শেখাচ্ছেন নিজের সারভাইভাল ট্রেনিং স্কুলে এবং ডিসকভারির মাধ্যমে দর্শকদের।
ডেভও চালান একটি সারভাইভাল ট্রেনিং স্কুল, তবে সেটা শেখায় সামরিক কেতায় বেঁচে থাকার কৌশল। দুজনের কায়দা ভিন্ন হলেও লক্ষ্যটা এক, পথ হারানো দলছুট পর্যটক কিংবা নৌকাডুবির শিকার যাত্রীর বেশে প্রতিকূল পরিবেশ থেকে লোকালয়ে ফিরে আসা। এ জন্য উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মানুষজনের কাছে সচরাচর যেসব জিনিস থাকে, তাই থাকে তাঁদের সঙ্গে। কোডি আগুন জ্বালাতে ওস্তাদ, গাছের ডাল ঘষে ঘষে আগুন জ্বালাতে বেশ পারদর্শী তিনি। সেইসঙ্গে পশুপাখির পায়ের ছাপ অনুসরণে। এ ছাড়া দড়ি পাকাতে, প্রকৃতি থেকে খাবার উপযোগী ফল বা অন্য কোনো উপাদান বাছাই করে খুঁজে বের করাই তাঁর পারদর্শিতা। ডেভ আবার ফাঁদ পেতে শিকার ধরা, আশ্রয় বানানোর জন্য কাঠকাটায় বেশ পারঙ্গম। এভাবেই দুজনে বেঁচে ফিরেছেন নোভাস্কোশিয়ার বর-শীতল উপকূল, নিউজিল্যান্ডের পাহাড়, পেরুর আগ্নেয় মরুভূমি, লাওসের জঙ্গল, অ্যারিজোনার পাইন বন, ব্রাজিলের কুখ্যাত পিরানহা মাছের নদীসহ অনেক দুর্গম জায়গা থেকে। ডিসকভারি চ্যানেলে তাঁদের এই অভিযান দেখা যাবে প্রতিদিন বিকেল সাড়ে ৪টায়।

No comments

Powered by Blogger.