'থাইলড্যাম' থেকে হাওর অঞ্চল এবং পায়রার পায়ে বেঁধে চিঠি by আখলাক হুসেইন খান

'থাইলড্যাম' মণিপুর রাজ্যের একটি নদী-দ্বীপের নাম। এ অঞ্চলের উপজাতীয় ভাষায় এ নামের বাংলা অর্থ হচ্ছে জীবন-মরণ। উপজাতিদের বিশ্বাস, মৃত্যুর পর তাদের আত্মা এই দ্বীপে অনন্তকালের জন্য ঠাঁই পায়। টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ হলে জলাবদ্ধতায় এই বাঁধ ডুবে যাবে। তাই তারা টিপাইমুখ বাঁধকে তাদের ধর্মবিশ্বাসের ওপর চরম আঘাত মনে করছে। বাঁধ পরিকল্পনার শুরু থেকেই তারা এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে প্রতিরোধ আন্দোলন করে আসছে।


ভারতের পরিবেশবাদীদের সমর্থনে প্রায় ২৫টি উপজাতীয় সংগঠন ২০০৬ সালে মণিপুর রাজ্যে ২৪ ঘণ্টার ধর্মঘটসহ অব্যাহত কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে। জলাবদ্ধতায় তাদের ৬০টি গ্রামের ৪০ হাজার মানুষের ভিটেমাটি হারানোসহ ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে যুক্ত পাঁচটি হ্রদ হারাতে হবে। রাজ্য সরকার টিপাইমুখ বাঁধের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে গত ২২ অক্টোবর বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন করে বাঁধ নির্মাণের কাজ উদ্বোধনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। উপজাতিগোষ্ঠীও বাঁধ নির্মাণ ঠেকাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে আন্দোলনে। তীর্থস্থান রক্ষার ধর্মবিশ্বাস থেকে এ আন্দোলন তাদের কাছে ধর্মযুদ্ধের মতো বলীয়ান হয়ে উঠেছে। তাদের সঙ্গে পূর্বাঞ্চলের আসাম, মেঘালয় ও মিজোরাম রাজ্যের বিভিন্ন সংগঠনও রাজপথে নেমে এসেছে।
খোদ ভারতেই বাঁধ ঠেকাতে আন্দোলন দানা বেঁধে উঠেছে। আর শত ভাগ ক্ষতির আশঙ্কাযুক্ত ভাটির দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষ কি চুপ করে বসে থাকতে পারে? উত্তর-পূর্বাঞ্চল তথা হাওর অঞ্চলের জীবন-মরণের যমদূত এ বাঁধ। জীবিকা রুদ্ধের ভয়াল থাবা। তিন কোটি মানুষের ভবিষ্যৎ হয়ে পড়বে অনিশ্চিত। দেড় কোটি মানুষ শরণার্থী হয়ে পড়ার আশঙ্কা দ্বারপ্রান্তে। নদ-নদী হারাবে প্রাণ। হাওরে কৃষি ও মৎস্য উৎপাদনের প্লাবনভূমি পানির অভাবে হয়ে উঠবে মরুভূমি। জলজ বন ও উদ্ভিদ, জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ-প্রতিবেশ ও আবাসভূমি বিলীন হয়ে জনবসতের অযোগ্য হয়ে উঠবে। জীবন-মরণের এই ভয়ংকর ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত এ অঞ্চলের মানুষ নিজেকে ও দেশকে বাঁচানো ইমানের অংশ মনে করে মণিপুরের উপজাতিদের মতো ধর্মযুদ্ধের মতোই বলীয়ান হয়ে আন্দোলনে এগিয়ে আসছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজসহ হাওরাঞ্চলের বিশাল কৃষক ও মৎস্যজীবী সমাজ এই বাঁধ ঠেকাতে এখন রাজপথে।
একটি অঞ্চলের প্রধান নদীর উৎসমুখে দৈত্যাকৃতির বাঁধ হলে ভাটিতে ক্ষতির কারণ হবে না_কোনো নির্বোধ ছাড়া কেউ তা বিশ্বাস করবে না। নদী-হাওর-বাঁওড় মরু করেই ক্ষান্ত থাকবে না এ বাঁধ। ভূমিকম্পের বড় কারণ হয়ে দেখা দেবে বলে বিশেষজ্ঞদের মতামত। বিশ্বের ছয়টি ভূমিকম্প-প্রবণ এলাকার মধ্যে এই বাঁধ এলাকা একটি। শিলাস্তরে গঠিত বরাক অববাহিকায় রয়েছে দুটি প্লেট ও অসংখ্য ফাটল বা চ্যুতি। ৫০ তলা উঁচু ভবনের সমান এই বাঁধের ওপর থেকে ছয়টি টারবাইনে একেকটি থেকে গড়িয়ে পড়া পানি প্রায় ১৬২ টন ওজনের সৃষ্টি করবে। কারো কারো মতে, জলাধারের তলদেশে প্রতি বর্গকিলোমিটারে স্থির অবস্থায় পানির অনুভূমিক চাপ থাকবে প্রায় ১৬০ টন। ভূমিকম্প হলে অনুভূমিক চাপ বেড়ে বাঁধ বিধ্বস্ত হতে পারে। আর এ বাঁধ ভাঙলে ভাটিতে সুনামি দেখা দিয়ে গ্রামগঞ্জ-শহর ভাসিয়ে নেওয়ার মতো বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে। বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে মুহূর্তে নদীপথ পরিবর্তন, গভীরতার ভারসাম্যহীন নদীতটের ধ্বংসপ্রক্রিয়ায় বড় ধরনের বন্যা ও সুনামি দেখা দিয়ে ধ্বংসযজ্ঞ ঘটাতে পারে। 'ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অন লার্জ ড্যাম' ১৯০০ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত বিশ্বে ১৬৪টি বাঁধভাঙা বিপর্যয় নির্ণয় করেছিল। অদূরবর্তী চীনে বাঁধ ভেঙে জান-মালের ক্ষয়ক্ষতির অসংখ্য নজির রয়েছে। এই যখন বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, সাধারণ মানুষ শঙ্কিত না হয়ে পারে না। তাইতো বাংলাদেশের রাজপথে চলছে বিভিন্ন সংগঠনের নানা কিছিমের কর্মসূচি। প্রতিবাদ, হরতাল, সমাবেশ, বিক্ষোভ মিছিল, মানববন্ধন, অবস্থান ধর্মঘট ও রোডমার্চে উত্তপ্ত উত্তর-পূর্বাঞ্চল। এই বার্তা পেঁৗছাতে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের নেতারা গত ২৬ নভেম্বর জকিগঞ্জের সুরমা-কুশিয়ারা নদীর উৎসস্থল সীমান্তবর্তী বরাক মোহনায় অবস্থান নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের উদ্দেশে পায়রার পায়ে চিঠি বেঁধে মুক্ত আকাশে ছেড়ে দিয়ে প্রতীকী কর্মসূচি পালন করেছেন। একইভাবে হবিগঞ্জ পরিবেশ আন্দোলনের নেতারা ২ ডিসেম্বর খোয়াই ব্রিজ পয়েন্টে পায়রার গলায় বেঁধে চিঠি ছেড়ে বার্তা পেঁৗছানোর প্রতীকী কর্মসূচি পালন করেছেন। ২৩ নভেম্বর থেকে শতাধিক সংগঠনের কর্মসূচি চলছে এবং লাগাতার দুই মাস কর্মসূচির মধ্যে টিপাই অভিমুখে ২৯ ডিসেম্বর খেলাফত মজলিসের পদযাত্রাসহ সিলেট বিএনপির আগামী ৭ জানুয়ারি ও অন্য কয়েকটি সংগঠনের ২৬ জানুয়ারি বরাক মোহনায় সমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণা হয়েছে। এর মধ্যে ১ ডিসেম্বর সিলেট বিএনপির ডাকা হরতাল খেলাফত মজলিস, খেলাফত আন্দোলন, জমিয়তে ইসলাম, ইসলামী ঐক্যজোট ও নেজামে ইসলাম পার্টির সমর্থনে সিলেট নগর ও উপজেলাগুলোতে সার্থকভাবে পালিত হয়েছে।
বিভিন্ন সময় আপত্তি তোলাসহ সম্ভবত ১৯৯৫ সালে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষ সর্বপ্রথম রাজপথে নেমে আসে। ওই বছর ফারাক্কা লংমার্চের অন্যতম সংগঠক জননেতা সাবেক মন্ত্রী মরহুম সিরাজুল হোসেন খানের নেতৃত্বে জকিগঞ্জ থেকে বরাক অভিমুখে কোদালমিছিল করে এ অঞ্চলের মানুষ। অব্যাহতভাবে এ আন্দোলন চলতে থাকে। ২০০৯ সালের ১৪ জুলাই টিপাইমুখ বাঁধ প্রতিরোধ আন্দোলন কমিটি পাঁচ দফা দাবি নিয়ে সিলেট ঘোষণার মাধ্যমে জেলা-উপজেলায় আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। তাদের সিলেট ঘোষণার দাবির মধ্যে ছিল_এক. টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্প ও সম্ভাব্য ফুলের তলা ব্যারাজ প্রকল্প বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থপরিপন্থী। এই মর্মে অবিলম্বে জাতীয় সংসদে একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। এই নীতির ভিত্তিতে ভারতের সঙ্গে যথাযথ কূটনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ ও গণদাবির মাধ্যমে ভারত সরকারকে অবিলম্বে টিপাইমুখ বাঁধ ও ফুলের তলা ব্যারাজ এবং আন্তনদী-সংযোগ প্রকল্প বাতিল করতে বাধ্য করতে হবে। দুই. বাংলাদেশের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ব্যতিরেকে দুই দেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত কোনো নদীতে অবকাঠামো নির্মাণ করা থেকে ভারতকে বিরত রাখতে হবে। তিন. নদীর ওপর বেষ্টনীমূলক দৃষ্টিভঙ্গি নয়; বরং মুক্ত নদীর দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে আঞ্চলিক পানিসম্পদ পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। চার. ভারতকে সব জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক নীতি, ঘোষণাপত্র, কনভেনশন, চুক্তি ও সমঝোতার প্রক্রিয়া মেনে চলতে হবে। পাঁচ. অমলশীদ পয়েন্টে প্রায় দেড় কিলোমিটার নদীবক্ষ ভরাট হওয়ার ফলে সুরমা নদীতে পানিপ্রবাহ শুকনো মৌসুমে বন্ধ হয়ে যায়। স্থানটি খননের মাধ্যমে সুরমার পানিপ্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে। এই দাবির সঙ্গে একমত প্রকাশ করে আন্দোলনকারীরা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। বাঁধ নির্মাণের অগ্রগতি প্রতিটি ধাপের খবরে আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠেছে। চূড়ান্ত ধাপ সম্পন্ন হওয়ার খবরে আন্দোলন এখন তুঙ্গে। এ আন্দোলন এখন নিউ ইয়র্ক ও সৌদি আরবে প্রবাসী বাংলাদেশিরাও চালিয়ে যাচ্ছেন। বর্তমান নেতারা ফারাক্কা লংমার্চের আদলে টিপাই লংমার্চের ডাক দেওয়ার কথা ভাবছেন। ইতিমধ্যে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১০ ডিসেম্বর টিপাই অভিমুখে লংমার্চের ডাক দিয়েছেন। অনেকেই মনে করেন, কঠোর কর্মসূচিতে লংমার্চ অন্তর্ভুক্ত হওয়া বিবেচনাপ্রসূত। তবে তা হতে হবে দলমত-নির্বিশেষে আপামর জনসাধারণের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে। যাতে সহজেই আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় এবং আন্দোলন সার্থকতা পায়। আর এ আন্দোলনে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন আদায়ই হবে ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টির অন্যতম উপায় এবং বাঁধ নির্মাণ থেকে সরে দাঁড়ানোর ক্ষেত্র তৈরির মোক্ষম বর্ম।
লেখক : হাওর গবেষক

No comments

Powered by Blogger.