সপ্তাহের হালচাল-বিএনপি একটি ভুল সংকেত দিল by আব্দুল কাইয়ুম
রোববার ঢাকা ও সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ককটেল হামলা, গাড়িতে আগুন ও পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের দায় কার? বিএনপির, না সরকারের? এ নিয়ে পরস্পরবিরোধী অভিযোগ আসছে। পত্রপত্রিকার খবরে এটা পরিষ্কার যে বিএনপি গোপনে কর্মী-ক্যাডার জমায়েত করে রাজধানী ঢাকায় একটা কিছু করতে চেয়েছিল, যা পুলিশের বাধার মুখে করা যায়নি। তারই সূত্র ধরে ককটেল বিস্ফোরণ, বাসে আগুন। দুজন নিরীহ মানুষকে জীবন দিতে হলো। এর দায় কিন্তু
বিএনপি এড়াতে পারে না। বিএনপি কি ভাবছে যেহেতু মানুষ নানা কারণে সরকারের ওপর বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ, তাই কৃত্রিমভাবে একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে ক্ষমতায় যাওয়া যাবে? এটা যদি ভেবে থাকে, তা হলে তা হবে রাজনৈতিক অদূরদর্শিতার নিকৃষ্টতম উদাহরণ। বিএনপির এই বালখিল্যতায় শুধু রাজনৈতিক মহলই অবাক হয়নি, বিস্মিত হয়েছেন দলের জ্যেষ্ঠ নেতারাও। ২০ ডিসেম্বর দি ডেইলি স্টার পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চুপিসারে ‘গণবিস্ফোরণ’ ঘটানোর এমন উদ্যোগের কথা খোদ বিএনপির ভেতরের নেতাদের কাছেও গোপন রাখা হয়েছিল বলে অভিযোগ উঠেছে। ব্যাপারটা তাঁরা ভালো চোখে দেখছেন না।
অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি কি বিএনপির জন্য কোনো লাভ এনে দেবে? এই তো সেদিন রাষ্ট্রপতি আলোচনার আহ্বান জানালেন। নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন বিষয়ে আলোচনা হবে। ২২ ডিসেম্বর থেকে তা শুরু হতে যাচ্ছে। তাহলে এখন এই সহিংসতা কেন?
রাষ্ট্রপতির আহ্বান বিএনপি যখন নাকচ করেনি, তাহলে তো সংগতভাবেই আশা করা যায় যে তারা ভাঙচুরের পথে না গিয়ে যুক্তিকে প্রাধান্য দেবে। তারা বলেছে, আলোচনা হোক, কিন্তু আলোচ্য বিষয় হতে হবে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার পুনর্বহাল। তারা যদি আলোচনাতেই যাবে, তাহলে রাজপথে ককটেল ফোটানোর পথে যাচ্ছে কেন?
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ১৮ ডিসেম্বর দৈনিক সমকালের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে পরিষ্কার বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের প্রক্রিয়া নিয়ে সংসদের ভেতরে বা বাইরে যেকোনো স্থানে আলোচনায় প্রস্তুত বিএনপি। তাঁরা বড় বড় লংমার্চ করেছেন। সেখানে প্রচুর লোকসমাগম হয়েছে। সামনের মাসে চট্টগ্রামের দিকে লংমার্চ করবেন। এরপর আরও বড় কর্মসূচি ঘোষণা করবেন। এর মাঝে সংসদে বা রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলোচনায় বসতে চাওয়ার একটা আলাদা তাৎপর্য আছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব নিশ্চয়ই না বুঝে এ কথা বলেননি। অথচ যেদিন পত্রিকায় তাঁর কথা ছাপা হলো, সেদিন সকালেই রাজপথে শুরু হয়ে গেল ককটেল, আগুন!
অবশ্য এখানে ক্ষমতাসীন দলেরও কিছু দায়িত্ব আছে। তাদেরও দেখতে হবে, শুধু পুলিশ দিয়ে সবকিছু ঠান্ডা করার প্রবণতা সরকারের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। আদালতের রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল হয়ে যাওয়ার পর সংসদে সংবিধান সংশোধনীর সময় ক্ষমতাসীন দল বিরোধী দলকে সংসদে গিয়ে আলোচনার আহ্বান জানালেও তারা তখন যায়নি। সেই অনমনীয় অবস্থান থেকে বিএনপি কিছুটা সরে আসায় আওয়ামী লীগের কাছে একটা বড় সুযোগ এসেছে। তারা সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে, আর রাষ্ট্রপতির সঙ্গে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন নিয়ে যুগপৎ আলোচনার পথ প্রশস্ত করতে পারে। এ জন্য একটা শান্তিপূর্ণ পরিবেশ দরকার।
আলোচনা আদৌ হবে কি না তা অনিশ্চিত। এ ধরনের আলোচনার উদ্যোগের সাফল্য নির্ভর করে একটি বিশেষ শর্তের ওপর। যখন উভয় পক্ষের কাছে লাভজনক বলে মনে হবে, তখনই তারা আলোচনায় বসবে। প্রশ্ন হলো, এ রকম একটি শর্ত সৃষ্টি করা যাবে কি? বিএনপি কি আস্থার সঙ্গে সংসদে যাবে, অথবা বঙ্গভবনে? কী লাভ হবে তাদের? আর আওয়ামী লীগ কি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে আলোচনায় বসতে চাইবে? তারা তো বলেই দিয়েছে, ওটা বাদ, নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে, আর সেটা হবে প্রধানত ক্ষমতাসীন দলের উদ্যোগে একটি ছোট আকারের সরকার। তাদের এখন এজেন্ডা হলো ‘শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন’। এ অবস্থায় এখন আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আলোচনায় তাদের কী লাভ?
লাভ দু পক্ষেরই আছে। সেই লাভ হয়তো সহজে চোখে পড়ে না। দুই পক্ষের লাভ খুঁজে বের করাই এখন দেশের রাজনীতির সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এটা যদি করা যায়, আর যদি তার ভিত্তিতে ওরা আলোচনায় বসে একটা অভিন্ন পথ বের করে, তাহলে রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা আসতে পারে। আর যদি তা না হয়, তাহলে দেশে দেখা দেবে এক অনিশ্চয়তা, যা কোনো পক্ষকেই সুবিধা এনে দেবে না। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা কেবল সংবিধানবহির্ভূত শক্তিকে ক্ষমতায় আনার পথ পরিষ্কার করে। সেটা সেনাশক্তি বা সেনাসমর্থিত সরকারের রূপ নিতে পারে। এতে আওয়ামী লীগ বা বিএনপির যে কোনো লাভ হয় না তা বিগত এক-এগারোর সময় দেখা গেছে। নিশ্চয়ই সে অধ্যায়ের পুনরাবির্ভাব কোনো পক্ষই চায় না।
রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দূর করাই এখন দুই পক্ষের অভিন্ন লাভ। যদিও নির্বাচনের এখনো অন্তত দুই বছর বাকি, তাও এ বিষয়ে চিন্তা করতে হচ্ছে, কারণ বিএনপি বলছে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া তারা নির্বাচনে যাবে না। তারা যদি না যায়, তাদের বাদ দিয়ে নির্বাচন করে আওয়ামী লীগ পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবে কি? ১৯৯৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি বিএনপি একা নির্বাচন করে টিকতে পারেনি। আর ২০০৭ সালে আওয়ামী লীগ নির্বাচন বর্জন করায় শেষ পর্যন্ত সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এল। তাতে আম-ছালা দুই-ই গেল। এবারও যদি বিএনপি নির্বাচনে না যায়, তাহলে আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিএনপিও ডুববে।
আওয়ামী লীগকে দেখতে হবে যেন বিএনপি নির্বাচনবিরোধী অবস্থানে অনড়ভাবে না থাকে। কিছুটা নমনীয় নীতি নিতে হবে। যেন বিএনপি নির্বাচনে আসতে পারে। অন্যদিকে বিএনপিকেও বুঝতে হবে যে নির্বাচনে গেলে তাদেরই লাভ। তাদের জয়লাভের সম্ভাবনা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন অনেক বেশি। একদিকে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, ডলারের দাম বাড়ছে আর অন্যদিকে খুন সস্তা হয়ে পড়ছে। অপহরণ, হত্যা, গুম, ডাকাতি বেড়েই চলেছে। যাতায়াত, যোগাযোগব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে। খিলগাঁও ফ্লাইওভার তো আক্ষরিক অর্থেই মড়মড় করে ভেঙে পড়ার উপক্রম হলো। পদ্মা সেতু অনিশ্চিত। এখন মেঘনা সেতুতে ভারী যান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আসছে। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের আশা তেমন নেই। সর্বত্র দলীয়করণ। সংসদ প্রায় অচল। ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জয়লাভ নিয়ে সন্দেহ থাকার কারণেই হয়তো করপোরেশনকে দুই টুকরো করা হলো। এ রকম ঘটনা আরও ঘটতে থাকবে, আর দুই বছরের মাথায় নির্বাচনে বিএনপির জয়লাভের শর্ত পাকাপোক্ত হতে থাকবে। এমনকি তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ছাড়া নির্বাচন করলেও বিএনপির বিজয় ঠেকিয়ে রাখা কষ্টকর হবে, যদি নির্বাচন কমিশন মোটামুটি শক্ত ও নিরপেক্ষ হয়। এই সুনিশ্চিত নির্বাচন বিএনপি করবে না তো কে করবে?
কিন্তু আওয়ামী লীগ কি সত্যিই চাইবে বিএনপিকে নির্বাচনে আসার সুযোগ করে দিতে? বিএনপিকে জেতানোর নির্বাচনে তাদের লাভ কী? লাভ আওয়ামী লীগেরও আছে। সুষ্ঠু নির্বাচন মানেই তাদের লাভ। প্রথম কথা হলো, সংবিধানবহির্ভূত শক্তির ক্ষমতায় আসার পথ বন্ধ। দ্বিতীয়ত, এখনো দুই বছর হাতে আছে। এই সময়ের মধ্যে বিদ্যুৎ-ব্যবস্থার উন্নয়ন, কৃষিতে সাফল্য, বিনিয়োগ বৃদ্ধি, নতুন কর্মসংস্থান, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার পথে লক্ষণীয় অগ্রগতি সাধন এবং দুর্নীতি রোধে দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ নিয়ে তারাও জনপ্রিয়তায় এগিয়ে যেতে পারে। হয়তো দুই বছর পর দেখা যাবে আওয়ামী লীগের বিজয় হাতের মুঠোয়। এ জন্য ওরা যদি উচ্চ আদালতের রায়ের শেষ অংশ মেনে, অর্থাৎ আগামী দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিধান কার্যকর করতে এখন রাজি হয়ে যায়, তাহলে বিএনপির পক্ষে অনমনীয় অবস্থানে থাকা আর সম্ভব হবে না।
দুই বছর পর যে নির্বাচন হবে, তাতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির জয়লাভের ৫০: ৫০ সম্ভাবনা সৃষ্টির জন্য দুই পক্ষের উদ্যোগ এখন দরকার। এতে দু পক্ষেরই লাভবান হওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। এ লক্ষ্য অর্জন করতে হলে দু পক্ষকেই কিছু ছাড় দিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। যেমন, আওয়ামী লীগকে বলতে হবে, উচ্চ আদালতের রায় কার্যকর করার জন্য দুই পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্দলীয়, নিরপেক্ষ একজন ব্যক্তির নেতৃত্বে গঠিত সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে, সেটাই হবে ‘নির্বাচনকালীন’ বা ‘অন্তর্বর্তীকালীন’ সরকার। এ জন্য সংবিধান সংশোধন না করলেও চলবে। কারণ উচ্চ আদালতের নির্দেশনা রয়েছে। অন্যদিকে বিএনপিকে বলতে হবে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা না হলেও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারব্যবস্থা হিসেবে তারা ওই ধরনের নির্বাচনকালীন ব্যবস্থা মেনে নিতে প্রস্তুত। সংসদে এই মর্মে উভয় পক্ষ সিদ্ধান্তে আসতে পারে। পাশাপাশি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলোচনায় নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে একমত হতে হবে। তাহলেই রাজনীতিতে অস্থিতিশীলতা দূর হওয়ার পথ প্রশস্ত হবে।
সংসদের বাইরেও সব দলের সঙ্গে একটা আলোচনায় মতৈক্য দরকার। সবাই একটি জাতীয় সনদে স্বাক্ষর করুক। দেশে নির্বাচনমুখী রাজনীতির জোয়ার সৃষ্টি হোক।
এ রকম একটা বাস্তব সম্ভাবনার মুখে গত রোববার বিএনপি-জামায়াতের সহিংস তৎপরতা মারাত্মক ভুল সংকেত দিয়েছে। দ্রুতই তাদের এ ভুল সংশোধন করা দরকার।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com
No comments