বিহারিরা পাকিস্তানকে আন্তরিক সমর্থন দিয়েছিল by শামসার আলী খান
রঙবেরঙের পোশাক পরে তরুণ-তরুণীরা ভারত ও বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে আনন্দ করছিল। পাকিস্তানি বিরোধী ও ভারতের পক্ষের স্লোগানের পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি স্লোগান ছিল জয় বাংলা। এ যন্ত্রণাদায়ক দৃশ্য দেখার জন্য আমিই ছিলাম একমাত্র দুর্ভাগা পাকিস্তানি। আমার মনের যে কী অবস্থা তা ভাষায় বোঝানো যাবে না ১৯৭১ সালের যুদ্ধের শেষ দিনগুলোকে বিকৃত করা কিংবা আড়ালে রাখা হয়েছে অথবা সবচেয়ে যা খারাপ_ ভুলে যাওয়া হয়েছে।
১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর সকাল ৬টায় আমি চট্টগ্রাম শহরের উপকণ্ঠে ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে পেঁৗছাই। সব পাকিস্তানি সেনা অফিসারকে এ কলেজে হাজির হয়ে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। ভারতীয় আর্মি ব্রিগেডিয়ার সিধু_ যিনি চট্টগ্রাম দখলের নেতৃত্ব দিয়েছেন, আমাদের কোনো রকম অপমান করেননি, বরং সদয় আচরণ করেন। এর একটি কারণ হতে পারে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার তাসকেনুদ্দিন, যিনি আত্মসমর্পণে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন, তিনি ছিলেন দেশ বিভাগের আগে ইন্ডিয়ান মিলিটারি একাডেমিতে সিধুর প্রশিক্ষক। আমি একটি জিপে সাদা পতাকা উড়িয়ে ভারতীয় বাহিনীর দিকে এগিয়ে যাই। এ সময় পাকিস্তানি অফিসারদের কেউ আমার সঙ্গে যেতে রাজি হননি। আমি একটি নালার কাছে পেঁৗছাই, যেখানে সেতুটি উড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। একজন শিখ মেজর এগিয়ে এসে আমাকে স্বাগত জানান এবং আত্মসমর্পণের জন্য সবাইকে গাড়ি নিয়ে আসার কথা বলেন। আমি কলেজে ফিরে গিয়ে ব্রিগেড মেজর ফকরকে তা জানাই। আমাদের সঙ্গে কয়েকটি বাস ও ট্রাক ছিল, কিন্তু তার কোনো চালককেই আমরা পাইনি। সবাই পালিয়ে গেছে। আমরা যখন কলেজ থেকে বের হয়ে আসি_ গেটের বাইরে ছিল একদল ক্ষুব্ধ মানুষ, যারা হামলা করতে পারে বলে মনে হয়েছিল। তাদের মধ্যে স্টেনগান হাতে 'মুক্তি'ও ছিল। সৌভাগ্যক্রমে জনতা শান্ত ছিল এবং তারা আমাদের পথ করে দেয়।
আমরা নালার কাছে গিয়ে দেখি, ভারতীয় আর্মির প্রকৌশলীরা চলার মতো ব্যবস্থা করছেন। আমি পাকিস্তানি সেনা অফিসারের ইউনিফর্ম পরা থাকা অবস্থাতেও কয়েকজন আমাকে স্যালুট দেয়। ব্রিগেডিয়ার সিধু আমার কাছে চট্টগ্রাম শহর কীভাবে নিয়ন্ত্রণে নেওয়া হবে, সে বিষয়ে পরামর্শ জানতে চান। আমি বিহারিদের নিরাপত্তার কথা বিশেষভাবে বলি। সেভাবেই ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিহার রেজিমেন্টকে তাৎক্ষণিক নির্দেশ দেওয়া হয়। সিধু আমাকে শহরের কমিশনার অফিসে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন। জেনারেল ইয়াহিয়া খান যুদ্ধ ঘোষণা করার আগে আমি সেখানে একটি সামরিক আদালতে দায়িত্ব পালন করি। চট্টগ্রাম শহরে তখন মুক্তির উৎসব। রঙবেরঙের পোশাক পরে তরুণ-তরুণীরা ভারত ও বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে আনন্দ করছিল। পাকিস্তানি বিরোধী ও ভারতের পক্ষের স্লোগানের পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি স্লোগান ছিল জয় বাংলা। এ যন্ত্রণাদায়ক দৃশ্য দেখার জন্য আমিই ছিলাম একমাত্র দুর্ভাগা পাকিস্তানি। আমার মনের যে কী অবস্থা তা ভাষায় বোঝানো যাবে না। উৎফুল্ল জনতা কমিশনার অফিসে চলে যায়। তারা মুক্তিদাতা ভারতীয় অফিসার ও জওয়ানদের ফুল তুলে দেয়। এ সময় এক তরুণী এগিয়ে এসে আমাকে একটি ফুল দিয়ে বলেন, আপনি পাকিস্তানি, কিন্তু আপনিও আমাদের সুখের দিনে শরিক হয়ে যান। এই বলে তিনি আমাকেও একটি ফুল দিলেন। হঠাৎ করেই একজন ভারতীয় আর্মি অফিসার আমাকে টেনে সরিয়ে দিলেন। আমি দেখতে পাই যে, এক তরুণের হাতে স্টেনগান এবং সে আমাকে গুলি করতে উদ্যত। কিন্তু ভারতীয় অফিসার আমার জীবন রক্ষা করেন।
ব্রিগেডিয়ার সিধু শহর ঘুরে দেখেন, বিশেষ করে যান বিহারি অধ্যুষিত এলাকায়। মনে হচ্ছিল, সেখানে কেউ নেই। সব বাড়িতে উড়ছে সাদা পতাকা, বাংলাদেশের পতাকা নেই। নয় মাসের যুদ্ধে বিহারি যুবকরা পাকিস্তানকে কী আন্তরিকভাবেই না সমর্থন দিয়েছে। এখন সব ঘরের দুয়ার বন্ধ। কিছুক্ষণ পর কয়েকজনকে বের হয়ে আসতে দেখা গেল। ব্রিগেডিয়ার সিধু সবাইকে বের হয়ে আসার জন্য আমার মাধ্যমে অনুরোধ জানালেন। প্রথমে কেউই এগিয়ে এলো না। কিন্তু হ্যান্ডমাইকে আমি বলি যে, আমি একজন পাকিস্তানি এবং আমার সঙ্গে ভারতীয় সৈন্যরা রয়েছে, যারা তাদের রক্ষা করবে_ এতে তারা ভরসা পায় এবং বয়স্করা এগিয়ে আসে। ব্রিগেডিয়ার সিধুু তাদের বলেন, বিহারি রেজিমেন্ট তাদের রক্ষায় মোতায়েন করা হয়েছে। আমি অপরাধবোধে আক্রান্ত ছিলাম। আমি জানি যে এসব লোক পাকিস্তানের পক্ষে এবং ভারতের বিপক্ষে ছিল। তারা মুক্তিবাহিনীর ঘোরতর বিরুদ্ধে ছিল। এখন তাদের আমরা পরিত্যাগ করেছি। রেলওয়ের কলোনি ও আদমজী নগরেরও চিত্র ছিল অভিন্ন। সন্ধ্যা নাগাদ আমরা আগ্রাবাদ হোটেলে পেঁৗছাই। সেখানে কয়েকজন ওয়েটার আমাকে চিনতে পারে এবং তাদের প্রতিক্রিয়া ছিল মিশ্র। শেষ পর্যন্ত আমাকে অস্বস্তিকর দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। আমার সন্তুষ্টির কেবল একটিই কারণ ছিল_ অবাঙালিদের রক্ষায় আমি ভূমিকা রাখতে পেরেছি, তখন এর প্রয়োজন ছিল সবচেয়ে বেশি।
স শামসার আলী খান : ১৯৭১ সালে পাকিস্তান আর্মির মেজর, বাংলাদেশে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে যুদ্ধ করেছেন। দি এক্সপ্রেস ট্রিবিউন পত্রিকায় ১৬ ডিসেম্বর ২০১১ তারিখ প্রকাশিত
আমরা নালার কাছে গিয়ে দেখি, ভারতীয় আর্মির প্রকৌশলীরা চলার মতো ব্যবস্থা করছেন। আমি পাকিস্তানি সেনা অফিসারের ইউনিফর্ম পরা থাকা অবস্থাতেও কয়েকজন আমাকে স্যালুট দেয়। ব্রিগেডিয়ার সিধু আমার কাছে চট্টগ্রাম শহর কীভাবে নিয়ন্ত্রণে নেওয়া হবে, সে বিষয়ে পরামর্শ জানতে চান। আমি বিহারিদের নিরাপত্তার কথা বিশেষভাবে বলি। সেভাবেই ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিহার রেজিমেন্টকে তাৎক্ষণিক নির্দেশ দেওয়া হয়। সিধু আমাকে শহরের কমিশনার অফিসে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন। জেনারেল ইয়াহিয়া খান যুদ্ধ ঘোষণা করার আগে আমি সেখানে একটি সামরিক আদালতে দায়িত্ব পালন করি। চট্টগ্রাম শহরে তখন মুক্তির উৎসব। রঙবেরঙের পোশাক পরে তরুণ-তরুণীরা ভারত ও বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে আনন্দ করছিল। পাকিস্তানি বিরোধী ও ভারতের পক্ষের স্লোগানের পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি স্লোগান ছিল জয় বাংলা। এ যন্ত্রণাদায়ক দৃশ্য দেখার জন্য আমিই ছিলাম একমাত্র দুর্ভাগা পাকিস্তানি। আমার মনের যে কী অবস্থা তা ভাষায় বোঝানো যাবে না। উৎফুল্ল জনতা কমিশনার অফিসে চলে যায়। তারা মুক্তিদাতা ভারতীয় অফিসার ও জওয়ানদের ফুল তুলে দেয়। এ সময় এক তরুণী এগিয়ে এসে আমাকে একটি ফুল দিয়ে বলেন, আপনি পাকিস্তানি, কিন্তু আপনিও আমাদের সুখের দিনে শরিক হয়ে যান। এই বলে তিনি আমাকেও একটি ফুল দিলেন। হঠাৎ করেই একজন ভারতীয় আর্মি অফিসার আমাকে টেনে সরিয়ে দিলেন। আমি দেখতে পাই যে, এক তরুণের হাতে স্টেনগান এবং সে আমাকে গুলি করতে উদ্যত। কিন্তু ভারতীয় অফিসার আমার জীবন রক্ষা করেন।
ব্রিগেডিয়ার সিধু শহর ঘুরে দেখেন, বিশেষ করে যান বিহারি অধ্যুষিত এলাকায়। মনে হচ্ছিল, সেখানে কেউ নেই। সব বাড়িতে উড়ছে সাদা পতাকা, বাংলাদেশের পতাকা নেই। নয় মাসের যুদ্ধে বিহারি যুবকরা পাকিস্তানকে কী আন্তরিকভাবেই না সমর্থন দিয়েছে। এখন সব ঘরের দুয়ার বন্ধ। কিছুক্ষণ পর কয়েকজনকে বের হয়ে আসতে দেখা গেল। ব্রিগেডিয়ার সিধু সবাইকে বের হয়ে আসার জন্য আমার মাধ্যমে অনুরোধ জানালেন। প্রথমে কেউই এগিয়ে এলো না। কিন্তু হ্যান্ডমাইকে আমি বলি যে, আমি একজন পাকিস্তানি এবং আমার সঙ্গে ভারতীয় সৈন্যরা রয়েছে, যারা তাদের রক্ষা করবে_ এতে তারা ভরসা পায় এবং বয়স্করা এগিয়ে আসে। ব্রিগেডিয়ার সিধুু তাদের বলেন, বিহারি রেজিমেন্ট তাদের রক্ষায় মোতায়েন করা হয়েছে। আমি অপরাধবোধে আক্রান্ত ছিলাম। আমি জানি যে এসব লোক পাকিস্তানের পক্ষে এবং ভারতের বিপক্ষে ছিল। তারা মুক্তিবাহিনীর ঘোরতর বিরুদ্ধে ছিল। এখন তাদের আমরা পরিত্যাগ করেছি। রেলওয়ের কলোনি ও আদমজী নগরেরও চিত্র ছিল অভিন্ন। সন্ধ্যা নাগাদ আমরা আগ্রাবাদ হোটেলে পেঁৗছাই। সেখানে কয়েকজন ওয়েটার আমাকে চিনতে পারে এবং তাদের প্রতিক্রিয়া ছিল মিশ্র। শেষ পর্যন্ত আমাকে অস্বস্তিকর দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। আমার সন্তুষ্টির কেবল একটিই কারণ ছিল_ অবাঙালিদের রক্ষায় আমি ভূমিকা রাখতে পেরেছি, তখন এর প্রয়োজন ছিল সবচেয়ে বেশি।
স শামসার আলী খান : ১৯৭১ সালে পাকিস্তান আর্মির মেজর, বাংলাদেশে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে যুদ্ধ করেছেন। দি এক্সপ্রেস ট্রিবিউন পত্রিকায় ১৬ ডিসেম্বর ২০১১ তারিখ প্রকাশিত
No comments