প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি-যেন রূপকথার গল্প

সংসদ সদস্যের বাড়ির সামনের সড়কটির দিকে তাকালেই বোঝা যাবে মেহেরপুরের কতটুকু উন্নয়ন হয়েছে। অথচ নির্বাচনের আগে এমপি সাহেব ১৯ দফার ইস্তেহার দিয়েছিলেন। তার একটিও পূরণ করতে পারেননি। দলের নেতা-কর্মীরাও এখন বিভক্ত। তিনি নির্বাচন পরবর্তী সময় থেকে এখনো আত্মীয়করণ নিয়ে ব্যস্ত। তাঁকে ঘিরে আছে জামায়াতের লোকজন। সংসদ সদস্য এবং তার শ্যালক নূরুল ইসলামের স্ত্রী জামায়াতের রোকন। শ্যালক সব কিছুর


নিয়ন্ত্রক। ফলে গ্রাম পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা দলের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন। স্থবির হয়ে পড়েছে জেলার উন্নয়ন। আগামীতে এর খেসারত দিতে হবে দলকে।' মেহেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক আবদুল মান্নান (ছোট) ক্ষোভের সঙ্গেই এসব কথা বলেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন, গত ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর দিবসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা 'মেহেরপুরে রেললাইন স্থাপন, মুজিবনগর ডিগ্রি কলেজ সরকারীকরণ ও মেহেরপুর সরকারি কলেজ ও মহিলা কলেজে অনার্স কোর্স চালু করার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু সংসদ সদস্য সেসব বাস্তবায়নেও কোনো ভূমিকা রাখছেন না। এমপি সাহেব লোকবল দিয়ে তাঁর মৎস্য চাষের জলাশয় লুট করার কারণে তাঁকে দুদিন অনশন করতে হয়েছে বলেও তিনি জানান।
মেহেরপুরের সাবেক সংসদ সদস্যদের মতো বর্তমান সংসদ সদস্যও নির্বাচনপূর্ব ঘোষণা দিয়েছিলেন 'এমপি হওয়া মানেই চুরি-ডাকাতি, লুটপাট করা_এমন ধারণা ভোটারদের, এ ধারণা পাল্টাতে হবে। নির্বাচিত হলে প্রথমেই স্থলবন্দর করা হবে, ভৈরব নদ খনন ও রেলপথ নির্মাণ করা হবে, আর্সেনিকমুক্ত টিউবওয়েল ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হবে।' বিরোধীদলের প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে বলেন, 'আমরা গাছ কাটার সরকার নয়, গাছ লাগানোর সরকার হব। অন্য সরকারের মতো টাকার বিনিময়ে নয়, যোগ্যতার ভিত্তিতে চাকরি দেব।' মেহেরপুর জেলাবাসীকে এমন ১৯টি প্রতিশ্রুতি দিয়ে গণজোয়ারে এমপি নির্বাচিত হন জয়নাল আবেদীন। কিন্তু নির্বাচিত হওয়ার তিন বছরে একটিও প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারেননি তিনি। বরং প্রতিশ্রুতির বিপরীত চিত্রই দেখতে হচ্ছে এলাকার মানুষকে। দেখতে হচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডারদের ভৈরব নদে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করার দৃশ্য।
আগের ক্ষমতাসীন দল যেখানে গাছের ডাল কেটেছে, সেখানে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের লোকজন গাছের শিকড় পর্যন্ত তুলে নিচ্ছে। মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা সড়কের ব্রিটিশ আমলে লাগানো ১৪টি বড় গাছ কেটে নেওয়া হয়েছে। অথচ গাছগুলো প্রমাণ দিতো মেহেরপুর শহর কত পুরনো। কালের সাক্ষী হয়ে থাকা গাছগুলো পথিকদের ছায়া দান করত। প্রায় শতভাগই দলীয় নিয়োগ, টেন্ডারবাজি ও দখল অব্যাহত আছে। টেন্ডারবাজি নিয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সেক্রেটারির বাড়িতে বোমা হামলার ঘটনাও ঘটে। জেলা আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি মিয়াজান আলী বলেন, এমপি ও তাঁর লোকজন নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণের পরিবর্তে টেন্ডারবাজি, জমি দখল, গাছ কাটা, চাঁদাবাজি_এসব নিয়ে ব্যস্ত আছেন। এতে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে।
গত তিন বছরে সংসদ সদস্যের নির্দেশে আমঝুপি ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান বোরহান উদ্দিন চুন্নুর নেতৃত্বে জেলার বিভিন্ন সড়কে প্রায় সাত হাজার ছোট বড় সরকারি গাছ কেটে কয়েক কোটি টাকার সম্পদ আত্মসাৎ করা হয়েছে। এ সম্পর্কে একাধিক অভিযোগ মেহেরপুর থানাতে করা আছে। মামলাও হয়েছে আদালতে। তারপরও গাছকাটা বন্ধ হয়নি।
মেহেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট মিয়াজান আলী বলেন, দলের ভেতর কোন্দল এবং সংসদ সদস্যের আত্মীয়করণের কারণে তৃণমূল পর্যায়ে দলের বর্তমান অবস্থা খুবই খারাপ। সঠিক নেতৃত্ব না থাকায় ভবিষ্যতে দায়ভার বহন করা দলের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়বে।
মেহেরপুরের একমাত্র নদ ভৈরব। নদটি জেলার অর্থনৈতিক দৃশ্য পাল্টে দিতে পারে। জেলার প্রবীণ ব্যক্তি রবিউল হোসেন বাঘা জানান, এক সময় মেহেরপুরের ভৈরব নদ থেকে মালামাল আর যাত্রী বোঝাই করে নিয়ে ভেঁপু বাজিয়ে রওনা দিত বিশাল বিশাল স্টিমার, মহাজনী নৌকা, বজরাসহ অন্যান্য জলযান। ছিল বেশ কটি বন্দর। ভৈরব নদপাড়ের মেহেরপুর শহরের উপকণ্ঠে একটি গ্রামের নাম বন্দর। ওখানে একদিন বন্দর ছিল বলেই ওই নামকরণ। মেহেরপুর শহরের মালোপাড়ার গোবিন্দ হালদার বলেন, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এলাকার এক শ্রেণীর মানুষের জীবিকা নির্বাহের একমাত্র অবলম্বন ছিল ভৈরব নদ। বর্তমানে শহরের আবর্জনা ফেলা হয় এ নদে। অবর্জনার ভাগাড় হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে নদটি। অথচ নির্বাচনের আগে সব প্রার্থীই প্রতিশ্রুতি দেন নির্বাচিত হলেই ভৈরব নদ খনন করা হবে। কিন্তু নির্বাচনের পর ক্ষমতায় গিয়ে সবাই তা ভুলে যান। খনন হয় না ভৈরব নদ। তবে তিনি জানান, ভৈরব নদ খননের আশা এখনো তাঁরা হারাননি। আগামী দুই বছরের মধ্যে ভালো কিছু দেখে যেতে পারবেন বলে এখনো আশা করেন তিনি। অথচ এই ভৈরব নদ খনন করা হলে ১৯ হাজার হেক্টর জমি সেচ সুবিধা পাবে। মিটবে জেলার মৎস্য চাহিদা। যা মেহেরপুরের উন্নয়নে অনেক সহায়ক ভূমিকা রাখবে। নদের পাড়ের জেলারা ফিরে পাবে তাদের পৈত্রিক পেশা। খননের পরিবর্তে তাঁরা উল্টো দখল করে চাষাবাদ করছে এই নদে। মেহেরপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক শেখ ইফতেখার হোসেন জানান, ভৈরব নদ খনন করা হলে ১৯ হাজার হেক্টর জমি সেচের সুবিধা পাবে। এতে কয়েক শ টন বাড়তি ফসল উৎপাদিত হবে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী (চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুর) আকবর হোসেন জানান, ভৈরব নদ খননের জন্য মন্ত্রণালয়ে এর গুরুত্ব তুলে ধরে চিঠি পাঠানো হয়েছে। একটি জরিপদল নদের বর্তমান চিত্র পরিদর্শনও করে গেছে।
মেহেরপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য জয়নাল আবেদীন জানান, বুড়িপোতা স্থলবন্দর স্থাপনের জন্য সমপ্রতি একটি টিম মুজিবনগর বুড়িপোতা সীমান্তে স্থলবন্দর স্থাপনের জন্য পরিদর্শন করে গেছে। আর ভৈরব নদ খনন ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সংসদে একাধিক বার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.