শহীদ পরিবার: চার প্রজন্মে by তৌহিদা শিরোপা

ছোট্ট নাযাহ্ আর তার মামাতো ভাইয়ের মধ্যে ঝগড়াই বেধে গেল। কে বেশি জানে মুক্তিযুদ্ধের কথা। তাদের বড়বাবা শহীদ সমাজসেবক মো. সলিমুল্লাহর প্রতিটি গল্প তাদের জানা। দেখা গেল, দুজনই সমান জানে মুক্তিযুদ্ধের গল্প। ঢাকার তাজমহল রোডের বাসায় তাদের এই আলাপচারিতা শুনে গর্বের হাসি হাসেন জেবুন্নেছা বেগম। শহীদ মো. সলিমুল্লাহর স্ত্রী। তাঁর হাসি বলে দেয় তিনি সার্থক। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে শহীদদের আত্মদানের কথা তিনি জানাতে


পেরেছেন। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলেমেয়েরা যখন বড় হয়েছে, তখন তো তারা বাস্তবতাকেই দেখেছে। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ আমার স্বামীকে ধরে মেরে ফেলা হয়। আমাদের এই বাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেয়। স্বামী, বাড়ি সব হারিয়ে ১০টি ছেলেমেয়ে নিয়ে দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলাম। যুদ্ধ শেষে বেঁচে থাকার সংগ্রাম। দিন-রাত কাজ করেছি। আমার স্বামীকে বাঁচাতে সেদিন দোতলা থেকে লাফ দিয়েছিলাম। দুই পায়ে কতটা আঘাত পেয়েছি, তখন যেন বুঝতে পারিনি। অনুভূতিহীন হয়ে গিয়েছিলাম। এখন সেই ব্যথা ভীষণ যন্ত্রণা দেয়। পায়ে ভর দিয়ে তেমন একটা দাঁড়াতে পারি না। আমার ছেলেমেয়ের সঙ্গে গল্প করার সময়ই পেতাম না। কিন্তু ওরা ওদের চেতনায়, ভালোবাসায় দেশকে ও শহীদদের আত্মত্যাগকে ধারণ করেছে। এখনই বরং সবাই মিলে একসঙ্গে হলে সে সময়ের কত গল্প হয়। আমার বড় মেয়ের নাতনি হলো নাযাহ্। সারাক্ষণ গল্প শুনতে চায়। একই গল্প বারবার বলতেও ক্লান্তি লাগে না।’ মায়ের কথার জের ধরেই পারভীন আলম বলেন, ‘আমার নাতি-নাতনি দুজনই ভীষণ পছন্দ করে মুক্তিযুদ্ধের গল্প। গল্প শুনতে শুনতে ওদের চেহারায় পরিবর্তন আসে। আট বছর বয়সেই সব জানে ওরা। যুদ্ধের সময় আমরা কবে কোথায় থেকেছি, কীভাবে কী হলো সব মুখস্থ বলতে পারবে। ১৯৭১ সালে আমি তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সবে মাত্র ভর্তি হয়েছি। কী যে কষ্টের দিন গেছে। আজ ভাবি, কত কষ্ট করেছি। ১০ ভাইবোনের মধ্যে আমি দ্বিতীয়। আমার বড় ভাইও বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। সাদী (রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী সাদী মহম্মদ) ও শিবলী (নৃত্যশিল্পী শিবলী মহম্মদ) তখন ছোট। সংসারের বোঝা মা কাঁধে তুলে নিলেন। নিজে সেলাই করতেন। আমি রুটি খেতে পারতাম না। মা হয়তো সবাইকে রুটি দিয়েছেন, আবার আমার জন্য অল্প একটু ভাত রাখতেন। ছোট ভাইবোনেরা যেন না দেখে। তাহলে তো ওরাও ভাত খেতে চাইবে। এমনিভাবে কেটেছে সংগ্রামের দিনগুলো। মা ধীরে ধীরে আড়ং, কারিতাসে কাপড় দিতে থাকলেন। অনেক নারীকর্মী কাজ করতে থাকল। মাকে দেখে এখনো অনুপ্রাণিত হই। কীভাবে শোককে চাপা দিয়ে নিজে উদ্যোক্তা হয়েছেন। সন্তানদের সফলভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এই গল্পগুলোই আমি আমার মেয়ের (ফারাহ্ মেহজাবীন) সঙ্গে করেছি। আমার ছোট্ট নাতনি নাযাহ্র সঙ্গে করি।’ ফারাহ্ মেহজাবীন পারভীন আলমের মেয়ে। নাযাহ্ বিনতে ইকরামের মা। তিনি বলেন, ‘নাযাহ্ আমার মাকে মণি মা ডাকে। মণি মা আর বড় মার সঙ্গ তার খুব প্রিয়। বেশির ভাগ গল্প তাদের কাছে শোনে। মা, নানু, মামাদের কাছে ছোট থেকে আমিও মুক্তিযুদ্ধের গল্প, নানাকে নির্মমভাবে মেরে ফেলার ও নানুর সংগ্রামের কথা শুনেছি। আমার মেয়ে নাযাহেক সময় পেলেই বলেছি। এই বয়সেই প্রবল দেশপ্রেম আমার মেয়ের মধ্যে। ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে পড়লেও ওকে আমরা বাসায় বাংলা বই, গল্পের বই পড়ে শোনাই। ও ভালোভাবে বলতে ও লিখতে পারে বাংলা। মহান মুক্তিযুদ্ধের গল্পগাথা সবাইকে জানাতে হবে। প্রত্যেকের ছোট ছোট ভালো কাজ দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। আমি, মা ও নানু মিলে বাড়িতে একটা বুটিক চালু করেছি। ইচ্ছা আছে, এর মাধ্যমে নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেওয়া।’ সানবীমস স্কুলে প্রথম শ্রেণীতে পড়ুয়া নাযাহ্র অবশ্য মণি মার গল্প শুনলে মন খারাপ হয়। ইশ্, তখন যদি সে থাকত। তাহলে সব পাকিস্তানিকে মেরেই ফেলত। বড়বাবাকে কিছুই হতে দিত না।

No comments

Powered by Blogger.