অর্থনীতির বর্তমান চালচিত্র by ড. জাহাঙ্গীর আলম
এখন একটি তুখোড় বিতর্ক চলছে বাংলাদেশে। এর বিষয়বস্তু আমাদের অর্থনীতি। দেশের সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে বিরোধীদলীয় নেত্রী, রাজনীতিক, সাংবাদিক, পেশাজীবী এবং সাধারণ মানুষ_এ বিতর্কে অংশ নিচ্ছেন সবাই। কেউ বলছেন, অর্থনীতি ভালো চলছে। আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। কেউ বলছেন, অর্থনীতি এখন বিপর্যস্ত। গভীর সংকটে নিমজ্জিত। এর মাঝে ভালো কোনো লক্ষণ নেই। এ আলোচনা-সমালোচনা বেশ আকর্ষণীয়, কৌতূহলদীপ্ত।
এর পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় অর্থনীতির কিছু নিয়ামক বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। অর্থনীতির একটি বড় নিয়ামক প্রবৃদ্ধির হার। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে প্রবৃদ্ধির হার কম। বর্তমানে ২ থেকে ৩ শতাংশ। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এ হার গড়ে ৭ শতাংশের বেশি। বর্তমানে বিশ্বের মোটমাট প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে গড়ে ৫ শতাংশ। বাংলাদেশে গত তিন বছর যাবৎ প্রবৃদ্ধির হার অর্জিত হয়েছে ৫.৭ থেকে ৬.৬ শতাংশ। ২০১১-১২ সালের প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন হলো ৭ শতাংশ। অনেকে মনে করছেন, এটি অর্জন করা সম্ভব হবে না। কারণ সামষ্টিক অর্থনীতির অবস্থা ভালো না। তাঁদের মতে, এবার প্রবৃদ্ধির হার হবে সর্বোচ্চ ৬.৫ শতাংশ। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াও বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে শতকরা ৪ থেকে ৫ ভাগ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হতে পারে। স্থিতাবস্থা বজায় থাকলে এবং পরিবেশ অনুকূলে হলে ব্যক্তি খাতও ৫-৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধির অর্জনে সফল হতে পারে। এ অবস্থায় বাংলাদেশে সম্প্রতি যে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে তা সার্বিক জাতীয় উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য যথেষ্ট নয়। আমাদের দেশে এখন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার হওয়া উচিত ৮ থেকে ১০ শতাংশ। উন্নয়নশীল এশীয় দেশগুলোর গড় প্রবৃদ্ধির হার বর্তমানে ৯.৫ শতাংশ। জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি এবং বিশ্বব্যাপী খাদ্যপণ্যের সরবরাহ পর্যাপ্ত না থাকায় সারা বিশ্বে এবার মূল্যস্ফীতির হার বেশি। এর অতি সাম্প্রতিক হার হলো ৪ শতাংশ। উন্নত দেশগুলোতে এ হার গড়ে প্রায় ২ শতাংশ। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রায় ৭ শতাংশ। আমাদের দেশে এখন সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ১২ শতাংশের কাছাকাছি। খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ১৩ শতাংশের বেশি। একটি উন্নয়নশীল দেশে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন, অবকাঠামো নির্মাণ, কৃষি ও শিল্পে বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য মূল্যস্ফীতি কিছুটা বেশি হতে পারে, কিন্তু ৬-৭ শতাংশের বেশি মূল্যস্ফীতির হার কিছুতেই কাম্য হতে পারে না। বাংলাদেশে বর্তমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির হার অসহনীয়। আমাদের বর্তমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রধান কারণ বিশাল অঙ্কের ভর্তুকি ও বাজেট ঘাটতি। ২০১১-১২ সালের জন্য বাজেট ধরা হয়েছে এক লাখ ৬৩ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ঘাটতি ধরা হয়েছে ৪৫ হাজার ২০৪ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ২৭.৬ শতাংশ এবং জিডিপির ৫ শতাংশ। এ ঘাটতির মধ্যে ভর্তুকি রয়েছে ২০ হাজার ৪৭৭ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ১২.৫ শতাংশ এবং জিডিপির ২.৩ শতাংশ। ঘাটতি মেটানোর জন্য অর্থের জোগান বৈদেশিক ঋণ থেকে আসবে ১৭ হাজার ৯৯৯ কোটি টাকা (জিডিপির ২ শতাংশ) এবং অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে নেওয়া হবে ২৭ হাজার ২০৮ কোটি টাকা (জিডিপির ৩ শতাংশ)। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেওয়া হবে ১৮ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা (জিডিপির ২.১ শতাংশ) এবং অন্যান্য উৎস থেকে নেওয়া হবে আট হাজার ২৪৮ কোটি টাকা (জিডিপির ০.৯ শতাংশ)।
ইতিমধ্যেই বৈদেশিক ঋণের ক্ষেত্রে দারুণ ভাটা পড়েছে। প্রার্থিত ঋণ মিলছে না। অন্যদিকে জাতীয় সঞ্চয়সহ অন্যান্য অভ্যন্তরীণ ঋণও প্রত্যাশা মোতাবেক আসছে না। ফলে সরকার পরিচালনার জন্য নির্ভর করতে হচ্ছে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ আহরণের ওপর। গত ২২ নভেম্বর পর্যন্ত প্রায় পাঁচ মাসে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার ঋণ নিয়েছে ২০ হাজার ২০৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এর মধ্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নিয়েছে ১২ হাজার ২২১ কোটি ৭৪ লাখ টাকা এবং অন্যান্য বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে নিয়েছে সাত হাজার ৯৮২ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। তাতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো পড়েছে তারল্য সংকটে। নির্ভর করছে উচ্চ সুদের কলমানির ওপর।
অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন নোট ছেপে সরকারকে ঋণ সরবরাহ করাতে বাজারে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। বলাবাহুল্য, বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে অভ্যন্তরীণ সম্পদের ওপর নির্ভরতা বাড়িয়ে সরকারি ব্যয় নির্বাহ একটি ভালো কাজ। কিন্তু তা নতুন নোট ছাপিয়ে নয়। সেভিংস সার্টিফিকেট ও ট্রেজারি বন্ড বিক্রির মাধ্যমে জনসাধারণের কাছ থেকে ঋণ নেওয়া মূল্যস্ফীতি নিরপেক্ষ। কিন্তু ইদানীং এ খাতে অর্থ আহরণ উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে। অন্যদিকে সরকারের রাজস্ব আদায়ের গতিও শ্লথ। চলতি ২০১১-১২ অর্থবছরে এনবিআর অংশে রাজস্ব আদায়ের টার্গেট ধরা হয়েছে ৯১ হাজার ৮৭০ কোটি টাকা। প্রথম তিন মাসে আদায় হয়েছে ১৫ হাজার ৬৯০ কোটি ৯০ লাখ টাকা। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এবার রাজস্ব আদায় প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশ কমে গেছে।
গত বাজেটে ২০১১-১২ সালের জন্য প্রাক্কলিত ভর্তুকির পরিমাণ ছিল ২০ হাজার ৪৭৭ কোটি টাকা, যা এখন বৃদ্ধি পাচ্ছে আনুমানিক ৪৭ হাজার ৩৮৫ কোটি টাকায়। ফলে জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বারবার বাড়িয়ে ভর্তুকি ও ব্যয় নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হচ্ছে। তাতে বৃদ্ধি পাচ্ছে মূল্যস্ফীতি। আর্থিক চাপ বাড়ছে কৃষিসহ অন্যান্য খাতের ওপর।
এ অবস্থায় কম গুরুত্বপূর্ণ ও অপ্রয়োজনীয় খাতে ব্যয় কমিয়ে বাজেটের আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য রক্ষা করার ব্যবস্থা নেওয়াই ছিল অধিকতর যুক্তিপূর্ণ। সম্প্রতি আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ দ্রুত কমে যাচ্ছে। দুই বছর ধরে বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ১১০০ কোটি মার্কিন ডলার মজুদ ছিল। ২০১১ সালের মে মাসের ৩ তারিখে এই মজুদের পরিমাণ ছিল এক হাজার ১৭৩ কোটি ডলার। গত ২৩ নভেম্বর তা নেমে এসেছে ৯৪০ কোটি ডলারে। বাণিজ্য ঘাটতি বৃদ্ধি, রেমিট্যান্স প্রবাহের প্রবৃদ্ধি হ্রাস এবং বৈদেশিক সহায়তার প্রবাহ শ্লথগতির কারণে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ এভাবে হ্রাস পেয়েছে। একটি দেশের আপৎকালীন খাদ্য আমদানি এবং অন্যান্য জরুরি আমদনি ব্যয় মেটানোর জন্য নূ্যনপক্ষে চার মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা মজুদ থাকা দরকার। বর্তমানে আমাদের প্রতি মাসের আমদানি ব্যয় মেটাতে প্রয়োজন হয় গড়ে ৩০০ কোটি ডলারের। সেদিক বিবেচনায় আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার বর্তমান মজুদ অপর্যাপ্ত, সংকটকালীন আমদানি ব্যয় মেটানোর জন্য যথেষ্ট নয়। ফলে ব্যাংকগুলোতে এখন ডলারের জন্য চলছে হাহাকার। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আর একটি ঝাঁকুনি দিয়েছে পুঁজিবাজারের ধস। ২০০৯-১০ অর্থবছরের জুন মাস শেষে ঢাকা স্টক এঙ্চেঞ্জের সাধারণ মূল্যসূচক ছিল ছয় হাজার ১৫৪। এরপর ব্যাংক আমানত ও সঞ্চয়ের ওপর থেকে সুদের হার কমিয়ে এবং কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ দিয়ে সাধারণ জনগণের মধ্যে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের আগ্রহ সৃষ্টি করা হয়। তাতে মূল্যসূচক দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে ২০১০ সালের ডিসেম্বর মাস শেষে আট হাজার ২৯০-তে গিয়ে পেঁৗছে।
এরপর শুরু হয় দরপতন। গত অক্টোবরের শেষে পাঁচ হাজারের নিচে নেমে যায় সাধারণ মূল্যসূচক। এতে বিক্ষুব্ধ হন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। তাঁরা রাস্তা অবরোধ থেকে শুরু করে অনশন পর্যন্ত করতে থাকেন। অবশেষে গত ১৬ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি হস্তক্ষেপের পর ২৩ নভেম্বর ২১ দফা প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে এসইসি। উদ্দেশ্য, বাজারে তারল্য বাড়ানো, বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনা ও বাজারের দরপতন ঠেকানো। এর ফলে প্রথমে বাজার চাঙ্গা হয়ে ওঠে। কিন্তু তার পরই আবার শুরু হয় দরপতন। ২৭ নভেম্বর পর্যন্ত ডিএসইর সাধারণ সূচক ফের কমে যায় ৫৩২ পয়েন্ট। এখন ক্ষণে বাড়ছে, ক্ষণে কমছে পুঁজিবাজারের সূচক। এই নিয়ত পরিবর্তনশীল পুঁজিবাজারে কবে নাগাদ স্থিতিশীলতা আসবে_সেটাই এখন বিনিয়োগকারীদের বড় প্রশ্ন।
উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী ক্রয় করতে গিয়ে যখন জনজীবন বিপর্যস্ত, তখন কৃষক তাঁর উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না। বিক্রি মূল্যের একটা বড় অংশ লুটে নিচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীরা। পথেঘাটে চাঁদাবাজি ও ঘুষ আদায় করা এখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। সার, জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ, বীজ ও কীটনাশকের মূল্যবৃদ্ধি এবং কৃষি শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধির কারণে কৃষিপণ্যের বাড়তি উৎপাদন খরচ মিটিয়ে লাভ বলতে কৃষকের আর তেমন কিছুই থাকছে না। সম্প্রতি পাটের বাজার ভীষণ মন্দা যাচ্ছে। অনেক স্থানে কৃষক গত বছরের এক-তৃতীয়াংশ দরে অর্থাৎ ৬০০ কিংবা ৭০০ টাকা মণ দরেও পাট বিক্রি করতে পারছেন না। সরকারি কিংবা বেসরকারি পাটকলগুলো পাট ক্রয়ে তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছে না। বিদেশেও এবার পাটের চাহিদা কম, নতুন বাজার সৃষ্টি হচ্ছে না। কৃষকরা এবার পাট ঘরেই মজুদ করে রাখছেন। ইতিমধ্যেই আমন ধান কাটা শুরু হয়েছে। ভালো ফলন হয়েছে এবার। তাই দাম পড়ে গেছে। ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকায় ধান বিক্রি করতে হচ্ছে কৃষকদের। তাতে উৎপাদন খরচও উঠে আসছে না। গুদামের অপ্রতুলতায় সরকার এখনো ধান-চাল সংগ্রহের ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এমনিভাবে একদিকে ভোগ্যপণ্যের উচ্চমূল্য; অন্যদিকে উৎপাদিত কৃষিপণ্যের নিম্নমূল্যের কারণে এখন প্রায় দিশেহারা দেশের কৃষক সমাজ। তাঁরা ক্রমেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন কৃষিকর্মে।
কেউ কেউ মনে করেন, এখন মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। সম্প্রতি এ মনোভাব পোষণ করেছেন প্রধানমন্ত্রীও। এ বিষয়ে একটি মতামত জরিপ করেছিল কালের কণ্ঠ। পাঠকদের মতামত হলো, এখন ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে ওই শ্রেণীর মানুষের_যারা ক্ষমতাবান, উচ্চবিত্ত, অসাধু, দুর্নীতিবাজ ও সুবিধাবাদী। সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়েনি। বেড়েছে দুর্ভোগ। বেড়েছে আয় বৈষম্য। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, দেশের অর্থনীতিবিদ ও সংবাদমাধ্যমগুলো অর্থনীতিকে টেনে নামাতে চাইছে। বস্তুত মুহিত হচ্ছেন রাষ্ট্রের কোষাধ্যক্ষ। সব টাকার জিম্মাদার তিনি। তিনি একজন বড় মাপের অর্থনীতিবিদ, ভালো লেখক ও সুবক্তা। জাতীয় অর্থনীতির সব তথ্য-উপাত্ত তাঁর কাছে সুবিন্যস্ত। তিনি যদি দেশের অর্থনীতিকে টেনে ওপরে নিয়ে যেতে পারতেন, তবে নিচে নামানোর সাধ্য ছিল কার?
লেখক : কৃষি অর্থনীতিবিদ, alamj52@gmail.com
ইতিমধ্যেই বৈদেশিক ঋণের ক্ষেত্রে দারুণ ভাটা পড়েছে। প্রার্থিত ঋণ মিলছে না। অন্যদিকে জাতীয় সঞ্চয়সহ অন্যান্য অভ্যন্তরীণ ঋণও প্রত্যাশা মোতাবেক আসছে না। ফলে সরকার পরিচালনার জন্য নির্ভর করতে হচ্ছে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ আহরণের ওপর। গত ২২ নভেম্বর পর্যন্ত প্রায় পাঁচ মাসে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার ঋণ নিয়েছে ২০ হাজার ২০৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এর মধ্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নিয়েছে ১২ হাজার ২২১ কোটি ৭৪ লাখ টাকা এবং অন্যান্য বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে নিয়েছে সাত হাজার ৯৮২ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। তাতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো পড়েছে তারল্য সংকটে। নির্ভর করছে উচ্চ সুদের কলমানির ওপর।
অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন নোট ছেপে সরকারকে ঋণ সরবরাহ করাতে বাজারে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। বলাবাহুল্য, বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে অভ্যন্তরীণ সম্পদের ওপর নির্ভরতা বাড়িয়ে সরকারি ব্যয় নির্বাহ একটি ভালো কাজ। কিন্তু তা নতুন নোট ছাপিয়ে নয়। সেভিংস সার্টিফিকেট ও ট্রেজারি বন্ড বিক্রির মাধ্যমে জনসাধারণের কাছ থেকে ঋণ নেওয়া মূল্যস্ফীতি নিরপেক্ষ। কিন্তু ইদানীং এ খাতে অর্থ আহরণ উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে। অন্যদিকে সরকারের রাজস্ব আদায়ের গতিও শ্লথ। চলতি ২০১১-১২ অর্থবছরে এনবিআর অংশে রাজস্ব আদায়ের টার্গেট ধরা হয়েছে ৯১ হাজার ৮৭০ কোটি টাকা। প্রথম তিন মাসে আদায় হয়েছে ১৫ হাজার ৬৯০ কোটি ৯০ লাখ টাকা। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এবার রাজস্ব আদায় প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশ কমে গেছে।
গত বাজেটে ২০১১-১২ সালের জন্য প্রাক্কলিত ভর্তুকির পরিমাণ ছিল ২০ হাজার ৪৭৭ কোটি টাকা, যা এখন বৃদ্ধি পাচ্ছে আনুমানিক ৪৭ হাজার ৩৮৫ কোটি টাকায়। ফলে জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বারবার বাড়িয়ে ভর্তুকি ও ব্যয় নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হচ্ছে। তাতে বৃদ্ধি পাচ্ছে মূল্যস্ফীতি। আর্থিক চাপ বাড়ছে কৃষিসহ অন্যান্য খাতের ওপর।
এ অবস্থায় কম গুরুত্বপূর্ণ ও অপ্রয়োজনীয় খাতে ব্যয় কমিয়ে বাজেটের আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য রক্ষা করার ব্যবস্থা নেওয়াই ছিল অধিকতর যুক্তিপূর্ণ। সম্প্রতি আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ দ্রুত কমে যাচ্ছে। দুই বছর ধরে বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ১১০০ কোটি মার্কিন ডলার মজুদ ছিল। ২০১১ সালের মে মাসের ৩ তারিখে এই মজুদের পরিমাণ ছিল এক হাজার ১৭৩ কোটি ডলার। গত ২৩ নভেম্বর তা নেমে এসেছে ৯৪০ কোটি ডলারে। বাণিজ্য ঘাটতি বৃদ্ধি, রেমিট্যান্স প্রবাহের প্রবৃদ্ধি হ্রাস এবং বৈদেশিক সহায়তার প্রবাহ শ্লথগতির কারণে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ এভাবে হ্রাস পেয়েছে। একটি দেশের আপৎকালীন খাদ্য আমদানি এবং অন্যান্য জরুরি আমদনি ব্যয় মেটানোর জন্য নূ্যনপক্ষে চার মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা মজুদ থাকা দরকার। বর্তমানে আমাদের প্রতি মাসের আমদানি ব্যয় মেটাতে প্রয়োজন হয় গড়ে ৩০০ কোটি ডলারের। সেদিক বিবেচনায় আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার বর্তমান মজুদ অপর্যাপ্ত, সংকটকালীন আমদানি ব্যয় মেটানোর জন্য যথেষ্ট নয়। ফলে ব্যাংকগুলোতে এখন ডলারের জন্য চলছে হাহাকার। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আর একটি ঝাঁকুনি দিয়েছে পুঁজিবাজারের ধস। ২০০৯-১০ অর্থবছরের জুন মাস শেষে ঢাকা স্টক এঙ্চেঞ্জের সাধারণ মূল্যসূচক ছিল ছয় হাজার ১৫৪। এরপর ব্যাংক আমানত ও সঞ্চয়ের ওপর থেকে সুদের হার কমিয়ে এবং কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ দিয়ে সাধারণ জনগণের মধ্যে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের আগ্রহ সৃষ্টি করা হয়। তাতে মূল্যসূচক দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে ২০১০ সালের ডিসেম্বর মাস শেষে আট হাজার ২৯০-তে গিয়ে পেঁৗছে।
এরপর শুরু হয় দরপতন। গত অক্টোবরের শেষে পাঁচ হাজারের নিচে নেমে যায় সাধারণ মূল্যসূচক। এতে বিক্ষুব্ধ হন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। তাঁরা রাস্তা অবরোধ থেকে শুরু করে অনশন পর্যন্ত করতে থাকেন। অবশেষে গত ১৬ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি হস্তক্ষেপের পর ২৩ নভেম্বর ২১ দফা প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে এসইসি। উদ্দেশ্য, বাজারে তারল্য বাড়ানো, বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনা ও বাজারের দরপতন ঠেকানো। এর ফলে প্রথমে বাজার চাঙ্গা হয়ে ওঠে। কিন্তু তার পরই আবার শুরু হয় দরপতন। ২৭ নভেম্বর পর্যন্ত ডিএসইর সাধারণ সূচক ফের কমে যায় ৫৩২ পয়েন্ট। এখন ক্ষণে বাড়ছে, ক্ষণে কমছে পুঁজিবাজারের সূচক। এই নিয়ত পরিবর্তনশীল পুঁজিবাজারে কবে নাগাদ স্থিতিশীলতা আসবে_সেটাই এখন বিনিয়োগকারীদের বড় প্রশ্ন।
উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী ক্রয় করতে গিয়ে যখন জনজীবন বিপর্যস্ত, তখন কৃষক তাঁর উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না। বিক্রি মূল্যের একটা বড় অংশ লুটে নিচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীরা। পথেঘাটে চাঁদাবাজি ও ঘুষ আদায় করা এখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। সার, জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ, বীজ ও কীটনাশকের মূল্যবৃদ্ধি এবং কৃষি শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধির কারণে কৃষিপণ্যের বাড়তি উৎপাদন খরচ মিটিয়ে লাভ বলতে কৃষকের আর তেমন কিছুই থাকছে না। সম্প্রতি পাটের বাজার ভীষণ মন্দা যাচ্ছে। অনেক স্থানে কৃষক গত বছরের এক-তৃতীয়াংশ দরে অর্থাৎ ৬০০ কিংবা ৭০০ টাকা মণ দরেও পাট বিক্রি করতে পারছেন না। সরকারি কিংবা বেসরকারি পাটকলগুলো পাট ক্রয়ে তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছে না। বিদেশেও এবার পাটের চাহিদা কম, নতুন বাজার সৃষ্টি হচ্ছে না। কৃষকরা এবার পাট ঘরেই মজুদ করে রাখছেন। ইতিমধ্যেই আমন ধান কাটা শুরু হয়েছে। ভালো ফলন হয়েছে এবার। তাই দাম পড়ে গেছে। ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকায় ধান বিক্রি করতে হচ্ছে কৃষকদের। তাতে উৎপাদন খরচও উঠে আসছে না। গুদামের অপ্রতুলতায় সরকার এখনো ধান-চাল সংগ্রহের ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এমনিভাবে একদিকে ভোগ্যপণ্যের উচ্চমূল্য; অন্যদিকে উৎপাদিত কৃষিপণ্যের নিম্নমূল্যের কারণে এখন প্রায় দিশেহারা দেশের কৃষক সমাজ। তাঁরা ক্রমেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন কৃষিকর্মে।
কেউ কেউ মনে করেন, এখন মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। সম্প্রতি এ মনোভাব পোষণ করেছেন প্রধানমন্ত্রীও। এ বিষয়ে একটি মতামত জরিপ করেছিল কালের কণ্ঠ। পাঠকদের মতামত হলো, এখন ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে ওই শ্রেণীর মানুষের_যারা ক্ষমতাবান, উচ্চবিত্ত, অসাধু, দুর্নীতিবাজ ও সুবিধাবাদী। সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়েনি। বেড়েছে দুর্ভোগ। বেড়েছে আয় বৈষম্য। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, দেশের অর্থনীতিবিদ ও সংবাদমাধ্যমগুলো অর্থনীতিকে টেনে নামাতে চাইছে। বস্তুত মুহিত হচ্ছেন রাষ্ট্রের কোষাধ্যক্ষ। সব টাকার জিম্মাদার তিনি। তিনি একজন বড় মাপের অর্থনীতিবিদ, ভালো লেখক ও সুবক্তা। জাতীয় অর্থনীতির সব তথ্য-উপাত্ত তাঁর কাছে সুবিন্যস্ত। তিনি যদি দেশের অর্থনীতিকে টেনে ওপরে নিয়ে যেতে পারতেন, তবে নিচে নামানোর সাধ্য ছিল কার?
লেখক : কৃষি অর্থনীতিবিদ, alamj52@gmail.com
No comments