উন্নত আর অনুন্নত দেশের রাজনৈতিক খেলার নাম মাইগ্রেশন by মেজর (অব.) সুধীর সাহা

বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করা একজন কানাডিয়ান বাঙালির গল্প দিয়ে আজকের কলাম শুরু করতে চাই। সে অনেক দিন আগের কথা- কানাডায় বাঙালির আগমন। ব্রিটিশ শাসনামলে বাংলার বাঙালিকে ইস্ট ইন্ডিয়ান এবং পাকিস্তানি শাসনামলে বাঙালিকে পাকিস্তানি হিসেবে চিহ্নিত করা হতো। সেই কারণে কানাডায় ঠিক কখন থেকে বাঙালি


ইমিগ্র্যান্ট হিসেবে আসতে শুরু করে, তার সঠিক তথ্য বের করা সম্ভব হয়নি। তবে ১৯৪৭ সালের পর কানাডা ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার সঙ্গে এই মর্মে একটি চুক্তি করেছিল যে প্রতিবছর কানাডা ভারত থেকে ১৫০, পাকিস্তান থেকে ১০০ এবং শ্রীলঙ্কা (সিলন) থেকে ৫০ জন করে নতুন ইমিগ্র্যান্ট গ্রহণ করবে। পাকিস্তানের এই ১০০ জনের মধ্যে হয়তো বা কোনো বাঙালি থাকতেও পারে; কিন্তু তার হিসাব কানাডায় নেই। কেননা সবাইকে তারা পাকিস্তানি হিসেবেই গণ্য করেছে। এরপর ১৯৭২ সালের পর থেকে বাংলাদেশি হিসেবেই বাঙালি আসতে শুরু করে কানাডায়। তবে ১৯৬০ সালের পর থেকে হাতেগোনা কয়েকজন বাঙালি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক এবং চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট অন্য দেশের মাধ্যমে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইংল্যান্ডের মাধ্যমে কানাডায় ইমিগ্র্যান্ট হিসেবে আসতে শুরু করে। এক তথ্য অনুযায়ী দেখা যায়, ১৯৯১ সাল পর্যন্ত কানাডায় ৫১৭০ জন বাঙালি ইমিগ্র্যান্ট হিসেবে বসবাস করত। বর্তমানে সবারই জানা, কানাডায় বাংলাদেশের বাঙালির সংখ্যা এক লাখের মতো।
এখন আমি যাঁর কথা বলব, তিনিও এসেছিলেন কানাডায় সেই প্রথমদিকের একসময়, অর্থাৎ ১৯৬৫ সালে। ভদ্রলোক অন্য এক দেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে) ফিরে যাওয়ার সময় যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ইংল্যান্ড বেড়িয়ে যেতে মনস্থ করলেন। একদিন তিনি যুক্তরাষ্ট্র দিয়ে কানাডার বর্ডারেও এলেন এবং ভিসা নিয়ে কয়েক দিন টরোন্টোতে থাকার মনস্থ করলেন। কানাডার ভিসা অফিসার তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা দেখে তাঁকে ট্যুরিস্ট ভিসা প্রদানের সময় অনুরোধ করলেন স্থায়ীভাবে কানাডায় থেকে যেতে। বিনিময়ে অনেক সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে- এমন প্রলোভনও দেখালেন। ভদ্রলোক ভিসা অফিসারকে ঠাট্টার ছলে জানালেন, ওই অফিসারের মতো একটি চাকরি পেলে তিনি চিন্তা করে দেখতে পারেন। তারপর ভদ্রলোক কানাডার ভেতরে চলে এলেন এবং যথারীতি পরদিনই ইমিগ্রেশন থেকে তাঁর হোটেল লবিতে একজন অফিসার দেখা করলেন। ভদ্রলোককে কানাডা পরদিন থেকেই রেভিনিউ কানাডার একটি চাকরিতে অফার দিল। তারা এও বলল, তুমি এক মাস করে দেখো, তারপর যদি পছন্দ না হয়, তখন তোমার দেশে চলে যেও। খেয়ালের বশে ভদ্রলোক সেদিন চাকরির অফারটি গ্রহণ করেছিলেন; এবং কানাডা সরকারের কাছ থেকে বাসা এবং বসবাসের যাবতীয় জিনিসপত্র বিনা মূল্যে পেয়েছিলেন। সেই যে তাঁর থাকা, তারপর একটি নাগরিকত্ব ও বাংলাদেশে ফিরে গিয়ে বিয়ে করে স্ত্রীকে নিয়ে কানাডায় পরবর্তী বসবাস। এই ছিল সেদিনকার কানাডার গল্প। কিন্তু আজ সেই গল্পের মোড় ঘুরে গেছে। সারা পৃথিবী থেকে কানাডায় ইমিগ্র্যান্ট হিসেবে আসার আজ যে কী প্রতিযোগিতা, তা ভাবলেও অবাক হতে হয়। কানাডা আজ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ থেকে বেছে বেছে অভিজ্ঞতা আর বিশেষজ্ঞতা বিচার করে সফল শিক্ষিত এবং সফল ব্যবসায়ীদের তাদের দেশে যাওয়ার সুযোগ দিচ্ছে।
শুধু কানাডাই নয়, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানিসহ আরো অনেক উন্নত দেশই একদিন সারা বিশ্বের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে তাদের দেশে স্থায়ীভাবে রেখে দেওয়ার নানাবিধ ফন্দি-ফিকির করত। ভালো চাকরি এবং ভালো বেতনসহ যাবতীয় লোভ দেখাত এসব দেশ। ফলে ভিনদেশের শিক্ষিত একটি শ্রেণী বেশি অর্থ এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার লোভে নিজেদের মাতৃভূমি ছেড়ে স্থায়ীভাবে এসব দেশে বসবাস করতে শুরু করল। এসব দেশের প্রয়োজনের চেয়ে বেশি অর্থ এবং সম্পদ ছিল। কিন্তু মানুষের মধ্যে প্রয়োজনের তুলনায় শিক্ষা ও জ্ঞান অপ্রতুল থাকায় তারা বিভিন্ন দেশ থেকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, অ্যাকাউন্ট্যান্ট, বৈজ্ঞানিক এবং আন্তর্জাতিক মানের অ্যাথলেটসহ বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের অন্যান্য দেশ থেকে গ্রহণের ব্যবস্থা করেছিল। এসব নতুন লোক যেন উল্লিখিত দেশগুলোতে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে পারে, সে জন্য তাদের নাগরিকত্ব প্রদানের মতো লোভনীয় কার্যক্রমও তারা হাতে নিয়েছিল। এসব উন্নত দেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে তাদের সমাজ ও রাষ্ট্রকে বিশেষভাবে উন্নত করতে সক্ষম হয়েছিল। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য দিকগুলো হচ্ছে- সামাজিক নিরাপত্তা, দুর্নীতিমুক্ত সমাজব্যবস্থা, উন্নত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবাব্যবস্থা এবং ন্যূনতম চাহিদা পূরণের নিশ্চয়তা। আর এগুলোর টানেই বিশেষজ্ঞ মানুষগুলো এসব উন্নত দেশে আসতে শুরু করেছিল সেসব দেশ থেকে, যেখানে রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা ছিল, দারিদ্র্য ছিল এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা ত্রুটিপূর্ণ ছিল। বিশেষ করে যেসব দেশ জাতিগত দাঙ্গা-হাঙ্গামার শিকার হয়েছিল, সেসব দেশ থেকে কিছু কিছু শিক্ষিত এবং বিশেষজ্ঞ লোকজন তাদের মাতৃভূমি ত্যাগ করে এসব উন্নত দেশে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। অর্থাৎ অন্যান্য দেশের অব্যবস্থা আর দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে সামাজিক প্রলোভনের নামে কিছু উন্নত দেশ অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের হাজার হাজার মেধাসম্পন্ন মানুষকে তাদের দেশে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়। একসময় পূর্ব ইউরোপ যখন সমস্যায় জর্জরিত ছিল, তখন সেখান থেকে প্রচুর লোক যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ায় গমন করেছিল।
উন্নত বিশ্বের সামাজিক রাজনীতির খপ্পরে পড়েছে এখন এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের শিক্ষিত ও মেধাসম্পন্ন লোকজন। কেননা পূর্ব ইউরোপ থেকে এখন আর কেউ আসে না। এ পদ্ধতির হাত ধরে বাংলাদেশ থেকেও বিপুলসংখ্যক মেধাসম্পন্ন ব্যক্তি কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি ও ইংল্যান্ডে চলে গেছে; এবং এ পদ্ধতি এখনো চালু আছে। প্রত্যেক মানুষ তার মাতৃভূমিতে বসবাস করে যতখানি শান্তি পায়, তেমনটা অন্য দেশে পায় না। একজন গ্রামের লোক শহরে এলেও যেখানে অস্বস্তিতে ভোগে, সেখানে দেশান্তর নিশ্চয়ই কাউকে সুখ বা শান্তি দেয় না। তা সত্ত্বেও কিন্তু মাইগ্রেশন পদ্ধতি টিকে আছে; এবং এর স্রোত শুধু একদিকেই বইছে। অর্থাৎ অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ থেকেই কেবল সক্ষম ও মেধাসম্পন্ন লোকগুলো উন্নত দেশে গমন করছে। কিন্তু উল্টোটা ঘটছে না। অর্থাৎ উন্নত দেশের কেউ মধ্যপ্রাচ্য বা এশিয়ায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছে না। মোটা অঙ্কের বেতনের চাকরি নিয়ে উন্নত দেশের কেউ কেউ অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে এলেও সে এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস কিংবা নাগরিকত্ব গ্রহণ করে না। তাই মেধার স্রোত শুধু একদিকেই গড়াচ্ছে। আর এর ফলে যেটুকু দাঁড়ানোর কথা ছিল অনুন্নত কিছু দেশের, তাও ঠিকমতো হচ্ছে না। কেননা তার দেশের অনেক সুসন্তান ইতিমধ্যেই দেশ ত্যাগ করেছে।
একদিকে উন্নত দেশের উন্নত জীবনযাপনের হাতছানি, অন্যদিকে নিজ দেশের দারিদ্র্য, অনুন্নত ও অব্যবস্থা, উচ্চশিক্ষার সুযোগের অভাব ইত্যাদি কারণ শক্তিশালী করেছে মাইগ্রেশন পদ্ধতিকে। মাইগ্রেশন পদ্ধতিকে আরো বেগবান ও লোভনীয় করার জন্য উন্নত বিশ্ব আবার বিশ্বরাজনীতির খেলায় সমানভাবে যোগ দিয়েছে। একজন মেধাসম্পন্ন শিক্ষিত মানুষ যেন অনুন্নত দেশ ছেড়ে উন্নত কোনো দেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে পারে এবং উন্নত ওই দেশটি যেন সেই ব্যক্তির মেধা কাজে লাগাতে পারে, এমন একটি রাজনৈতিক ছকের মধ্যে আজ সারা বিশ্ব বন্দি হয়ে আছে। এটা যেন দুইয়ে দুইয়ে চারের মতো সত্য বিষয়। পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মধ্যপ্রাচ্য, চীন, রাশিয়া বা অন্য কোনো দেশে সমস্যা দেখা দেবে এবং সমস্যাসংকুল দেশ থেকে একদল যোগ্য মানুষ দেশ ত্যাগ করবে- এমনটাই যেন ছকে বাঁধা বিষয়।
কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি- যেখানেই যাবেন, একটু ভালোভাবে লক্ষ করলে বুঝতে পারবেন, শিক্ষা ক্ষেত্রে, চিকিৎসা ক্ষেত্রে, বিজ্ঞান ক্ষেত্রে বা সেবামূলক ক্ষেত্রে এসব দেশকে কতটাই না উপকৃত করেছে মাইগ্রেশন পদ্ধতি। কোনো উন্নত হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য অধ্যাপক, হাসপাতালের প্রখ্যাত নার্স, ভালো ভালো ইঞ্জিনিয়ার বা বিজ্ঞানী, যাঁদের পূর্ব ইতিহাস নেবেন, তাঁদের অনেককেই দেখবেন, তাঁরা হয়তো একদিন এসেছিল ভারত, পাকিস্তান, চীন, বাংলাদেশ, রাশিয়া, মিসর, ইরান, ফিলিপাইন অথবা এমন কোনো দেশ থেকে। এসব বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি আজ সোজা করে ধরে রেখেছেন উন্নত দেশগুলোর সুনাম আর আভিজাত্য। আর অন্যদিকে এমন কিছু ব্যতিক্রমী মানুষের অভাব অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশের অবস্থা দৈন্যের দিকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করেছে। তাই মাইগ্রেশন পদ্ধতি আজ যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, তা আর কিছুই নয়। তা হলো উন্নত আর অনুন্নত দেশের রাজনৈতিক খেলার জয়-পরাজয়ের বাস্তবতা।

লেখক : কলামিস্ট ও ইমিগ্রেশন বিশেষজ্ঞ

No comments

Powered by Blogger.