ফিরে দেখা-কিছু নস্টালজিয়া ও একটি অস্বস্তিকর প্রশ্ন by এম আবদুল হাফিজ
নতুন দেশের সামাজিক, সামরিক এবং পারিপাশর্ি্বকতার সঙ্গে খাপ খাওয়াতেই আমি গলদঘর্ম। এরই মধ্যে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ঘটল। দেশে অস্বস্তিকর অবস্থা। বঙ্গবন্ধুবিহীন বাংলাদেশ কোন পথে, কীভাবে যাবে, আরও কোনো পরিবর্তন হবে কি-না, হলেও তা কার বা কাদের অনুকূলে হবে_ এসব নিয়েই তখন দেশময় গুঞ্জন
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম প্রহরে যখন বঙ্গবন্ধু তার পূর্ব রাতে পাকিস্তানি সামরিক ক্র্যাকডাউনের পর নিজে গ্রেফতার হওয়ার সময় স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়েছেন। তার এ ঘোষণায় সাড়া দিয়ে জাতি ইতিমধ্যেই দেশময় প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে, বাঙালি শত্রুর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছে। এটাই ছিল বাঙালি জাতির জীবনে একটি মাহেন্দ্রক্ষণ_ ইংরেজিতে যাকে বলে ঞযব হধঃরড়হ্থং ভরহবংঃ যড়ঁৎ. স্বভাবতই প্রতিটি বাঙালি তার অবস্থান নির্বিশেষে এই ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হতে চেয়েছিল। এর মধ্যে পাকিস্তানে আটকেপড়া সামরিক ব্যক্তিরাও ছিলেন।
আমি তখন সীমান্ত ছাউনি শিয়ালকোটে অবস্থিত অষ্টম ডিভিশন হেডকোয়ার্টার্সে চাকরিরত। শিয়ালকোট থেকে ছোট ছোট শহর নারোয়াল বা পাসরুরগামী রাস্তা একেবারেই সীমান্তসংলগ্ন। কোথাও তা ভারত সীমান্ত থেকে ১০০ গজেরও কম। সঙ্গত কারণেই তখন যারা পাকিস্তান আর্মি থেকে ডিফেক্ট করতে চেয়েছিল তাদের জন্য শিয়ালকোট এক্সিটটি আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিল। একাত্তরের প্রথম কয়েক মাস থমথমে অবস্থা বিরাজ করেছিল এবং কোনো ডিফেকশনের পরিকল্পনা ড্রয়িং আলোচনায়ই সীমাবদ্ধ থাকত। তবে ডিফেকশনে দৃঢ়সংকল্প কর্মকর্তারা অন্যান্য স্টেশন থেকেও ওই কাজে শিয়ালকোটের সুবিধাদি যাচাই করতে প্রায়ই শিয়ালকোটে আসতেন। যারা ওইভাবে আসতেন তাদের কারও কারও সঙ্গে দেখাও হতো। কিন্তু কস্মিনকালেও তাদের আসার উদ্দেশ্য ব্যক্ত করতেন না।
আমার সঙ্গে একবার শুধু জিয়াউদ্দীনের দেখা হয়েছিল। তার সঙ্গে অন্য যারা ছিলেন তাদের আমি চিনতাম না। পরে শুনেছি ওই অচেনাদেরই একজন ছিলেন তাহের। তিনি ছিলেন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কমান্ডো অফিসার। অনেক উচ্চমানের কর্মকর্তাদেরই শুধু কমান্ডো ট্রেনিংয়ের জন্য বাছাই করা হতো। নানামুখী উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে একাত্তরের অর্ধেক কেটে যাওয়ার পর প্রথম বম্ব শেলটির বিস্ফোরণ ঘটালেন মনজুর। সম্ভবত জুলাইয়ের মাঝামাঝি এক রাতে তাহের ও জিয়াউদ্দীনসহ তিনি সপরিবারে তার ক্যান্টনমেন্টের চাবিন্দা কলোনির বাসভবন থেকে ডিফেক্ট করলেন। মনজুর শিয়ালকোটেরই প্রেসটিজিয়াস ১৪ (প্যারা) ব্রিগেডে বিএম থাকা অবস্থায় তার গ্যারেজে ব্যক্তিগত গাড়ি এবং শয়নকক্ষের ওয়ারড্রোব অক্ষত রেখে অজানা পথে পাড়ি জমালেন এমনভাবে যে একটি কাকপক্ষীও তা জানল না। সম্ভবত যাওয়ার দিনে সন্ধ্যায়ও তিনি আমাদের সঙ্গে আড্ডা দিয়েছেন। কিন্তু তার অভিপ্রায়ের কথা ঘুণাক্ষরেও কাউকে বুঝতে দেননি।
এই ত্রয়ীর মধ্যে শুধু মনজুরই উচ্চাভিলাষী ছিলেন। পরে জেনেছি বাকি দু'জন সমাজতন্ত্রের কোনো এক সংস্করণের অনুসারী ছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর রাজনীতি বা জীবনের সর্বত্রই আদর্শের যে আকাল দেখলাম, সেখানে তাহের বা জিয়াউদ্দীনের মতো মতাদর্শের ধারককে আমার কাছে শ্রদ্ধার পাত্রই মনে হয়েছিল। তবে তিনজনই নিজ নিজ অবস্থানে ছিলেন একরোখা। চাকরিতে মোটামুটি সমসাময়িক হওয়ায় মনজুরকে অনেক বেশি চিনতাম এবং তার সঙ্গে বেশি মিশেছিও। ১৯৮০ সালে অস্ট্রেলিয়া ও মালয়েশিয়া একটি সামরিক ডেলিগেশনে আমি তার সফরসঙ্গী ছিলাম। অত্যন্ত মেধাবী এই কর্মকর্তা অপরিসীম ঝুঁকি নিয়ে ডিফেক্ট করায় সফল হয়েছিলেন। কিন্তু জিয়া হত্যার পর চট্টগ্রাম অভ্যুত্থানে মর্মান্তিকভাবে বিফল ছিলেন।
১৯৭৫-এর ট্র্যাজেডির পর কোনো এক সময় আমি সিএমএইচে ভর্তি থাকা অবস্থায় কর্নেল তাহেরকে একবারই দেখেছিলাম। তিনি ক্রাচে ভর দিয়ে আমার কামরায়ই ভর্তি তার কোনো বন্ধুকে দেখতে এসেছিলেন। অতঃপর কখনও তাকে দেখার বা তার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ আমার হয়নি। নতুন দেশের সামাজিক, সামরিক এবং পারিপাশর্ি্বকতার সঙ্গে খাপ খাওয়াতেই আমি গলদঘর্ম। এরই মধ্যে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ঘটল। দেশে অস্বস্তিকর অবস্থা। বঙ্গবন্ধুবিহীন বাংলাদেশ কোন পথে, কীভাবে যাবে, আরও কোনো পরিবর্তন হবে কি-না, হলেও তা কার বা কাদের অনুকূলে হবে_ এসব নিয়েই তখন দেশময় গুঞ্জন।
এসব গুঞ্জনকে সত্য প্রমাণিত করে পরবর্তী নভেম্বরের ৩ তারিখে পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটল। যশোরে আমার পোস্টিং সত্ত্বেও কোনো অফিসিয়াল কাজে আমি সেদিন ঢাকায়। বঙ্গভবনে অবস্থানকারী ১৫ আগস্টের কুশীলবদের সঙ্গে ক্যান্টনমেন্টের চতুর্থ বেঙ্গল ব্যাটালিয়নে অবস্থিত খালেদ মোশাররফ তার সমর্থক এবং আমার মতো কিছু কৌতূহলী দর্শকদের উপস্থিতিতে দরকষাকষিতেই কেটে গেল শীতের নাতিদীর্ঘ দিন। ঢাকায় তিন দিন অবস্থানের পর পরিস্থিতি ক্রমেই ঘোলাটে এবং অস্থিতিশীল হয়ে ওঠায় ৬ নভেম্বর যশোরে ফিরে যাই। সেখান থেকে পরের দিন তাহেরের নেতৃত্বাধীন সিপাহি বিপ্লবের বিস্তারিত খবরাখবর জানতে থাকি।
জিয়া-তাহের সমীকরণ অনেক আলোচিত বিধায় এ নিয়ে কিছু লেখা অনাবশ্যক মনে করছি। উভয়ের যৌথ প্রচেষ্টায় খালেদ মোশাররফের পাল্টা অভ্যুত্থানটি ব্যর্থ হয়_ একথা সর্বজনবিদিত। তাই এখন সোজা চলে যাচ্ছি চলমান তাহের বিতর্কে, যা উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে এবং রাজনৈতিক আলোচনার শীর্ষে রয়েছে। আদালতের রায়ের তাৎপর্যপূর্ণ অংশ হলো মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার বীরউত্তম জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করা। বিগত বছরগুলোতে কেউ কেউ জেনারেল জিয়াকে বিচ্ছিন্নভাবে 'স্বাধীনতাবিরোধী' মুক্তিযুদ্ধে অনুপ্রবেশকারী অথবা 'পাকিস্তানের এজেন্ট' হিসেবে চিত্রিত করেছেন। জেনারেল জিয়া যে প্রকৃত অর্থেই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না, উচ্চ আদালতের রায় সে সত্যকে পাকাপোক্ত করল। আমরা তা মানলামও।
মিলিটারিতে বিতর্ককালে কোণঠাসা হলে আমরা সচরাচর একটি স্লাং ব্যবহার করে থাকি। সো হোয়াট? তো কী হয়েছে? আপনারা যা বলছেন, সবই ঠিক। তাহেরকে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করা হয়েছে। একথা আলবৎ সত্য। তাহের বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সংশ্লিষ্ট সবার অনুকম্পা পাওয়ার হকদার ছিল। সে কথাও ঠিক। মার্কিন সাংবাদিক লিফশুলজ, মরহুম মনজুর বা মার্কিন মুলুকে বসবাসকারী জেনারেল শিশু যা বলেছেন সে সবই ঠিক। আগেই বলেছি, আমি ব্যক্তিগতভাবে তাহেরের মতাদর্শবান মানুষকে শ্রদ্ধা করি। তার ওপর অন্যায় করা হয়েছে।
তবুও কোথায় যেন একটি খটকা থেকেই যায়। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরের সময়টা কিন্তু মোটেই স্বাভাবিক ছিল না। একদিকে জাতি বিভিন্ন মত ও পথে বিভক্ত। দেশে যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে। দেশের সীমান্তে অঘোষিত যুদ্ধ চলছে। সময়টা কি তাহলে আইনের খুঁটিনাটি তালাশের অধিক অনুকূল ছিল না_ জলে আগুনের শিখা নিভিয়ে ফেলা সেটা যেভাবেই হোক। তাহেরের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবীরা ইতিমধ্যেই আর্মিকে ধ্বংসের মুখোমুখি করেছে। মহিলা অফিসারসহ বিভিন্ন পদমর্যাদার অফিসার খুন হয়েছে। অনেকে পালিয়ে বেঁচেছেন। ওই অবস্থায় কার বাঁচবার অগ্রাধিকার? দেশের না, ব্যক্তিবিশেষের?
শুনেছি অনুরূপ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল স্বাধীনতার অব্যবহিত পর সিরাজ শিকদারের বিপ্লবে। তার টার্গেট ছিল রাজনীতিক, সেনা কর্মকর্তা নয়। শুনেছি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তাকে বিনা বিচারে এক্সটা জুডিসিয়াল মার্ডারের টার্গেট করা হয়েছিল। যদি তা সত্য হয় বঙ্গবন্ধুর জন্যও কোনো বিকল্প ছিল না। তাকে কষ্টার্জিত স্বাধীনতাকেই অগ্রাধিকার দিতে হয়েছিল। সদ্যস্বাধীন দেশকে নিয়ে অ্যাডভেঞ্চার করতে নয়। বঙ্গবন্ধুর স্থলে অন্য কেউ হলেও দেশপ্রেমিক হলে সেই একই পদক্ষেপ নিত।
আফটার অল, এভরি থিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ অ্যান্ড ওয়ার!
ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম আবদুল হাফিজ : সাবেক মহাপরিচালক, বিআইআইএসএস ও কলাম লেখক
আমি তখন সীমান্ত ছাউনি শিয়ালকোটে অবস্থিত অষ্টম ডিভিশন হেডকোয়ার্টার্সে চাকরিরত। শিয়ালকোট থেকে ছোট ছোট শহর নারোয়াল বা পাসরুরগামী রাস্তা একেবারেই সীমান্তসংলগ্ন। কোথাও তা ভারত সীমান্ত থেকে ১০০ গজেরও কম। সঙ্গত কারণেই তখন যারা পাকিস্তান আর্মি থেকে ডিফেক্ট করতে চেয়েছিল তাদের জন্য শিয়ালকোট এক্সিটটি আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিল। একাত্তরের প্রথম কয়েক মাস থমথমে অবস্থা বিরাজ করেছিল এবং কোনো ডিফেকশনের পরিকল্পনা ড্রয়িং আলোচনায়ই সীমাবদ্ধ থাকত। তবে ডিফেকশনে দৃঢ়সংকল্প কর্মকর্তারা অন্যান্য স্টেশন থেকেও ওই কাজে শিয়ালকোটের সুবিধাদি যাচাই করতে প্রায়ই শিয়ালকোটে আসতেন। যারা ওইভাবে আসতেন তাদের কারও কারও সঙ্গে দেখাও হতো। কিন্তু কস্মিনকালেও তাদের আসার উদ্দেশ্য ব্যক্ত করতেন না।
আমার সঙ্গে একবার শুধু জিয়াউদ্দীনের দেখা হয়েছিল। তার সঙ্গে অন্য যারা ছিলেন তাদের আমি চিনতাম না। পরে শুনেছি ওই অচেনাদেরই একজন ছিলেন তাহের। তিনি ছিলেন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কমান্ডো অফিসার। অনেক উচ্চমানের কর্মকর্তাদেরই শুধু কমান্ডো ট্রেনিংয়ের জন্য বাছাই করা হতো। নানামুখী উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে একাত্তরের অর্ধেক কেটে যাওয়ার পর প্রথম বম্ব শেলটির বিস্ফোরণ ঘটালেন মনজুর। সম্ভবত জুলাইয়ের মাঝামাঝি এক রাতে তাহের ও জিয়াউদ্দীনসহ তিনি সপরিবারে তার ক্যান্টনমেন্টের চাবিন্দা কলোনির বাসভবন থেকে ডিফেক্ট করলেন। মনজুর শিয়ালকোটেরই প্রেসটিজিয়াস ১৪ (প্যারা) ব্রিগেডে বিএম থাকা অবস্থায় তার গ্যারেজে ব্যক্তিগত গাড়ি এবং শয়নকক্ষের ওয়ারড্রোব অক্ষত রেখে অজানা পথে পাড়ি জমালেন এমনভাবে যে একটি কাকপক্ষীও তা জানল না। সম্ভবত যাওয়ার দিনে সন্ধ্যায়ও তিনি আমাদের সঙ্গে আড্ডা দিয়েছেন। কিন্তু তার অভিপ্রায়ের কথা ঘুণাক্ষরেও কাউকে বুঝতে দেননি।
এই ত্রয়ীর মধ্যে শুধু মনজুরই উচ্চাভিলাষী ছিলেন। পরে জেনেছি বাকি দু'জন সমাজতন্ত্রের কোনো এক সংস্করণের অনুসারী ছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর রাজনীতি বা জীবনের সর্বত্রই আদর্শের যে আকাল দেখলাম, সেখানে তাহের বা জিয়াউদ্দীনের মতো মতাদর্শের ধারককে আমার কাছে শ্রদ্ধার পাত্রই মনে হয়েছিল। তবে তিনজনই নিজ নিজ অবস্থানে ছিলেন একরোখা। চাকরিতে মোটামুটি সমসাময়িক হওয়ায় মনজুরকে অনেক বেশি চিনতাম এবং তার সঙ্গে বেশি মিশেছিও। ১৯৮০ সালে অস্ট্রেলিয়া ও মালয়েশিয়া একটি সামরিক ডেলিগেশনে আমি তার সফরসঙ্গী ছিলাম। অত্যন্ত মেধাবী এই কর্মকর্তা অপরিসীম ঝুঁকি নিয়ে ডিফেক্ট করায় সফল হয়েছিলেন। কিন্তু জিয়া হত্যার পর চট্টগ্রাম অভ্যুত্থানে মর্মান্তিকভাবে বিফল ছিলেন।
১৯৭৫-এর ট্র্যাজেডির পর কোনো এক সময় আমি সিএমএইচে ভর্তি থাকা অবস্থায় কর্নেল তাহেরকে একবারই দেখেছিলাম। তিনি ক্রাচে ভর দিয়ে আমার কামরায়ই ভর্তি তার কোনো বন্ধুকে দেখতে এসেছিলেন। অতঃপর কখনও তাকে দেখার বা তার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ আমার হয়নি। নতুন দেশের সামাজিক, সামরিক এবং পারিপাশর্ি্বকতার সঙ্গে খাপ খাওয়াতেই আমি গলদঘর্ম। এরই মধ্যে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ঘটল। দেশে অস্বস্তিকর অবস্থা। বঙ্গবন্ধুবিহীন বাংলাদেশ কোন পথে, কীভাবে যাবে, আরও কোনো পরিবর্তন হবে কি-না, হলেও তা কার বা কাদের অনুকূলে হবে_ এসব নিয়েই তখন দেশময় গুঞ্জন।
এসব গুঞ্জনকে সত্য প্রমাণিত করে পরবর্তী নভেম্বরের ৩ তারিখে পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটল। যশোরে আমার পোস্টিং সত্ত্বেও কোনো অফিসিয়াল কাজে আমি সেদিন ঢাকায়। বঙ্গভবনে অবস্থানকারী ১৫ আগস্টের কুশীলবদের সঙ্গে ক্যান্টনমেন্টের চতুর্থ বেঙ্গল ব্যাটালিয়নে অবস্থিত খালেদ মোশাররফ তার সমর্থক এবং আমার মতো কিছু কৌতূহলী দর্শকদের উপস্থিতিতে দরকষাকষিতেই কেটে গেল শীতের নাতিদীর্ঘ দিন। ঢাকায় তিন দিন অবস্থানের পর পরিস্থিতি ক্রমেই ঘোলাটে এবং অস্থিতিশীল হয়ে ওঠায় ৬ নভেম্বর যশোরে ফিরে যাই। সেখান থেকে পরের দিন তাহেরের নেতৃত্বাধীন সিপাহি বিপ্লবের বিস্তারিত খবরাখবর জানতে থাকি।
জিয়া-তাহের সমীকরণ অনেক আলোচিত বিধায় এ নিয়ে কিছু লেখা অনাবশ্যক মনে করছি। উভয়ের যৌথ প্রচেষ্টায় খালেদ মোশাররফের পাল্টা অভ্যুত্থানটি ব্যর্থ হয়_ একথা সর্বজনবিদিত। তাই এখন সোজা চলে যাচ্ছি চলমান তাহের বিতর্কে, যা উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে এবং রাজনৈতিক আলোচনার শীর্ষে রয়েছে। আদালতের রায়ের তাৎপর্যপূর্ণ অংশ হলো মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার বীরউত্তম জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করা। বিগত বছরগুলোতে কেউ কেউ জেনারেল জিয়াকে বিচ্ছিন্নভাবে 'স্বাধীনতাবিরোধী' মুক্তিযুদ্ধে অনুপ্রবেশকারী অথবা 'পাকিস্তানের এজেন্ট' হিসেবে চিত্রিত করেছেন। জেনারেল জিয়া যে প্রকৃত অর্থেই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না, উচ্চ আদালতের রায় সে সত্যকে পাকাপোক্ত করল। আমরা তা মানলামও।
মিলিটারিতে বিতর্ককালে কোণঠাসা হলে আমরা সচরাচর একটি স্লাং ব্যবহার করে থাকি। সো হোয়াট? তো কী হয়েছে? আপনারা যা বলছেন, সবই ঠিক। তাহেরকে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করা হয়েছে। একথা আলবৎ সত্য। তাহের বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সংশ্লিষ্ট সবার অনুকম্পা পাওয়ার হকদার ছিল। সে কথাও ঠিক। মার্কিন সাংবাদিক লিফশুলজ, মরহুম মনজুর বা মার্কিন মুলুকে বসবাসকারী জেনারেল শিশু যা বলেছেন সে সবই ঠিক। আগেই বলেছি, আমি ব্যক্তিগতভাবে তাহেরের মতাদর্শবান মানুষকে শ্রদ্ধা করি। তার ওপর অন্যায় করা হয়েছে।
তবুও কোথায় যেন একটি খটকা থেকেই যায়। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরের সময়টা কিন্তু মোটেই স্বাভাবিক ছিল না। একদিকে জাতি বিভিন্ন মত ও পথে বিভক্ত। দেশে যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে। দেশের সীমান্তে অঘোষিত যুদ্ধ চলছে। সময়টা কি তাহলে আইনের খুঁটিনাটি তালাশের অধিক অনুকূল ছিল না_ জলে আগুনের শিখা নিভিয়ে ফেলা সেটা যেভাবেই হোক। তাহেরের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবীরা ইতিমধ্যেই আর্মিকে ধ্বংসের মুখোমুখি করেছে। মহিলা অফিসারসহ বিভিন্ন পদমর্যাদার অফিসার খুন হয়েছে। অনেকে পালিয়ে বেঁচেছেন। ওই অবস্থায় কার বাঁচবার অগ্রাধিকার? দেশের না, ব্যক্তিবিশেষের?
শুনেছি অনুরূপ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল স্বাধীনতার অব্যবহিত পর সিরাজ শিকদারের বিপ্লবে। তার টার্গেট ছিল রাজনীতিক, সেনা কর্মকর্তা নয়। শুনেছি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তাকে বিনা বিচারে এক্সটা জুডিসিয়াল মার্ডারের টার্গেট করা হয়েছিল। যদি তা সত্য হয় বঙ্গবন্ধুর জন্যও কোনো বিকল্প ছিল না। তাকে কষ্টার্জিত স্বাধীনতাকেই অগ্রাধিকার দিতে হয়েছিল। সদ্যস্বাধীন দেশকে নিয়ে অ্যাডভেঞ্চার করতে নয়। বঙ্গবন্ধুর স্থলে অন্য কেউ হলেও দেশপ্রেমিক হলে সেই একই পদক্ষেপ নিত।
আফটার অল, এভরি থিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ অ্যান্ড ওয়ার!
ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম আবদুল হাফিজ : সাবেক মহাপরিচালক, বিআইআইএসএস ও কলাম লেখক
No comments