গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ধারক by সালাহ উদ্দীন আহমদ
প্রয়াত বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ বাংলার সুমহান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধারক ছিলেন। ১৯৫৪ সালে মোরশেদ সাহেবকে ঢাকার হাইকোর্টে বিচারপতি করা হয়। এ দেশের মানুষের ন্যায়সঙ্গত দাবি-দাওয়ার প্রতি নৈতিক সমর্থন দিতে তিনি কখনও দ্বিধা করেননি।
ভাষা আন্দোলনের ফলে এ দেশে এক নয়া বাঙালি জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল। পাকিস্তানের স্বৈরাচারী সরকারের উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাঙালিদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর সরকারি মহল থেকে মামলা শুরু হলো বাংলার সমন্বয়ধর্মী এবং মানবতাবাদী সাহিত্য ও সংস্কৃতির ওপর। এই মহল থেকেই শুরু হলো এক হীন ষড়যন্ত্র, ষড়যন্ত্রটা হলো বাঙালিদের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার বীজ ছড়িয়ে দিয়ে রবীন্দ্রনাথকে অমুসলিম কবি হিসেবে চিহ্নিত করে তাকে বাঙালি মুসলমানদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য থেকে বিচ্ছিন্ন করা। দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, এ ষড়যন্ত্রে দোসর হলেন মুষ্টিমেয় কয়েকজন বাঙালি মুসলিম বুদ্ধিজীবী ও সাহিত্যিক। তারা একটি লিখিত বক্তব্যের মাধ্যমে ঘোষণা করেন, যেহেতু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মুসলমান নন, তার রচনা মুসলিম সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক চেতনাকে বিকাশ করতে সক্ষম নয়। সুতরাং তাদের দাবি হলো, রবীন্দ্রনাথকে বাঙালি মুসলিম সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গন থেকে বিদায় দিতে হবে। এ বিবৃতির বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের বহুসংখ্যক সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী প্রতিবাদ জানিয়ে একটি পাল্টা বিবৃতি প্রকাশ করেন। যেটাতে বলা হয়, রবীন্দ্রনাথ অমুসলমান হলেও তিনি হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সব বাংলা ভাষাভাষী মানুষের সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একজন শ্রেষ্ঠ ধারক। তারা জোর দিয়ে বলেন, ধর্ম সাংস্কৃতিক অংশ হলেও ধর্ম ও সংস্কৃতি এক জিনিস নয়। পাকিস্তান সরকারের রবীন্দ্রবিরোধী নীতির পরিপ্রেক্ষিতে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে দেখা দিল এক নতুন সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণ। ১৯৬১ সালে যে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে সারা পূর্ব পাকিস্তানে রবীন্দ্র জন্ম শতবার্ষিকী পালিত হয় সেটিতে এসব চেতনা বলিষ্ঠভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল। বিচারপতি মোরশেদ সম্ভাব্য রাজরোষ উপেক্ষা করে রবীন্দ্র জন্ম শতবার্ষিকী উদযাপন কমিটির সভাপতির পদ গ্রহণ করতে একটুও দ্বিধা করেননি। বস্তুত তার অসাধারণ ব্যক্তিত্ব কমিটির কাজে প্রধান সহায়ক হয়েছিলেন।
১৯৬৪ সালে বিচারপতি মোরশেদ ঢাকার হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত হন। তার নিয়োগের ফলে এ উচ্চ পদটি লাভ করেছিল অসামান্য মর্যাদা। বিচারপতি মোরশেদ রায়ের মধ্যে সূক্ষ্ম-নিরপেক্ষ বিচারবুদ্ধি, অসাধারণ প্রজ্ঞা, গভীর অন্তর্দৃষ্টি এবং মানবিক গুণবলির প্রতি প্রগাঢ় শ্রদ্ধা এমন বলিষ্ঠভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল, যার ফলে তিনি দেশের একজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছিলেন।
তিনি বিশ্বাস করতেন, বিচার কাজ এমনভাবে পরিচালিত করতে হবে যার ফলে আইনের কেবল বাহ্যিক দিকই নয়, আইনের অন্তর্নিহিত মর্মবাণীও প্রতিষ্ঠিত হয়। বিচারপতি মোরশেদ অবাধ গণতন্ত্রের প্রবক্তা ছিলেন। সুতরাং এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই, পাকিস্তানের জঙ্গি রাষ্ট্রপতি ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান কর্তৃক তথাকথিত মৌলিক গণতন্ত্র প্রবর্তনকে তিনি সুনজরে দেখতে পারেননি। এটি ছিল গণতন্ত্রের মুখোশ পরা নিছক একটি সামরিক একনায়কতন্ত্র। এ সামরিকতন্ত্র কর্তৃক দেশের বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতাকে খর্ব করার প্রচেষ্টা বিচারপতি মোরশেদকে গভীরভাবে বিচলিত করে। অতঃপর তিনি ১৯৬৭ সালের শেষদিকে প্রধান বিচারপতির পদ থেকে ইস্তফা দেন। এরপর থেকে তিনি দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আত্মনিয়োগ করেন। তিনি যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো রাজনৈতিক দলে যোগ দেননি; কিন্তু তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ দফা দাবির প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছিলেন। পাকিস্তান সরকার যখন শেখ সাহেবকে প্রধান আসামি করে কুখ্যাত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা শুরু করে, তখন বিচারপতি মোরশেদ শেখ মুজিব ও এই মামলায় অন্য যারা অভিযুক্ত হন তাদের পরামর্শ দেওয়ার জন্য বিনা দ্বিধায় এগিয়ে আসেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সামরিক সরকার বিচারপতি মোরশেদকে তথাকথিত শান্তিকমিটির কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্ত করার চেষ্টা করে। কিন্তু মোরশেদ সাহেব এ ব্যাপারে সরকারের পুনঃপুন আহ্বানে সাড়া দিতে অস্বীকার করেন নিজের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার প্রতি, সম্ভাব্য হুমকির প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করে। তিনি পাকিস্তানি হানাদারদের সঙ্গে সহযোগিতা করতে অস্বীকৃতি জানান। এটা অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, স্বাধীনতার পর দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করার কাজে এ মহানুভব ব্যক্তির সাহায্য বাংলাদেশ সরকার নিতে ব্যর্থ হলো। এই মহান আইনবিশারদ, নির্ভীক বিচারক এবং একজন নিবেদিতপ্রাণ বুদ্ধিজীবী ছিলেন মানবিক ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের শ্রেষ্ঠ ধারক। বেশকিছুকাল রোগশয্যায় অতিবাহিত করে ১৯৭৯ সালের ৩ এপ্রিল তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন।
১৯৬৪ সালে বিচারপতি মোরশেদ ঢাকার হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত হন। তার নিয়োগের ফলে এ উচ্চ পদটি লাভ করেছিল অসামান্য মর্যাদা। বিচারপতি মোরশেদ রায়ের মধ্যে সূক্ষ্ম-নিরপেক্ষ বিচারবুদ্ধি, অসাধারণ প্রজ্ঞা, গভীর অন্তর্দৃষ্টি এবং মানবিক গুণবলির প্রতি প্রগাঢ় শ্রদ্ধা এমন বলিষ্ঠভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল, যার ফলে তিনি দেশের একজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছিলেন।
তিনি বিশ্বাস করতেন, বিচার কাজ এমনভাবে পরিচালিত করতে হবে যার ফলে আইনের কেবল বাহ্যিক দিকই নয়, আইনের অন্তর্নিহিত মর্মবাণীও প্রতিষ্ঠিত হয়। বিচারপতি মোরশেদ অবাধ গণতন্ত্রের প্রবক্তা ছিলেন। সুতরাং এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই, পাকিস্তানের জঙ্গি রাষ্ট্রপতি ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান কর্তৃক তথাকথিত মৌলিক গণতন্ত্র প্রবর্তনকে তিনি সুনজরে দেখতে পারেননি। এটি ছিল গণতন্ত্রের মুখোশ পরা নিছক একটি সামরিক একনায়কতন্ত্র। এ সামরিকতন্ত্র কর্তৃক দেশের বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতাকে খর্ব করার প্রচেষ্টা বিচারপতি মোরশেদকে গভীরভাবে বিচলিত করে। অতঃপর তিনি ১৯৬৭ সালের শেষদিকে প্রধান বিচারপতির পদ থেকে ইস্তফা দেন। এরপর থেকে তিনি দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আত্মনিয়োগ করেন। তিনি যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো রাজনৈতিক দলে যোগ দেননি; কিন্তু তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ দফা দাবির প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছিলেন। পাকিস্তান সরকার যখন শেখ সাহেবকে প্রধান আসামি করে কুখ্যাত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা শুরু করে, তখন বিচারপতি মোরশেদ শেখ মুজিব ও এই মামলায় অন্য যারা অভিযুক্ত হন তাদের পরামর্শ দেওয়ার জন্য বিনা দ্বিধায় এগিয়ে আসেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সামরিক সরকার বিচারপতি মোরশেদকে তথাকথিত শান্তিকমিটির কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্ত করার চেষ্টা করে। কিন্তু মোরশেদ সাহেব এ ব্যাপারে সরকারের পুনঃপুন আহ্বানে সাড়া দিতে অস্বীকার করেন নিজের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার প্রতি, সম্ভাব্য হুমকির প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করে। তিনি পাকিস্তানি হানাদারদের সঙ্গে সহযোগিতা করতে অস্বীকৃতি জানান। এটা অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, স্বাধীনতার পর দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করার কাজে এ মহানুভব ব্যক্তির সাহায্য বাংলাদেশ সরকার নিতে ব্যর্থ হলো। এই মহান আইনবিশারদ, নির্ভীক বিচারক এবং একজন নিবেদিতপ্রাণ বুদ্ধিজীবী ছিলেন মানবিক ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের শ্রেষ্ঠ ধারক। বেশকিছুকাল রোগশয্যায় অতিবাহিত করে ১৯৭৯ সালের ৩ এপ্রিল তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন।
No comments