‘আ চাইল্ড..’ এবং ঈদে রাক্ষুসী পদ্মাকে উপহার! by মাহবুব মিঠু
বইটি পেয়েছিলাম জেসিকার কাছ থেকে। একটা সংস্থায় সিনিয়র সোশ্যাল ওয়ার্কার হিসেবে কর্মরত সে। ঠিক বই নয়, প্রথম অধ্যায়ের ফটোকপি। ওটুকু পড়েই পরের সপ্তাহে গোটা বইটাই কিনে ফেলি। ফিকশন নয়। লেখকের জীবনের উপরে ভিত্তি করে লেখা। অসম্ভব হৃদয়স্পর্শী! পশ্চিমা সমাজে, পরিবারে শিশু নির্যাতনের উপরে প্রাঞ্জল, অনবদ্য লেখা। গল্পের ছোট্ট শিশু ডেভিডের কান্না একটু কান পাতলেই শুনতে পাবেন।
বইটির নাম ‘A Child Called IT.’
ছেলেটির জীবন শুরু হয়েছিল অসম্ভব ভাল একটা পারিবারিক আবহের মধ্যে। অচিরেই সেটা পাল্টে যেতে থাকে। মা ধীরে ধীরে ভীষণ রকম অত্যাচারী হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্র ছেলেটিকে নিজের জিন্মায় নিতে বাধ্য হয়।
গল্প যতো এগোতে থাকে ততোই ভিন্ন ভিন্ন কায়দার অদ্ভুত এবং নির্মম অত্যাচারের ঘটনা প্রকাশ পেতে থাকে। না খাইয়ে রাখা থেকে শুরু করে চড় থাপ্পড় কিংবা শরীরে ছুরি চালানো---হেন অত্যাচার নেই যা মা প্রয়োগ করে নি। কুকুরের খাবারের বাটি থেকে উচ্ছিষ্ট খাদ্য গ্রহণে বাধ্য করা, এমনকি জ্বলন্ত ষ্টোভে হাত চেপে রেখে শাস্তি দেয়াসহ নিজের বমি নিজেকে খেতে বাধ্য করত সেই মা। এমনি আরো অবিশ্বাস্য অত্যাচারের কাহিনী বর্ণিত আছে বইটিতে। বইটা পড়া শুরু করলে শেষ করতেই হবে।
আমাদের গল্প, মুন্নী মানসুর: রাক্ষুসী পদ্মাকে উপহার।
ঘটনাস্থল পাবনা। ঈদের আগে দরিদ্র বাবা অন্ন সংস্থান করতে না পেরে দু দু’টো সন্তানকে পদ্মার বুকে ছুড়ে ফেলে। বাবা তাদের বলেছিল, চুল কাটতে নিয়ে যাবেন। অতি খুশিতে বাবার হাত ধরে মুন্নী (১০) ও মানসুর (৫)হাঁটা শুরু করে।
সামনে ঈদ। বাবা নিশ্চয়ই ঈদে অন্তত শিরনী রান্নার ব্যবস্থা করবেন। আর না হোক মহাজনের বড়িতে হাত পেতে একবেলা তো গোশত-ভাত খাওয়া যাবে। এতো কষ্টের ভিতরেও ঈদ যেন দমকা বাতাসের মতো এক ঝলক দোলা দিয়ে যায় দুটো অবুঝ মনে।
নিষ্ঠুর বাবার মনে ভিন্ন চিন্তা। একমাত্র সে-ই জানে কি ঘটতে যাচ্ছে একটু পরেই। বাবা তাদের চুল কাটতে না নিয়ে, গেলেন পদ্মানদীর উপরে লালন শাহ সেতুতে। পরের খবর সবাই জানি। বাবা অকপটে স্বীকার করেছেন, ‘‘অভাবের সংসার। পেটে দানাপানি দিতে পারি না। সন্তান রেখে কি করব!’’
এ ঘটনা নিয়ে বাবার পক্ষে-বিপক্ষে তুমুল আলোচনার সুযোগ আছে। কেউ কেউ সেই সুযোগটা নিয়েছিও। কিন্তু এটুকু সবাই মানতে বাধ্য হবেন, কাজটি এক কথায় ক্ষমার অযোগ্য। ঘটনার পরে অনেক আলোচনা হয়েছে। কেউ কেউ রাষ্ট্রকে পুরো দোষটা দিতে চাইছেন। কেউবা সেটা মানছেন না। বাবার নিষ্ঠুর দিকটাই তুলে ধরছেন।
অনেকেই মনে করছেন, মানসিক রোগ ছাড়া একজন পিতার পক্ষে এ রকম জঘন্য কাজ করা সম্ভব নয়। হতে পারে। দরিদ্রতার কষাঘাতে জর্জরিত বাবা সন্তানদের ছুড়ে ফেলে বাড়তি বোঝা থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছেন। কিংবা সেই সাথে সমাজ ও রাষ্ট্রের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছেন নিজে টিকে থাকার জন্য। তবে অতি অবশ্যই এই ঘৃণ্য কাজে তার জীবনের প্রধান সমস্যা দরিদ্রতাই প্ররোচিত করেছে। এই দরিদ্রতার জন্য আমরা জনগণ স্বাভাবিকভাবে সরকারকেই দোষারোপ করব। বলব, সরকারের কেউ কেউ দুর্নীতিবাজ, জনগণের বরাদ্দকৃত সুবিধা মেরে খায়। সবই ঠিক আছে। কিন্তু শুধুই কি সরকার দায়ী?
একটা ঘটনা বলছি। ২০০৫ সালে ঈদের ছুটিতে বাইরে চাকরি করা সবাই গ্রামে এলে মিলিতভাবে একটা উদ্যোগ নিয়েছিলাম। নাম ছিল ‘মাটির টানে’। পাঠক এনজিও ভেবে বসবেন না। কোনো সংস্থা নয়, শুধু ব্যক্তিগত উদ্যোগগুলোকে একসাথে করে কার্যকারিতা বাড়ানো। ঈদে বাড়িতে এলে সবার যাকাত এবং বাড়তি সাহায্যের টাকায় এলাকার একেবারে দু:স্থদের সহায়তা করা। দশ/পাঁচ টাকা করে হাজার জনকে দিয়ে প্রশংসা না কুড়িয়ে সাধ্যমতো দু’চার জনকে স্বাবলম্বী করতে সহায়তা করে বাকিদের ঘৃণা কুড়ানো। কোনো সুদ দিতে হবে না। শুধু সাধ্যমতো মাসে মাসে কিছু টাকা দিয়ে মূল টাকাটা ফিরিয়ে দেবে। সেই সাথে তাদেরকে অন্যদের সহায়তা করার নৈতিক শিক্ষা দেওয়া। কারণ সে মানুষের সাহায্যে কিছু একটা করতে পেরেছে। তাই তাকেও নৈতিকভাবে মানুষের সহযোগিতায় এগিয়ে আসতে হবে। মূলধন ফিরে পেলে সেটা আবার অন্য কাউকে দেওয়া হবে। এভাবে বছর বছর সবার মিলিত টাকা দিয়ে এক সময় অনেক জনকে সাহায্য করা যেত। পরের বছর কথা মতো কাজও হয়েছিল। সবাই মিলে এক ব্যক্তিকে ভ্যান কিনে দেওয়া হলো। কয়েক মাস না যেতেই শুনি, সেই ভ্যান বিক্রি হয়ে গেছে। অভাবে নয়। আসলে যাকে দেয়া হয়েছিল, সে অর্থে সে অভাবী ছিল না। যাদেরকে দায়িত্ব দেওয়া হয় তারা নিজের লোককে দু:স্থ বানিয়ে ভ্যান পেতে সাহায্য করে। পরে আরো জানতে পারি, ভ্যানের টাকা কিছুটা সেই দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিও ভাগে পেয়েছিল।
এইতো আমরা জনগণ বা জনগণের উল্লেখযোগ্য একটা অংশ। সুযোগের অভাবে সাধু। জনগণ এমন একটা জাত, যে জাতের সমালোচনা করা যায় না। একেবারে আশরাফ, ব্রাক্ষণ গোত্রীয়। ঘুষখোর ঘুস খেয়ে দিব্যি জনগণের কাতারে নাম লিখিয়ে নেয়। যে চাঁদাবাজ সে-ও একই রকম। এভাবে শেষ পর্যন্ত জনগণের বাইরে কেউ থাকছে না। আর আমরা অতি সাধারণ জনগণও সুযোগ পেলে ‘মাটির টানের’ মতো ছোট্ট উদ্যোগের টাকাটাও মেরে দিই।
এই আচরণ নিয়ে আমাদের কি অধিকার আছে সন্তানহন্তারক সেই পিতাকে পাষণ্ড বলার? যে রাষ্ট্রনেতারা দুর্নীতিকে লালন করে একটা শ্রেণীকে চরম দরিদ্র থাকতে বাধ্য করছেন তাদের কি শাস্তি হয়েছে কখনো? তবুও সেই পাষণ্ড পিতাকে শাস্তি ভোগ করতেই হবে। কারণ সে যেটা করেছে সেটা প্রশ্নাতীতভাবে অমানবিক, পৈশাচিক এবং সেটা হত্যা বা হত্যার চেষ্টা(মুন্নী ও মানসুরের দেহ এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি)।
গল্প বর্ণনা আমার উদ্দেশ্য নয়। শুধু গল্পের অবতারণার মধ্য দিয়ে সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশেও শিশুদের ভঙ্গুর অবস্থানের কথা তুলে ধরতে চেয়েছি। রাষ্ট্র এবং সরকার যদি অদক্ষ হয়, দুর্নীতিগ্রস্ত হয় কিংবা কোনো সমাজে যদি প্রচণ্ড রকম দরিদ্রতা বিরাজ করে তবে কতো ভাবে যে সেটা মানুষকে প্রভাবিত করে, পাবনার এই ঘটনা তারই একটা বড় প্রমাণ। আজ বিভিন্নভাবে প্রমাণিত যে, যে কোনো রকমের সামাজিক এবং পারিবারিক অশান্তি কিংবা গোলযোগের শিকার প্রথমে শিশুরাই হয়। তাই পরিবারের দরিদ্রতার অসহায় শিকার মুন্নী ও মানসুর, কিংবা ক্ষুধার জ্বালায় খাবার চুরি করলে গণপিটুনির শিকার হওয়া, এবং রাজনৈতিক দলের মিছিল মিটিংয়ে ভাড়া খেটে গিয়ে ধরা পড়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার বুটের লাথি ---কোনো কিছু থেকেই শিশুরা রেহাই পায় না।
আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, এ ঘটনা সভ্য দেশে ঘটলে পুরো জাতি দোষীর উপযুক্ত শাস্তির জন্য সরব হতো; পাশাপাশি সরকারকে দাঁড় করাত বিচারের কাঠগড়ায়। কিন্তু কে করবে কার বিচার! আমরা জনগণ নিজেই তো সুবিধাবাদী, বিতর্কে ঘি ঢালতে থাকি।
সামগ্রিকভাবে উন্মত্ত পিতার কুকীর্তির মধ্য দিয়ে সমাজের একটা বড় অংশের অসহায়ত্ব এবং সমাজে বিদ্যমান বিশাল বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরার সাথে সাথে ‘শিশু সুরক্ষার’ বিষয়টি সামনে চলে এসেছে। প্রথম গল্পের ডেভিডের তবুও যাবার একটা জায়গা ছিল। হোক না সেটা মন্দের ভাল। রাষ্ট্র সেই ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু মুন্নী আর মানসুরের? না পরিবার, না সমাজ, না রাষ্ট্র। ‘কোথাও কেউ নেই’। শেষমেষ দু’টো জীবন্ত শিশুকে হন্তারক পিতার কারণে ঈদের সময় রাক্ষুসী পদ্মার গ্রাস হতে হলো।
ডেভিডকে সরকারি হেফাজতে নেবার পথে সে ভাবছিল: ‘‘Now I know I am going to jail’.‘Good.’ I tell myself. At least she (mother) won’t be able to beat me if I’m in jail.’’
প্রমত্তা পদ্মার বুকে ছুড়ে ফেলার সময়ে হয়তো বাঁচার আকুতি নিয়ে হাত-পা ছুঁড়ে কিছুক্ষণ ব্যর্থ লাফালাফির চেষ্টা করেছিল কচি দু’টো দেহ। তারপর ব্রিজ থেকে নিচে, পদ্মার বিস্তীর্ণ বুকের দিকে ধেয়ে যেতে যেতে, ওরাও কি ভেবেছিল: ‘‘Good’! Still better than starving!’’
ডেভিড পুলিশ অফিসারের সাথে ছুটে চলেছে হাইওয়ে ধরে। রাস্তার ধারে লেখা একটা সাইনবোর্ড চোখে পড়ে তার, “The most beautiful highway in the world.” হঠাৎ সে অফিসারকে জিজ্ঞেস করে, ‘‘Aren’t you taking me to some kind of jail?’’
অফিসারটি মৃদু হেসে জবাব দেয়, ‘‘No David. You have nothing to worry about, honest. Your mother is never going to hurt you again.’’
পাবনার বারদাগ গ্রামের মুন্নী ও মানসুরও তো ঈদের গোশত-পোলাওর ঘ্রাণে, পৃথিবীর সবচেয়ে ভরসার মানুষটির হাত ধরে, মেঠো পথ কিংবা ভাঙা-চোরা ইটের রাস্তা দিয়ে নিশ্চিন্তে হেঁটে যাবার সময় সেরকমই ভেবেছিল। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর পথে, সবচেয়ে নিরাপদ মানুষের হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে তারা! কিন্তু তারপর?
মুন্নী-মানসুরের গল্পের বাকি সবটুকু শুধুই কান্নার। এ কান্নার নোনা জলে পদ্মা আরো প্রমত্তা হবে। সেই জলে সারাদেশ ভেসে গেলেও কখনো টলবে না সেই লুটেরাদের বিবেক। হররোজ যারা হতদরিদ্রদের নামে বরাদ্দ চাল-ডাল-আটা মেরে দিয়ে, ধুলো উড়িয়ে, নতুন মডেলের গাড়ি হাঁকিয়ে গোটা দেশ চষে বেড়ায়।
ছেলেটির জীবন শুরু হয়েছিল অসম্ভব ভাল একটা পারিবারিক আবহের মধ্যে। অচিরেই সেটা পাল্টে যেতে থাকে। মা ধীরে ধীরে ভীষণ রকম অত্যাচারী হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্র ছেলেটিকে নিজের জিন্মায় নিতে বাধ্য হয়।
গল্প যতো এগোতে থাকে ততোই ভিন্ন ভিন্ন কায়দার অদ্ভুত এবং নির্মম অত্যাচারের ঘটনা প্রকাশ পেতে থাকে। না খাইয়ে রাখা থেকে শুরু করে চড় থাপ্পড় কিংবা শরীরে ছুরি চালানো---হেন অত্যাচার নেই যা মা প্রয়োগ করে নি। কুকুরের খাবারের বাটি থেকে উচ্ছিষ্ট খাদ্য গ্রহণে বাধ্য করা, এমনকি জ্বলন্ত ষ্টোভে হাত চেপে রেখে শাস্তি দেয়াসহ নিজের বমি নিজেকে খেতে বাধ্য করত সেই মা। এমনি আরো অবিশ্বাস্য অত্যাচারের কাহিনী বর্ণিত আছে বইটিতে। বইটা পড়া শুরু করলে শেষ করতেই হবে।
আমাদের গল্প, মুন্নী মানসুর: রাক্ষুসী পদ্মাকে উপহার।
ঘটনাস্থল পাবনা। ঈদের আগে দরিদ্র বাবা অন্ন সংস্থান করতে না পেরে দু দু’টো সন্তানকে পদ্মার বুকে ছুড়ে ফেলে। বাবা তাদের বলেছিল, চুল কাটতে নিয়ে যাবেন। অতি খুশিতে বাবার হাত ধরে মুন্নী (১০) ও মানসুর (৫)হাঁটা শুরু করে।
সামনে ঈদ। বাবা নিশ্চয়ই ঈদে অন্তত শিরনী রান্নার ব্যবস্থা করবেন। আর না হোক মহাজনের বড়িতে হাত পেতে একবেলা তো গোশত-ভাত খাওয়া যাবে। এতো কষ্টের ভিতরেও ঈদ যেন দমকা বাতাসের মতো এক ঝলক দোলা দিয়ে যায় দুটো অবুঝ মনে।
নিষ্ঠুর বাবার মনে ভিন্ন চিন্তা। একমাত্র সে-ই জানে কি ঘটতে যাচ্ছে একটু পরেই। বাবা তাদের চুল কাটতে না নিয়ে, গেলেন পদ্মানদীর উপরে লালন শাহ সেতুতে। পরের খবর সবাই জানি। বাবা অকপটে স্বীকার করেছেন, ‘‘অভাবের সংসার। পেটে দানাপানি দিতে পারি না। সন্তান রেখে কি করব!’’
এ ঘটনা নিয়ে বাবার পক্ষে-বিপক্ষে তুমুল আলোচনার সুযোগ আছে। কেউ কেউ সেই সুযোগটা নিয়েছিও। কিন্তু এটুকু সবাই মানতে বাধ্য হবেন, কাজটি এক কথায় ক্ষমার অযোগ্য। ঘটনার পরে অনেক আলোচনা হয়েছে। কেউ কেউ রাষ্ট্রকে পুরো দোষটা দিতে চাইছেন। কেউবা সেটা মানছেন না। বাবার নিষ্ঠুর দিকটাই তুলে ধরছেন।
অনেকেই মনে করছেন, মানসিক রোগ ছাড়া একজন পিতার পক্ষে এ রকম জঘন্য কাজ করা সম্ভব নয়। হতে পারে। দরিদ্রতার কষাঘাতে জর্জরিত বাবা সন্তানদের ছুড়ে ফেলে বাড়তি বোঝা থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছেন। কিংবা সেই সাথে সমাজ ও রাষ্ট্রের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছেন নিজে টিকে থাকার জন্য। তবে অতি অবশ্যই এই ঘৃণ্য কাজে তার জীবনের প্রধান সমস্যা দরিদ্রতাই প্ররোচিত করেছে। এই দরিদ্রতার জন্য আমরা জনগণ স্বাভাবিকভাবে সরকারকেই দোষারোপ করব। বলব, সরকারের কেউ কেউ দুর্নীতিবাজ, জনগণের বরাদ্দকৃত সুবিধা মেরে খায়। সবই ঠিক আছে। কিন্তু শুধুই কি সরকার দায়ী?
একটা ঘটনা বলছি। ২০০৫ সালে ঈদের ছুটিতে বাইরে চাকরি করা সবাই গ্রামে এলে মিলিতভাবে একটা উদ্যোগ নিয়েছিলাম। নাম ছিল ‘মাটির টানে’। পাঠক এনজিও ভেবে বসবেন না। কোনো সংস্থা নয়, শুধু ব্যক্তিগত উদ্যোগগুলোকে একসাথে করে কার্যকারিতা বাড়ানো। ঈদে বাড়িতে এলে সবার যাকাত এবং বাড়তি সাহায্যের টাকায় এলাকার একেবারে দু:স্থদের সহায়তা করা। দশ/পাঁচ টাকা করে হাজার জনকে দিয়ে প্রশংসা না কুড়িয়ে সাধ্যমতো দু’চার জনকে স্বাবলম্বী করতে সহায়তা করে বাকিদের ঘৃণা কুড়ানো। কোনো সুদ দিতে হবে না। শুধু সাধ্যমতো মাসে মাসে কিছু টাকা দিয়ে মূল টাকাটা ফিরিয়ে দেবে। সেই সাথে তাদেরকে অন্যদের সহায়তা করার নৈতিক শিক্ষা দেওয়া। কারণ সে মানুষের সাহায্যে কিছু একটা করতে পেরেছে। তাই তাকেও নৈতিকভাবে মানুষের সহযোগিতায় এগিয়ে আসতে হবে। মূলধন ফিরে পেলে সেটা আবার অন্য কাউকে দেওয়া হবে। এভাবে বছর বছর সবার মিলিত টাকা দিয়ে এক সময় অনেক জনকে সাহায্য করা যেত। পরের বছর কথা মতো কাজও হয়েছিল। সবাই মিলে এক ব্যক্তিকে ভ্যান কিনে দেওয়া হলো। কয়েক মাস না যেতেই শুনি, সেই ভ্যান বিক্রি হয়ে গেছে। অভাবে নয়। আসলে যাকে দেয়া হয়েছিল, সে অর্থে সে অভাবী ছিল না। যাদেরকে দায়িত্ব দেওয়া হয় তারা নিজের লোককে দু:স্থ বানিয়ে ভ্যান পেতে সাহায্য করে। পরে আরো জানতে পারি, ভ্যানের টাকা কিছুটা সেই দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিও ভাগে পেয়েছিল।
এইতো আমরা জনগণ বা জনগণের উল্লেখযোগ্য একটা অংশ। সুযোগের অভাবে সাধু। জনগণ এমন একটা জাত, যে জাতের সমালোচনা করা যায় না। একেবারে আশরাফ, ব্রাক্ষণ গোত্রীয়। ঘুষখোর ঘুস খেয়ে দিব্যি জনগণের কাতারে নাম লিখিয়ে নেয়। যে চাঁদাবাজ সে-ও একই রকম। এভাবে শেষ পর্যন্ত জনগণের বাইরে কেউ থাকছে না। আর আমরা অতি সাধারণ জনগণও সুযোগ পেলে ‘মাটির টানের’ মতো ছোট্ট উদ্যোগের টাকাটাও মেরে দিই।
এই আচরণ নিয়ে আমাদের কি অধিকার আছে সন্তানহন্তারক সেই পিতাকে পাষণ্ড বলার? যে রাষ্ট্রনেতারা দুর্নীতিকে লালন করে একটা শ্রেণীকে চরম দরিদ্র থাকতে বাধ্য করছেন তাদের কি শাস্তি হয়েছে কখনো? তবুও সেই পাষণ্ড পিতাকে শাস্তি ভোগ করতেই হবে। কারণ সে যেটা করেছে সেটা প্রশ্নাতীতভাবে অমানবিক, পৈশাচিক এবং সেটা হত্যা বা হত্যার চেষ্টা(মুন্নী ও মানসুরের দেহ এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি)।
গল্প বর্ণনা আমার উদ্দেশ্য নয়। শুধু গল্পের অবতারণার মধ্য দিয়ে সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশেও শিশুদের ভঙ্গুর অবস্থানের কথা তুলে ধরতে চেয়েছি। রাষ্ট্র এবং সরকার যদি অদক্ষ হয়, দুর্নীতিগ্রস্ত হয় কিংবা কোনো সমাজে যদি প্রচণ্ড রকম দরিদ্রতা বিরাজ করে তবে কতো ভাবে যে সেটা মানুষকে প্রভাবিত করে, পাবনার এই ঘটনা তারই একটা বড় প্রমাণ। আজ বিভিন্নভাবে প্রমাণিত যে, যে কোনো রকমের সামাজিক এবং পারিবারিক অশান্তি কিংবা গোলযোগের শিকার প্রথমে শিশুরাই হয়। তাই পরিবারের দরিদ্রতার অসহায় শিকার মুন্নী ও মানসুর, কিংবা ক্ষুধার জ্বালায় খাবার চুরি করলে গণপিটুনির শিকার হওয়া, এবং রাজনৈতিক দলের মিছিল মিটিংয়ে ভাড়া খেটে গিয়ে ধরা পড়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার বুটের লাথি ---কোনো কিছু থেকেই শিশুরা রেহাই পায় না।
আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, এ ঘটনা সভ্য দেশে ঘটলে পুরো জাতি দোষীর উপযুক্ত শাস্তির জন্য সরব হতো; পাশাপাশি সরকারকে দাঁড় করাত বিচারের কাঠগড়ায়। কিন্তু কে করবে কার বিচার! আমরা জনগণ নিজেই তো সুবিধাবাদী, বিতর্কে ঘি ঢালতে থাকি।
সামগ্রিকভাবে উন্মত্ত পিতার কুকীর্তির মধ্য দিয়ে সমাজের একটা বড় অংশের অসহায়ত্ব এবং সমাজে বিদ্যমান বিশাল বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরার সাথে সাথে ‘শিশু সুরক্ষার’ বিষয়টি সামনে চলে এসেছে। প্রথম গল্পের ডেভিডের তবুও যাবার একটা জায়গা ছিল। হোক না সেটা মন্দের ভাল। রাষ্ট্র সেই ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু মুন্নী আর মানসুরের? না পরিবার, না সমাজ, না রাষ্ট্র। ‘কোথাও কেউ নেই’। শেষমেষ দু’টো জীবন্ত শিশুকে হন্তারক পিতার কারণে ঈদের সময় রাক্ষুসী পদ্মার গ্রাস হতে হলো।
ডেভিডকে সরকারি হেফাজতে নেবার পথে সে ভাবছিল: ‘‘Now I know I am going to jail’.‘Good.’ I tell myself. At least she (mother) won’t be able to beat me if I’m in jail.’’
প্রমত্তা পদ্মার বুকে ছুড়ে ফেলার সময়ে হয়তো বাঁচার আকুতি নিয়ে হাত-পা ছুঁড়ে কিছুক্ষণ ব্যর্থ লাফালাফির চেষ্টা করেছিল কচি দু’টো দেহ। তারপর ব্রিজ থেকে নিচে, পদ্মার বিস্তীর্ণ বুকের দিকে ধেয়ে যেতে যেতে, ওরাও কি ভেবেছিল: ‘‘Good’! Still better than starving!’’
ডেভিড পুলিশ অফিসারের সাথে ছুটে চলেছে হাইওয়ে ধরে। রাস্তার ধারে লেখা একটা সাইনবোর্ড চোখে পড়ে তার, “The most beautiful highway in the world.” হঠাৎ সে অফিসারকে জিজ্ঞেস করে, ‘‘Aren’t you taking me to some kind of jail?’’
অফিসারটি মৃদু হেসে জবাব দেয়, ‘‘No David. You have nothing to worry about, honest. Your mother is never going to hurt you again.’’
পাবনার বারদাগ গ্রামের মুন্নী ও মানসুরও তো ঈদের গোশত-পোলাওর ঘ্রাণে, পৃথিবীর সবচেয়ে ভরসার মানুষটির হাত ধরে, মেঠো পথ কিংবা ভাঙা-চোরা ইটের রাস্তা দিয়ে নিশ্চিন্তে হেঁটে যাবার সময় সেরকমই ভেবেছিল। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর পথে, সবচেয়ে নিরাপদ মানুষের হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে তারা! কিন্তু তারপর?
মুন্নী-মানসুরের গল্পের বাকি সবটুকু শুধুই কান্নার। এ কান্নার নোনা জলে পদ্মা আরো প্রমত্তা হবে। সেই জলে সারাদেশ ভেসে গেলেও কখনো টলবে না সেই লুটেরাদের বিবেক। হররোজ যারা হতদরিদ্রদের নামে বরাদ্দ চাল-ডাল-আটা মেরে দিয়ে, ধুলো উড়িয়ে, নতুন মডেলের গাড়ি হাঁকিয়ে গোটা দেশ চষে বেড়ায়।
No comments