স্মরণ ॥ নূরজাহান আপার গান by ওয়াহিদুল হক
বাঙালী সংস্কৃতির পোষকতা করেছে ঢাকা রেডিও। বৃহৎভাবে এই রেডিও, সেই অতীব সঙ্গীনকালে, অসাম্প্রদায়িক একটি ভূমিকা পালন করেছে। সকলেই জানে অচিরেই পূর্ববঙ্গে যে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বান ডাকবে এবং শুরু হবে বাঙালীর জাতীয়-মুক্তি নির্মাণের প্রথম চেতনা সঞ্চার ও কয়েক বছরেই সে লক্ষ্যে বিরাট অভিঘাতÑতাতে গোড়া
থেকেই যেমন ছিল রেডিওর অবদান তেমনি চৌষট্টির পরে একটা বাংলা ও বাঙালীমুখী টেলিভিশনেরও ভূমিকা।
ঢাকা রেডিওর সেই সংস্কৃতি পক্ষ নিরাপস ভূমিকা সম্ভব করেছিল। জানি না ঐ ত্রয়ীকে কোন বিন্যাসে লেখা ভাল নাজির ফতেহ আহাদ না উল্টো আহাদ নাজির ফতেহ-তাঁদের এবং নূরজাহান মুরশিদের অপরিবর্তনের আধুনিক ও সাম্প্রদায়িকতার সব সংস্পর্শ পরিহার প্রভাবের কারণে, নেতৃত্বের কারণে। আমি গৌরববোধ করি আমি এই চারজনকেই কাছ থেকে দেখেছি।
আমি কল্পনা করতাম, ঠিক জানতাম না, নূরজাহান বেগও ওই ছোট সংস্কৃতি পক্ষের চক্রটিতে ছিলেন। রেডিওতে শুনে শুনেই আমার মা ওঁর খুব ভক্ত হয়েছিলেন। আমি ধারণা করি ওই অতীব গুরুত্বপূর্ণ সময়ে নূরজাহান বেগ, তাঁর শিক্ষা ও রুচি এবং বাঙালী সংস্কৃতির পক্ষে এবং সংস্কৃতিবিহীনতার কাছে আত্মসমর্পণের বিরুদ্ধে স্থির দাঁড়িয়েছিলেন।
তার বহুকাল পরের কথা চার দশকের বেশি। বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদকে জানতাম অধ্যাপককুলের ব্যতিক্রম বলে। পঞ্চাশের দশকে ‘নিউ ভ্যালুজ’ বলে একটি সাহিত্য ও শিল্প সমালোচনার মাসিকপত্র বের করেন তিনি ইংরেজীতে। পূর্ববঙ্গের মেধা ও মনন চর্চার ক্ষেত্রে অগ্রসরতম ব্যক্তিদের প্রায় সকলকে লেখক হিসেবে পেয়েছিলেন মুরশিদ সাহেব। ইংরেজীর দুর্ধর্ষ অধ্যাপক হিসেবে নাম পেয়েছিলেন পেশায় আসার অল্পদিনের মধ্যেই। অধ্যাপক মুরশিদ চলনে-বলনে সঙ্গ নির্বাচনে একটু ফর্মাল ও আভিজাত্যানুসারী ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষকের অনেকেই আমার ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিগত বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও আমি কখনও ভাবতে পারতাম না যে তিনি টিএসসির ভেতরকার নিতান্ত প্লিবিয়ান মাঠে একদিন, ঘোর জিয়া কালে আমার সঙ্গে কথা বলতে আসবেন। তিনি এলেন এবং ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের মাঠের পাশের আসনে বসলেন, তাঁর সাহেবী পোশাকে এবং বললেন তাঁরা একটা বাংলা সাপ্তাহিক কাগজ বের করতে যাচ্ছেনÑসাহিত্যপত্র নয়। তাতে যেন আমি একটা কলাম লিখি রাজনীতি-সংস্কৃতি মিলিয়ে। আমি খুব সম্মানিত বোধ করি। আমি কোন কালে কোন প্রকারের লেখক ছিলাম না। না গল্প, উপন্যাস, কবিতার, না প্রবন্ধের শিল্প-সমালোচনার। তখন বোধহয় আমার সাংবাদিকতার প্রায় চল্লিশ বছর হয়েছে এবং আমি সাংবাদিকসুলভ লেখাও তখন পর্যন্ত লিখেছি বলে মনে পড়ে না। মুরশিদ সাহেব আমাকে লেখক হিসেবে কেন নির্বাচন করেছিলেন, সে আজও আমার কাছে রহস্য।
বেরোচ্ছে ‘এদেশ একাল’, সম্পাদক নূরজাহান। সেই আমাদের নূরজাহান বেগ, রেডিওর নূরজাহান। এই চার দশক তাঁকে দেখিনি, বৃত্তান্ত আমি কিছুই জানি না তাঁর এবং আমি নিশ্চিত যে, আমাকে দেখে তিনি বোঝেননি যে, আমি তাঁর রেডিও কালের কোন কিশোর। টাকে মাথা ছাওয়া এক প্রৌঢ় প্রবীণকে তিনি গ্রহণ করলেন কতকালের আপন ছোট ভাইটির মতো। মুরশিদ সাহেব তাঁর সিনিয়রিটির সব ক’টি বছর মুছে দিয়ে টেনে নেন খুবই কাছে। বেরোতে থাকে ‘এদেশ একাল’। বেশ ছিল পত্রিকাটি। সেই সামরিক একনায়কত্বের কালে, একটি মেধাবী প্রকাশনা, সুবুদ্ধির, সুরুচির। কমিটমেন্টের। আমার লেখাগুলোর ভালমন্দ জানি নাÑবেশ বড় হতো সেগুলো এবং আমার সম্পাদক তা নিয়ে কোনদিন অনুযোগ করেননি।
কি কারণে সে পত্রিকা একদিন বন্ধ হয়ে গেল, জানি না। কিন্তু সম্পর্কটি থেকে গেল। সেই সম্পর্কসূত্রেই একদিন বসতে পেলাম মেঝেতে, কার্পেটে পাতা চাদরের ওপর। হারমোনিয়ামও একটি আছে তাতে, নূরজাহান আপা আর আমি ছাড়া, তিনি গান শিখবেন। বেশ তো। কার উদ্যোগে আরম্ভ হয়ে যায় ‘অন্তর মম বিকশিত করো, অন্তরতর হে’। আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করি তাঁর অনায়াস সঙ্গীতক্ষমতা।
যেমন নূরজাহান আপা গান করছেন এ মুহূর্তে। আর সব পরিচয় মুছে ফেলে। অনভ্যাসের ছাপ, অগ্রসর বয়সেও, ছাপিয়ে উঠেছিল সুরবাহিত কবিগুরুর সেই অনন্য প্রার্থনাÑ নির্মল করো, উজ্জ্বল করো, সুন্দর করো হে। ঈশ্বর কিংবা আপন হৃদয়ের গুহাস্থিত অন্তরমানবকেই ফর্মাশ করা একটা ফর্দ বিশেষ, তার চেয়ে ভাল কেউ কখনও চাইতে পারেনি নিজের জন্য। গানের সঙ্গীতের দিকটা গায়ককে স্পষ্ট করে কিছু বলতে দেয় না। সঙ্গীতটা একটা বোবা, নিতান্ত বোবা, আত্মপ্রকাশ-প্রয়াস, যা কিনা অপরে কিছু সঞ্চালন করবে বলেই আরম্ভ হয় বটে। কিন্তু অচিরে বোবা সুর কথাকে ঢেকে দিতে থাকে সৌন্দর্য দিয়ে, মোহময়তা দিয়ে। রবীন্দ্রনাথের গানে এই সঙ্কট আরও ঘনীভূত। কথা-সুর যেন হরিহর তাঁর গানে, এমনই রটনা। অসম্ভব রটনা। তাঁর মোহন চিকন সুর তাঁর কথাকে আড়াল করে অতি অবশ্য। এবং অনেকের কাছে তার কথাটা কিছু পৌঁছায়, সুর তেমন নয়। রবীন্দ্রসঙ্গীত যেন কথা গান-উনগান।
তিলে তিলে উত্তম করে গড়ে তোলা হলেও গান তো শেষ পর্যন্ত একটা স্রোতই বটে। তাঁর গান টেকনিককে ফুটিয়ে না তুলে এগিয়ে চলে। কতটুকু তাঁর পর শিক্ষালব্ধ, কতটুকু নিজের, বোঝা যায় না, যা বোঝা যায় তা হলো তিনি অনেক এগিয়ে থাকা একটা গানের মানুষ, রবীন্দ্রনাথের মানুষ। এতদিনে আমাদের মধ্যকার সকল অপরিচয় মুছে দেয় তাঁর গান। আসল পরিচয়টা আমার কাছে একমাত্র প্রাসঙ্গিক পরিচয়টা ফুটে উঠতে উঠতে আকাশই একটা ভরে তোলে। যত কেন চাইলাম, আর তাঁকে পাইনি সে রূপে। জীবন তো এমনই।
ঢাকা রেডিওর সেই সংস্কৃতি পক্ষ নিরাপস ভূমিকা সম্ভব করেছিল। জানি না ঐ ত্রয়ীকে কোন বিন্যাসে লেখা ভাল নাজির ফতেহ আহাদ না উল্টো আহাদ নাজির ফতেহ-তাঁদের এবং নূরজাহান মুরশিদের অপরিবর্তনের আধুনিক ও সাম্প্রদায়িকতার সব সংস্পর্শ পরিহার প্রভাবের কারণে, নেতৃত্বের কারণে। আমি গৌরববোধ করি আমি এই চারজনকেই কাছ থেকে দেখেছি।
আমি কল্পনা করতাম, ঠিক জানতাম না, নূরজাহান বেগও ওই ছোট সংস্কৃতি পক্ষের চক্রটিতে ছিলেন। রেডিওতে শুনে শুনেই আমার মা ওঁর খুব ভক্ত হয়েছিলেন। আমি ধারণা করি ওই অতীব গুরুত্বপূর্ণ সময়ে নূরজাহান বেগ, তাঁর শিক্ষা ও রুচি এবং বাঙালী সংস্কৃতির পক্ষে এবং সংস্কৃতিবিহীনতার কাছে আত্মসমর্পণের বিরুদ্ধে স্থির দাঁড়িয়েছিলেন।
তার বহুকাল পরের কথা চার দশকের বেশি। বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদকে জানতাম অধ্যাপককুলের ব্যতিক্রম বলে। পঞ্চাশের দশকে ‘নিউ ভ্যালুজ’ বলে একটি সাহিত্য ও শিল্প সমালোচনার মাসিকপত্র বের করেন তিনি ইংরেজীতে। পূর্ববঙ্গের মেধা ও মনন চর্চার ক্ষেত্রে অগ্রসরতম ব্যক্তিদের প্রায় সকলকে লেখক হিসেবে পেয়েছিলেন মুরশিদ সাহেব। ইংরেজীর দুর্ধর্ষ অধ্যাপক হিসেবে নাম পেয়েছিলেন পেশায় আসার অল্পদিনের মধ্যেই। অধ্যাপক মুরশিদ চলনে-বলনে সঙ্গ নির্বাচনে একটু ফর্মাল ও আভিজাত্যানুসারী ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষকের অনেকেই আমার ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিগত বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও আমি কখনও ভাবতে পারতাম না যে তিনি টিএসসির ভেতরকার নিতান্ত প্লিবিয়ান মাঠে একদিন, ঘোর জিয়া কালে আমার সঙ্গে কথা বলতে আসবেন। তিনি এলেন এবং ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের মাঠের পাশের আসনে বসলেন, তাঁর সাহেবী পোশাকে এবং বললেন তাঁরা একটা বাংলা সাপ্তাহিক কাগজ বের করতে যাচ্ছেনÑসাহিত্যপত্র নয়। তাতে যেন আমি একটা কলাম লিখি রাজনীতি-সংস্কৃতি মিলিয়ে। আমি খুব সম্মানিত বোধ করি। আমি কোন কালে কোন প্রকারের লেখক ছিলাম না। না গল্প, উপন্যাস, কবিতার, না প্রবন্ধের শিল্প-সমালোচনার। তখন বোধহয় আমার সাংবাদিকতার প্রায় চল্লিশ বছর হয়েছে এবং আমি সাংবাদিকসুলভ লেখাও তখন পর্যন্ত লিখেছি বলে মনে পড়ে না। মুরশিদ সাহেব আমাকে লেখক হিসেবে কেন নির্বাচন করেছিলেন, সে আজও আমার কাছে রহস্য।
বেরোচ্ছে ‘এদেশ একাল’, সম্পাদক নূরজাহান। সেই আমাদের নূরজাহান বেগ, রেডিওর নূরজাহান। এই চার দশক তাঁকে দেখিনি, বৃত্তান্ত আমি কিছুই জানি না তাঁর এবং আমি নিশ্চিত যে, আমাকে দেখে তিনি বোঝেননি যে, আমি তাঁর রেডিও কালের কোন কিশোর। টাকে মাথা ছাওয়া এক প্রৌঢ় প্রবীণকে তিনি গ্রহণ করলেন কতকালের আপন ছোট ভাইটির মতো। মুরশিদ সাহেব তাঁর সিনিয়রিটির সব ক’টি বছর মুছে দিয়ে টেনে নেন খুবই কাছে। বেরোতে থাকে ‘এদেশ একাল’। বেশ ছিল পত্রিকাটি। সেই সামরিক একনায়কত্বের কালে, একটি মেধাবী প্রকাশনা, সুবুদ্ধির, সুরুচির। কমিটমেন্টের। আমার লেখাগুলোর ভালমন্দ জানি নাÑবেশ বড় হতো সেগুলো এবং আমার সম্পাদক তা নিয়ে কোনদিন অনুযোগ করেননি।
কি কারণে সে পত্রিকা একদিন বন্ধ হয়ে গেল, জানি না। কিন্তু সম্পর্কটি থেকে গেল। সেই সম্পর্কসূত্রেই একদিন বসতে পেলাম মেঝেতে, কার্পেটে পাতা চাদরের ওপর। হারমোনিয়ামও একটি আছে তাতে, নূরজাহান আপা আর আমি ছাড়া, তিনি গান শিখবেন। বেশ তো। কার উদ্যোগে আরম্ভ হয়ে যায় ‘অন্তর মম বিকশিত করো, অন্তরতর হে’। আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করি তাঁর অনায়াস সঙ্গীতক্ষমতা।
যেমন নূরজাহান আপা গান করছেন এ মুহূর্তে। আর সব পরিচয় মুছে ফেলে। অনভ্যাসের ছাপ, অগ্রসর বয়সেও, ছাপিয়ে উঠেছিল সুরবাহিত কবিগুরুর সেই অনন্য প্রার্থনাÑ নির্মল করো, উজ্জ্বল করো, সুন্দর করো হে। ঈশ্বর কিংবা আপন হৃদয়ের গুহাস্থিত অন্তরমানবকেই ফর্মাশ করা একটা ফর্দ বিশেষ, তার চেয়ে ভাল কেউ কখনও চাইতে পারেনি নিজের জন্য। গানের সঙ্গীতের দিকটা গায়ককে স্পষ্ট করে কিছু বলতে দেয় না। সঙ্গীতটা একটা বোবা, নিতান্ত বোবা, আত্মপ্রকাশ-প্রয়াস, যা কিনা অপরে কিছু সঞ্চালন করবে বলেই আরম্ভ হয় বটে। কিন্তু অচিরে বোবা সুর কথাকে ঢেকে দিতে থাকে সৌন্দর্য দিয়ে, মোহময়তা দিয়ে। রবীন্দ্রনাথের গানে এই সঙ্কট আরও ঘনীভূত। কথা-সুর যেন হরিহর তাঁর গানে, এমনই রটনা। অসম্ভব রটনা। তাঁর মোহন চিকন সুর তাঁর কথাকে আড়াল করে অতি অবশ্য। এবং অনেকের কাছে তার কথাটা কিছু পৌঁছায়, সুর তেমন নয়। রবীন্দ্রসঙ্গীত যেন কথা গান-উনগান।
তিলে তিলে উত্তম করে গড়ে তোলা হলেও গান তো শেষ পর্যন্ত একটা স্রোতই বটে। তাঁর গান টেকনিককে ফুটিয়ে না তুলে এগিয়ে চলে। কতটুকু তাঁর পর শিক্ষালব্ধ, কতটুকু নিজের, বোঝা যায় না, যা বোঝা যায় তা হলো তিনি অনেক এগিয়ে থাকা একটা গানের মানুষ, রবীন্দ্রনাথের মানুষ। এতদিনে আমাদের মধ্যকার সকল অপরিচয় মুছে দেয় তাঁর গান। আসল পরিচয়টা আমার কাছে একমাত্র প্রাসঙ্গিক পরিচয়টা ফুটে উঠতে উঠতে আকাশই একটা ভরে তোলে। যত কেন চাইলাম, আর তাঁকে পাইনি সে রূপে। জীবন তো এমনই।
No comments