নারীর ক্ষমতায়ন-প্রয়োজন অর্থপূর্ণ পরিবর্তন by সাহিদুর রশিদ তালুকদার

তরুণ এবং অনাগত_ উভয় প্রজন্মকেই আমাদের দেখাতে হবে এবং উপলব্ধি করাতে হবে যে, ছেলেদের মতোই মেয়েরাও স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব, তাদেরও পছন্দ এবং প্রাপ্য সুযোগ গ্রহণ করার অধিকার রয়েছে, পরিবারে এবং সমাজে তাদের সমান চাওয়া রয়েছে এবং নারীরা সমাজের সম্মানিত সদস্য


এই যে গোলকধাঁধা। একদিকে আমাদের নারীরা দেশে দেশে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, অন্যদিকে আমরা তাদের পৃথিবীর মুখ পর্যন্ত দেখতে দিচ্ছি না। সাম্প্রতিক একটি গবেষণা, যার ভিত্তি ছিল ক্রমহ্রাসমান লিঙ্গীয় হারকে দেখা, সেখানে ধারণা করা হয়, ২০২০ সাল নাগাদ ভারতে নারীর তুলনায় পুরুষের হার ২০ শতংাশ বেড়ে যাবে! এটা হচ্ছে জঘন্যতম অসমতা যা আমরা নারীদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছি। পৃথিবীতে তাদের ভূমিষ্ঠ হওয়ার অধিকারকেই আমরা হরণ করছি।
প্রাগৈতিহাসিককাল থেকেই আমাদের অর্ধাঙ্গীরা আমাদের সুখ-দুঃখের গ্রহীতা। পুরাণে আমরা তাদের আদর্শায়িত করি এবং মন্দিরে আমরা তাদের দেবীত্ব প্রদান করি। ঘরে আমরা তাদের ভালোবাসি এবং সম্মান করি মা এবং বোন হিসেবে। যৌবনে আমরা তাদের নিয়ে স্বপ্নে বিভোর থাকি। তাদের সৌন্দর্য এবং স্বর্ণময়তার জন্য আমরা তাদের স্বীকৃতি দিই। এ তালিকা ক্রমে ঊর্ধ্বমুখী হবে; কিন্তু তারপরও বাস্তবতা আমাদের দেখায় যে, আমাদের পক্ষ হতে এত সুন্দর থেকে সুন্দরতম অনুভূতি থাকার পরও নারীরা এখন পর্যন্ত অবদমিত। আমাদের সম্মিলিত ভালোবাসা, সম্মান এবং স্বীকৃতি সমাজে তাদের প্রাপ্য স্থান দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এটা কি অপ্রত্যাশিত নয়? তারপরও, আমরা সীমিত হলেও কিছু সাফল্য লাভ করেছি। বর্তমানে বেশিরভাগ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই নারীদের ভোট প্রদানের ক্ষমতা রয়েছে। তাদের এখন রাস্তাঘাট, বিশ্ববিদ্যালয় এবং অফিস-আদালতে ভালোভাবেই দেখা যাচ্ছে, যা আগে সম্ভব ছিল না। ফলে তাত্তি্বকভাবে এটা বলা যায়, স্বনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে অংশগ্রহণ করে ক্ষমতায়নের পথে আমরা উন্নতি লাভ করেছি; কিন্তু বাস্তবিকভাবে আমরা কি বলতে পারি যে, পরিবর্তনের মাত্রা যথেষ্ট? বাস্তবিক নির্দেশকগুলো যেমন_ গৃহনির্যাতন, ইভ টিজিং, নারী নিপীড়ন, কন্যাশিশু হত্যা অথবা যৌতুকের জন্য মৃত্যু ইত্যাদি বিষয় উন্নতির লক্ষণ প্রকাশ করে না।
এখন বিশেল্গষণ করা যাক, কেন এবং কীভাবে এসব পদক্ষেপ নারীর ক্ষমতায়নে ব্যর্থ। শিক্ষার মাধ্যমে আলোচ্য বিষয়ের অনেক কিছু চিহ্নিত করা সম্ভব। একজন শিক্ষিত নারীও কিন্তু নারীই, ঠিক নয় কি? ওই নারী কি এমন একজনকে বিয়ে করতে পারবে না যাকে সবাই দ্বিধাহীনভাবে পছন্দ করবে, সে পছন্দ করুক আর নাই করুক? হ্যাঁ, সে করতে পারবে। বর্ণ, ধর্ম, মর্যাদা, জাতিসত্তার ছলে বা ছদ্মাবরণে সে উৎসর্গীকৃত হবে। সে কি চার দেয়ালের মাঝে বন্দি হবে না? হ্যাঁ, যথেষ্টই হবে। শিক্ষা কি তাকে অর্থনৈতিক মুক্তি এনে দেবে? একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত এনে দেবে। সে একটি চাকরি পেতে পারে, কিন্তু তার বেতন তার যোগ্যতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে না। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, নারীরা গড়ে দশ থেকে পঞ্চাশ শতাংশ কম বেতন পায় পুরুষ সহকর্মীদের তুলনায়। তারপরও তার কি অর্জিত অর্থ ইচ্ছামতো খরচ করার স্বাধীনতা থাকবে? নারীদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতাকে অনেক সমাজেই ভালো চোখে দেখা হয় না।
অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন নারীদের শুধু সমালোচনাই হজম করতে হয় না, সঙ্গে বাড়তি কিছু মূল্যও পরিশোধ করতে হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় কর্মজীবী নারীরা তাদের গৃহকর্ম থেকে অব্যাহতি পায় না, সুতরাং তাদের নিতে হয় দুই ধরনের দায়িত্ব। এত কিছুর পরও তারা কি তাদের প্রাপ্য পায়? সাধারণত পায় না। এ কাহিনী গ্রামীণ এবং দরিদ্র নারীদের ক্ষেত্রেও সমানভাবে সত্য। তারা বাড়িতে এবং মাঠে সমান পরিশ্রম করে; কিন্তু নারী হওয়ার কারণে তারা অবমূল্যায়িত হয়। তারা যে পরিমাণ পরিশ্রম করে, সে তুলনায় খুব কমই বাহবা পায়। নারী শিক্ষা এবং তাদের আয় করার ক্ষমতা সামাজিক পরিস্থিতিতে পরিবর্তন আনছে, তবুও তাদের অবস্থার তেমন উন্নতি হচ্ছে না। কিছু ক্ষেত্রে এ পরিবর্তন তাদের জীবনে ইতিবাচক প্রভাব রাখছে, কিন্তু অন্য বেশকিছু ক্ষেত্রে তাদের বোঝা আরও বেড়ে যাচ্ছে এবং তাদের সেই বাড়তি পরিশ্রমের মূল্যায়ন হচ্ছে না।
বর্তমানে নারীদের বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত বা গতিশীলতা সম্পর্কে সবাই ওয়াকিবহাল; অবশ্য শিক্ষিত ও স্বাধীন নারীরা অন্যদের তুলনায় অনেক বেশিই গতিশীলতা ভোগ করে; কিন্তু এখানে দেখার বিষয় হলো তারা কি সব স্থানে নিরাপদবোধ করে? এমন খবরও জানা যায়, ইভ টিজিং প্রতিরোধ কমিটির নারী সদস্যই স্বয়ং নির্যাতনের শিকার হয়েছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, বাস্তবিক অর্থে কোনো কিছুই নারীদের নির্যাতন ও অনিরাপত্তাবোধ থেকে মুক্তি দিতে পারছে না। আমরা কি এ অবস্থাকে নারীর ক্ষমতায়ন বলতে পারি?
রাজনৈতিকভাবে নারীদের ক্ষমতা প্রদান দেখা হয় নারীর ক্ষমতায়নের একটি অংশ হিসেবে। যদিও এটা নারীদের বিরুদ্ধে যেতে পারে। ভারতের আইনসভায় এক-তৃতীয়াংশ আসন নারীদের জন্য রাখার যে বিধান রাখা হয়েছে, সে বিষয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। অনেকেই এ আইনকে স্বাগত জানিয়েছেন, অন্যদিকে অনেকেই আবার এ আইনের বিপক্ষে রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন যে, এর ফলে আইনসভায় সংখ্যালঘুদের অবস্থান ভবিষ্যতে দুর্বল হয়ে পড়বে। কিন্তু আমি ভিন্ন প্রেক্ষাপটের একটি সমস্যা দেখতে পাচ্ছি। দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় এ ধরনের আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা চালু রয়েছে, বিশেষ করে গ্রাম পঞ্চায়েত এবং পৌরসভায়। এ ধরনের আসন সংরক্ষণের ক্ষেত্রে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয় নারী সদস্যদের, কারণ তারা অনেক ধরনের কর্মকাণ্ড করতে বাধ্য হন যাতে তারা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না।
নারীদের ভালো থাকার জন্য, ভালো জীবনের জন্যই আসলে সব ধরনের কর্মকাণ্ড। সমান অধিকার, সমান সুযোগ, নারীর ক্ষমতায়ন ইত্যাদির লক্ষ্যই হলো তাদের জন্য সুন্দর জীবনের আয়োজন করা। প্রকৃতপক্ষে নারীদের প্রতি আমাদের যে দৃষ্টিভঙ্গি সেটা পরিবর্তন করা উচিত এবং সেটা করলেই তাদের জীবন অনেক সহজ হবে, তাদের দুঃখ-যন্ত্রণা লাঘব হবে এবং তাদের জীবন সার্থক ও অর্থপূর্ণ হয়ে উঠবে। নারীর প্রতি প্রচলিত যে দৃষ্টিভঙ্গি তার পরিবর্তন না হলে, কোনো ধর্মশাস্ত্রই তাদের অধিকার নিশ্চিত করতে পারবে না, কোনো ধরনের নারীবাদী কর্মকাণ্ডই তাদের জীবনে নিরাপত্তা ও শান্তি এনে দিতে পারবে না, কোনো কর্মসংস্থানই তাদের স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করবে না, কোনো মাত্রার শিক্ষাই তাদের মুক্তি এনে দিতে সক্ষম হবে না। নারী মুক্তির বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আমরা তাদের দুঃখ-দুর্দশাই বৃদ্ধি করতে পারব, নারী মুক্তি নীতিমালার মাধ্যমে আমরা তাদের বিভিন্ন ধারা-উপধারার বাঁধতে পারব; কিন্তু তাদের প্রকৃত মুক্তির জন্য যা প্রয়োজন_ তাদের ইচ্ছার প্রতি, স্বাধীনতার প্রতি আমাদের মনের গভীর থেকে সম্মান উৎপাদন, মনের গভীর থেকে স্বীকৃতির। নারীদের প্রতি এই যে সম্মান, তা লিখিত এবং চর্চাগতভাবে_ উভয়ভাবেই ধারণ করতে হবে। লিখিতভাবে দীর্ঘদিন ধরে বিষয়গুলো রয়েছে; কিন্তু এখন সেগুলোর চর্চা করার সময় এসেছে। তরুণ এবং অনাগত_ উভয় প্রজন্মকেই আমাদের দেখাতে হবে এবং উপলব্ধি করাতে হবে, ছেলেদের মতোই মেয়েরাও স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব, তাদেরও পছন্দ এবং প্রাপ্য সুযোগ গ্রহণ করার অধিকার রয়েছে, পরিবারে এবং সমাজে তাদের সমান চাওয়া রয়েছে এবং নারীরা সমাজের সম্মানিত সদস্য। এ চর্চা আমাদের পরিবার থেকেই শুরু করতে হবে। আমরা যদি আমাদের স্ত্রী, মা এবং বোনদের প্রতি সম্মান দেখাই, তাহলে আমাদের সন্তানরাও তাদের স্ত্রী, মা এবং বোনদের প্রতি সম্মান দেখাবে। এভাবেই অবদমন থেকে ক্ষমতায়নের দিকে একটি অর্থপূর্ণ পরিবর্তন সম্ভব হবে।

সাহিদুর রশিদ তালুকদার : গবেষক টেক্সাসটেক ইউনিভার্সিটি;কাউন্টার কারেন্টস থেকে ঈষৎ সংক্ষেপে ভাষান্তর রাসেল আহাম্মেদ
 

No comments

Powered by Blogger.