বিলেতের স্ন্যাপশট- টেমসে ভাসা একনৌকা বাংলা কবিতা by শামীম আজাদ

বাংলাদেশে সত্তরের শেষের দিকে হবে, কবি শামসুর রাহমান, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, সাইয়ীদ আতিকুল্লাহ, সৈয়দ শামসুল হক প্রমুখ অগ্রণী হয়ে ‘পদাবলী’ নামে একটি কবিতা সংগঠন করেন। পদাবলীর উদ্যোগেই বাংলাদেশে প্রথম বিনিময়মূল্যে কবিতা পাঠ। কবি রফিক আজাদ ও লেখক রশীদ হায়দার আমাকে ডাকলেন।


আমার তখন কবি হওয়ার কী আকাঙ্ক্ষা! কিছু কবিতা ছাপা হয়েছে, গ্রন্থ হয়নি। কাজ করতে গিয়ে পেলাম রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, মোহন রায়হান, তারিক সুজাত, কামাল চৌধুরীদের। ওরা আমার চেয়ে বয়সে ছোট, কিন্তু কারও কারও বই বেরিয়ে গেছে। ওরা কেউ রাগী কবি, কেউ অনুরাগী কবি, কেউ রাজনীতির কবি বলে আলোচিতও হচ্ছেন। আমার হলো লেট স্টার্ট। বসতে বসতে বিরাশিতে বেরোল প্রথম একক কবিতার বই!
পদাবলীর প্রথম পরিবেশনা হয় ঢাকার ব্রিটিশ কাউন্সিলে। আমি আর দিলারা হাফিজ দরজায় দাঁড়িয়ে সমাগত দর্শকদের হাতে বোটানিক্যাল গার্ডেনের রাঙা গোলাপ ও আমাদের প্রকাশনা তুলে দিলাম।
এদিকে গ্রিনরুমে আমাদের কবিকুলের যা অবস্থা! গরম চায়ে গলা পরিষ্কার করেন, পানি পান করে সিগারেট নিয়ে কাঁপেন। তারপর একে একে শামসুর রাহমান, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, রফিক আজাদ, বেলাল চৌধুরীসহ বাদবাকিরা মঞ্চে ঠিকই উঠলেন। তখন কবিদের ওভাবে পারফর্ম করার কোনো কনসেপ্টই ছিল না। মঞ্চে নীল আলোর পেছনে বাজল সেতার। আর আমরা ও দর্শক-শ্রোতারা সবাই হতবাক। অনেকেই যোগ দিলেন আমাদের সংগঠনে, অনেকে দিলেন না। নির্মলেন্দু গুণ এ আইডিয়াটা একেবারেই পছন্দ করলেন না। তিনি রচনা লিখলেন ‘অচল পদাবলী’। কিন্তু পদাবলী হয়ে উঠল বাংলাদেশের কবি, কবিতাপ্রেমী এবং উঠতি কবির কুঞ্জ। আর একদিন তারই ধারাবাহিকতায় জন্ম নিল জাতীয় কবিতা উৎসব। যার মঞ্চে বসেই পটুয়া কামরুল হাসান এঁকেছিলেন স্বৈরাচারীর সেই বিখ্যাত ব্যঙ্গচিত্র।
আগামীকাল ২ সেপ্টেম্বর বিলেতে শুরু হচ্ছে সংহতি সাহিত্য পরিষদ আয়োজিত চতুর্থ বাংলা কবিতা উৎসব। সংহতির জমজমাট কবিতা উৎসব আমাকে আমাদের পদাবলীর কথাই স্মরণ করায়। শিকড় নামের সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশনা থেকে সংহতির উত্তরণ। এবং পর্যায়ক্রমে এতে যোগ হয়েছে সম্মেলন, সেমিনার, সম্মাননা ও পারফরম্যান্স। এবারও দেশবিদেশ থেকে আসছেন খ্যাতনামা কবি ও কবিতাপ্রেমী। এবার বাংলাদেশ থেকে আসছেন কবি নির্মলেন্দু গুণ, সৈয়দ আল ফারুক, মারুফ রায়হান ও ওবায়েদ আকাশ। কানাডা থেকে কবি মাসুদ খান এবং জার্মানি থেকে কবি নাজমুন্নেছা। বিলেতের নানা শহর থেকে আসছেন অনেক প্রতিষ্ঠিত এবং নবীন কবি। উদ্বোধনীর পর নানা আড্ডা, আলোচনা পাঠ ও পদ্যের সঙ্গে একটি নৌবিহারও আছে। আর তাতে বাংলাদেশ থেকে বহু দূরে বিলেতে বয়ে যাওয়া টেমসে ভাসবে একনৌকা বাংলা কবিতা।
বিলেতের শিল্পী-সংস্কৃতিসেবীরাও বসে থাকেন তার আশায়। আমি বলি, সংহতিই বিলেতে বাংলা কবিতাকেন্দ্রিক একমাত্র প্রতিষ্ঠান। এবং এই অনাবাসে আমাদের মতো সারা জীবন কবিতা করে যাওয়া মানুষদের শ্বাস নেওয়ার স্থান, আমার এক বিস্ময়কর উপাধান। এখানে যে পদ্যের শাঁস উঠে আসে, তা দিয়ে একদিন প্রজ্ঞাবানেরা হয়তো নির্মাণ করবেন তৃতীয় বাংলার কবিতার ইতিহাস। প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি তো একই সঙ্গে পণ্ডিতও। তিনি জানেন অনাবাসী এই বাঙালিদের জন্য এর কী সাংঘাতিক প্রয়োজন। চলা অব্যাহত রাখলে কোয়ান্টিটিই একসময় কোয়ালিটি টেনে আনেই। এটা তো প্রমাণিত সত্য।
সাহিত্যের সব শাখার মধ্যে কবিতাই এখনো অধিকসংখ্যক মানুষের ব্যক্তিগত সম্পদ। কারণটি হলো কবিতায় ‘চির পদার্থ’র উপস্থিতি। আর এ পর্যায়ে চির পদার্থের সদ্ব্যবহার করা আর কি। এর শ্রোতারা এবং আয়োজকেরা কি আলাদা? না, বরং তারাই অত্যাবশ্যকীয়। তারা না হলে আমরা একা একাই আগের মতো কবিতা লিখতাম। বিলেতে সংহতি সাহিত্য পরিষদ নতুন কবিদের প্রণোদনার স্থান।
যখন আমার জানালা থেকে আলো চলে যাওয়ার জন্য উদ্যোগ নিয়েছে তখনই সংহতির সূর্য এসে লাফিয়ে পড়েছে। একদল তরুণ কবিতা ভালোবাসে বলেই আবার আমাদের ঘিরে থাকছে। আমি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কুসুম। এই বেলায় আমার চোখ চকচকে থাকতেই আমি দেখে নিচ্ছি সব। আমার সামনে সংহতির এই যে আলো, তা এখন আমার গা ঘষাঘষি করছে। আমাকে আরও কিছুদিন এই কবিতাকেন্দ্রিক কোলাহলে আয়ু প্রদান করছে।
গত বছর অতিথি কবি মহাদেব সাহা ও আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী আমার হাতে সংহতি কবিতা পদক তুলে দিতে গেলে এক অদ্ভুত আনন্দ ও কোলাহলময় পরিবেশের সৃষ্টি হয়। তাদের দুদিক থেকে যোগ হয় উল্লসিত তরুণ কর্মীদের হাত। আর নির্ধারিত স্থানে ফিরে যাওয়ার আগে আমার সঙ্গে তরুণ-তরুণীদের ছবি তোলার কী হুলুস্থুল। মনে হলো অস্কার জিতে গেছি! দেশ ছেড়ে এসেছি কত বছর আগে। কিন্তু সুদূর এই অনাবাসে থেকে দেশে ও বিদেশে নিরন্তর লিখে যাচ্ছি বাংলা ভাষায়ই কবিতা। ঘরে ফেরার সময় চোখে পানি এসে যায়। এমন ঘটনা বিলেতে হবে ভাবিনি! বুঝি, এভাবে চলতে থাকলে তৃতীয় বাংলার এ সংগঠনটি ইউরোপেই হয়ে উঠবে বাংলা ভাষাভাষী কবিদের পদাবলী কুঞ্জ।
মনে পড়ছে এর শিকড় পত্রিকার তরুণ কবি ফারুক আহমদ আর নাট্যকার আবু তাহেরের কথা এবং তাঁদের একদল বন্ধুর কথা। প্রবল বৈপরীত্যে সময় বদলের সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা সংগঠনকে বারবার ঢেলে সাজিয়েছেন। ত্রৈমাসিক সে পত্রিকার যখন প্রবল অর্থসংকট তখন উইকাম হাউসের ছোট্ট একটি কক্ষ থেকে তাঁরা পত্রিকাকে অনলাইন করে দিলেন। আবার সংযুক্ত করলেন আমাদের এখানকারই মানুষের লেখা ইংরেজি কবিতাও। শিকড়-এর উজ্জীবনী থেকেই সংহতি সাহিত্য পরিষদ। সেই তরুণেরাই পথযাত্রায় এখন অনেক পরিপক্ব।
সংহতি প্রতিষ্ঠা করেছেন কবি ফারুক আহমদ আর এই টার্মের সভাপতি ইকবাল হোসেন ও সাংগঠনিক সম্পাদক শামসুল হক। শুভ কামনা, তাঁদের আয়োজন সার্থক হোক। দেখা হবে কবিতায় কবিতায়!
 শামীম আজাদ: কবি, লেখক ও কলামিস্ট।
shetuli@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.