স্মরণ- নূরজাহান মুরশিদ by হাসনাত আবদুল হাই

বেগম নূরজাহান মুরশিদের জীবন ও কর্মের আলোচনায় বাঙালি মুসলমান নারীর স্বাধীনতা অর্জন, অধিকার আদায় এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে অগ্রগতির ইতিহাস প্রাসঙ্গিক এই জন্য যে তিনি এই ইতিহাসের অংশ। বর্তমানে সব বাঙালি মুসলমান শিক্ষিত পেশাজীবী মহিলা সম্পর্কে এ কথা বলা চলে না।


বেগম নূরজাহান মুরশিদের জীবন ও কর্ম এমন ছিল, যেখানে বাঙালি মুসলিম নারী আন্দোলনের সব কটি দিক সংযুক্ত। এর কোনোটির জন্য তিনি কৃতজ্ঞ পূর্বসূরিদের কাছে এবং পরিবর্তনশীল সমাজের কাছে। অন্য বেশ কিছু ক্ষেত্রে তাঁর বিচরণ ও অর্জন সম্ভব হয়েছে একান্তভাবে নিজস্ব বিশ্বাস ও উদ্যোগের ভিত্তিতে।
বেগম নূরজাহান মুরশিদ জন্মেছিলেন এক সম্ভ্রান্ত এবং শিক্ষিত মুসলিম পরিবারে। মুসলিম সমাজে অবরোধ প্রথা এর আগেই তিরোহিত, অন্তত নাগরিক শিক্ষিত পরিবারে। তবু তিনি যে ঘরের বাইরে এসে স্বচ্ছন্দে বিচরণ করতে পারলেন এবং শিক্ষা লাভের জন্য ধাপে ধাপে অগ্রসর হলেন, এর পেছনে ছিল নিকট অতীতের ‘নারী আন্দোলন’, যেখানে মেয়েদের পাশাপাশি কিছু উদারপন্থী প্রগতিশীল পুরুষও অংশ নিয়েছিলেন। সম্পন্ন পরিবারের সন্তান, উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রতি পিতা-মাতার সমর্থন এবং উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিতা হওয়া—এসব মিলে তাঁকে ব্যক্তিকেন্দ্রিকভাবে স্বার্থপর করে তোলা স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু কেবল নিজের জন্য নয়, অন্যদের ও সমাজের প্রতিও দায়বদ্ধতার কথা মনে হয়েছে তাঁর। কারও প্ররোচনায় বা প্রভাবে নয়, অন্তরের তাগিদেই তিনি আকৃষ্ট হয়েছেন সমাজসংস্কারের আন্দোলন বা আদর্শের প্রতি।
চল্লিশের দশকের প্রথম দিকে তিনি রেণু চক্রবর্তী নামের কমিউনিস্ট পার্টির এক নেত্রীর কাছে বাম আদর্শ এবং কমিউনিজম সম্পর্কে অনুশীলনে অংশ নিলেন। রেণু চক্রবর্তী ছিলেন স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী বিধান চন্দ্র রায়ের ভগিনী। বাম আদর্শের প্রতি বেগম নূরজাহান মুরশিদের এই আগ্রহ এবং বামপন্থী সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ততা থেকে বোঝা যায় যে তাঁর সামাজিক দায়বদ্ধতা কেবল মেয়েদের কল্যাণের জন্য নয়, নারী-পুরুষের এবং শ্রেণীনির্বিশেষে সবার উন্নতির জন্যই নিবেদিত হয়েছিল।
দেশ ভাগের আগেই তিনি চাকরির জগতে প্রবেশ করলেন। যে পেশা তিনি বেছে নিলেন, সেটি প্রধানত পুরুষদেরই কর্মস্থল বলে বিবেচিত ছিল। অল ইন্ডিয়া রেডিওতে তিনিই বোধ হয় প্রথম মুসলিম মহিলা চাকরিজীবী। তিনি চাকরিতে যোগ দিলেন এই শর্তে যে তাকে ঢাকায় নিয়োগ দেওয়া যাবে না, কেননা, ঢাকা তখন সাম্প্রদায়িক শহর হিসেবে চিহ্নিত। মেয়েদের স্কুলে অথবা কলেজে নয়, একেবারে পুরুষ পরিচালিত রেডিও অফিসে চাকরি নিয়ে বাঙালি মুসলমান নারী হিসেবে নূরজাহান মুরশিদ সেখানে একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকলেন। তাঁর এই দৃষ্টান্ত যে অন্যান্য শিক্ষিত মুসলমান মেয়ের কাছে অনুকরণীয় হয়েছে এবং পুরুষদের স্বীকৃতি অর্জনে সহায়ক হয়েছে তা অনুমান করা যায়।
দেশভাগের আগেই তাঁর মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতাও এসেছিল, যা পরবর্তীকালে ব্যবহারিকভাবে এটা ব্যক্ত হয়। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে এসে তিনি সেখানে একটি রাজনৈতিক পরিবেশ দেখতে পান। তাঁর শ্বশুর ছিলেন বেঙ্গল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলির সদস্য। সেই সুবাদে রাজনীতির অনেক বিষয় সম্পর্কে তিনি অবহিত হতে পেরেছেন এবং রাজনীতির প্রতি ধীরে ধীরে আকৃষ্ট হয়েছেন। স্বাধীনতার পর বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে মুসলিম লীগবিরোধী ‘যুক্তফ্রন্ট’ নামে যে মোর্চা গঠিত হয়, তার প্রার্থী হিসেবে তিনি নির্বাচনে জয়লাভ করেন। কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপে যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে দেওয়া হয় কিছুদিনের মধ্যেই। এ সময় ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ তাদের দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ কথাটি বাদ দিলে তিনি সেই দলের সদস্য হিসেবে যোগদান করেন। এরপর তিনি নিজে উদ্যোগ নিয়ে আওয়ামী মহিলা শাখা প্রতিষ্ঠা করেন।
তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন। তিনি প্রতিমন্ত্রী নিযুক্ত হয়েছিলেন। তার অনেক পর মতাদর্শের ভিন্নতার কারণে তিনি গণফোরাম নামে নবগঠিত এক রাজনৈতিক দলে যোগদান করেন এবং আমৃত্যু তার সদস্য ছিলেন।
সাধারণভাবে অর্থাৎ শ্রেণীনির্বিশেষে নারীর সমান অধিকার আদায় এবং ক্ষমতায়নের বিষয়টি পরিলক্ষিত হয়েছিল বলেই তিনি এদেশ-একাল নামে একটি পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে বৌদ্ধিক পর্যায়ে নারী আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে প্রয়াস পেয়েছিলেন। এটি দেশের প্রথম জেন্ডার-বিষয়ক পত্রিকা ছিল। এদেশ-একাল-এ নারীর প্রতি বৈষম্য, নারী নির্যাতন, নারীর ক্ষমতায়ন—এসব বিষয়ে গুরুত্ব পেয়েছে। এখানে বৃহত্তম পরিবেশে নারীর ক্ষমতায়নের বিষয় নিয়ে চিন্তাভাবনা করার এবং বক্তব্য রাখার প্রবণতা লক্ষণীয়। মৌলবাদীদের তৎপরতায় মেয়েদের পেছনে রাখার এবং কোথাও কোথাও নির্যাতনের যে লক্ষণ ও দৃষ্টান্ত দেখা গিয়েছে, তার বিরুদ্ধেও এসব লেখা সোচ্চার। তাঁর এদেশ-একাল পত্রিকা ছিল নয়া নারীবাদী আন্দোলনের মুখপাত্র এবং পত্রিকাটি জীবনমুখী ও ব্যবহারিক ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা করেছে। আগের মতো এ ক্ষেত্রেও তিনি পুরুষদের সহযোগিতা ও সমর্থন নিয়েই অগ্রসর হয়েছিলেন।
নূরজাহান মুরশিদ জাতীয় পর্যায়ে রাজনীতিতে সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন এবং গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি দীর্ঘ সময় অধ্যাপনার মতো বুদ্ধিবৃত্তিক পেশায় নিয়োজিত ছিলেন, যেখানে নারী-পুরুষের ভেদাভেদ নেই। তাঁকে বাঙালি মুসলমান নারীবাদী আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী একজন ব্যক্তিত্ব মনে করলে কি তাঁর ভূমিকা বা পরিস্থিতি ছোট করে দেখা হবে? জেন্ডারের দুই অংশের ভেতর সেতুবন্ধ তৈরি করতে চেয়েছিলেন বলে তাঁর সম্পর্কে এমন উপসংহারে আসার অবকাশ নেই। তিনি তাঁর নিজস্ব সময়ে, সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে, কাজের ভেতর এবং চিন্তার প্রকাশে, সমাজের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা পালন করতে পেরেছেন বলেই স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
সংক্ষিপ্তকৃত এই প্রবন্ধ নূরজাহান মুরশিদের নবম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে উৎসর্গ করা হলো
হাসনাত আবদুল হাই
কথাসাহিত্যিক

No comments

Powered by Blogger.