একজন দেশপ্রেমিক নূরজাহান মুরশিদ by সুকুমারী ভট্টাচার্য
নূরজাহানের সঙ্গে প্রথম দেখা হয় কলেজে ঢুকে, ১৯৩৮ সালে যখন আমরা দুজনে সবে ম্যাট্রিক পাস করে এসেছি। ও ইতিহাসের ছাত্রী ছিল, বিএ ক্লাসে। আমি সংস্কৃতের। চার বছরে আমাদের প্রধানত নানা বিষয়ে কমিটির মাধ্যমে যোগাযোগ ছিল; আমি লাইব্রেরি কমিটিতে ছিলাম ও ছিল স্পোর্টস কমিটিতে।
এমনিতে খেলাধুলায় ওর দক্ষতা ছিল, ভালো খেলত। প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরপুর ছিল নূরজাহান, সব সময় হাসিখুশি, রসিকতায় উজ্জ্বল; সেই চেহারাটা খুব স্পষ্ট মনে পড়ে। একবার কলেজে আমাদের ক্লাসে কী একটা উপলক্ষে ভোজ হয় কলকাতার কাছে কোথাও; হঠাৎ দেখা গেল মাথায় সাদা টুপি, পুরো বাবুর্চির সাজে নূরজাহান নীরবে পরিবেশন করছে। নিখুঁতভাবে পরিবেশন করে গেল হাসিমুখে শেষ পর্যন্ত; পরে আমরা কয়জন বসে ওকে খাওয়ালাম। ওর এই ধরনের পরিহাসপ্রিয়তা প্রায়ই দেখেছি।
দেশ ভাগের কিছু পরে ও স্থির করল, পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে যাবে। ও তখন পার্ক সার্কাসে মন্নুজান হল নামে একটি স্নাতকোত্তর ছাত্রীদের হোস্টেলে সুপারিনটেনডেন্ট ছিল। মুশকিলে পড়েছিল, ওই কাজটা থেকে কিভাবে মুক্তি পাবে। তখন আমারও খানিকটা আশ্রয়-সংকট ছিল, কর্মস্থল থেকে বাড়ি অনেক দূরে ছিল বলে আমাকে বলে ওই হোস্টেলের ভার নিতে। যত দূর মনে পড়ে, কোনো লেখাপড়া হয়নি এ জন্য; বা হয়ে থাকলেও একাই সেটা সামলেছিল। আমার তখন সুবিধা ছিল, তাই ওর কর্মভার নিলাম। কোনো টাকা পাইনি, শুধু দুটো ঘরের ছোট একটা ফ্ল্যাট চার তলার ওপরে এবং খাওয়ার ব্যবস্থা। এরই সঙ্গে নূরজাহান একটা দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিল, ওর ছোট বোন লতিফা, যে ব্রেবোর্ন কলেজে পড়ত ও কলেজ হোস্টেলে থাকত, তার লোকাল গার্ডিয়ান হওয়ার দায়িত্ব। মাঝে একবার লতিফা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ছিল, সেখানে ও একদিন জোর করে বলল যে ও সুস্থ হয়ে গেছে, ওকে হাসপাতাল থেকে নিয়ে যেতে। ওর চাপে নিজে রিস্ক বন্ড সই করে আমার ফ্ল্যাটে নিয়ে সুপথ্যের ব্যবস্থা করলাম। কয়দিন পর ও সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে হোস্টেলে ফিরে গেল। এই সামান্য ব্যাপারটায় নূরজাহান খুব কৃতজ্ঞতা জানাল। সে কথা মনে পড়ে। পরে নূরজাহানের বড় মেয়ের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল বেশ খানিকটা, ওকে আমার খুব ভালো লেগেছিল। এরপর যোগাযোগ ছিল না, ১৯৭১ সাল পর্যন্ত। তখন রাজনৈতিক পরিবেশ পূর্ব-পাকিস্তানে খুব উত্তপ্ত, তাই নূরজাহান আর ওর স্বামী সারওয়ার মুরশিদ আমাদের বাড়িতে কয়েক সপ্তাহ ছিল, ওদের ছেলেমেয়েরা কলকাতায়ই অন্যত্র ছিল। সেই সময় ও উদ্বাস্তু ক্যাম্পে মাঝেমধ্যে কাজ করত, ওর মুখে তার বিবরণ শুনতাম। রাজনৈতিক সমাধান হওয়ার পর ওরা ফিরে গেল। ও পার্লামেন্টের সদস্য ছিল কিছুদিন, কাজেই দায়িত্বপূর্ণ কাজেও ওর দক্ষতা ছিল, মন্ত্রীও হয়েছিল।
এরপর বহু দিন ওর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না। কয়েক বছর আগে আমি ১০ দিনের জন্য বাংলাদেশে গিয়েছিলাম, তখন আমার একটি বক্তৃতা সভায় আসেন সারওয়ার মুরশিদ সাহেব। তিনি আমাকে তাঁদের বাড়িতে নিয়ে যান। গিয়ে দেখি নূরজাহান বিছানায়, বেশ অসুস্থ, ক্ষীণবল, ক্ষীণকণ্ঠ। শুনলাম বেশ কিছুদিন ভুগছে, মনটা বড় খারাপ লাগল। ওর দুই নাতনি গান শোনাল, রবীন্দ্রসংগীত- অপূর্ব, যেমন সুরেলা কণ্ঠ, তেমনই আশ্চর্য নিখুঁত অনুশীলন। নূরজাহানের বিছানার পাশে বসে গাইল। সে-ই আমার সঙ্গে নূরজাহানের শেষ দেখা। এর কিছুদিন পর এক রাতে সারওয়ার মুরশিদ সাহেব ফোনে আমাকে জানালেন, নূরজাহান আর নেই। স্মৃতিচারণা করতে বসে যেটা প্রথমেই মনে আসে, সেটা ওর প্রাণ-প্রাচুর্য, চঞ্চল ও উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব এবং এ কারণেই ভীষণ ধাক্কা লাগে ভাবতে যে নূরজাহান আর নেই। খুব সাহসী ছিল, যেটা তখনকার মেয়েদের মধ্যে খুব বেশি দেখা যেত না। এক ধরনের বেপরোয়া ভাব ছিল, সেটাও মেয়েদের মধ্যে বিরল। সব মিলে একটি পূর্ণ চরিত্র, যার প্রাণচাঞ্চল্য আমাদের মুগ্ধ করেছিল। ওর স্মৃতির উদ্দেশে প্রীতি জানাই।
নূরজাহান মুরশিদ স্মৃতি পরিষদ থেকে প্রেরিত
দেশ ভাগের কিছু পরে ও স্থির করল, পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে যাবে। ও তখন পার্ক সার্কাসে মন্নুজান হল নামে একটি স্নাতকোত্তর ছাত্রীদের হোস্টেলে সুপারিনটেনডেন্ট ছিল। মুশকিলে পড়েছিল, ওই কাজটা থেকে কিভাবে মুক্তি পাবে। তখন আমারও খানিকটা আশ্রয়-সংকট ছিল, কর্মস্থল থেকে বাড়ি অনেক দূরে ছিল বলে আমাকে বলে ওই হোস্টেলের ভার নিতে। যত দূর মনে পড়ে, কোনো লেখাপড়া হয়নি এ জন্য; বা হয়ে থাকলেও একাই সেটা সামলেছিল। আমার তখন সুবিধা ছিল, তাই ওর কর্মভার নিলাম। কোনো টাকা পাইনি, শুধু দুটো ঘরের ছোট একটা ফ্ল্যাট চার তলার ওপরে এবং খাওয়ার ব্যবস্থা। এরই সঙ্গে নূরজাহান একটা দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিল, ওর ছোট বোন লতিফা, যে ব্রেবোর্ন কলেজে পড়ত ও কলেজ হোস্টেলে থাকত, তার লোকাল গার্ডিয়ান হওয়ার দায়িত্ব। মাঝে একবার লতিফা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ছিল, সেখানে ও একদিন জোর করে বলল যে ও সুস্থ হয়ে গেছে, ওকে হাসপাতাল থেকে নিয়ে যেতে। ওর চাপে নিজে রিস্ক বন্ড সই করে আমার ফ্ল্যাটে নিয়ে সুপথ্যের ব্যবস্থা করলাম। কয়দিন পর ও সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে হোস্টেলে ফিরে গেল। এই সামান্য ব্যাপারটায় নূরজাহান খুব কৃতজ্ঞতা জানাল। সে কথা মনে পড়ে। পরে নূরজাহানের বড় মেয়ের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল বেশ খানিকটা, ওকে আমার খুব ভালো লেগেছিল। এরপর যোগাযোগ ছিল না, ১৯৭১ সাল পর্যন্ত। তখন রাজনৈতিক পরিবেশ পূর্ব-পাকিস্তানে খুব উত্তপ্ত, তাই নূরজাহান আর ওর স্বামী সারওয়ার মুরশিদ আমাদের বাড়িতে কয়েক সপ্তাহ ছিল, ওদের ছেলেমেয়েরা কলকাতায়ই অন্যত্র ছিল। সেই সময় ও উদ্বাস্তু ক্যাম্পে মাঝেমধ্যে কাজ করত, ওর মুখে তার বিবরণ শুনতাম। রাজনৈতিক সমাধান হওয়ার পর ওরা ফিরে গেল। ও পার্লামেন্টের সদস্য ছিল কিছুদিন, কাজেই দায়িত্বপূর্ণ কাজেও ওর দক্ষতা ছিল, মন্ত্রীও হয়েছিল।
এরপর বহু দিন ওর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না। কয়েক বছর আগে আমি ১০ দিনের জন্য বাংলাদেশে গিয়েছিলাম, তখন আমার একটি বক্তৃতা সভায় আসেন সারওয়ার মুরশিদ সাহেব। তিনি আমাকে তাঁদের বাড়িতে নিয়ে যান। গিয়ে দেখি নূরজাহান বিছানায়, বেশ অসুস্থ, ক্ষীণবল, ক্ষীণকণ্ঠ। শুনলাম বেশ কিছুদিন ভুগছে, মনটা বড় খারাপ লাগল। ওর দুই নাতনি গান শোনাল, রবীন্দ্রসংগীত- অপূর্ব, যেমন সুরেলা কণ্ঠ, তেমনই আশ্চর্য নিখুঁত অনুশীলন। নূরজাহানের বিছানার পাশে বসে গাইল। সে-ই আমার সঙ্গে নূরজাহানের শেষ দেখা। এর কিছুদিন পর এক রাতে সারওয়ার মুরশিদ সাহেব ফোনে আমাকে জানালেন, নূরজাহান আর নেই। স্মৃতিচারণা করতে বসে যেটা প্রথমেই মনে আসে, সেটা ওর প্রাণ-প্রাচুর্য, চঞ্চল ও উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব এবং এ কারণেই ভীষণ ধাক্কা লাগে ভাবতে যে নূরজাহান আর নেই। খুব সাহসী ছিল, যেটা তখনকার মেয়েদের মধ্যে খুব বেশি দেখা যেত না। এক ধরনের বেপরোয়া ভাব ছিল, সেটাও মেয়েদের মধ্যে বিরল। সব মিলে একটি পূর্ণ চরিত্র, যার প্রাণচাঞ্চল্য আমাদের মুগ্ধ করেছিল। ওর স্মৃতির উদ্দেশে প্রীতি জানাই।
নূরজাহান মুরশিদ স্মৃতি পরিষদ থেকে প্রেরিত
No comments