বীর মুক্তিযোদ্ধা- তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
৪৯৮ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। শহীদ আবদুল মান্নান বীর বিক্রম বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন তিনি কুমিল্লা জেলার অন্তর্গত চৌদ্দগ্রাম। জেলা শহরের দক্ষিণে। চৌদ্দগ্রামের পূর্ব পাশে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্ত। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চৌদ্দগ্রামের ওপর দিয়ে।
এ সড়কের কিছু অংশ সীমান্তের খুব কাছ দিয়ে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এ সড়কে নিয়মিত টহল দিত। চৌদ্দগ্রাম-মিয়াবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে ছিল তাদের ক্যাম্প। মুক্তিযোদ্ধারা প্রায়ই সীমান্ত অতিক্রম করে টহল দলের ওপর বা ওই সব ক্যাম্পে আক্রমণ করতেন।
এরই ধারাবাহিকতায় অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি আবদুল মান্নানসহ মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল সীমান্ত অতিক্রম করে চৌদ্দগ্রামে অবস্থান নেয়। তাদের লক্ষ্য পাকিস্তানি সেনাদের ওপর অতর্কিতে আক্রমণ করা। চৌদ্দগ্রামে পৌঁছে মুক্তিযোদ্ধারা খবর পান, পাকিস্তানি সেনাদের একটি টহল দল কুমিল্লা থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক দিয়ে ফেনীর দিকে গেছে।
মুক্তিযোদ্ধারা সিদ্ধান্ত নেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর টহল দল যখন ফিরে আসবে, তখন তাঁরা আক্রমণ করবেন। ওই দলে সেনা কতজন, তাদের শক্তি কী—এ খবর তাঁরা পাননি। এর পরও মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করার দুঃসাহসী সিদ্ধান্ত নেন। এরপর আবদুল মান্নানসহ মুক্তিযোদ্ধারা দ্রুত অবস্থান নেন ওই সড়কের সদর উপজেলার অন্তর্গত হাজতখোলা (১৯৭১ সালে চৌদ্দগ্রামের অন্তর্গত) নামক স্থানে।
মুক্তিযোদ্ধাদের বেশির ভাগের কাছে হালকা অস্ত্র—স্টেনগান, রাইফেল ও কিছু হ্যান্ডগ্রেনেড। ভারী অস্ত্র বলতে একটি এলএমজি ও দু-তিনটি এসএমজি। তাই সম্বল করে তাঁরা সেখানে অপেক্ষায় থাকেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর টহল দলের জন্য। তারপর সময় গড়াতে থাকে। একসময় সেখানে উপস্থিত হয় পাকিস্তানি সেনাদের টহল দল। আবদুল মান্নান ও তাঁর সহযোদ্ধারা অতর্কিতে আক্রমণ করেন। আকস্মিক আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা হকচকিত। তবে নিমিষেই তারা পাল্টা আক্রমণ শুরু করে।
পাকিস্তানি সেনা সংখ্যায় ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের চেয়ে বেশি। অস্ত্রশস্ত্রও ছিল অত্যাধুনিক। একপর্যায়ে পাকিস্তানি সেনাদের পাল্টা আক্রমণের তীব্রতা আরও বেড়ে যায়। এ রকম পরিস্থিতিতে সম্মুখযুদ্ধ করা ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর থাকে না। আবদুল মান্নান ও তাঁর সহযোদ্ধারা এতে বিচলিত হননি। সাহসিকতার সঙ্গে আক্রমণ মোকাবিলা করেন। তাঁদের নির্ভুল গুলিবর্ষণে হতাহত হয় অনেক পাকিস্তানি সেনা।
এই সম্মুখযুদ্ধে শেষ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধারাই জয়ী হন। পাকিস্তানি সেনারা বিপুল ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে নিহত ও আহত সেনাদের নিয়ে কুমিল্লায় পালিয়ে যায়। কিন্তু যুদ্ধের একপর্যায়ে বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন আবদুল মান্নান। সহযোদ্ধারা তাঁকে উদ্ধার করার আগেই নিভে যায় তাঁর জীবনপ্রদীপ। যুদ্ধশেষে সহযোদ্ধারা তাঁর মরদেহ সমাহিত করেন পাশের মিজি বাড়িতে।
সহযোদ্ধারা তখন শহীদ আবদুল মান্নানের কবর চিহ্নিত করে রাখেন। স্বাধীনতার পর তাঁর স্ত্রী কবর দেখে আসেন। কিন্তু এখন সেই কবরের অস্তিত্ব আছে কি না তিনি জানেন না।
আবদুল মান্নান চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। ১৯৭১ সালের মার্চে ছুটিতে বাড়িতে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ শেষে ভারতে যান। পরে যুদ্ধ করেন ২ নম্বর সেক্টরে। কুমিল্লা জেলার বিভিন্ন স্থানে তিনি সাহসিকতা ও বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য শহীদ আবদুল মান্নানকে মরণোত্তর বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৭৯।
শহীদ আবদুল মান্নানের পৈতৃক বাড়ি কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর (ডাক কৃষ্ণপুর) উপজেলার সিদ্ধেশ্বরী গ্রামে। বিবাহিত ছিলেন। তাঁর বাবার নাম আলতাফ আলী, মা জোলেখা বেগম। স্ত্রী সোনাভান বিবি। তাঁদের এক মেয়ে। শহীদ আবদুল মান্নানের ছবি পাওয়া যায়নি।
শহীদ আবদুল মান্নানের স্ত্রী সোনাভান বিবি এখনো বেঁচে আছেন। তবে অসুস্থ। মেয়ের সঙ্গে থাকেন। মেয়ে নূরজাহান বেগমের বিয়ে হয়েছে একই গ্রামের সেলিমউদ্দিনের সঙ্গে। তিনি ক্ষুদ্র ব্যবসা করেন। সোনাভান বিবি জানান, যখন আবদুল মান্নান শহীদ হন, তখন তাঁর মেয়ের বয়স নয় মাস। স্বাধীনতার পর তাঁর ভাইয়েরা কয়েকবার তাঁকে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু স্বামীর বাড়ি ছেড়ে তিনি যাননি। অনেক দুঃখ-কষ্টের মধ্যে মেয়েকে বড় করে বিয়ে দিয়েছেন।
সূত্র: সেলিমউদ্দিন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ২।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
এরই ধারাবাহিকতায় অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি আবদুল মান্নানসহ মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল সীমান্ত অতিক্রম করে চৌদ্দগ্রামে অবস্থান নেয়। তাদের লক্ষ্য পাকিস্তানি সেনাদের ওপর অতর্কিতে আক্রমণ করা। চৌদ্দগ্রামে পৌঁছে মুক্তিযোদ্ধারা খবর পান, পাকিস্তানি সেনাদের একটি টহল দল কুমিল্লা থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক দিয়ে ফেনীর দিকে গেছে।
মুক্তিযোদ্ধারা সিদ্ধান্ত নেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর টহল দল যখন ফিরে আসবে, তখন তাঁরা আক্রমণ করবেন। ওই দলে সেনা কতজন, তাদের শক্তি কী—এ খবর তাঁরা পাননি। এর পরও মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করার দুঃসাহসী সিদ্ধান্ত নেন। এরপর আবদুল মান্নানসহ মুক্তিযোদ্ধারা দ্রুত অবস্থান নেন ওই সড়কের সদর উপজেলার অন্তর্গত হাজতখোলা (১৯৭১ সালে চৌদ্দগ্রামের অন্তর্গত) নামক স্থানে।
মুক্তিযোদ্ধাদের বেশির ভাগের কাছে হালকা অস্ত্র—স্টেনগান, রাইফেল ও কিছু হ্যান্ডগ্রেনেড। ভারী অস্ত্র বলতে একটি এলএমজি ও দু-তিনটি এসএমজি। তাই সম্বল করে তাঁরা সেখানে অপেক্ষায় থাকেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর টহল দলের জন্য। তারপর সময় গড়াতে থাকে। একসময় সেখানে উপস্থিত হয় পাকিস্তানি সেনাদের টহল দল। আবদুল মান্নান ও তাঁর সহযোদ্ধারা অতর্কিতে আক্রমণ করেন। আকস্মিক আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা হকচকিত। তবে নিমিষেই তারা পাল্টা আক্রমণ শুরু করে।
পাকিস্তানি সেনা সংখ্যায় ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের চেয়ে বেশি। অস্ত্রশস্ত্রও ছিল অত্যাধুনিক। একপর্যায়ে পাকিস্তানি সেনাদের পাল্টা আক্রমণের তীব্রতা আরও বেড়ে যায়। এ রকম পরিস্থিতিতে সম্মুখযুদ্ধ করা ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর থাকে না। আবদুল মান্নান ও তাঁর সহযোদ্ধারা এতে বিচলিত হননি। সাহসিকতার সঙ্গে আক্রমণ মোকাবিলা করেন। তাঁদের নির্ভুল গুলিবর্ষণে হতাহত হয় অনেক পাকিস্তানি সেনা।
এই সম্মুখযুদ্ধে শেষ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধারাই জয়ী হন। পাকিস্তানি সেনারা বিপুল ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে নিহত ও আহত সেনাদের নিয়ে কুমিল্লায় পালিয়ে যায়। কিন্তু যুদ্ধের একপর্যায়ে বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন আবদুল মান্নান। সহযোদ্ধারা তাঁকে উদ্ধার করার আগেই নিভে যায় তাঁর জীবনপ্রদীপ। যুদ্ধশেষে সহযোদ্ধারা তাঁর মরদেহ সমাহিত করেন পাশের মিজি বাড়িতে।
সহযোদ্ধারা তখন শহীদ আবদুল মান্নানের কবর চিহ্নিত করে রাখেন। স্বাধীনতার পর তাঁর স্ত্রী কবর দেখে আসেন। কিন্তু এখন সেই কবরের অস্তিত্ব আছে কি না তিনি জানেন না।
আবদুল মান্নান চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। ১৯৭১ সালের মার্চে ছুটিতে বাড়িতে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ শেষে ভারতে যান। পরে যুদ্ধ করেন ২ নম্বর সেক্টরে। কুমিল্লা জেলার বিভিন্ন স্থানে তিনি সাহসিকতা ও বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য শহীদ আবদুল মান্নানকে মরণোত্তর বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৭৯।
শহীদ আবদুল মান্নানের পৈতৃক বাড়ি কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর (ডাক কৃষ্ণপুর) উপজেলার সিদ্ধেশ্বরী গ্রামে। বিবাহিত ছিলেন। তাঁর বাবার নাম আলতাফ আলী, মা জোলেখা বেগম। স্ত্রী সোনাভান বিবি। তাঁদের এক মেয়ে। শহীদ আবদুল মান্নানের ছবি পাওয়া যায়নি।
শহীদ আবদুল মান্নানের স্ত্রী সোনাভান বিবি এখনো বেঁচে আছেন। তবে অসুস্থ। মেয়ের সঙ্গে থাকেন। মেয়ে নূরজাহান বেগমের বিয়ে হয়েছে একই গ্রামের সেলিমউদ্দিনের সঙ্গে। তিনি ক্ষুদ্র ব্যবসা করেন। সোনাভান বিবি জানান, যখন আবদুল মান্নান শহীদ হন, তখন তাঁর মেয়ের বয়স নয় মাস। স্বাধীনতার পর তাঁর ভাইয়েরা কয়েকবার তাঁকে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু স্বামীর বাড়ি ছেড়ে তিনি যাননি। অনেক দুঃখ-কষ্টের মধ্যে মেয়েকে বড় করে বিয়ে দিয়েছেন।
সূত্র: সেলিমউদ্দিন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ২।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
No comments