দেশীয় অর্থায়নে এখনই পদ্মা সেতু নির্মাণ শুরু করার প্রস্তাব- ১৪ উৎস থেকে চার বছরে ৯৮ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ সম্ভব ॥ ড. বারকাতের গবেষণা রিপোর্ট
পদ্মা সেতু নির্মাণের বিষয়টি এখন আর কোনও নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের দাবির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এটি এখন গণআকাক্সক্ষায় রূপান্তরিত হয়েছে দাবি করে অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাত সম্পূর্ণ দেশীয় অর্থায়নে এ মুহূর্তেই পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজ শুরু করার প্রস্তাব করেছেন।
একই সঙ্গে তিনি এই সেতু নির্মাণে সম্ভাব্য ২৪ হাজার কোটি টাকা যোগানোর বিপরীতে অর্থসংস্থানের ১৪টি সুনির্দিষ্ট উৎসের কথা বলেছেন, যেখান থেকে আগামী ৪ বছরে অর্থসংস্থান হতে পারে ৯৮ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা, যা দিয়ে শুধু একটি নয়, চারটি পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্ভব বলে তিনি দাবি করেছেন।
বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি কার্যালয়ে এ বিষয়ে আয়োজিত এক জাতীয় কর্মশালায় ‘নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু : জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ সুযোগ’ শীর্ষক ড. আবুল বারকাত ৪০ পৃষ্ঠার একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। ওই গবেষণা প্রতিবেদনে ড. বারকাত পদ্মা সেতু নির্মাণ ও এর সম্ভাব্য ব্যয় এবং অর্থসংস্থানের বিভিন্ন যৌক্তিক দিক তুলে ধরেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন ওই জাতীয় কর্মশালায় সভাপতিত্ব করেন। এতে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদও বক্তব্য রাখেন। কর্মশালায় ড. বারকাতের গবেষণা প্রতিবেদনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে এক ডজনেরও বেশি অর্থনীতিবিদ বক্তব্য রাখেন।
গবেষণা প্রতিবেদনের শুরুতেই ড. আবুল বারকাত বিশ্বব্যাংক কর্তৃক পদ্মা সেতুর ঋণচুক্তি বাতিল বাংলাদেশের জন্য এক মহাআশীর্বাদ বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ১৯৭২-৭৩ সালের বাংলাদেশের অর্থনীতি আর ২০১২’র অর্থনীতি এক নয়। এখন আমাদের অর্থনীতি অনেকগুণ বেশি শক্তিশালী। জনগণ অনেক বেশি আত্মশক্তি-আত্মমর্যাদাসম্পন্ন। পদ্মা সেতু নির্মাণে জনগণ এখন অনেক বেশি ত্যাগ স্বীকারে সর্বাত্মক প্রস্তুত। তাই জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি ও তা সুসংহতকরণের এখনই শ্রেষ্ঠ সময় বলে তিনি দাবি করেন।
ড. বারকাত বলেন, যেহেতু আগামী ৪ বছরে পদ্মা সেতু নির্মাণে ব্যয় হবে আনুমানিক ২৪ হাজার কোটি টাকা। আর ঠিক একই সময়ে ১৪টি বিভিন্ন সুনির্দিষ্ট উৎস থেকে সম্ভাব্য অর্থসংস্থান হতে পারে ৯৮ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা। তাই পদ্মা সেতু নির্মাণকাজ পরিকল্পিতভাবে এ মুহূর্তেই শুরু করা সম্ভব। তবে অর্থসংস্থানে বেশি নজর দিতে হবে সুদবিহীন উৎসসমূহে। যেসব উৎস থেকে সম্ভাব্য আহরণ হতে পারে ৪৯ হাজার ১৫০ কোটি টাকা অর্থাৎ ২টি পদ্মা সেতু নির্মাণ ব্যয়ের সমপরিমাণ অর্থ। সেই সঙ্গে তিনি নিজস্ব অর্থায়নে বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের সংশ্লিষ্ট খাতসমূহে, এক্ষেত্রে তিনি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি, প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থ হুন্ডিকৃত অর্থউত্তর অধিকহারে ব্যাংকিং চ্যানেলে আনা, ন্যূনতম ৮ থেকে ৩০ বছর মেয়াদী ‘পদ্মা সেতু বন্ড’ সার্বভৌম বন্ড ও পদ্মা সেতু আইপিওতে প্রবাসীদের বিনিয়োগে আগ্রহী করে তোলা, যা থেকে টাকার অঙ্কে উদ্বৃত্ত অর্থ ৭৪ হাজার ২২৫ কোটি টাকা উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করে রফতানি আয় বৃদ্ধি করা সম্ভব।
গবেষণা প্রতিবেদনে তিনি চার বছরে সম্ভাব্য আয়ের উৎস ও খাতভিত্তিক অর্থসংস্থানের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থ (উৎস বৈদেশিক) সম্ভব ৪ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা, পেনশন ফান্ড, ব্যাংক ব্যবস্থা ও বীমা কোম্পানি (দেশজ) ৩৪ হাজার ৯০০ কোটি টাকা, প্রবাসে অবস্থানরত (স্থায়ী/অস্থায়ী) বাংলাদেশীদের প্রবাসে সঞ্চিত অর্থের দেশে বিনিয়োগ (বৈদেশিক) ৫ হাজার কোটি টাকা, দেশের মধ্যে অপ্রদর্শিত আয় (দেশজ) সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা, এডিপির তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প এবং অব্যয়িত অংশ (দেশজ) ১৬ হাজার কোটি টাকা, তামাকজাত পণ্যের ওপর অতিরিক্ত কর (দেশজ) ১৮শ’ কোটি টাকা, ব্যক্তিগত আয়কর (যাদের বছরে কমপক্ষে ১ কোটি টাকা আয়কর দেবার কথা কিন্তু দেন না) (দেশজ) থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকা, কৃচ্ছ্রসাধন করে (দেশজ) ১ হাজার কোটি টাকা এবং লেভি, সারচার্জ ও আইপিওর মাধ্যমে (দেশজ) ৫ হাজার ৩শ’ কোটি টাকা যোগান সম্ভব বলে আবুল বারকাত মনে করেন।
তিনি বলেন, অর্থনৈতিক কূটনৈতিক ফলপ্রদতা বৃদ্ধির মাধ্যমে উন্নয়ন সহযোগী বিনিয়োগকারীদের থেকে সহজ শর্তে স্বল্প সুদে দীর্ঘমেয়াদী ঋণ সংগ্রহ করা এবং ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে অনুদান সংগ্রহ করা। এই ক্ষেত্রে তিনি তিনটি বিষয় গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় রাখতে তিনটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করার পরামর্শ দেন। একটি হচ্ছে সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ও বাস্তবায়ন সমন্বয়কারী কমিটি হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে পদ্মা সেতু ইন্টিগ্রিটি কমিটি। যার সঙ্গে থাকবে অর্থায়ন ও অর্থসংস্থান কমিটি এবং কারিগরি প্রযুক্তি। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, ‘পদ্মা সেতু পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি’ গঠন করে এর মাধ্যমে বাজারে আইপিও ছাড়া এবং তৃতীয়টি হচ্ছে, পদ্মা সেতু বৃহৎ অবকাঠামোর জন্য নির্মাণসামগ্রী (যন্ত্রপাতি, যন্ত্রাংশ, কাঁচামাল, উৎপাদন নিমিত্তে শিল্প স্থাপনে পদক্ষেপ গ্রহণ,
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে (দেশে-বিদেশে অবস্থানরত) হালনাগাদ তালিকা প্রণয়ন ও সংরক্ষণসহ জরুরী ভিত্তি একটি জীবন্ত ও রিয়েলটাইম ওয়েবসাইট চালু রাখা, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চেতনায় উদ্বুদ্ধ সংগঠন গড়ে তোলা, গণঅবহিতকরণ কার্যক্রমসহ সংশ্লিষ্ট প্রচার ব্যবস্থা শক্তিশালী করা। আবুল বারকাত তাঁর প্রবন্ধে বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণ ব্যয় ৩০ বছরেই উঠে আসবে। ১০ বছর থেকে ঘাটতি থাকবে না। তাই বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীতে আর তখন আলাদা বরাদ্দ রাখার প্রয়োজন হবে না। এছাড়া সেতু চালু হবার ৪০তম বছরে নীট ক্যাশ ফ্লো ১০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে, যা শততম বছরে ২ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। উন্নত কানেক্টিভিটি সমগ্র অর্থনীতির চেহারা আমূল পাল্টে দেবে। সুতরাং নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ বিষয়টি উন্নয়ন আন্দোলনের বিশ্বনন্দিত ‘মেড ইন বাংলাদেশ মডেল।’
তিনি বলেন, পদ্মা সেতুর জন্য বিশ্বব্যাংকের ঋণচুক্তি বাতিল আমাদের জন্য মহাআশীর্বাদ। এই বাংলাদেশকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর কঠিন বাস্তবতার সামনে দাঁড় করিয়েছে। সরকার পরিচালনাকারী নেতৃত্ব এবং উন্নয়ন নীতিনির্ধারক ও বাস্তবায়নকারী এই প্রথম এক বড়ধরনের ঝাঁকুনি খেলেন। এটা প্রয়োজনও ছিল। কারণ তাদের মানসকাঠামোর দারিদ্র্য অর্থাৎ নতজানু মানসিকতা, ভিক্ষুক মানসিকতা, অন্যায় মুখ বুজে সহ্য করার মানসিকতা এতই প্রকট যে স্ব-উদ্যোগে বড় কিছু করা সম্ভব এ বিশ্বাস প্রায় হারিয়ে গিয়েছিল।
আবুল বারকাত তাঁর প্রতিবেদনে বলেন, বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির কথা বলছে। কিন্তু অকাট্য প্রমাণ দিতে পারছে না। কোনও শ্বেতপত্রও প্রকাশ করছে না। এ অবস্থানের কারণে তিনি বিশ্বব্যাংকের স্বচ্ছতা নিয়ে কঠোর সমালোচনা করে বিশ্বব্যাংকেও দুর্নীতিবাজ বলতে দ্বিধা করেননি। এমনকি দেশীয় অর্থনীতিবিদ ও রাজনীতিবিদ যাঁরা বলছেন, বিশ্বব্যাংকের টাকা ছাড়া পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্ভব নয়, তাদের তিনি বিশ্বব্যাংকের দালাল ও নব্য রাজাকার বলেও অভিহিত করেছেন।
তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তি বাতিল করে পদ্মা সেতু নির্মাণকাজে ১৮ মাস পিছিয়ে দিয়েছে। এ কারণে সেতু নির্মাণে ব্যয়ও বেড়ে গেছে। পাশাপাশি সেতু থেকে আয়ও (মূলত যানবাহন চলাচলে টোল আদায়) পিছিয়ে গেছে। সময় প্রলম্বিত করার দায়ে এ সময়ে দৈনিক ১ কোটি ৭০ লাখ ৯৯ হাজার টাকা করে ১৮ মাসে সম্ভাব্য টোল আদায় হতে পারত ৫৮৩ কোটি ৯৪ লাখ টাকা, যা বিশ্বব্যাংককে ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্রদানের দাবি করেন তিনি।
সভাপতির বক্তব্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, আমাদের জাতীয় সঞ্চয় মোট জিডিপির ২৯ শতাংশ, বিনিয়োগ ২৪ শতাংশ। এ দুইয়ের মধ্যে গ্যাপ ৫ শতাংশ কোথায় যায় সেটি সরকার খুঁজে বের করতে পারে, যা পদ্মা সেতু নির্মাণে কাজে আসতে পারে।
ড. খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, আমরা নিজেদের অর্থায়নেই এ সেতুটি নির্মাণকাজ শুরু করতে পারি। কাজ শুরু হলেই অন্যান্য সহযোগী আমাদের পাশে দাঁড়াবে। তাই এক্ষেত্রে কালক্ষেপনের কোনও অর্থ হয় না। তবে তিনি আশঙ্কা করছেন, পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয় শেষ পর্যন্ত ২৪ হাজার কোটি টাকা থেকে বেড়ে গিয়ে ২৮-৩০ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়াতে পারে।
বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি কার্যালয়ে এ বিষয়ে আয়োজিত এক জাতীয় কর্মশালায় ‘নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু : জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ সুযোগ’ শীর্ষক ড. আবুল বারকাত ৪০ পৃষ্ঠার একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। ওই গবেষণা প্রতিবেদনে ড. বারকাত পদ্মা সেতু নির্মাণ ও এর সম্ভাব্য ব্যয় এবং অর্থসংস্থানের বিভিন্ন যৌক্তিক দিক তুলে ধরেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন ওই জাতীয় কর্মশালায় সভাপতিত্ব করেন। এতে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদও বক্তব্য রাখেন। কর্মশালায় ড. বারকাতের গবেষণা প্রতিবেদনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে এক ডজনেরও বেশি অর্থনীতিবিদ বক্তব্য রাখেন।
গবেষণা প্রতিবেদনের শুরুতেই ড. আবুল বারকাত বিশ্বব্যাংক কর্তৃক পদ্মা সেতুর ঋণচুক্তি বাতিল বাংলাদেশের জন্য এক মহাআশীর্বাদ বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ১৯৭২-৭৩ সালের বাংলাদেশের অর্থনীতি আর ২০১২’র অর্থনীতি এক নয়। এখন আমাদের অর্থনীতি অনেকগুণ বেশি শক্তিশালী। জনগণ অনেক বেশি আত্মশক্তি-আত্মমর্যাদাসম্পন্ন। পদ্মা সেতু নির্মাণে জনগণ এখন অনেক বেশি ত্যাগ স্বীকারে সর্বাত্মক প্রস্তুত। তাই জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি ও তা সুসংহতকরণের এখনই শ্রেষ্ঠ সময় বলে তিনি দাবি করেন।
ড. বারকাত বলেন, যেহেতু আগামী ৪ বছরে পদ্মা সেতু নির্মাণে ব্যয় হবে আনুমানিক ২৪ হাজার কোটি টাকা। আর ঠিক একই সময়ে ১৪টি বিভিন্ন সুনির্দিষ্ট উৎস থেকে সম্ভাব্য অর্থসংস্থান হতে পারে ৯৮ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা। তাই পদ্মা সেতু নির্মাণকাজ পরিকল্পিতভাবে এ মুহূর্তেই শুরু করা সম্ভব। তবে অর্থসংস্থানে বেশি নজর দিতে হবে সুদবিহীন উৎসসমূহে। যেসব উৎস থেকে সম্ভাব্য আহরণ হতে পারে ৪৯ হাজার ১৫০ কোটি টাকা অর্থাৎ ২টি পদ্মা সেতু নির্মাণ ব্যয়ের সমপরিমাণ অর্থ। সেই সঙ্গে তিনি নিজস্ব অর্থায়নে বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের সংশ্লিষ্ট খাতসমূহে, এক্ষেত্রে তিনি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি, প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থ হুন্ডিকৃত অর্থউত্তর অধিকহারে ব্যাংকিং চ্যানেলে আনা, ন্যূনতম ৮ থেকে ৩০ বছর মেয়াদী ‘পদ্মা সেতু বন্ড’ সার্বভৌম বন্ড ও পদ্মা সেতু আইপিওতে প্রবাসীদের বিনিয়োগে আগ্রহী করে তোলা, যা থেকে টাকার অঙ্কে উদ্বৃত্ত অর্থ ৭৪ হাজার ২২৫ কোটি টাকা উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করে রফতানি আয় বৃদ্ধি করা সম্ভব।
গবেষণা প্রতিবেদনে তিনি চার বছরে সম্ভাব্য আয়ের উৎস ও খাতভিত্তিক অর্থসংস্থানের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থ (উৎস বৈদেশিক) সম্ভব ৪ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা, পেনশন ফান্ড, ব্যাংক ব্যবস্থা ও বীমা কোম্পানি (দেশজ) ৩৪ হাজার ৯০০ কোটি টাকা, প্রবাসে অবস্থানরত (স্থায়ী/অস্থায়ী) বাংলাদেশীদের প্রবাসে সঞ্চিত অর্থের দেশে বিনিয়োগ (বৈদেশিক) ৫ হাজার কোটি টাকা, দেশের মধ্যে অপ্রদর্শিত আয় (দেশজ) সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা, এডিপির তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প এবং অব্যয়িত অংশ (দেশজ) ১৬ হাজার কোটি টাকা, তামাকজাত পণ্যের ওপর অতিরিক্ত কর (দেশজ) ১৮শ’ কোটি টাকা, ব্যক্তিগত আয়কর (যাদের বছরে কমপক্ষে ১ কোটি টাকা আয়কর দেবার কথা কিন্তু দেন না) (দেশজ) থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকা, কৃচ্ছ্রসাধন করে (দেশজ) ১ হাজার কোটি টাকা এবং লেভি, সারচার্জ ও আইপিওর মাধ্যমে (দেশজ) ৫ হাজার ৩শ’ কোটি টাকা যোগান সম্ভব বলে আবুল বারকাত মনে করেন।
তিনি বলেন, অর্থনৈতিক কূটনৈতিক ফলপ্রদতা বৃদ্ধির মাধ্যমে উন্নয়ন সহযোগী বিনিয়োগকারীদের থেকে সহজ শর্তে স্বল্প সুদে দীর্ঘমেয়াদী ঋণ সংগ্রহ করা এবং ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে অনুদান সংগ্রহ করা। এই ক্ষেত্রে তিনি তিনটি বিষয় গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় রাখতে তিনটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করার পরামর্শ দেন। একটি হচ্ছে সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ও বাস্তবায়ন সমন্বয়কারী কমিটি হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে পদ্মা সেতু ইন্টিগ্রিটি কমিটি। যার সঙ্গে থাকবে অর্থায়ন ও অর্থসংস্থান কমিটি এবং কারিগরি প্রযুক্তি। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, ‘পদ্মা সেতু পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি’ গঠন করে এর মাধ্যমে বাজারে আইপিও ছাড়া এবং তৃতীয়টি হচ্ছে, পদ্মা সেতু বৃহৎ অবকাঠামোর জন্য নির্মাণসামগ্রী (যন্ত্রপাতি, যন্ত্রাংশ, কাঁচামাল, উৎপাদন নিমিত্তে শিল্প স্থাপনে পদক্ষেপ গ্রহণ,
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে (দেশে-বিদেশে অবস্থানরত) হালনাগাদ তালিকা প্রণয়ন ও সংরক্ষণসহ জরুরী ভিত্তি একটি জীবন্ত ও রিয়েলটাইম ওয়েবসাইট চালু রাখা, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চেতনায় উদ্বুদ্ধ সংগঠন গড়ে তোলা, গণঅবহিতকরণ কার্যক্রমসহ সংশ্লিষ্ট প্রচার ব্যবস্থা শক্তিশালী করা। আবুল বারকাত তাঁর প্রবন্ধে বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণ ব্যয় ৩০ বছরেই উঠে আসবে। ১০ বছর থেকে ঘাটতি থাকবে না। তাই বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীতে আর তখন আলাদা বরাদ্দ রাখার প্রয়োজন হবে না। এছাড়া সেতু চালু হবার ৪০তম বছরে নীট ক্যাশ ফ্লো ১০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে, যা শততম বছরে ২ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। উন্নত কানেক্টিভিটি সমগ্র অর্থনীতির চেহারা আমূল পাল্টে দেবে। সুতরাং নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ বিষয়টি উন্নয়ন আন্দোলনের বিশ্বনন্দিত ‘মেড ইন বাংলাদেশ মডেল।’
তিনি বলেন, পদ্মা সেতুর জন্য বিশ্বব্যাংকের ঋণচুক্তি বাতিল আমাদের জন্য মহাআশীর্বাদ। এই বাংলাদেশকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর কঠিন বাস্তবতার সামনে দাঁড় করিয়েছে। সরকার পরিচালনাকারী নেতৃত্ব এবং উন্নয়ন নীতিনির্ধারক ও বাস্তবায়নকারী এই প্রথম এক বড়ধরনের ঝাঁকুনি খেলেন। এটা প্রয়োজনও ছিল। কারণ তাদের মানসকাঠামোর দারিদ্র্য অর্থাৎ নতজানু মানসিকতা, ভিক্ষুক মানসিকতা, অন্যায় মুখ বুজে সহ্য করার মানসিকতা এতই প্রকট যে স্ব-উদ্যোগে বড় কিছু করা সম্ভব এ বিশ্বাস প্রায় হারিয়ে গিয়েছিল।
আবুল বারকাত তাঁর প্রতিবেদনে বলেন, বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির কথা বলছে। কিন্তু অকাট্য প্রমাণ দিতে পারছে না। কোনও শ্বেতপত্রও প্রকাশ করছে না। এ অবস্থানের কারণে তিনি বিশ্বব্যাংকের স্বচ্ছতা নিয়ে কঠোর সমালোচনা করে বিশ্বব্যাংকেও দুর্নীতিবাজ বলতে দ্বিধা করেননি। এমনকি দেশীয় অর্থনীতিবিদ ও রাজনীতিবিদ যাঁরা বলছেন, বিশ্বব্যাংকের টাকা ছাড়া পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্ভব নয়, তাদের তিনি বিশ্বব্যাংকের দালাল ও নব্য রাজাকার বলেও অভিহিত করেছেন।
তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তি বাতিল করে পদ্মা সেতু নির্মাণকাজে ১৮ মাস পিছিয়ে দিয়েছে। এ কারণে সেতু নির্মাণে ব্যয়ও বেড়ে গেছে। পাশাপাশি সেতু থেকে আয়ও (মূলত যানবাহন চলাচলে টোল আদায়) পিছিয়ে গেছে। সময় প্রলম্বিত করার দায়ে এ সময়ে দৈনিক ১ কোটি ৭০ লাখ ৯৯ হাজার টাকা করে ১৮ মাসে সম্ভাব্য টোল আদায় হতে পারত ৫৮৩ কোটি ৯৪ লাখ টাকা, যা বিশ্বব্যাংককে ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্রদানের দাবি করেন তিনি।
সভাপতির বক্তব্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, আমাদের জাতীয় সঞ্চয় মোট জিডিপির ২৯ শতাংশ, বিনিয়োগ ২৪ শতাংশ। এ দুইয়ের মধ্যে গ্যাপ ৫ শতাংশ কোথায় যায় সেটি সরকার খুঁজে বের করতে পারে, যা পদ্মা সেতু নির্মাণে কাজে আসতে পারে।
ড. খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, আমরা নিজেদের অর্থায়নেই এ সেতুটি নির্মাণকাজ শুরু করতে পারি। কাজ শুরু হলেই অন্যান্য সহযোগী আমাদের পাশে দাঁড়াবে। তাই এক্ষেত্রে কালক্ষেপনের কোনও অর্থ হয় না। তবে তিনি আশঙ্কা করছেন, পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয় শেষ পর্যন্ত ২৪ হাজার কোটি টাকা থেকে বেড়ে গিয়ে ২৮-৩০ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়াতে পারে।
No comments