চউকের প্রকল্প- নগরবাসীর ভোগান্তি চরমে
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক) নির্দিষ্ট সময়ের দ্বিগুণ অতিরিক্ত সময়েও উন্নয়ন প্রকল্প শেষ করতে পারছে না। ফলে জনভোগান্তি চরমে উঠেছে। এরই প্রতিবাদস্বরূপ নগরবাসী ভোগান্তির শিখরে ওঠা সড়কে ধানের চারা লাগানোর মতো প্রতীকী প্রতিবাদ করেছে কিছুদিন আগে।
প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার ৩২টি প্রকল্পের উন্নয়নের খতিয়ান দেখিয়ে গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। এতে একদিকে বিতর্কিত হচ্ছে সরকার, অন্যদিকে প্রতারণার আশ্রয় নিচ্ছে কর্তৃপক্ষ। মূলত সঠিক তথ্য গোপন করে মনগড়া তথ্য দিয়ে নগরবাসীর কাছে সহযোগিতাও কামনা করার মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
অভিযোগ রয়েছে, চউক নির্দিষ্ট সময়ের চেয়ে অতিরিক্ত আরও এক বছরেও কোন প্রকল্প শেষ করতে পারছে না। প্রায় ২৩ কোটি ৮৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা ব্যয়ে কাপাসগোলা রোডের উন্নয়ন কাজ ২০১২ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও আগামী এক বছরের মধ্যে শেষ না হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। মুরাদপুর থেকে জিইসি মোড় পর্যন্ত ১৫০ কোটি ৭০ লাখ ৫৭ হাজার টাকা ব্যযে ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজ ২০১৩ সালের জুনে শেষ করার কথা দিয়ে শুরুই করতে পারেনি। প্রায় ৫৮ কোটি ৮৯ লাখ ৯১ হাজার টাকা ব্যয়ে কদমতলী ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজ ২০১০ সালের জুনে শুরুর কথা থাকলেও তা শুরু করা হয়েছে চলতি বছরের জুনে। ২০১৩ সালের জুনে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ২০১৪ সালেও তা শেষ হবে কিনা তা অনিশ্চিত। ৫৬ কোটি ৫৫ লাখ ৫২ হাজার টাকা ব্যয়ে হাটহাজারী সড়কের উন্নয়ন কাজ ২০১৩ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা অনিশ্চয়তার মুখে রয়েছে। প্রায় ৪০ কোটি ৩৮ লাখ ৯০ হাজার টাকা ব্যয়ে পাঠানটুলী রোডের উন্নয়ন কাজ চলতি বছরের জুনে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও আগামী এক বছরে শেষ হয় কিনা সন্দেহ রয়েছে।
এদিকে, বাকলিয়ার কল্পলোক আবাসিক এলাকার দ্বিতীয় পর্যায়ের উন্নয়ন কাজ দীর্ঘ আট বছর ধরে চলমান থাকা প্রকল্প আগামী দুই বছরেও শেষ হবে না বলে প্লট মালিকরা শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। বিপণিবিতান বি-ব্লকের দশতলা বাণিজ্যিক ভবন প্রায় ৪৫ কোটি ৩৯ লাখ ৪২ হাজার টাকা ব্যয়ে চলমান নির্মাণ কাজ দীর্ঘ আট বছরেরও বেশি সময় অতিবাহিতের পরও শেষ হয়নি। কাজিরদেউরি কাঁচাবাজার ও এ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স ৪৪ কোটি ৩১ লাখ ৬১ হাজার টাকায় চলতি বছরের ডিসেম্বরে নির্মাণ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও অনিশ্চয়তায় রয়েছে সমাপ্তি নিয়ে। মেহেদীবাগ আবাসিক এলাকায় চউক কর্মকর্তাদের জন্য ১৮ কোটি ৩ লাখ ৮৪ হাজার টাকা ব্যয়ে চলতি বছরের জুনে ফ্ল্যাট নির্মাণ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা রয়েছে চরম অনিশ্চয়তায়। চলতি বছরের ডিসেম্বরে বহদ্দারহাট জংশন ফ্লাইওভার নির্মাণ প্রকল্প ১০৬ কোটি ১৬ লাখ ৭৮ হাজার টাকা ব্যয়ে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও গার্ডার ভেঙ্গে পড়ে নগরবাসীর মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। ফলে ব্যবহারকারীরা এর ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কিত রয়েছেন। যদিও এটি চট্টগ্রামের সর্বপ্রথম ফ্লাইওভার। প্রথম ফ্লাইওভারে প্রজেক্ট ডাইরেক্টর প্রকৌশলী হাবিবুর রহমানের চরম অনিয়ম, দুর্নীতি ও ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি এবং অব্যবস্থাপনা এ ফ্লাইওভারটিকে মৃত্যুকূপে পরিণত করেছে। প্রায় ৬৮১ কোটি ১১ লাখ ১৮ হাজার টাকা ব্যয়ে চিটাগাং সিটি আউটার রিং রোড ২০১১ সাল থেকে ১৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাস্তবায়নের কথা বলা হলেও চউকের পক্ষ থেকে দু’ বছর পিছিয়ে ২০১৬ সালে বাস্তবায়নের কথা বলা হচ্ছে। নগরীর নাসিরাবাদে ১৯৬টি ফ্ল্যাটের ৩টি বহুতল ভবনের আদলে সিডিএ স্কয়ার নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ১৫৩ কোটি ১৯ লাখ ৪৩ হাজার টাকা। এ প্রকল্পটি ২০১৩ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা নির্মাণে আরও দুই বছর অতিরিক্ত সময় লাগার সম্ভাবনা রয়েছে।
চউকের পক্ষ থেকে জানা গেছে, নগরব্যাপী ৩২ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে নগরবাসী ছাড়াও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ, চট্টগ্রাম ওয়াসা, বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ড, কর্ণফুলী গ্যাস, বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন লিমিটেড ও বাংলাদেশ রেলওয়ের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে। ভুয়া তথ্য দিয়ে এ ধরনের গণবিজ্ঞপ্তি প্রচার করায় নগরবাসীর মাঝে ক্ষোভের সঞ্চার করেছে। সমাপ্ত প্রকল্প হিসেবে দেখানো হয়েছে নগরীর আন্দরকিল্লা সংলগ্ন সিরাজুদ্দৌলা রোডের উন্নয়ন, সদরঘাট ও ফিরিঙ্গীবাজার রোডের উন্নয়ন, ডিটি রোড থেকে বায়েজিদ বোস্তামী পর্যন্ত সংযোগ সড়ক, বায়েজিদ বোস্তামী রোডের উন্নয়ন, সাগরিকা রোডের উন্নয়ন, আন্দরকিল্লা মোড় থেকে লালদীঘির পাড় পর্যন্ত সড়কের উন্নয়ন, সিডিএ পাবলিক কলেজ নির্মাণ ও কালুরঘাট শিল্প নগরীর রাস্তার উন্নয়ন।
চলমান কাজের মধ্যে দেখানো হয়েছে গনি বেকারী থেকে চকবাজার পর্যন্ত সড়কের উন্নয়ন, অলি খাঁ মসজিদ থেকে কাপাসগোলা পর্যন্ত সড়কের উন্নয়ন, অলি খাঁ মসজিদ থেকে মুরাদপুর পর্যন্ত সড়কের উন্নয়ন, মুরাদপুর থেকে অক্সিজেন পর্যন্ত সড়কের উন্নয়ন, অক্সিজেন থেকে কুয়াইশ পর্যন্ত সড়কের উন্নয়ন, আরাকান সড়কের উন্নয়ন ও পাঠানটুলী সড়কের উন্নয়ন কাজ চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হওয়ার আশ্বাস দেয়া হয়েছে নগরবাসীকে। এছাড়াও চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে চউক বিপণিবিতান বি- ব্লকের নির্মাণ প্রকল্প সম্পন্নের কথা বলা হয়েছে।
এদিকে, কদমতলী ফ্লাইওভার নির্মাণ, বহদ্দারহাট ফ্লাইওভার নির্মাণ, কমার্স কলেজ সড়কের উন্নয়ন, কর্ণফুলী বাজার, এক্সেস রোডের উন্নয়ন, দেওয়ানহাট থেকে অলংকার মোড় পর্যন্ত সড়কের উন্নয়ন, দেওয়ানহাট ওভারব্রিজ নির্মাণ, অনন্যা আবাসিক এলাকার উন্নয়ন, কাজিরদেউরি কাঁচাবাজার এ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স নির্মাণ, মোহরাতে সিডিএ গার্লস কলেজ নির্মাণ, সল্টগোলায় গার্মেন্টস নারী শ্রমিকদের ডরমেটরি নির্মাণ, সল্টগোলা বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ, মেহেদিবাগ সিডিএ অফিসার্স কোয়ার্টার নির্মাণ, চট্টগ্রাম সরকারী কলেজের অবকাঠামো নির্মাণ, প্যারেড মাঠ সংস্কার ও উন্নয়ন প্রকল্প আগামী ২০১৩ সালের জুন থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হওয়ার নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে নাগরবাসীকে। তবে নাসিরাবাদে সিডিএ স্কয়ার বা ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্প আগামী ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে শেষ করার কথা বলা হয়েছে। এছাড়াও চিটাগাং আউটার রিং রোড নির্মাণ প্রকল্প ২০১৪ সালের জুনে শুরু হয়ে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে শেষ করার কথা জানানো হয়েছে চউকের পক্ষ থেকে।
এ ব্যাপারে নির্দিষ্ট সময়ে নির্মাণ না হওয়া ও প্রকল্পের কাজ শুরু না হওয়া কয়েক প্রজেক্ট ডাইরেক্টর অভিযোগ করেছেন, চউকের অসাধু কর্মকর্তারা ঠিকাদারদের সঙ্গে অর্থ বাণিজ্যে মেতে ওঠায় প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হতে দীর্ঘ সময় ব্যয় হচ্ছে। এছাড়াও বেশকিছু প্রকল্প বিশেষ করে ফ্লাইওভার নির্মাণে নিযুক্ত প্রজেক্ট ডাইরেক্টররা ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগসাজশ করে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ চউকে জমা পড়লেও তা ফাইলবন্দী হয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি বহদ্দারহাট ফ্লাইওভারের একটি গার্ডার ভেঙ্গে পড়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে গঠিত তদন্ত কমিটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে কয়েকটি পরামর্শ দিয়ে প্রজেক্ট ডাইরেক্টরকে রক্ষা করেছে। যেখানে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে চট্টগ্রামের উন্নয়নে বহদ্দারহাট ফ্লাইওভার নির্মাণ প্রকল্প সুচারুরূপে করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল তাও মানতে নারাজ চউকের কর্মকর্তারা।
Ñমাকসুদ আহমদ, চট্টগ্রাম
No comments