কালো হীরের কথা by তৌফিক অপু
ছোট্ট একটি ছেলের কথায় বেশ বিব্রত বোধ করলেন স্কুল শিক্ষিকা। কিছুতেই ছেলেটির নাম বোধগম্য হচ্ছিল না। শিক্ষিকা আবার জিজ্ঞেস করলেন কি নাম তোমার? ছেলেটির সহজ সরল উত্তর আমার নাম ‘রোলিহলাহলা’। শিক্ষিকা বুঝতে পারলেন আদিবাসী নাম এটা। তিনি বললেন, এ নাম আমার পছন্দ নয়। তোমার ক্রিশ্চান নাম থাকতে হবে।
ঠিক আছে, তোমার নাম আজ থেকে নেলসন। সেই থেকে বিশ্ব মানবতার মুক্তি ও স্বাধীনতার প্রতীক নেলসন ম্যান্ডেলা। মানব প্রেমেই যার ধর্ম। পুরোদস্তুর একজন মানব প্রেমিক। জীবনভর সংগ্রাম করেছেন মানুষের মুক্তির জন্য। আফ্রিকার মহান এই মুক্তি সংগ্রামী নেতা ১৮ জুলাই পা রেখেছেন ৯৪ বছরে। দীর্ঘ এ জীবনে বহু চড়াই-উৎরাই পাড়ি দিয়ে অধিষ্ঠিত হয়েছেন বিশ্ব রাষ্ট্রনায়কের মর্যাদায়। প্রায় ২৮ বছরের জেল আর নির্বাসন তাকে এক মুহূর্তের জন্য আদর্শচ্যুত করতে পারেনি।
একজন মানুষ নিজেকে কতটা উচ্চতায় মেলে ধরতে পারলে সর্বজন সমাদৃত হন। এ ব্যাপারে পিটার গাব্রি যথার্থই বলেছেন,
“ওভ ঃযব ড়িৎষফ পড়ঁষফ ড়হষু যধাব
ড়হব ভধঃযবৎ, ঃযব সধহ ঃযধঃ বি
ড়িঁষফ পযড়ড়ংব ঃড় নব ড়ঁৎ ভধঃযবৎ,
ড়িঁষফ নব হবষংড়হ গধহফবষধ ... ”
“যদি এ বিশ্বে কোন একজন বিশ্বপিতা থাকত, তবে আমরা আমাদের পিতা হিসেবে যে মানুষটিকে বেছে নিতাম তিনি নেলসন ম্যান্ডেলা।”
১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই জন্মগ্রহণ করা ম্যান্ডেলার আসল নাম রোলিহলাহলা মাডিক দালিবুংগা ম্যান্ডেলা। সেই স্কুল শিক্ষিকার দেয়া নাম নেলসন ম্যান্ডেলা নামেই আজ বিশ্বব্যাপী পরিচিত।
তাঁর বাবা হেনরি ম্যান্ডেলার ছিল চারজন স্ত্রী। তৃতীয় স্ত্রী নোসিকেনির সন্তান হলেন নেলসন ম্যান্ডেলা। হেনরি ম্যান্ডেলা ছিলেন থেমবু উপজাতির গোত্র প্রধান। জোসা (ীযড়ংধ) হচ্ছে এ উপজাতির নিজস্ব ভাষা। নেলসন ম্যান্ডেলা অনেকটা বাবার আদর্শেই প্রভাবিত ছিলেন। বাবা হেনরি ম্যান্ডেলা সাদা চামড়ার ম্যাজিস্ট্রেটের অন্যায় নির্দেশ প্রায়ই অমান্য করতেন। যে কারণে তাকে পরিকল্পিতভাবে গোত্র প্রধানের পদ থেকে অপসারণ করা হয়। ভূমিস্বত্ব বিলোপ আইন করে কালো চামড়াদের থেকে ভূমি ক্রোক করা হয়। সে আইনের শিকার ম্যান্ডেলার বাবাও হন। আস্তে আস্তে এমনভাবে তাদের কোণঠাসা করা হয় যার ফলে হেনরি বাপ-দাদার ভিটা ভেজো ছেড়ে কুনু নামের গ্রামে চলে যেতে বাধ্য হন।
পাহাড় পর্বত বেষ্টিত দক্ষিণ আফ্রিকার ছোট্ট একটি গ্রামের নাম এম ভেজো। জোহানেসবার্গ থেকে গ্রামটির দূরত্ব ৫০০ কিমি.। প্রথম মহাযুদ্ধ মাত্র শেষ হয়েছে ঠিক সে সময় এ গ্রামে জন্ম নেন নেলসন ম্যান্ডেলা। দক্ষিণ আফ্রিকাজুড়ে বর্ণবাদের শিকড় উপড়ে ফেলে শত শত বছরের ব্রিটিশ রাজত্বের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলা দক্ষিণ আফ্রিকার ন্যাশনাল কংগ্রেস (এএনসি) পার্টির বয়স তখন মাত্র ৬ বছর। পুরো দক্ষিণ আফ্রিকাজুড়ে বর্ণবাদের রেষারেষি যখন তুঙ্গে ঠিক তখনই সে পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে ম্যান্ডেলার বেড়ে ওঠা। স্কুল জীবনের সূত্রপাত। সেখানেও বর্ণবৈষম্য। পরবর্তী সময়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য হিলটাউন শহরের কাছাকাছি ফোর্ট হেয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এখানে তিনি মুখোমুখি হন কৃষ্ণাঙ্গ ছাত্রদের নানাবিধ সমস্যার সঙ্গে। কালোদের নিম্নমানের খাবার সরবরাহ, থাকার অযোগ্য পরিবেশে সীট ব্যবস্থাÑ সব মিলিয়ে ছাত্রদের মধ্যে এক ধরনের বিক্ষোভ কাজ করত। ম্যান্ডেলা এসব সমস্যা গভীরে ঢোকার চেষ্টা করতেন। তিনি ইউরোপের ইতিহাস, ঔপনিবেশিক শাসন, আফ্রিকার ভৌগোলিক অবস্থান এবং বিভিন্ন গোত্রের ভাষা সম্পর্কে জানার জন্য স্টাডি শুরু করেন। এ সময়টায় তাঁর সঙ্গে পরিচয় ঘটে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস পার্টির বড় বড় নেতার সঙ্গে। পার্টির মতবাদে একাত্মতা প্রকাশ করে সক্রিয় হন ছাত্র আন্দোলনে। এ কারণে ১৯৪০ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির মাত্র এক বছরের মাথায় তিনি বহিষ্কৃত হন। পরের বছর তিনি জোহানেসবার্গ চলে আসেন। এখানে কোর্স সমাপ্ত করে ১৯৪২ সালে ব্যাচেলর ডিগ্রী অর্জন করেন। পরবর্তীতে উইটওয়াটার স্ট্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন শাস্ত্রে অধ্যয়ন শুরু করেন। এ সময়টায় তিনি আরও বেশি সক্রিয় হন রাজনীতিতে। ন্যাশনাল কংগ্রেস পার্টির ব্যানারে প্রতিষ্ঠা করেন ইয়ুথ লীগ। ১৯৪৪ সালে সংগঠনটি যাত্রা শুরু করে। ১৯৫১ সালে তিনি ইয়ুথ লীগের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পান।
জোহানেসবার্গ ম্যান্ডেলার রাজনীতিতে জড়িত হওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখে। স্বর্ণখনির শহর জোহানেসবার্গ। এখানে বিভিন্ন জায়গা থেকে কালো চামড়ার শ্রমিকরা কাজ করতে আসে। সে সময় তিনি প্রত্যক্ষ করেন শ্রমিক বৈষম্য। তথাকথিত সাদা চামড়ার ভদ্রলোকদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে কৃষ্ণাঙ্গরা। গত শতাব্দীর ৫০ দশকের শুরুতেই শ্বেতাঙ্গ সরকারের বর্ণ বৈষম্যমূলক নীপিড়নের বিরুদ্ধে এএনসি অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে। ক্রমেই এ আন্দোলন প্রবল আকার ধারণ করতে থাকে। আন্দোলনের নেতৃত্বে বড় শহরগুলোতে বিশেষ করে জোহানেসবার্গে প্রাধান্য পায়। অন্যদিকে সরকার আন্দোলন দমনে নানা রকম পন্থা অবলম্বন করে। এক সময় এএনসি নিষিদ্ধ ঘোষণার উপক্রম হয়। কিন্তু ম্যান্ডেলা বসে ছিলেন না। তিনি কৃষ্ণাঙ্গদের অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোকে একত্রিত করার উদ্যোগ নেন। যে কারণে বর্ণ বৈষম্যমূলক আন্দোলনের গতি বৃদ্ধি পায়। সে সময়ে ম্যান্ডেলার বিভিন্ন প্ল্যান এবং দিকনির্দেশনাকে তার নামের প্রথম আদ্যাক্ষর নিয়ে এম প্ল্যান নাম দেয়া হয়।
১৯৬০ সালে এএনসির পাশাপাশি আরেক বর্ণবাদবিরোধী জাতীয়তাবাদী দল প্যান আফ্রিকানিস্ট কংগ্রেস আরও কঠোর কর্মসূচী ঘোষণা করে। তারা পরিচয়পত্র নিয়ে আন্দোলন করে। কারণ তখন কৃষ্ণাঙ্গদের এই পরিচয়পত্র দেয়া হতো শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় অবস্থান করার জন্য। অনেকটা পাশের মতো। নির্দিষ্ট অঞ্চলের বাইরে তারা চলাফেরা করতে পারত না। প্রতিবাদ গড়ে উঠেছিল পরিচয়পত্রের বিরুদ্ধে। এ আন্দোলন চলাকালে শাসক শ্রেণী কঠোরভাবে আন্দোলন দমনে নেমে পড়ে। ১৯৬০ সালের ২১ মার্চ শার্পভিল শহরে পুলিশ বর্বোরোচিত এক হত্যাকা- চালায় বিক্ষোভকারী জনতার ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করা হয়। এতে নিহত হয় ৬৯ জন এবং আহত হয় প্রায় দু’শ’ জন। এ হত্যাকা- আন্দোলনের গতিকে আরও বাড়িয়ে দেয়। পুরো দক্ষিণ আফ্রিকাজুড়ে উঠে প্রতিবাদের ঝড়। এ সময় সরকার জরুরী অবস্থা জারি করে। গ্রেফতার করা হয় এএনসি এবং প্যানের বহু সদস্যকে। সেই সঙ্গে নিষিদ্ধ ঘোষিত হয় দল দুটো।
ম্যান্ডেলা এবং আরও অনেক প্রশিক্ষিত সহযোদ্ধা দক্ষিণ আফ্রিকার সর্বত্র সশস্ত্র গেরিলা সংগ্রাম ছড়িয়ে দেয়ার প্রয়াস নেন। ম্যান্ডেলাকে ছদ্মবেশে দাড়ি রেখে গোপনে সশস্ত্র নেতৃত্ব দিতে হয়েছিল। প্রতিরোধ যখন জোরদার হচ্ছে তখন ১৯৬২ সালের আগস্ট মাসে ম্যান্ডেলা গ্রেফতার হন। এর আগেও তিনি কারাবরণ করেছেন। কিন্তু এবার দেশদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত হন। তাকে চিহ্নিত করা হয় একজন সন্ত্রাসী হিসেবে। গ্রেফতারের পর ম্যান্ডেলা আফ্রিকার ইতিহাসকে স্মরণ করে আদিবাসী জোশা যোদ্ধাদের বাঘের চামড়ার পোশাক পরে আদালতে উপস্থিত হন। সেখানে দাঁড়িয়ে তিনি উদ্ভূত পরিস্থিতির ভবিষ্যত বর্ণনা করেন। তিনি জোড় দাবি করেন, “আমি একদিন নির্দোষ প্রমাণিত হবো। ভবিষ্যত প্রজন্মই বলবে আমি যে নির্দোষ। আর বর্তমান সরকারই দোষী প্রমাণিত হবে।” তার এ কথাগুলো তিন যুগ যুগ পরে হলেও সত্য প্রমাণিত হয়। বিচার চলাকালে ম্যান্ডেলার মানব মুক্তির ডাক সারা বিশ্বকে আলোড়িত করে। দেশে দেশে বর্ণবিদ্বেষীদের বিরুদ্ধে মুক্তিকামীদের অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করে। তার বিরুদ্ধে আনীত দেশদ্রোহিতার মামলার রায়ে তাকে যেন মৃত্যুদ- দেয়া না হয় সে ব্যাপারে বিশ্বমত গঠিত হয়। দীর্ঘদিন বিচার চলার পর ১৯৬৪ সালের জুন মাসে বিচারের রায়ে নেলসন ম্যান্ডেলাকে দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদ- দেয়া হয়। রবেন আইল্যান্ডের নির্জন কারাগারে তার এ বন্দীজীবন কাটাতে হয়। মোট ২৭ বছর কারাভোগের মধ্যে ১৮ বছরই নির্জন সেলে বন্দী ছিলেন। সময়ের আবর্তনে দেশের অভ্যন্তরের শক্তিশালী প্রতিরোধ এবং আন্তর্জাতিক চাপে ১৯৯০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ সরকারের প্রেসিডেন্ট এফ ডব্লিউ ডিক্লার্ক আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন। আলোচনা এবং সমঝোতার মাধ্যমে সে বছরই ফেব্রুয়ারির ১১ তারিখে নেলসন ম্যান্ডেলা কারাগার থেকে মুক্ত হন। দক্ষিণ আফ্রিকায় সে সময়টা ছিল ৪০০ বছরের সংখ্যালঘু সাদা চামড়ার অত্যাচার থেকে কালো চামড়ার মানুষের মুক্তি।
ম্যান্ডেলার মুক্তির পর আলোচনার প্রাথমিক পর্যায়ে শ্বেতাঙ্গ সরকার ৩টি শর্ত দেয়। এক এএনসিকে সশস্ত্র সংগ্রাম পরিহার করতে হবে। দুই কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে। তিন সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার গঠনের দাবি প্রত্যাহার করতে হবে। ম্যান্ডেলা সেসব শর্ত না মানার পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেন। এক. কৃষ্ণাঙ্গদের ক্ষমতার অংশীদারিত্বের দাবি না মানা পর্যন্ত সশস্ত্র সংগ্রাম চলবে। দুই. এএনসি কোন কমিউনিস্ট নিয়ন্ত্রিত দল নয়। জনগণের সপক্ষে কাজ করে এমন যে কোন দল আমাদের বন্ধু। আর বন্ধুর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা নিশ্চয়ই কোন মর্যাদাকর কাজ নয়। তিন. সব ধরনের হানাহানি এবং বিদ্বেষ পরিহারের অন্যতম উপায় হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন ব্যবস্থা মেনে নেয়া। তার এ দাবি গণদাবিতে পরিণত হয়। দাবি উঠে ভোটাভুটির মাধ্যমে নির্বাচন সম্পন্ন করার। ২৭ এপ্রিল ১৯৯৪-এ বর্ণবাদ জাতিভেদহীন প্রথম অবাধ নির্বাচনে নেলসন ম্যান্ডেলা বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ম্যান্ডেলার প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন ব্যবস্থা যেন শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে ভীতি সঞ্চার না করে। মানুষের মধ্যকার অতিমানবীয় গুণাবলী মানুষকে স্মরণীয় করে তোলে। ১৯৯৬ সালে ম্যান্ডেলার জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও তিনি ঘোষণা দেন দ্বিতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নেবেন না। অনেক অনুরোধ উপেক্ষ করে তিনি তার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। পরবর্তীতে দ্বিতীয় কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এমবেকি। ১৯৯৯-এ নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয়।
ম্যান্ডেলা এক সময় জনসম্মুখে আসতে পছন্দ করতেন। যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কয়েকটি দেশের আমন্ত্রণে বিভিন্ন টকশোতে অংশ নেন তিনি। কিন্তু গত চার বছর ধরে তার জন্মস্থান কানুতেই সময় কাটাচ্ছেন তিনি। এর মধ্যে অসুস্থ হয়ে বেশ কয়েকবার হাসপাতালেও ভর্তি হয়েছেন তিনি। ম্যান্ডেলার জন্মদিনে ভাল কাজে উদ্বুদ্ধ করতে প্রতিবছর বিভিন্ন সংগঠন নানাবিধ কর্মসূচী গ্রহণ করে। ২০০৯ সালে জাতিসংঘ ১৮ জুলাইকে আন্তর্জাতিক ম্যান্ডেলা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। তিনি ৬৭ বছর বয়স পর্যন্ত রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। সেটিকে স্মরণ রাখতে ম্যান্ডেলা সেন্টার অব মেমোরি দেশবাসীকে ৬৭ মিনিট জনহিতকর কাজে উৎসর্গ করার আহ্বান জানিয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষের জন্য ম্যান্ডেলা যে ত্যাগের পরিচয় দিয়েছেন তা বিরল ঘটনা। তার আদর্শকে বাঁচিয়া রাখাই দক্ষিণ আফ্রিকার জনগণের জন্য এখন বড় কাজ।
তিনি সাদা এবং কালোকে একই ছাতার নিচে নিয়ে আসতে পেরেছিলেন। যে আফ্রিকা ছিল বর্ণবাদের অভয়ারণ্য সেই আফ্রিকা এখন পরিণত হয়েছে সম্প্রীতির জনপদে। তার এই রাজনৈতিক বিচক্ষণতা তাকে মুক্তিকামী সংগ্রামের নেতার পাশাপাশি দক্ষ জনপ্রশাসকের পরিচয়ে পরিচিত করেছে। মানুষের জন্য যার মন কাঁদে সে কি কখনও চুপ করে বসে থাকতে পারে? তাই তো এই বয়সেও তিনি এইচআইভি/এইডসের বিরুদ্ধে কাজ করে যাচ্ছেন। এ লক্ষ্যে ২০০৭ সালে গঠন করেনে এন্ডার্স নামক একটি সংগঠন।
বিংশ শতাব্দী জুড়ে পৃথিবীতে একের পর এক দেশ স্বাধীনতা লাভ করেছে। মানুষ ফিরে পেয়েছে তাদের অধিকার। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকাকে ম্যান্ডেলা যেভাবে সব রকম দুর্যোগ থেকে রক্ষা করেছেন তার দ্বিতীয় আরেকটি উদাহরণ পৃথিবীতে নেই। তার এই সফলতা শুধুমাত্র রাজনৈতিক বিচক্ষণতার মাধ্যমে আসেনি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অতিমানবীয় গুণাবলী চরিত্রের সরলতা এবং সত্যের প্রতি অটল থাকার মানসিকতা তাকে নিয়ে গেছে অন্য এক উচ্চতায়। ঠাঁই পেয়েছেন মানুষের মণিকোঠায়। এ পৃথিবীতে বর্তমানে নির্ভরযোগ্য রাজনৈতিক ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন একটি কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এককভাবে গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার মতো নেতা এখন আর দেখা যায় না। সেলসন ম্যান্ডেলা আমাদের কাছে এসেছেন আপামর গ্রহণযোগ্য একজন ব্যক্তি হিসেবে। তার ৯৪তম জন্মদিনে তাকে জানাই প্রাণঢালা শুভেচ্ছা। যুগে যুগে নেলসন ম্যান্ডেলার মতো মানুষের প্রয়োজন রয়েছে পৃথিবীতে। তার দীর্ঘায়ু কামনা করছি।
একজন মানুষ নিজেকে কতটা উচ্চতায় মেলে ধরতে পারলে সর্বজন সমাদৃত হন। এ ব্যাপারে পিটার গাব্রি যথার্থই বলেছেন,
“ওভ ঃযব ড়িৎষফ পড়ঁষফ ড়হষু যধাব
ড়হব ভধঃযবৎ, ঃযব সধহ ঃযধঃ বি
ড়িঁষফ পযড়ড়ংব ঃড় নব ড়ঁৎ ভধঃযবৎ,
ড়িঁষফ নব হবষংড়হ গধহফবষধ ... ”
“যদি এ বিশ্বে কোন একজন বিশ্বপিতা থাকত, তবে আমরা আমাদের পিতা হিসেবে যে মানুষটিকে বেছে নিতাম তিনি নেলসন ম্যান্ডেলা।”
১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই জন্মগ্রহণ করা ম্যান্ডেলার আসল নাম রোলিহলাহলা মাডিক দালিবুংগা ম্যান্ডেলা। সেই স্কুল শিক্ষিকার দেয়া নাম নেলসন ম্যান্ডেলা নামেই আজ বিশ্বব্যাপী পরিচিত।
তাঁর বাবা হেনরি ম্যান্ডেলার ছিল চারজন স্ত্রী। তৃতীয় স্ত্রী নোসিকেনির সন্তান হলেন নেলসন ম্যান্ডেলা। হেনরি ম্যান্ডেলা ছিলেন থেমবু উপজাতির গোত্র প্রধান। জোসা (ীযড়ংধ) হচ্ছে এ উপজাতির নিজস্ব ভাষা। নেলসন ম্যান্ডেলা অনেকটা বাবার আদর্শেই প্রভাবিত ছিলেন। বাবা হেনরি ম্যান্ডেলা সাদা চামড়ার ম্যাজিস্ট্রেটের অন্যায় নির্দেশ প্রায়ই অমান্য করতেন। যে কারণে তাকে পরিকল্পিতভাবে গোত্র প্রধানের পদ থেকে অপসারণ করা হয়। ভূমিস্বত্ব বিলোপ আইন করে কালো চামড়াদের থেকে ভূমি ক্রোক করা হয়। সে আইনের শিকার ম্যান্ডেলার বাবাও হন। আস্তে আস্তে এমনভাবে তাদের কোণঠাসা করা হয় যার ফলে হেনরি বাপ-দাদার ভিটা ভেজো ছেড়ে কুনু নামের গ্রামে চলে যেতে বাধ্য হন।
পাহাড় পর্বত বেষ্টিত দক্ষিণ আফ্রিকার ছোট্ট একটি গ্রামের নাম এম ভেজো। জোহানেসবার্গ থেকে গ্রামটির দূরত্ব ৫০০ কিমি.। প্রথম মহাযুদ্ধ মাত্র শেষ হয়েছে ঠিক সে সময় এ গ্রামে জন্ম নেন নেলসন ম্যান্ডেলা। দক্ষিণ আফ্রিকাজুড়ে বর্ণবাদের শিকড় উপড়ে ফেলে শত শত বছরের ব্রিটিশ রাজত্বের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলা দক্ষিণ আফ্রিকার ন্যাশনাল কংগ্রেস (এএনসি) পার্টির বয়স তখন মাত্র ৬ বছর। পুরো দক্ষিণ আফ্রিকাজুড়ে বর্ণবাদের রেষারেষি যখন তুঙ্গে ঠিক তখনই সে পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে ম্যান্ডেলার বেড়ে ওঠা। স্কুল জীবনের সূত্রপাত। সেখানেও বর্ণবৈষম্য। পরবর্তী সময়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য হিলটাউন শহরের কাছাকাছি ফোর্ট হেয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এখানে তিনি মুখোমুখি হন কৃষ্ণাঙ্গ ছাত্রদের নানাবিধ সমস্যার সঙ্গে। কালোদের নিম্নমানের খাবার সরবরাহ, থাকার অযোগ্য পরিবেশে সীট ব্যবস্থাÑ সব মিলিয়ে ছাত্রদের মধ্যে এক ধরনের বিক্ষোভ কাজ করত। ম্যান্ডেলা এসব সমস্যা গভীরে ঢোকার চেষ্টা করতেন। তিনি ইউরোপের ইতিহাস, ঔপনিবেশিক শাসন, আফ্রিকার ভৌগোলিক অবস্থান এবং বিভিন্ন গোত্রের ভাষা সম্পর্কে জানার জন্য স্টাডি শুরু করেন। এ সময়টায় তাঁর সঙ্গে পরিচয় ঘটে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস পার্টির বড় বড় নেতার সঙ্গে। পার্টির মতবাদে একাত্মতা প্রকাশ করে সক্রিয় হন ছাত্র আন্দোলনে। এ কারণে ১৯৪০ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির মাত্র এক বছরের মাথায় তিনি বহিষ্কৃত হন। পরের বছর তিনি জোহানেসবার্গ চলে আসেন। এখানে কোর্স সমাপ্ত করে ১৯৪২ সালে ব্যাচেলর ডিগ্রী অর্জন করেন। পরবর্তীতে উইটওয়াটার স্ট্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন শাস্ত্রে অধ্যয়ন শুরু করেন। এ সময়টায় তিনি আরও বেশি সক্রিয় হন রাজনীতিতে। ন্যাশনাল কংগ্রেস পার্টির ব্যানারে প্রতিষ্ঠা করেন ইয়ুথ লীগ। ১৯৪৪ সালে সংগঠনটি যাত্রা শুরু করে। ১৯৫১ সালে তিনি ইয়ুথ লীগের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পান।
জোহানেসবার্গ ম্যান্ডেলার রাজনীতিতে জড়িত হওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখে। স্বর্ণখনির শহর জোহানেসবার্গ। এখানে বিভিন্ন জায়গা থেকে কালো চামড়ার শ্রমিকরা কাজ করতে আসে। সে সময় তিনি প্রত্যক্ষ করেন শ্রমিক বৈষম্য। তথাকথিত সাদা চামড়ার ভদ্রলোকদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে কৃষ্ণাঙ্গরা। গত শতাব্দীর ৫০ দশকের শুরুতেই শ্বেতাঙ্গ সরকারের বর্ণ বৈষম্যমূলক নীপিড়নের বিরুদ্ধে এএনসি অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে। ক্রমেই এ আন্দোলন প্রবল আকার ধারণ করতে থাকে। আন্দোলনের নেতৃত্বে বড় শহরগুলোতে বিশেষ করে জোহানেসবার্গে প্রাধান্য পায়। অন্যদিকে সরকার আন্দোলন দমনে নানা রকম পন্থা অবলম্বন করে। এক সময় এএনসি নিষিদ্ধ ঘোষণার উপক্রম হয়। কিন্তু ম্যান্ডেলা বসে ছিলেন না। তিনি কৃষ্ণাঙ্গদের অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোকে একত্রিত করার উদ্যোগ নেন। যে কারণে বর্ণ বৈষম্যমূলক আন্দোলনের গতি বৃদ্ধি পায়। সে সময়ে ম্যান্ডেলার বিভিন্ন প্ল্যান এবং দিকনির্দেশনাকে তার নামের প্রথম আদ্যাক্ষর নিয়ে এম প্ল্যান নাম দেয়া হয়।
১৯৬০ সালে এএনসির পাশাপাশি আরেক বর্ণবাদবিরোধী জাতীয়তাবাদী দল প্যান আফ্রিকানিস্ট কংগ্রেস আরও কঠোর কর্মসূচী ঘোষণা করে। তারা পরিচয়পত্র নিয়ে আন্দোলন করে। কারণ তখন কৃষ্ণাঙ্গদের এই পরিচয়পত্র দেয়া হতো শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় অবস্থান করার জন্য। অনেকটা পাশের মতো। নির্দিষ্ট অঞ্চলের বাইরে তারা চলাফেরা করতে পারত না। প্রতিবাদ গড়ে উঠেছিল পরিচয়পত্রের বিরুদ্ধে। এ আন্দোলন চলাকালে শাসক শ্রেণী কঠোরভাবে আন্দোলন দমনে নেমে পড়ে। ১৯৬০ সালের ২১ মার্চ শার্পভিল শহরে পুলিশ বর্বোরোচিত এক হত্যাকা- চালায় বিক্ষোভকারী জনতার ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করা হয়। এতে নিহত হয় ৬৯ জন এবং আহত হয় প্রায় দু’শ’ জন। এ হত্যাকা- আন্দোলনের গতিকে আরও বাড়িয়ে দেয়। পুরো দক্ষিণ আফ্রিকাজুড়ে উঠে প্রতিবাদের ঝড়। এ সময় সরকার জরুরী অবস্থা জারি করে। গ্রেফতার করা হয় এএনসি এবং প্যানের বহু সদস্যকে। সেই সঙ্গে নিষিদ্ধ ঘোষিত হয় দল দুটো।
ম্যান্ডেলা এবং আরও অনেক প্রশিক্ষিত সহযোদ্ধা দক্ষিণ আফ্রিকার সর্বত্র সশস্ত্র গেরিলা সংগ্রাম ছড়িয়ে দেয়ার প্রয়াস নেন। ম্যান্ডেলাকে ছদ্মবেশে দাড়ি রেখে গোপনে সশস্ত্র নেতৃত্ব দিতে হয়েছিল। প্রতিরোধ যখন জোরদার হচ্ছে তখন ১৯৬২ সালের আগস্ট মাসে ম্যান্ডেলা গ্রেফতার হন। এর আগেও তিনি কারাবরণ করেছেন। কিন্তু এবার দেশদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত হন। তাকে চিহ্নিত করা হয় একজন সন্ত্রাসী হিসেবে। গ্রেফতারের পর ম্যান্ডেলা আফ্রিকার ইতিহাসকে স্মরণ করে আদিবাসী জোশা যোদ্ধাদের বাঘের চামড়ার পোশাক পরে আদালতে উপস্থিত হন। সেখানে দাঁড়িয়ে তিনি উদ্ভূত পরিস্থিতির ভবিষ্যত বর্ণনা করেন। তিনি জোড় দাবি করেন, “আমি একদিন নির্দোষ প্রমাণিত হবো। ভবিষ্যত প্রজন্মই বলবে আমি যে নির্দোষ। আর বর্তমান সরকারই দোষী প্রমাণিত হবে।” তার এ কথাগুলো তিন যুগ যুগ পরে হলেও সত্য প্রমাণিত হয়। বিচার চলাকালে ম্যান্ডেলার মানব মুক্তির ডাক সারা বিশ্বকে আলোড়িত করে। দেশে দেশে বর্ণবিদ্বেষীদের বিরুদ্ধে মুক্তিকামীদের অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করে। তার বিরুদ্ধে আনীত দেশদ্রোহিতার মামলার রায়ে তাকে যেন মৃত্যুদ- দেয়া না হয় সে ব্যাপারে বিশ্বমত গঠিত হয়। দীর্ঘদিন বিচার চলার পর ১৯৬৪ সালের জুন মাসে বিচারের রায়ে নেলসন ম্যান্ডেলাকে দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদ- দেয়া হয়। রবেন আইল্যান্ডের নির্জন কারাগারে তার এ বন্দীজীবন কাটাতে হয়। মোট ২৭ বছর কারাভোগের মধ্যে ১৮ বছরই নির্জন সেলে বন্দী ছিলেন। সময়ের আবর্তনে দেশের অভ্যন্তরের শক্তিশালী প্রতিরোধ এবং আন্তর্জাতিক চাপে ১৯৯০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ সরকারের প্রেসিডেন্ট এফ ডব্লিউ ডিক্লার্ক আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন। আলোচনা এবং সমঝোতার মাধ্যমে সে বছরই ফেব্রুয়ারির ১১ তারিখে নেলসন ম্যান্ডেলা কারাগার থেকে মুক্ত হন। দক্ষিণ আফ্রিকায় সে সময়টা ছিল ৪০০ বছরের সংখ্যালঘু সাদা চামড়ার অত্যাচার থেকে কালো চামড়ার মানুষের মুক্তি।
ম্যান্ডেলার মুক্তির পর আলোচনার প্রাথমিক পর্যায়ে শ্বেতাঙ্গ সরকার ৩টি শর্ত দেয়। এক এএনসিকে সশস্ত্র সংগ্রাম পরিহার করতে হবে। দুই কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে। তিন সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার গঠনের দাবি প্রত্যাহার করতে হবে। ম্যান্ডেলা সেসব শর্ত না মানার পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেন। এক. কৃষ্ণাঙ্গদের ক্ষমতার অংশীদারিত্বের দাবি না মানা পর্যন্ত সশস্ত্র সংগ্রাম চলবে। দুই. এএনসি কোন কমিউনিস্ট নিয়ন্ত্রিত দল নয়। জনগণের সপক্ষে কাজ করে এমন যে কোন দল আমাদের বন্ধু। আর বন্ধুর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা নিশ্চয়ই কোন মর্যাদাকর কাজ নয়। তিন. সব ধরনের হানাহানি এবং বিদ্বেষ পরিহারের অন্যতম উপায় হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন ব্যবস্থা মেনে নেয়া। তার এ দাবি গণদাবিতে পরিণত হয়। দাবি উঠে ভোটাভুটির মাধ্যমে নির্বাচন সম্পন্ন করার। ২৭ এপ্রিল ১৯৯৪-এ বর্ণবাদ জাতিভেদহীন প্রথম অবাধ নির্বাচনে নেলসন ম্যান্ডেলা বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ম্যান্ডেলার প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন ব্যবস্থা যেন শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে ভীতি সঞ্চার না করে। মানুষের মধ্যকার অতিমানবীয় গুণাবলী মানুষকে স্মরণীয় করে তোলে। ১৯৯৬ সালে ম্যান্ডেলার জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও তিনি ঘোষণা দেন দ্বিতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নেবেন না। অনেক অনুরোধ উপেক্ষ করে তিনি তার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। পরবর্তীতে দ্বিতীয় কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এমবেকি। ১৯৯৯-এ নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয়।
ম্যান্ডেলা এক সময় জনসম্মুখে আসতে পছন্দ করতেন। যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কয়েকটি দেশের আমন্ত্রণে বিভিন্ন টকশোতে অংশ নেন তিনি। কিন্তু গত চার বছর ধরে তার জন্মস্থান কানুতেই সময় কাটাচ্ছেন তিনি। এর মধ্যে অসুস্থ হয়ে বেশ কয়েকবার হাসপাতালেও ভর্তি হয়েছেন তিনি। ম্যান্ডেলার জন্মদিনে ভাল কাজে উদ্বুদ্ধ করতে প্রতিবছর বিভিন্ন সংগঠন নানাবিধ কর্মসূচী গ্রহণ করে। ২০০৯ সালে জাতিসংঘ ১৮ জুলাইকে আন্তর্জাতিক ম্যান্ডেলা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। তিনি ৬৭ বছর বয়স পর্যন্ত রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। সেটিকে স্মরণ রাখতে ম্যান্ডেলা সেন্টার অব মেমোরি দেশবাসীকে ৬৭ মিনিট জনহিতকর কাজে উৎসর্গ করার আহ্বান জানিয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষের জন্য ম্যান্ডেলা যে ত্যাগের পরিচয় দিয়েছেন তা বিরল ঘটনা। তার আদর্শকে বাঁচিয়া রাখাই দক্ষিণ আফ্রিকার জনগণের জন্য এখন বড় কাজ।
তিনি সাদা এবং কালোকে একই ছাতার নিচে নিয়ে আসতে পেরেছিলেন। যে আফ্রিকা ছিল বর্ণবাদের অভয়ারণ্য সেই আফ্রিকা এখন পরিণত হয়েছে সম্প্রীতির জনপদে। তার এই রাজনৈতিক বিচক্ষণতা তাকে মুক্তিকামী সংগ্রামের নেতার পাশাপাশি দক্ষ জনপ্রশাসকের পরিচয়ে পরিচিত করেছে। মানুষের জন্য যার মন কাঁদে সে কি কখনও চুপ করে বসে থাকতে পারে? তাই তো এই বয়সেও তিনি এইচআইভি/এইডসের বিরুদ্ধে কাজ করে যাচ্ছেন। এ লক্ষ্যে ২০০৭ সালে গঠন করেনে এন্ডার্স নামক একটি সংগঠন।
বিংশ শতাব্দী জুড়ে পৃথিবীতে একের পর এক দেশ স্বাধীনতা লাভ করেছে। মানুষ ফিরে পেয়েছে তাদের অধিকার। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকাকে ম্যান্ডেলা যেভাবে সব রকম দুর্যোগ থেকে রক্ষা করেছেন তার দ্বিতীয় আরেকটি উদাহরণ পৃথিবীতে নেই। তার এই সফলতা শুধুমাত্র রাজনৈতিক বিচক্ষণতার মাধ্যমে আসেনি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অতিমানবীয় গুণাবলী চরিত্রের সরলতা এবং সত্যের প্রতি অটল থাকার মানসিকতা তাকে নিয়ে গেছে অন্য এক উচ্চতায়। ঠাঁই পেয়েছেন মানুষের মণিকোঠায়। এ পৃথিবীতে বর্তমানে নির্ভরযোগ্য রাজনৈতিক ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন একটি কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এককভাবে গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার মতো নেতা এখন আর দেখা যায় না। সেলসন ম্যান্ডেলা আমাদের কাছে এসেছেন আপামর গ্রহণযোগ্য একজন ব্যক্তি হিসেবে। তার ৯৪তম জন্মদিনে তাকে জানাই প্রাণঢালা শুভেচ্ছা। যুগে যুগে নেলসন ম্যান্ডেলার মতো মানুষের প্রয়োজন রয়েছে পৃথিবীতে। তার দীর্ঘায়ু কামনা করছি।
No comments