শিক্ষাই আমায় মুক্তি দেবে by মোঃ আরিফুর রহমান
বেগম রোকেয়া সাখাওয়াতকে বাঙালী নারী জাগরণ ও বাঙালী নারীকে শিক্ষার সুযোগদানের পথিকৃৎ বলা হয়। তাঁর ঐকান্তিক চেষ্টার মধ্য দিয়েই বাঙালী নারী গৃহের চার দেয়ালের বন্দী জীবনের নাগপাশ থেকে মুক্তি পাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করে। আর তাদের মধ্যে এই ইচ্ছার বীজ রোপিত হয় শিক্ষার মধ্য দিয়েই।
বেগম রোকেয়া মেয়েদের শিক্ষার জন্য নিরলস চেষ্টা করে গেছেন। যার ফলশ্রুতিতে নারীরাও শিক্ষার অধিকার লাভ করে। কালের পরিক্রমায় এখন নারীও পুরুষের সমান শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে। সরকার নারী শিক্ষার প্রসারের জন্য বিভিন্ন সময় নানা রকম উপবৃত্তিসহ আনুষঙ্গিক অনেক সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে। এর প্রমাণ আমরা দেখি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছেলেদের থেকেও বেশি পরিমাণে ছাত্রী ভর্তি হচ্ছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে ছাত্রছাত্রীর আনুপাতিক হার প্রায় সমান। এমনকি উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রেও নারী-পুরুষ সমান সুযোগ লাভ করছে। নারীরা শিক্ষার সুযোগ লাভ করায় তারা বাংলাদেশের সর্বক্ষেত্রেই তাদের যোগ্যতার প্রমাণ রাখতে সক্ষম হচ্ছে।
সরকারী চাকরি, বেসরকারি চাকরি, গবেষণাসহ সকল ক্ষেত্রেই নারী পুরুষের সমকক্ষ হতে সক্ষম হয়েছে। এমনকি রাজনীতিতেও নারী এখন পুরুষের মতো সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য নারীকে অবহেলা করার আর কোন সুযোগেই নেই। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর করার মাধ্যমে এবং সংবিধানের কারণে বাংলাদেশ সরকারও নারীর সমান অধিকারের নিশ্চয়তা দেয়ার জন্য আইনগতভাবে বাধ্য। সে অনুযায়ী শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রজনন, ব্যবসায় সর্বোপরি নারীর ক্ষমতায়নের জন্য সরকার চেষ্টা করে যাচ্ছে। তবু কিছু সমস্যা এখনও পরিলক্ষিত হয়। জেন্ডার বৈষম্য, জেন্ডার অন্ধতা, জেন্ডার অজ্ঞতা এমনি নানা বিষয় থেকে নারীকে উত্তরণের জন্য প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে শিক্ষাকে। একমাত্র শিক্ষাই পারে সমাজে সচেতনতা সৃষ্টি করতে, পারে দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোভাবের ইতিবাচক পরিবর্তন করতে। নব্বইয়ের দশক থেকে উপমহাদেশে নারী শিক্ষা প্রসারের জন্য ‘মীনা’ কার্টুন, প্রচার শুরু হয়। এতে মেয়ে শিশুর শিক্ষার গুরুত্ব সমাজের সবার কাছে তুলে ধরা হয়। এই কার্টুনের থিম সং-এ বলায় হয়Ñ
‘শিক্ষা আমায় মুক্তি দিবে।’ অর্থাৎ নারীর ক্ষমতায়ন ও নারীর অধিকার বাস্তবায়নের অন্যতম হাতিয়ার হলো শিক্ষা। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও তারা অবদমিত হচ্ছে যা নারী শিক্ষার প্রসারের ক্ষেত্রে অনেক বড় বাধা।
ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা ও সংস্কার নারীর মধ্যে হীনম্মন্যতা সৃষ্টি করে। নারীর প্রতি বৈষম্য শুরু হয় নিজ পরিবার থেকে এবং শেষ পর্যন্ত তা রাষ্ট্রে গিয়ে পৌঁছে। সমাজ নারীর মধ্যে নারীসুলভ ত্রুটির ধারণা এমন বদ্ধমূল করে দেয় যে, নারী নিজেকে অনেক সময়ই পুরুষের তুলনায় দৈহিক ও মানসিক দিক দিয়ে দুর্বল, কম মেধাসম্পন্ন ও সামর্থ্যহীন ভাবতে শেখে যা তাকে পুরুষের ওপর নির্ভরশীল করে দেয়। আমাদের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাও এ ক্ষেত্রে অনেকটাই দায়ী। এ শিক্ষা ব্যবস্থার কাঠামোও কিছু কিছু ক্ষেত্রে নারীকে অবমূল্যায়ন করে থাকে। অনেক শিক্ষকই দাবি করেন যে তাঁরা ছেলে ও মেয়েদের প্রতি সমআচরণ প্রর্দশন করেন কিন্তু বাস্তবে তাদের মনোভাবে সূক্ষ্ম পক্ষপাতিত্ব লক্ষ্য করা যায়। মেয়েদের তুলনায় ছেলেরা সমালোচনা, প্রশংসা ও গঠনমূলক ফলাবর্তনের মাধ্যমে শিক্ষকদের কাছ থেকে অনেক বেশি ইন্টারেকশনের সুযোগ পায় এবং শ্রেণীকক্ষে শিখন-শেখানো কার্যাবলীতে তাদের অংশগ্রহণও বেশি। কম্বাইন্ড স্কুলগুলোতে দেখা যায়, মেয়েদের তুলনায় ছেলেরা পঠন-পাঠন প্রক্রিয়ায় বেশি অংশগ্রহণ করে থাকে। যেখানে মেয়েদের স্কুলে মেয়েরা ঠিকই সক্রিয় অংশগ্রহণ করে সেখানে কম্বাইন্ড স্কুলে তারা তা করতে পারে না। এর কারণ কি? এর কারণ হচ্ছে শ্রেণীকক্ষে উন্মুক্ত আলোচনার পরিবেশে ছেলেদেরই প্রাধান্য দেয়া হয়। হয়ত শিক্ষকরা বুঝতেই পারেন না যে তারা ছাত্রীদের অবমূল্যায়ন করছে। আবার সহপাঠী ছেলেদের মানসিকতাও এর জন্য অনেকটা দায়ী।
অনেক বিদ্যালয়ে ছাত্রীদের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে হয়। অনেক বিদ্যালয়ে শিক্ষক, কর্মচারী ও সহপাঠীদের দ্বারা শারীরিক ও মানসিক সহিংসতার খবরও প্রায়ই পত্রিকার পাতায় দেখা যায়। যৌন নির্যাতন ও হয়রানির শিকার আমাদের দেশের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। যা পুরো বাঙালী জাতির জন্য লজ্জাকর আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই ঘটনাগুলো পুরো জাতির নৈতিকতা, বিবেকবোধ নিয়ে প্রশ্ন জাগিয়ে তোলে। কেননা শিক্ষাই জাতির মেরুদ-। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পবিত্র অঙ্গন আর এখানেই যদি নারীদের যৌন নির্যাতনের শিকার হতে হয়, তবে তা সমগ্র জাতির মূল্যবোধকেই হানা দেয়।
আমাদের দেশের বিদ্যালয়গুলোয় মেয়েদের উপযোগী স্বাস্থ্যসম্মত সহায়ক বিদ্যালয় পরিবেশের অনুপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে পল্লী এলাকার বিদ্যালয়গুলোর পরিবেশ, শৌচাগারসহ সবকিছুই নারী শিক্ষার অন্তরায়। মেয়েদের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধার অভাবে দেখা যায় কমবয়স্ক মেয়েরা বিশেষ করে বয়োসন্ধিকালের পরবর্তী সময়ে শ্রেণীতে প্রায়ই অনুপস্থিত থাকে। বয়োসন্ধিকালের যে ব্যাপারগুলো নারী হিসেবে অতি স্বাভাবিক ঘটনা সেগুলোই তাদের কাছে অনেক সময়ই আতঙ্কের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। বিদ্যালয়ের অনুপযুক্ত পরিবেশের কারণে যা তাদের শিক্ষা জীবনকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
শ্রেণীকক্ষে সহপাঠীদের সঙ্গে সুন্দর ও সহযোগিতাপূর্ণ আচরণ সকলেরই কাম্য হলেও অনেক সময় দেখা যায় ছেলে সহপাঠীরা মেয়েদের ভিন্ন চোখে দেখে। বিশেষ করে যারা মেধার দিক দিয়ে দুর্বল অথবা অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসর তাদের প্রতি অবহেলা করা হয় যা এই মেয়েদের শিক্ষার প্রতি অনেক সময়ই অনাগ্রহ সৃষ্টি করে।
আমাদের দেশে এখন অনেক মেয়ে কারিগরি ও বিজ্ঞান শিক্ষায় অংশগ্রহণ করলেও তা যথার্থ নয়। পরিবারে মেয়েরা ছোটবেলা থেকেই বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত হয়ে থাকে। বিজ্ঞান পড়া অনেক কঠিন, প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস করা অনেক কষ্টকর; সায়েন্স পড়ে সময় নষ্ট না করে মানবিক পড় সংসারের কাজে লাগবে ইত্যাদি অজুহাতে অনেক পরিবারই মেয়েদের এই লেখাপড়া থেকে নিরুৎসাহিত করে। অথচ দেখা যায় যে সকল পরিবার নারীদের এই বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষায় উৎসাহিত করেছে আজ তাদের গর্বে বুক ভরে যায় নিজেদের মেয়েদের সাফল্য গাঁথা দেখে। মেয়েদের তাদের পছন্দমতো বিষয়ে পড়তে না দেয়া নারীর প্রতি অবমূল্যায়ন ও অবহেলা ছাড়া আর কিছুই নয়। মফস্বল এলাকাগুলোতে যেখানে কাছে পিঠে ভাল স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় নেই সেসব এলাকার মেয়েদের অনেক সময়ই দূরের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর ব্যাপারে পরিবার নিরুৎসাহিত করে। অবশ্য এক্ষেত্রে পরিবারের উদ্বেগ প্রকাশের কারণও রয়েছেÑ রাষ্ট্রব্যবস্থাই মেয়েদের নিরাপত্তা ঠিক মতো দিতে পারে না। ইভটিজিংয়ের শিকার হতে হয় মেয়েদের যার ফলে মেয়েরা নিজেরা ও হীনম্মন্যতা বোধে ভোগে। যদিও সরকার ইভটিজিং প্রতিরোধে অনেক আইন করেছে এবং তার বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে এখনও ইভটিজিংয়ের শিকার হচ্ছে মেয়েরা যা তাদের শিক্ষা গ্রহণে নিরুৎসাহিত করে আবার মেয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশে লেখাপড়ার সুযোগ পেলেও মেয়ে হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে এই ভয়ে পরিবার থেকে মেয়েকে উচ্চ শিক্ষার জন্যও নিরুৎসাহিত করা হয় যা নারীদের উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে অন্যতম বাধা।
ঢাকা শহরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে সব মেয়ে অধ্যয়ন করে তাদের অনেককেই আবাসন সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। হলে পর্যাপ্ত সিট না থাকার কারণে অনেক মেয়েকেই গণরুমে থাকতে হয় যা তাদের লেখাপড়াকে বিঘিœত করে। আবার যে সব প্রাইভেট হোস্টেল রয়েছে সেগুলোর নিম্নমান ও অনেক সময় ছাত্রীদের মানসিক বিপর্যয় ঘটায়। এসব হোস্টেল সম্পর্কে সত্য মিথ্যা অনেক গুজব ছড়ানো থাকে যার ফলে এসব হোস্টেলে সম্ভ্রান্ত পরিবারগুলো মেয়েদের রেখে পড়ালেখা চালানোতে নিরুৎসাহী থাকে। তাছাড়া মেয়েদের সাবলেট থাকতে গেলেও পোহাতে হয় অনেক ঝামেলা। আবাসন সঙ্কট নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে বিশেষ করে নারীর উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে অন্যতম বাধা।
আমাদের দেশের বর্তমান শিক্ষা কাঠামোও চাকরি বাজারে পরিস্থিতিতে দেখা যায় আনুষ্ঠানিক শিক্ষা জীবন শেষ করতে ২৭-২৮ বছর বয়স হয়ে যায়। বেশি বয়সে মেয়েদের জন্য পাত্র পাওয়া কঠিন মনে করে অনেক বাবা মা অধ্যয়নকালীন সময়ই মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেয় যা মেয়েদের লেখাপড়ার ক্ষেত্রে বিঘœ ঘটায়।
বর্তমান বাংলাদেশে দিন দিন নারী শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটলেও পরিবার, শিক্ষক, সহপাঠীদের মানসিকতা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নারী শিক্ষার উপযোগী ভৌত অবকাঠামোর অভাব, নারী শিক্ষার অনুপযোগী সামাজিক পরিবেশ, রাষ্ট্রীয় আইনের ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতা ইত্যাদি এখনও নারী শিক্ষার কাঙ্খিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের প্রধান অন্তরায়। ব্যক্তি পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র সবাইকেই মূলত নারীদের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি যেমন করতে হবে তেমনি নারীর শিক্ষা অর্জনের পথকে আরও মসৃণ করে তুলতে হবে। প্রাথমিক মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষায় নারীকে বৃত্তি প্রদান, কোটাসহ যে সব সুবিধা দেয়া হচ্ছে সেগুলোর সঙ্গে সঙ্গে সমস্যাগুলোর আলোচনা করা হয়েছে সেগুলো যদি সমাধান করা সম্ভব হয় তবে নারীরা পুরুষের সঙ্গে সমকক্ষ হয়েই দেশের উন্নয়নে কাজ করে যাবে। তাই আমাদের সবারই উচিত নারীকে অবমূল্যায়ন না করে তাদের শিক্ষা গ্রহণের জন্য সকল প্রকার সুযোগ-সুবিধার নিশ্চয়তা দেয়া।
No comments