সামাজিক যোগাযোগ-আরেক দেয়াল by রেবেকা এল স্টেইন

তিউনিসিয়া ও মিসরের গণজাগরণকে ফেসবুক বা টুইটার-বিপ্লব আখ্যা দেওয়ার চল চলছে। আবার একইভাবে চালু আছে গণবিদ্রোহে সোশ্যাল মিডিয়ার (সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম) ভূমিকা অতিরঞ্জিত করা হচ্ছে—এমন মত। তবে এসব মিডিয়াকে রাষ্ট্রের জনসংযোগ ও বিদ্রোহ দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের বিষয়টি ততটা নজরে আসেনি।


উদাহরণস্বরূপ, ইসরায়েলের দিকেই দেখুন। বিগত কয়েক বছরে ইসরায়েলি মন্ত্রীরা ও নানা সরকারি প্রতিষ্ঠান সরকারি মত প্রচার এবং ইসরায়েলের আন্তর্জাতিক সুনামের ব্যবস্থাপনা (বিশেষত সামরিক সংঘাতের সময়) করতে ফেসবুক, ফ্লিকার, টুইটার ও ইউটিউবকে অবলম্বন করছে। পার্শ্ববর্তী আরব রাষ্ট্রগুলো যেখানে ইন্টারনেটকে দেখছে গণবিদ্রোহের বিপজ্জনক হাতিয়ার হিসেবে, আর একে দমনের কথা ভাবছে, সেখানে ইসরায়েলের অবস্থান ঠিক তার বিপরীত। গত বছর সোশ্যাল মিডিয়ার পেছনে ইসরায়েলের বাজেট অনেক বাড়ানো হয়েছে।
২০০৬ সালে লেবাননের ওপর ইসরায়েলি সামরিক অভিযান ব্যর্থ হওয়ার পর ন্যাশনাল ইনফরমেশন ডিরেক্টরেট নামের একটি নতুন প্রতিষ্ঠান তৈরি করা হয়, যার দায়িত্ব সামরিক সংকটের সময়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যবস্থাপনা করা। ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে ইন্টারনেট ও নিউ মিডিয়া বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা হয়, যার ওপর দায়িত্ব থাকবে জনসংযোগ তৎপরতা বাড়ানোর লক্ষ্যে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও মন্ত্রণালয়ের ইন্টারনেট তৎপরতার সমন্বয়। গত বছরের আগস্ট মাসের মধ্যেই ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর তাদের নিজস্ব ইউটিউব, টুইটার, ফ্লিকার ও ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলেছে। ফেসবুক অ্যাকাউন্টটি হিব্রু, ইংরেজি ও আরবি ভাষায় হালনাগাদ করা হয়। সপ্তাহ দুয়েক আগে তৃতীয় রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে (বারাক ওবামা ও ডেভিড ক্যামেরনের পর) বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ইউটিউবে সরাসরি সাক্ষাৎকার দেন। অথচ এই ব্যক্তি চলতি ধারার সংবাদমাধ্যমকে (তা সে দেশি বা আন্তর্জাতিক যা-ই হোক না কেন) পায়ে ঠেলায় সিদ্ধহস্ত।
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) সোশ্যাল মিডিয়া-সম্পৃক্ততা শুরু হয় ২০০৮-০৯ সালে দুই তরুণ সেনা কর্তৃক পরীক্ষামূলক ইউটিউব তৎপরতার মাধ্যমে। তখন গাজায় আকস্মিক ইসরায়েলি হামলা শুরু হয়েছে কেবল। আইডিএফের তুলে দেওয়া ভিডিও (হামলা চালানোর দৃশ্য এবং তাদের মুখপাত্রদের ভিডিও ব্লগসহ) লোকে দেখেছে ২০ লাখেরও অধিক বার। গত বছরের মে মাসে ত্রাণবাহী জাহাজে প্রাণঘাতী হামলা চালানোর পর আইডিএফ আবার ইউটিউবে ব্যবহার করে দীর্ঘমেয়াদি প্রচারণা চালায়। তবে সামরিক বাহিনীর সৌজন্যে প্রাপ্য এসব ভিডিওর ব্যাপক প্রচারণা সত্ত্বেও ইসরায়েলের সেই অপকর্মের বিরুদ্ধে নিন্দা জানানো থেকে বিশ্ববাসীকে খুব বেশি নিরস্ত্র করা যায়নি। পরিণতিতে সোশ্যাল মিডিয়ার প্রতি রাষ্ট্রের আরও মনোযোগী হওয়ার পক্ষে তাদের যুক্তি আরও জোরালো হয়। আইডিএফের টুইটার অ্যাকাউন্ট চালু আছে ২০০৯ সালের অক্টোবর থেকে। প্রতি ঘণ্টায় হালনাগাদ করা এই অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে সরকারি বক্তব্য প্রচারিত হয়। সম্প্রতি আইডিএফ একটি ফ্লিকার ফটোস্ট্রিম চালু করেছে। আন্তর্জাতিক ব্লগারদের উদ্দেশে আইডিএফ নিয়মিত উপদেশ ও সংবাদাদি হাজির করে। ভবিষ্যৎ সামরিক মিশনে ব্লগারদের এমবেড করার পরিকল্পনাও করছে আইডিএফ।
আনুষ্ঠানিক সামরিক বাগ্রীতি থেকে ব্যক্তিগত অনানুষ্ঠানিক ভাষার দিকে যাত্রা আইডিএফের জন্য সহজ ছিল না। উচ্চমাত্রার মিথস্ক্রিয়ার সুবিধাসংবলিত ফেসবুক যেমন এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সুযোগ সৃষ্টি করেছে, তেমনি এটি বড় প্রতিবন্ধকও হতে পারে বলে মনে করা হয়। ফেসবুকের আদর্শ ছাঁচে একটি ‘দেয়াল’ আছে, যেখানে যে কেউ লিখতে পারে। এই ছাঁচকে কাজের মনে করা হয় না। কেননা, নিন্দুকদের অবিরাম মন্তব্য করে ভরিয়ে দিতে পারে সেই দেয়াল। ২০০৮-০৯ সালে গাজা আক্রমণের সময় আইডিএফের ইউটিউব চ্যানেল শুরুতে খুলে দেওয়া হয়েছিল মন্তব্য করার জন্য, কিন্তু পরের দিনই তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। আইডিএফের প্রোগ্রামাররা এখন বিকল্প ছাঁচ নির্মাণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, যেখানে অনেক কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা সম্ভব। নৈমিত্তিক ব্যবহারকারী ফেসবুকে যে প্রশ্ন ছুড়ে দেবেন, তা যাচাই করা এবং আগাম তা অনুমোদন এবং পরে আইডিএফের মুখপাত্রদের মাধ্যমে সেসবের জবাব দেওয়ার ব্যবস্থা দাঁড় করার কাজ চলছে।
সম্প্রতি ইসরায়েলের সরকারি প্রেস দপ্তর ফেসবুক পাতা চালু করার দুই দিন পরই তারা নামিয়ে নেয়, কেননা ‘ইসরায়েলবিরোধী প্রচারকর্মী ও হিংসা বিস্তারকারী দেয়ালে এত বেশি মন্তব্য ছুড়ে দিচ্ছিল যে সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। ‘ইসরায়েলি রাষ্ট্রব্যবস্থা বর্ণবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত’ এমন মন্তব্যে ভরপুর ছিল, যা বিশ্বস্ত অনুসারীদের ভড়কে দেয়। তারা আরও সক্রিয় নজরদারির আহ্বান জানায়। একই সময়ে ইসরায়েল এক ফেসবুক বিজয় অর্জন করে, যখন ‘দ্য থার্ড প্যালেস্টাইনিয়াল ইন্তিফাদা’ নামের একটি পাতা সরিয়ে নিতে সম্মত হয় ফেসবুক। ইসরায়েলের পাবলিক ডিপ্লোমেসি অ্যান্ড ডায়াসপোরা অ্যাফেয়ার্স মিনিস্ট্রি এবং ফেসবুক ইসরায়েলবিরোধী উসকানি দেওয়ার মঞ্চ হয়ে ওঠা নিয়ে উদ্বিগ্ন ব্যক্তিদের চাপে ফেসবুক সেই সিদ্ধান্তটি নেয়।
তবে ফেসবুক ও অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া সাইটের ওপর রাষ্ট্র কতটা নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে সক্ষম হবে, তা এখনো স্পষ্ট হয়নি। সম্প্রতি আইডিএফের মুখপাত্র আভি বেনাইয়াহু বলেছেন, ‘পশ্চিমা প্রযুক্তি যেভাবে ক্ষমতাসীন সরকারগুলোর ক্ষতি করছে, তাতে আমাদের অভিভূত না হয়ে উপায় নেই।...যেকোনো গোয়েন্দা অভিযানের চেয়ে ক্ষমতাসীন সরকারের জন্য ক্ষতির কারণ হওয়ার ক্ষমতা রাখে একটিমাত্র সেলফোন ক্যামেরা।’ তবে, ফেসবুকের রূপকার্থক দেয়াল এবং ইসরায়েলের বিভেদসূচক দেয়ালের মধ্যকার অনুরণনের কথা ইসরায়েলি কর্মকর্তারা কেউ বললেন না। ফেসবুকের দেয়াল আর ইসরায়েলের দেয়াল উভয়ই রাজনীতির ক্রীড়ামঞ্চ নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রের প্রচেষ্টাকেই তো মূর্ত করে তোলে।

লন্ডন রিভিউ অব বুকস থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
রেবেকা এল স্টেইন: যুক্তরাষ্ট্রের ডিউক ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক।

No comments

Powered by Blogger.