শিবের গীত-চেয়ার মার্কেট by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

গত কুড়ি বছর ধরে বাংলাদেশে দুই ধরনের সরকার চলছে: এক. কেয়ার টেকার, যা নির্বাচনের আগে কিছুদিন দেশ চালায়; এবং দুই. চেয়ার টেকার, যা নির্বাচনের মাধ্যমে চেয়ার গ্রহণ করে মোটামুটি অনন্তকাল দেশ চালায়। এ দুই ধরনের সরকার নিয়ে টেনেটুনে চলছিল আমাদের, কিন্তু এক-এগারোর পর তৃতীয় আরেক ধরনের সরকারের উদয়


হলো, যার নজর গেল চেয়ারের দিকে এবং কেয়ার-ফেয়ার বাদ দিয়ে চেয়ার নিয়ে মনোযোগী হলো। এই সরকারকে বলা যায় শেয়ার টেকার, যারা চেয়ার শেয়ার, অর্থাৎ ভাগাভাগি করে নিল। এই ভাগাভাগিটা ছিল সেনা ও অসেনা শাসকদের মধ্যে, যাদের অনেকে ছিলেন নেহাতই অচেনা। কিন্তু ভাগাভাগি করে চেয়ারে বসেও একসময় নতুন চেয়ার টেকারদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে তাদের চলে যেতে হলো। দু-একজনকে ভাগতেও হলো। ভোগান্তিটা অবশ্য হলো চেয়ারের জন্যই। চেয়ারের ভোগটা কখনো দীর্ঘস্থায়ী হয় না, যদিও চেয়ারে বসলে এ কথাটা মনে থাকে না। ভোগের অন্তে ভোগান্তিটা তাই ভাগ্যও ফেরাতে পারে না।
আগামী নির্বাচন একটা কেয়ার টেকার সরকারের অধীনে হবে কি হবে না, হওয়াটা গণতন্ত্রের জন্য ফেয়ার না আনফেয়ার হবে, এ নিয়ে বিতর্ক চলছে। সেই বিতর্কে আমরা যাব না, যেহেতু আমাদের উদ্বেগ অন্য বিষয় নিয়ে, অর্থাৎ নতুন এক শেয়ার টেকার বাহিনীর কাহিনি নিয়ে। দেশের শেয়ার মার্কেটে কয়েক মাস আগে এক মহা ধস নামল, যার আঘাতে বিধ্বস্ত হলো অনেক ছোট বিনিয়োগকারী। তাদের সংখ্যা শুনেছি ৩০ লাখ। আরও শুনেছি, শেয়ারবাজার থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়ে গেছে। এই লুটপাটের টাকা নিজেদের মধ্যে শেয়ার করে নিলেন কয়েক ডজন রাঘব-রুই। শেয়ারব্যবসার বিশাল সব শেয়ার যাঁদের হাতে গেল, তাঁরা হলেন নব্য শেয়ার টেকার। পূবাইলের এক ক্ষুদ্র দোকানদার অথবা নড়াইলের এক স্কুলের দপ্তরির জীবনের সঞ্চিত টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন শেয়ার মার্কেটে, আগ-পাছ না ভেবেই, নিয়মটিয়ম না জেনেই। শেয়ার টেকাররা সেই টাকা টেক ওভার করল দপ্তরি-দোকানদারকে চির দেনাদার করে দিয়ে। তাঁরা কেন নির্বোধের মতো বিনিয়োগ করলেন, বিয়োগের আশঙ্কা জেনেও রাঘব-রুইদের নিয়োগ দিলেন ভাগ্যের জিম্মাদার হিসেবে। সে জন্য খুব তিরস্কার শুনতে হলো তাঁদের। কিন্তু শেয়ার টেকারদের জন্য কোনো তিরস্কার থাকল না, থাকল শুধু পুরস্কার। একটা দন্তহীন করে ফেলা তদন্ত প্রতিবেদনে অবশ্য শেয়ার মার্কেট বিপর্যয়ের নানা কারণ খতিয়ে দেখা হয়েছে, কিছু নামধামও এসেছে, কিন্তু সেটি এক প্রতিবেদনা হয়েই বরং দুর্ভাগা বিনিয়োগকারীদের বেদনা বাড়াচ্ছে; যেহেতু রাঘব-রুইরা রয়ে যাচ্ছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
পত্রপত্রিকায় লেখা হচ্ছে, শেয়ার কেলেঙ্কারির নেপথ্যের নায়কদের কিছুই হবে না। কেলেঙ্কারির আবার নায়ক কীভাবে হয়, সে প্রশ্ন না তুলেও এই সম্ভাবনাটা মেনে নেওয়া ছাড়া আমাদের উপায় থাকে না। নায়ক তো বটেই, নিয়ামকও। শেয়ারবাজারের রাজা এবং ভক্ষক হিসেবে দেখা দিয়েছেন যে কিছু রক্ষক, সে খবর তো রাত-দিন শুনছি। কিন্তু প্রশ্ন হলো: কেন এই নায়কদের কিছুই হবে না, কেন যা কিছু হওয়ার, তা হবে সেই দপ্তরি-দোকানদারদের মতো বোকাদের? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে নেমেছেন পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞরা, সুশীল সমাজের চিন্তাশীলেরা, মিডিয়ার বক্তা আর (এই অধমসম) স্তম্ভকারেরা। কিন্তু আসাদ চৌধুরীর একটি কবিতাগ্রন্থের শিরোনাম ধার করে বলা যায়, এ প্রশ্নের ‘উত্তরে পাহাড়’। সেই পাহাড়কে টপকাতে হলে পা হড়কে যাবে সবচেয়ে অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞেরও। তবে আমি একটি উত্তর পেয়েছি, যেটি একটি ঢিবির সমান বলে ডিঙানো যাবে এবং সেটি হচ্ছে: চেয়ার মার্কেট। ক্ষমতার চেয়ার ধরে রাখা অথবা পুনরাধিকার করা এখন তিন বছরেরও কম সময়ের ব্যাপার এবং এই চেয়ার এমনই এক অতি-মহামূল্যবান বস্তু যে একে ধরে রাখতে যেমন লাগে বিশাল তহবিল, উদ্ধার করতেও লাগে তেমনই বিশাল (বা বিশালতর) তহবিল। তা ছাড়া, চেয়ার কি মোটে একটা? চেয়ার না হাজার হাজার? ক্ষমতার পালাবদলে অনেক চেয়ারনশিন চেয়ার হারান। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ভিসি চেয়ার হারান রাত নয়টা এক মিনিটে; নয়টা দেড় মিনিটে চেয়ারলীন হন আরেক ভিসি। একদিকে চেয়ার হারাচ্ছেন এক দল, তো অন্যদিকে চেয়ারসীন হচ্ছেন অন্য দল। চেয়ারের একটা বিশাল বাজার এখন বাংলাদেশে। এ বাজারের উত্থান-পতন শেয়ারবাজারের মতোই। শেয়ার টেকারদের তহবিলের একটা অংশ এই চেয়ার মার্কেটে গেছে। এ জন্য তারা নিরাপদ। তারা সর্বোৎকৃষ্ট বিনিয়োগকারী। দরকারিও!
আমাদের সবাইকেই এখন চেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগ করা উচিত। তাতে অন্তত চেয়ারবদল হলে, নিজের দল চেয়ারের দখল নিলে অথবা চেয়ার না হারালে, এই বিনিয়োগটা নানাবিধ নিয়োগে রূপান্তরিত হতে পারে।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.