মিডিয়া ভাবনা-প্রেস কাউন্সিলের এই রায় যথেষ্ট নয় by মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর
‘বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল’ নামের যে একটা সরকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তা অনেকেই হয়তো জানেন না। জানলেও এর অস্তিত্ব অনেকে অনুভব করেন না। সম্প্রতি কালের কণ্ঠ (সম্পাদক: আবেদ খান) পত্রিকার হলুদ সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে একটি মামলার রায় ঘোষণা করায় বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
প্রথম আলো পত্রিকার সম্পাদক মতিউর রহমানের দায়ের করা মামলার পরিপ্রেক্ষিতে উভয় পক্ষের শুনানি শেষে প্রেস কাউন্সিল ১২ এপ্রিল এই রায় প্রদান করেন। নিঃসন্দেহে সামপ্রতিক কালে মিডিয়া জগতের জন্য এটি একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। একটা মামলার নিষ্পত্তি করার জন্য প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বিচারপতি বি কে দাশ ও সম্মানিত সদস্যদের প্রতি আমি ব্যক্তিগতভাবে আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। এ জন্য তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদকে অভিনন্দন জানাই। তাঁর নেতৃত্বে তথ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিষ্ঠান প্রেস কাউন্সিল অনেক দিন পর সক্রিয় হয়েছেন। আমি এই কলামে প্রেস কাউন্সিলকে সক্রিয় করার জন্য তাগিদ দিয়ে অনেকবার লিখেছি। এ জন্য আজ একটু আত্মতৃপ্তিও বোধ হচ্ছে। প্রেস কাউন্সিলে কোনো মামলা দায়ের হলে তা যেন দ্রুততার সঙ্গে নিষ্পত্তি হয়, এটাই সবার কাম্য। বিলম্বিত বিচার কিন্তু বিচার না পাওয়ারই সমতুল্য।
বিচারের রায়ে বলা হয়েছে: ‘প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানকে ঘিরে দৈনিক কালের কণ্ঠ যে অপসাংবাদিকতার পরিচয় দিয়েছে, তা সাংবাদিকতা নীতিমালার পরিপন্থী। কালের কণ্ঠ পত্রিকা অহেতুক মিথ্যা, বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিষোদ্গার করে হলুদ সাংবাদিকতার প্রকাশ ঘটিয়েছে।’ রায়ে ভবিষ্যতে আদালতে বিচারাধীন কোনো মামলা বা এমন সাক্ষীসাবুদ ছাড়া কোনো তথ্য পত্রিকায় প্রকাশ থেকে বিরত থাকার জন্য কালের কণ্ঠকে সতর্ক করেছেন প্রেস কাউন্সিল। একই সঙ্গে কালের কণ্ঠ পত্রিকার সম্পাদক আবেদ খান ও প্রকাশক মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীনকে ভবিষ্যতে এমন সংবাদ প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং সতর্ক করা হয়েছে।
রায়ে আরও বলা হয়েছে: ‘প্রথম আলোর সম্পাদক সম্পর্কে কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত তর্কিত সংবাদটি তথ্যনির্ভর নয়। এটি মিথ্যা, বানোয়াট ও কুৎসাপূর্ণ।’ (সূত্র: প্রথম আলো, ২১ এপ্রিল)
উল্লেখ্য, ২০১০ সালের ১০ মে কালের কণ্ঠ পত্রিকা ‘হোতা তাজউদ্দীনকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন জনাব মতিউর রহমান’ শিরোনামে একটি খবর প্রকাশ করেছিল। এই খবরে মতিউর রহমানকে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ আনা হয়েছিল। এই রিপোর্টকে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন দাবি করে জনাব মতিউর রহমান ২৪ অক্টোবর (২০১০) প্রেস কাউন্সিলে মামলা করেন। ১২ এপ্রিল সেই মামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছে।
মতিউর রহমানকে ধন্যবাদ জানাই এই মামলা করার জন্য। প্রেস কাউন্সিল একটি প্রায় নিষ্ক্রিয় প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও তিনি একটি মামলা করেছিলেন। এই মামলা করা না হলে আমরা এ রকম একটি রায় পেতাম না। একটি দৈনিক পত্রিকা যে কী ধরনের ‘হলুদ সাংবাদিকতা’ করতে পারে, এই রায়ের মাধ্যমে তা দেশবাসী জানতে পেরেছে। কোনো পাঠক যদি এখন আশঙ্কা করেন, এই পত্রিকা (কালের কণ্ঠ) নানা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যেসব রিপোর্ট প্রায়শই প্রকাশ করছে, সেগুলোও মিথ্যা, বানোয়াট ও কুৎসাপূর্ণ, তাহলে কি ওই পাঠককে দোষ দেওয়া যাবে? শুধু পার্থক্য, অন্যরা মামলা করেনি বলে তা এখনো প্রমাণিত হয়নি। আমার ধারণা, মতিউর রহমানের মামলা আরও অনেককে বিভিন্ন পত্রিকার বিরুদ্ধে মামলা করতে উৎসাহিত করবে।
সংবাদপত্র বা টিভি চ্যানেল যেমন নিজেদের, তেমনি বহু পাঠক বা দর্শকও গণমাধ্যমকে ‘মহাশক্তিশালী’ প্রতিষ্ঠান মনে করেন। গণমাধ্যম এক অর্থে সত্যিই মহাশক্তিশালী। গণমাধ্যম সমাজের নানা কুকীর্তি, অপশাসন, দুর্নীতি উন্মোচনে বিরাট ভূমিকা পালন করতে পারে। বাংলাদেশের স্বাধীন গণমাধ্যম তা বহু বছর ধরে সাফল্যের সঙ্গে করে আসছে। কিন্তু এর পাশাপাশি কিছু গণমাধ্যম নানা গোষ্ঠী বা দলীয় স্বার্থে অহেতুক মিথ্যা, বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিষোদ্গার করে হলুদ সাংবাদিকতাকে প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে। আমি এই কলামে অনেক বছর ধরে এই অভিযোগ করছি এবং এর প্রতিকার কামনা করেছি। আমি মন্তব্য করলেই ‘হলুদ সাংবাদিকতা’ প্রমাণিত হবে না। আমার মতামত ভুলও হতে পারে। আমি আমার সাংবাদিকতার জ্ঞান ও কাণ্ডজ্ঞান থেকে মন্তব্য করেছি। রায় দেওয়ার মালিক প্রেস কাউন্সিল। প্রেস কাউন্সিলের মতো প্রতিষ্ঠানে কোনো অভিযোগ গেলে তাঁরা দুই পক্ষের বক্তব্য শুনে, তথ্য-প্রমাণ যাচাই করে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছান। সেটা বিচারিক প্রক্রিয়া। প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানের ক্ষেত্রে তা হয়েছে। তাঁর অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হয়েছে। প্রেস কাউন্সিল তাঁদের রায়ে কালের কণ্ঠ পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশককে সতর্ক করে দিয়েছেন। একটি জাতীয় দৈনিকের সম্পাদক ও প্রকাশককে সাংবাদিকতার জন্য সতর্ক করা খুব ছোট ব্যাপার নয়। এতে পত্রিকাটির সাংবাদিকতার মান ও বিশ্বাসযোগ্যতাই আজ পাঠকের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। একটি পত্রিকা বা টিভি চ্যানেলের প্রধান সম্পদই হলো ‘বিশ্বাসযোগ্যতা’। কালের কণ্ঠ এখন সেই বিশ্বাসযোগ্যতার ক্ষেত্রে পাঠকের সন্দেহের মুখোমুখি হয়েছে। একটা দৈনিক পত্রিকার জন্য এর চেয়ে বড় সংকট আর কিছু হতে পারে না।
এই সংকট আজ কালের কণ্ঠ পত্রিকার হয়েছে বটে, ঠিকমতো মামলা করলে আরও কয়েকটি দৈনিকের বিরুদ্ধেও এ রকম ‘রায়’ হতে পারত বলে আমার ধারণা। তবে সব সংক্ষুব্ধ প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে মামলা করতে আগ্রহী হয় না। এটাই একশ্রেণীর সংবাদপত্র বা টিভির জন্য একটা বড় সুযোগ। তাই সূত্রবিহীন, অপর পক্ষের বক্তব্যবিহীন, মিথ্যা, বানোয়াট, ব্যক্তিগত বিষোদ্গারে ভরা প্রতিবেদন, কলাম ও টক শো ঢাকার কয়েকটি দৈনিকে ও টিভিতে প্রায়শ প্রচারিত হচ্ছে। আমি মনে করি, সংক্ষুব্ধ প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিদের এ ব্যাপারে মামলা করা উচিত। তা না হলে এসব পত্রিকা বা টিভি চ্যানেল তাদের শক্তির অপব্যয় করতেই থাকবে। দেশে হলুদ সাংবাদিকতা প্রশ্রয় পাবে। প্রকৃত সাংবাদিক ও সাংবাদিকতা পেশা সম্পর্কে জনমনে নানা প্রশ্নের জন্ম হবে। প্রথম আলোর সম্পাদকের এই মামলা ও প্রেস কাউন্সিলের রায় অন্যদেরও উৎসাহিত করুক, এটাই আমার প্রত্যাশা।
হলুদ সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে মামলা না করার পেছনে আরও একটা কারণ কাজ করতে পারে, তা হলো প্রেস কাউন্সিলের আইনে শাস্তি প্রদানের সীমাবদ্ধতা। এটা প্রতিষ্ঠানের আইনেরই দুর্বলতা। আমি মনে করি, প্রধানত এ জন্যই প্রেস কাউন্সিল এত দিনেও কার্যকর প্রতিষ্ঠান হতে পারেনি। আইনের দুর্বলতার কারণেই মতিউর রহমান সম্পর্কে তথ্যবিহীন মারাত্মক অভিযোগ প্রকাশ করেও কালের কণ্ঠ পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক তেমন শাস্তি পাননি। আজ মতিউর রহমান যদি প্রথম আলোর মতো জনপ্রিয় ও পাঠকনন্দিত দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক না হয়ে নেহাত ছাপোষা একজন মানুষ হতেন, তাহলে তাঁকে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সঙ্গে যুক্ত থাকার কাল্পনিক অভিযোগে এত দিনে কারাগারেই থাকতে হতো। রিমান্ডে এনে তাঁর ওপর নির্যাতনও চালানো হতো। কারণ, একটি দৈনিক পত্রিকায় এ রকম অভিযোগ প্রকাশ করা হয়েছে। কাজেই এই ‘কাল্পনিক’ প্রতিবেদন প্রকাশ করা খুব ছোট অপরাধ নয়। সংবাদপত্রে এ রকম সূত্রবিহীন, তথ্যবিহীন, কাল্পনিক, বানোয়াট, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রতিবেদন একজন নির্দোষ মানুষের জীবন ধ্বংস করে দিতে পারে। সারা জীবনের তিলে তিলে গড়া তার ভাবমূর্তিতে কালিমা লেপন করে দিতে পারে। আর বিচারে এই প্রতিবেদন ‘মিথ্যা’ প্রমাণিত হওয়ার পর শুধু সম্পাদক ও প্রকাশককে ‘সতর্ক করা’ হয়েছে। অপরাধের তুলনায় এটা কোনো শাস্তি হলো? পাঠক, একবার শুধু ভাবুন, কালের কণ্ঠ পত্রিকার এই মিথ্যা ও বানোয়াট প্রতিবেদনটি আপনাকে নিয়ে লেখা হয়েছিল। আপনার অবস্থাটি একবার কল্পনা করুন এবং এরপর বলুন, এ ধরনের অপসাংবাদিকতার জন্য পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশকের কেমন শাস্তি হওয়া উচিত।
আমি মনে করি, এ ধরনের মিথ্যা, সূত্রবিহীন, অপর পক্ষের বক্তব্যবিহীন বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রতিবেদন বছরে তিনটি প্রকাশিত হলে (এবং মিথ্যা প্রমাণিত হলে) সেই পত্রিকার ডিক্লারেশন অন্তত এক দিনের জন্য স্থগিত করা, প্রতিবেদকের অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিল করা, সম্পাদককে ‘সম্পাদক’ পদে প্রতীকীভাবে হলেও এক দিনের জন্য অযোগ্য ঘোষণা করা ও অভিযোগকারীকে কোটি টাকার অঙ্কে মানহানির ক্ষতিপূরণ দেওয়া—এ ধরনের কিছু ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। ক্ষতিপূরণের টাকার অঙ্ক মাননীয় বিচারকেরাই নির্ধারণ করে দেবেন। তবে অবশ্যই একটা অর্থদণ্ডের ব্যবস্থা থাকা উচিত।
তবে সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ, বিচার বা রায় যেন সুষ্ঠু, সৎ ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার পথে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়, প্রেস কাউন্সিলকে সেটাও দেখতে হবে। সমাজের নানা অন্ধকার দিক উন্মোচনে সংবাদপত্র তথা গণমাধ্যম নিরন্তর কাজ করে যাবে, এটাই প্রত্যাশিত। তবে গণমাধ্যম সেই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যেন ভুল তথ্য, বানোয়াট তথ্য, প্রমাণহীন অভিযোগ ও অপর পক্ষের বক্তব্য ছাড়া কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ না করে, সেদিকে সচেষ্ট থাকবে। সেটাও পাঠকের প্রত্যাশা। প্রেস কাউন্সিল কালের কণ্ঠ পত্রিকার একটি প্রতিবেদন সম্পর্কে যে রায় দিয়েছেন, তা দেশের সব গণমাধ্যমের পরিচালকদের সচেতন করবে বলে আশা করা যায়। এই রায় সব সম্পাদক ও সাংবাদিককে দায়িত্বসচেতন ও পেশাদারি হতেও অনুপ্রাণিত করবে।
সাংবাদিকতার মূল্যায়নে বা প্রেস কাউন্সিলে মামলার শুনানিতেও ‘সংবাদ সূত্র’ সম্পর্কে একটা বিভ্রান্তি কাজ করে থাকতে পারে। কোনো কোনো পত্রিকা বা টিভি অস্পষ্ট বা অলীক কোনো সূত্রের বরাত দিয়ে মিথ্যা বা বানোয়াট সংবাদ প্রকাশ করে থাকে। আবার কেউ কেউ সূত্রের বরাত দেওয়ারই প্রয়োজনীয়তা বোধ করে না। কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি সম্পর্কে সমালোচনামূলক তথ্যভিত্তিক প্রতিবেদন প্রকাশেও অপর পক্ষের কোনো বক্তব্য থাকে না। বক্তব্য সংগ্রহ করার কোনো চেষ্টার কথাও লেখা হয় না। এসব প্রতিবেদন এতই ‘কাল্পনিক’ যে অপর পক্ষের বক্তব্যের কোনো প্রয়োজনীয়তাও সাংবাদিক অনুভব করেন না।
সংবাদপত্র সূত্রের স্পষ্টতা এবং প্রতিটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে অপর পক্ষের বিস্তারিত বক্তব্য যুক্ত করার জন্য একটা ‘দিকনির্দেশনা’ প্রেস কাউন্সিল দিতে পারেন। এই ‘দিকনির্দেশনা’ বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার আবশ্যিক শর্ত। এটা প্রেস কাউন্সিলের নিজস্ব কোনো বিধিমালা নয়। প্রেস কাউন্সিল শুধু সৎ ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার স্বার্থে তা প্রত্যেক সাংবাদিককে মনে করিয়ে দিতে পারেন।
আমাদের দেশে সাংবাদিকতার উজ্জ্বল ঐতিহ্য থাকা সত্ত্বেও মাত্র হাতেগোনা কয়েকজন মতলববাজ প্রকাশক, সম্পাদকের কারণে সাংবাদিকতা পেশা আজ আংশিক কলুষিত হয়ে যাচ্ছে। প্রেস কাউন্সিল যদি এ ব্যাপারে শক্ত ভূমিকা পালন করতে পারেন, তাহলে এই দুর্নাম থেকে সাংবাদিক ও সাংবাদিকতা পেশা নিজেদের রক্ষা করতে পারবে।
আমি আবার বলতে চাই, অপসাংবাদিকতার জন্য সংবাদপত্র বা টিভি চ্যানেলের সম্পাদক ও প্রকাশক/মালিক যদি দৃষ্টিগ্রাহ্য শাস্তি না পান, তাহলে প্রেস কাউন্সিলের এই বিচার ও রায় হাস্যকর বিষয়ে পরিণত হবে। এ ব্যাপারে তথ্যমন্ত্রীকে আরেকটু ভাবনাচিন্তা করার জন্য অনুরোধ করছি।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: উন্নয়নকর্মী ও কলাম লেখক।
বিচারের রায়ে বলা হয়েছে: ‘প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানকে ঘিরে দৈনিক কালের কণ্ঠ যে অপসাংবাদিকতার পরিচয় দিয়েছে, তা সাংবাদিকতা নীতিমালার পরিপন্থী। কালের কণ্ঠ পত্রিকা অহেতুক মিথ্যা, বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিষোদ্গার করে হলুদ সাংবাদিকতার প্রকাশ ঘটিয়েছে।’ রায়ে ভবিষ্যতে আদালতে বিচারাধীন কোনো মামলা বা এমন সাক্ষীসাবুদ ছাড়া কোনো তথ্য পত্রিকায় প্রকাশ থেকে বিরত থাকার জন্য কালের কণ্ঠকে সতর্ক করেছেন প্রেস কাউন্সিল। একই সঙ্গে কালের কণ্ঠ পত্রিকার সম্পাদক আবেদ খান ও প্রকাশক মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীনকে ভবিষ্যতে এমন সংবাদ প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং সতর্ক করা হয়েছে।
রায়ে আরও বলা হয়েছে: ‘প্রথম আলোর সম্পাদক সম্পর্কে কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত তর্কিত সংবাদটি তথ্যনির্ভর নয়। এটি মিথ্যা, বানোয়াট ও কুৎসাপূর্ণ।’ (সূত্র: প্রথম আলো, ২১ এপ্রিল)
উল্লেখ্য, ২০১০ সালের ১০ মে কালের কণ্ঠ পত্রিকা ‘হোতা তাজউদ্দীনকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন জনাব মতিউর রহমান’ শিরোনামে একটি খবর প্রকাশ করেছিল। এই খবরে মতিউর রহমানকে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ আনা হয়েছিল। এই রিপোর্টকে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন দাবি করে জনাব মতিউর রহমান ২৪ অক্টোবর (২০১০) প্রেস কাউন্সিলে মামলা করেন। ১২ এপ্রিল সেই মামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছে।
মতিউর রহমানকে ধন্যবাদ জানাই এই মামলা করার জন্য। প্রেস কাউন্সিল একটি প্রায় নিষ্ক্রিয় প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও তিনি একটি মামলা করেছিলেন। এই মামলা করা না হলে আমরা এ রকম একটি রায় পেতাম না। একটি দৈনিক পত্রিকা যে কী ধরনের ‘হলুদ সাংবাদিকতা’ করতে পারে, এই রায়ের মাধ্যমে তা দেশবাসী জানতে পেরেছে। কোনো পাঠক যদি এখন আশঙ্কা করেন, এই পত্রিকা (কালের কণ্ঠ) নানা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যেসব রিপোর্ট প্রায়শই প্রকাশ করছে, সেগুলোও মিথ্যা, বানোয়াট ও কুৎসাপূর্ণ, তাহলে কি ওই পাঠককে দোষ দেওয়া যাবে? শুধু পার্থক্য, অন্যরা মামলা করেনি বলে তা এখনো প্রমাণিত হয়নি। আমার ধারণা, মতিউর রহমানের মামলা আরও অনেককে বিভিন্ন পত্রিকার বিরুদ্ধে মামলা করতে উৎসাহিত করবে।
সংবাদপত্র বা টিভি চ্যানেল যেমন নিজেদের, তেমনি বহু পাঠক বা দর্শকও গণমাধ্যমকে ‘মহাশক্তিশালী’ প্রতিষ্ঠান মনে করেন। গণমাধ্যম এক অর্থে সত্যিই মহাশক্তিশালী। গণমাধ্যম সমাজের নানা কুকীর্তি, অপশাসন, দুর্নীতি উন্মোচনে বিরাট ভূমিকা পালন করতে পারে। বাংলাদেশের স্বাধীন গণমাধ্যম তা বহু বছর ধরে সাফল্যের সঙ্গে করে আসছে। কিন্তু এর পাশাপাশি কিছু গণমাধ্যম নানা গোষ্ঠী বা দলীয় স্বার্থে অহেতুক মিথ্যা, বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিষোদ্গার করে হলুদ সাংবাদিকতাকে প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে। আমি এই কলামে অনেক বছর ধরে এই অভিযোগ করছি এবং এর প্রতিকার কামনা করেছি। আমি মন্তব্য করলেই ‘হলুদ সাংবাদিকতা’ প্রমাণিত হবে না। আমার মতামত ভুলও হতে পারে। আমি আমার সাংবাদিকতার জ্ঞান ও কাণ্ডজ্ঞান থেকে মন্তব্য করেছি। রায় দেওয়ার মালিক প্রেস কাউন্সিল। প্রেস কাউন্সিলের মতো প্রতিষ্ঠানে কোনো অভিযোগ গেলে তাঁরা দুই পক্ষের বক্তব্য শুনে, তথ্য-প্রমাণ যাচাই করে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছান। সেটা বিচারিক প্রক্রিয়া। প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানের ক্ষেত্রে তা হয়েছে। তাঁর অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হয়েছে। প্রেস কাউন্সিল তাঁদের রায়ে কালের কণ্ঠ পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশককে সতর্ক করে দিয়েছেন। একটি জাতীয় দৈনিকের সম্পাদক ও প্রকাশককে সাংবাদিকতার জন্য সতর্ক করা খুব ছোট ব্যাপার নয়। এতে পত্রিকাটির সাংবাদিকতার মান ও বিশ্বাসযোগ্যতাই আজ পাঠকের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। একটি পত্রিকা বা টিভি চ্যানেলের প্রধান সম্পদই হলো ‘বিশ্বাসযোগ্যতা’। কালের কণ্ঠ এখন সেই বিশ্বাসযোগ্যতার ক্ষেত্রে পাঠকের সন্দেহের মুখোমুখি হয়েছে। একটা দৈনিক পত্রিকার জন্য এর চেয়ে বড় সংকট আর কিছু হতে পারে না।
এই সংকট আজ কালের কণ্ঠ পত্রিকার হয়েছে বটে, ঠিকমতো মামলা করলে আরও কয়েকটি দৈনিকের বিরুদ্ধেও এ রকম ‘রায়’ হতে পারত বলে আমার ধারণা। তবে সব সংক্ষুব্ধ প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে মামলা করতে আগ্রহী হয় না। এটাই একশ্রেণীর সংবাদপত্র বা টিভির জন্য একটা বড় সুযোগ। তাই সূত্রবিহীন, অপর পক্ষের বক্তব্যবিহীন, মিথ্যা, বানোয়াট, ব্যক্তিগত বিষোদ্গারে ভরা প্রতিবেদন, কলাম ও টক শো ঢাকার কয়েকটি দৈনিকে ও টিভিতে প্রায়শ প্রচারিত হচ্ছে। আমি মনে করি, সংক্ষুব্ধ প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিদের এ ব্যাপারে মামলা করা উচিত। তা না হলে এসব পত্রিকা বা টিভি চ্যানেল তাদের শক্তির অপব্যয় করতেই থাকবে। দেশে হলুদ সাংবাদিকতা প্রশ্রয় পাবে। প্রকৃত সাংবাদিক ও সাংবাদিকতা পেশা সম্পর্কে জনমনে নানা প্রশ্নের জন্ম হবে। প্রথম আলোর সম্পাদকের এই মামলা ও প্রেস কাউন্সিলের রায় অন্যদেরও উৎসাহিত করুক, এটাই আমার প্রত্যাশা।
হলুদ সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে মামলা না করার পেছনে আরও একটা কারণ কাজ করতে পারে, তা হলো প্রেস কাউন্সিলের আইনে শাস্তি প্রদানের সীমাবদ্ধতা। এটা প্রতিষ্ঠানের আইনেরই দুর্বলতা। আমি মনে করি, প্রধানত এ জন্যই প্রেস কাউন্সিল এত দিনেও কার্যকর প্রতিষ্ঠান হতে পারেনি। আইনের দুর্বলতার কারণেই মতিউর রহমান সম্পর্কে তথ্যবিহীন মারাত্মক অভিযোগ প্রকাশ করেও কালের কণ্ঠ পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক তেমন শাস্তি পাননি। আজ মতিউর রহমান যদি প্রথম আলোর মতো জনপ্রিয় ও পাঠকনন্দিত দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক না হয়ে নেহাত ছাপোষা একজন মানুষ হতেন, তাহলে তাঁকে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সঙ্গে যুক্ত থাকার কাল্পনিক অভিযোগে এত দিনে কারাগারেই থাকতে হতো। রিমান্ডে এনে তাঁর ওপর নির্যাতনও চালানো হতো। কারণ, একটি দৈনিক পত্রিকায় এ রকম অভিযোগ প্রকাশ করা হয়েছে। কাজেই এই ‘কাল্পনিক’ প্রতিবেদন প্রকাশ করা খুব ছোট অপরাধ নয়। সংবাদপত্রে এ রকম সূত্রবিহীন, তথ্যবিহীন, কাল্পনিক, বানোয়াট, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রতিবেদন একজন নির্দোষ মানুষের জীবন ধ্বংস করে দিতে পারে। সারা জীবনের তিলে তিলে গড়া তার ভাবমূর্তিতে কালিমা লেপন করে দিতে পারে। আর বিচারে এই প্রতিবেদন ‘মিথ্যা’ প্রমাণিত হওয়ার পর শুধু সম্পাদক ও প্রকাশককে ‘সতর্ক করা’ হয়েছে। অপরাধের তুলনায় এটা কোনো শাস্তি হলো? পাঠক, একবার শুধু ভাবুন, কালের কণ্ঠ পত্রিকার এই মিথ্যা ও বানোয়াট প্রতিবেদনটি আপনাকে নিয়ে লেখা হয়েছিল। আপনার অবস্থাটি একবার কল্পনা করুন এবং এরপর বলুন, এ ধরনের অপসাংবাদিকতার জন্য পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশকের কেমন শাস্তি হওয়া উচিত।
আমি মনে করি, এ ধরনের মিথ্যা, সূত্রবিহীন, অপর পক্ষের বক্তব্যবিহীন বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রতিবেদন বছরে তিনটি প্রকাশিত হলে (এবং মিথ্যা প্রমাণিত হলে) সেই পত্রিকার ডিক্লারেশন অন্তত এক দিনের জন্য স্থগিত করা, প্রতিবেদকের অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিল করা, সম্পাদককে ‘সম্পাদক’ পদে প্রতীকীভাবে হলেও এক দিনের জন্য অযোগ্য ঘোষণা করা ও অভিযোগকারীকে কোটি টাকার অঙ্কে মানহানির ক্ষতিপূরণ দেওয়া—এ ধরনের কিছু ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। ক্ষতিপূরণের টাকার অঙ্ক মাননীয় বিচারকেরাই নির্ধারণ করে দেবেন। তবে অবশ্যই একটা অর্থদণ্ডের ব্যবস্থা থাকা উচিত।
তবে সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ, বিচার বা রায় যেন সুষ্ঠু, সৎ ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার পথে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়, প্রেস কাউন্সিলকে সেটাও দেখতে হবে। সমাজের নানা অন্ধকার দিক উন্মোচনে সংবাদপত্র তথা গণমাধ্যম নিরন্তর কাজ করে যাবে, এটাই প্রত্যাশিত। তবে গণমাধ্যম সেই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যেন ভুল তথ্য, বানোয়াট তথ্য, প্রমাণহীন অভিযোগ ও অপর পক্ষের বক্তব্য ছাড়া কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ না করে, সেদিকে সচেষ্ট থাকবে। সেটাও পাঠকের প্রত্যাশা। প্রেস কাউন্সিল কালের কণ্ঠ পত্রিকার একটি প্রতিবেদন সম্পর্কে যে রায় দিয়েছেন, তা দেশের সব গণমাধ্যমের পরিচালকদের সচেতন করবে বলে আশা করা যায়। এই রায় সব সম্পাদক ও সাংবাদিককে দায়িত্বসচেতন ও পেশাদারি হতেও অনুপ্রাণিত করবে।
সাংবাদিকতার মূল্যায়নে বা প্রেস কাউন্সিলে মামলার শুনানিতেও ‘সংবাদ সূত্র’ সম্পর্কে একটা বিভ্রান্তি কাজ করে থাকতে পারে। কোনো কোনো পত্রিকা বা টিভি অস্পষ্ট বা অলীক কোনো সূত্রের বরাত দিয়ে মিথ্যা বা বানোয়াট সংবাদ প্রকাশ করে থাকে। আবার কেউ কেউ সূত্রের বরাত দেওয়ারই প্রয়োজনীয়তা বোধ করে না। কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি সম্পর্কে সমালোচনামূলক তথ্যভিত্তিক প্রতিবেদন প্রকাশেও অপর পক্ষের কোনো বক্তব্য থাকে না। বক্তব্য সংগ্রহ করার কোনো চেষ্টার কথাও লেখা হয় না। এসব প্রতিবেদন এতই ‘কাল্পনিক’ যে অপর পক্ষের বক্তব্যের কোনো প্রয়োজনীয়তাও সাংবাদিক অনুভব করেন না।
সংবাদপত্র সূত্রের স্পষ্টতা এবং প্রতিটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে অপর পক্ষের বিস্তারিত বক্তব্য যুক্ত করার জন্য একটা ‘দিকনির্দেশনা’ প্রেস কাউন্সিল দিতে পারেন। এই ‘দিকনির্দেশনা’ বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার আবশ্যিক শর্ত। এটা প্রেস কাউন্সিলের নিজস্ব কোনো বিধিমালা নয়। প্রেস কাউন্সিল শুধু সৎ ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার স্বার্থে তা প্রত্যেক সাংবাদিককে মনে করিয়ে দিতে পারেন।
আমাদের দেশে সাংবাদিকতার উজ্জ্বল ঐতিহ্য থাকা সত্ত্বেও মাত্র হাতেগোনা কয়েকজন মতলববাজ প্রকাশক, সম্পাদকের কারণে সাংবাদিকতা পেশা আজ আংশিক কলুষিত হয়ে যাচ্ছে। প্রেস কাউন্সিল যদি এ ব্যাপারে শক্ত ভূমিকা পালন করতে পারেন, তাহলে এই দুর্নাম থেকে সাংবাদিক ও সাংবাদিকতা পেশা নিজেদের রক্ষা করতে পারবে।
আমি আবার বলতে চাই, অপসাংবাদিকতার জন্য সংবাদপত্র বা টিভি চ্যানেলের সম্পাদক ও প্রকাশক/মালিক যদি দৃষ্টিগ্রাহ্য শাস্তি না পান, তাহলে প্রেস কাউন্সিলের এই বিচার ও রায় হাস্যকর বিষয়ে পরিণত হবে। এ ব্যাপারে তথ্যমন্ত্রীকে আরেকটু ভাবনাচিন্তা করার জন্য অনুরোধ করছি।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: উন্নয়নকর্মী ও কলাম লেখক।
No comments