জাতীয় সার্বভৌমত্ব নিয়ে কথা by হায়দার আকবর খান রনো
আমাদের দেশে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের হস্তক্ষেপ এবং ব্যতিক্রমহীনভাবে আমাদের বর্তমান ও অতীতের সব সরকার তথা শাসকগোষ্ঠী যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কাছে জাতীয় স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে এসেছে, এ খবর নতুন কিছু না হলেও খুব সাম্প্রতিককালে খবরের কাগজে প্রকাশিত কতিপয় খবরে আমরা বেশি করে আতঙ্কিত না হয়ে পারছি না।
গত ৩১ মার্চ (২০১২ সাল) অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন যে টিফা চুক্তি এখন স্বাক্ষরিত হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশের সঙ্গে এই চুক্তি সম্পাদনের প্রক্রিয়া এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে। Trade and Investment Framework Agreement বা সংক্ষেপে TIFA চুক্তি করার জন্য মার্কিন প্রশাসন অনেক আগে থেকেই চাপ দিয়ে আসছিল। বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে এই চুক্তি স্বাক্ষর করানোর জন্য চেষ্টা হয়েছিল। অবশ্য শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকার সম্মত হয়নি। তখন এ বিষয়ে অনেক প্রতিবাদ এসেছিল। অনেক লেখালেখিও হয়েছিল। এই চুক্তিটি জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী এবং কোনো স্বাধীন জাতির জন্য তা অমর্যাদাকরও বটে। এ বিষয়ে আমি নিজেও ইতিপূর্বে লিখেছিলাম। তাই বিস্তারিত বিবরণে যাচ্ছি না। এককথায়, এ রকম চুক্তির ফলে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যসংক্রান্ত বিষয়ে বিরোধ নিরসনের বহুপাক্ষিক সুযোগ হারাবে। এটা জানা কথা যে বহুপাক্ষিকভাবে অধিকতর ভালো দরকষাকষি করা যায়। বাংলাদেশ তা হারাবে এবং স্বল্পোন্নত দেশগুলো তথা তৃতীয় বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। আমরা একঘরে হয়ে বস্তুত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কৃপানির্ভর হয়ে পড়ব। টিফা চুক্তিটি এখন নতুন নামে পরিবেশন করা হচ্ছে। নাম দেওয়া হয়েছে টিকফা (Trade and Investment Co-operation Framework Agreement বা সংক্ষেপে TICFA)। বিষয়বস্তু ও চুক্তির শর্তগুলো সে আগের মতোই। এই চুক্তির ফলে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে মেধাস্বত্ব আইনের আওতায় সফটওয়্যার লাইসেন্সের জন্য বছরে ৫০ কোটি ডলার দিতে হবে। এ ছাড়াও আমাদের শিল্প, কৃষি, বাণিজ্য অর্থনীতির ওপর মার্কিনিদের খবরদারিও বাড়বে। এসব কথা যে অর্থমন্ত্রী জানেন না, এমনটি মনে করার কোনো কারণ নেই। তবু কেন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কাছে এতটা আত্মসমর্পণ?
কারণ হয়তো এটা হতে পারে যে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংক ইস্যুকে কেন্দ্র করে মার্কিন প্রশাসন যে বাংলাদেশ সরকারের ওপর বেশ চটেছে এবং যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে, সেটাকে কমিয়ে আনার জন্য এবং মার্কিন সরকারকে তুষ্ট করার জন্যই বর্তমানের মহাজোট সরকারের পক্ষ থেকে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। গ্রামীণ ব্যাংকের নতুন প্রশাসনের বিষয়ে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে সার্চ কমিটি গঠন করার জন্য আমেরিকার তরফ থেকে নতুন করে একটা চাপ এসেছিল। বাংলাদেশ সরকার সম্মত হয়নি। তবে আমেরিকাকে সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করার মতো হিম্মত, দেশপ্রেমিক বা তেজ বর্তমান সরকারের নেই। তাই একটা চাপকে অস্বীকার করতে গিয়ে আরেকটা চাপের কাছে নতিস্বীকার করতে হয়েছে। কারণ আওয়ামী লীগ বা বিএনপি- দুটি দলের যে শ্রেণীভিত্তি, তাতে তারা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে পারে না। ক্ষমতায় যাওয়া বা ক্ষমতায় আসার জন্য তারা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কৃপা ভিক্ষা করে থাকে। তাই দেখা যায়, মার্কিন প্রশাসনের নিম্নপদস্থ কোনো ব্যক্তির আমন্ত্রণ পেলেও এই দলের বড় বড় নেতারা যেন হুমড়ি খেয়ে পড়েন। দুটি দলের মধ্যে ক্ষমতার ঝগড়া থাকলেও সাম্রাজ্যবাদের প্রশ্নে এদের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই।
স্বল্প সময়ের ব্যবধানে বেশ কয়েকটা আতঙ্কজনক খবর এসেছে। ৩১ মার্চের এই খবরের আগেও একই মাসের পহেলা তারিখের আরেকটি খবর আমাদের চমকে দিয়েছিল এবং বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। মার্কিন সেনাবাহিনীর প্যাসিফিক কমান্ডের প্রধান অ্যাডমিরাল রবার্ট উইলার্ড মার্কিন কংগ্রেসের সামনে শুনানি প্রদানকালে এই ভয়ংকর খবরটি ফাঁস করে দিয়েছিলেন। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার পাঁচটি দেশে মার্কিন বিশেষ বাহিনীর দল মোতায়েন রয়েছে। মার্কিন বাহিনীর প্রশান্ত মহাসাগরীয় কমান্ড তাদের নিয়োগ করেছে। তারা নাকি সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রমে আমাদের সক্ষমতা বাড়াতে এবং বিশেষ করে সমুদ্রসীমার নিরাপত্তা জোরদার করতে এখানে এসেছে। হায়রে! পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সন্ত্রাসী মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ নাকি আমাদের দেশে সন্ত্রাসবিরোধী কাজে সহায়তা করবে। আর সমুদ্রসীমার নিরাপত্তা। মার্কিন সেনাদের কাছ থেকে কি নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পাওয়া যায়? এ যেন শিয়ালের কাছে মুরগি রাখার মতো। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে এই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদই কিন্তু ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর পাঠিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত তারা নৌবহর কাজে লাগাতে পারেনি। কারণ, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারত দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছিল আমাদের স্বাধীনতার সপক্ষে। সেই সোভিয়েত ইউনিয়ন অবশ্য এখন আর নেই। কিন্তু সেদিনের সেই ভারত, ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন ভারত কি এতটাই বদলে গেছে যে মার্কিন সেনাবহর এখন ভারতেও অবস্থান করছে। হায়রে! এ যে বড় দুর্ভাগ্যের কথা।
গত ৫ মার্চ কালের কণ্ঠে প্রকাশিত হয়েছে পেন্টাগনের এক সামরিক কর্মকর্তা লে. কর্নেল গ্রেগরির বক্তব্য। তিনি বলেছেন, 'রুটিন মাফিক নানা কাজেই ইউএস স্পেশাল ফোর্সের সদস্যরা বাংলাদেশে যান। এ ছাড়া বাংলাদেশ সরকারও আমন্ত্রণ জানায় স্পেশাল ফোর্সকে।' এ কথা এখন জানা গেছে যে মার্কিন সৈন্যরা নিয়মিত বাংলাদেশে যাতায়াত করেন। আমাদের বেশ কিছু স্পর্শকাতর জায়গায় তাঁরা অফিস করে বসে আছেন বলেও শোনা যায়। সিআইএ, এফবিআই ইত্যাদির কাজকর্মও চলে বাংলাদেশে। বাংলাদেশে যে মার্কিন সৈন্যরা যাতায়াত করেন, তাঁদের নিয়ন্ত্রণ করে মার্কিন সেনা দপ্তর। আমাদের সরকার নয়। ১৯৯৮ সালে, শেখ হাসিনার প্রথমবারের প্রধানমন্ত্রিত্বের আমলেই বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যে SOFA চুক্তি (Status of Forces Agreement) স্বাক্ষর করেছিল, তাতে তখন থেকেই আমরা সার্বভৌমত্ব হারিয়েছি। যদিও আমাদের সংবিধানের ১৪৫(ক) ধারা অনুযায়ী বিদেশের সঙ্গে সম্পাদিত সব চুক্তি পার্লামেন্ট দ্বারা অনুমোদিত হতে হবে, তবু এই SOFA চুক্তি সংসদে পেশ করা হয়নি। এভাবে গোপন করাও হচ্ছে সংবিধান লঙ্ঘন করা। বস্তুত বিদেশি রাষ্ট্র বা বিদেশি কম্পানির সঙ্গে সম্পাদিত কোনো চুক্তিই আজ পর্যন্ত সংসদে পেশ করা হয়নি।
SOFA চুক্তির বলে মার্কিন সেনারা যেকোনো সময় বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারবেন। বাংলাদেশ সরকারের অনুমতির কোনো প্রয়োজন নেই। ভিসারও দরকার নেই। কাস্টমস চেকও হবে না। তাঁরা সশস্ত্রভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ ও যেকোনো জায়গায় যেতে পারবেন। সর্বোপরি মার্কিন সৈন্যরা যদি বাংলাদেশে খুন বা ধর্ষণের মতো অপরাধও করেন, তাহলেও বাংলাদেশের কোনো আদালতে তার বিচার করা চলবে না। বড়জোর আমরা মার্কিন সরকারের কাছে নালিশ জানাতে পারব। ছি! ছি! এ ধরনের দাসত্বমূলক চুক্তি যাঁরা করতে পারেন, তাঁরা আর যা-ই হোক দেশপ্রেমিক নন। সাধারণত কোনো দ্বিপাক্ষিক চুক্তিতে উভয় পক্ষের সমান অধিকার থাকে। কিন্তু SOFA চুক্তিতে একতরফাভাবে মার্কিনিদের যে সুবিধা দেওয়া হচ্ছে, বাংলাদেশ কি একই ধরনের সুবিধা পাবে? অর্থাৎ বাংলাদেশের সৈন্যরা কি বিনা ভিসা ও বিনা কাস্টমস চেকিংয়ে সশস্ত্রভাবে মার্কিন দেশে প্রবেশ করতে পারবেন এবং কোনো অপরাধ করলেও মার্কিন আদালত বিচার করতে পারবেন না? এমন দাবিকে অবাস্তব বলে উড়িয়ে দেওয়া হবে। অথচ মার্কিন সরকার ও সেনাবাহিনীকে একতরফাভাবে এমন অধিকার দেওয়া হচ্ছে বাংলাদেশে। একেই বলে নয়া পদ্ধতিতে উপনিবেশবাদ।
যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে তারা আফগানিস্তানে সামরিক হামলা চালাবে ২০০১ সালে। সেই সময় বাংলাদেশের ক্ষমতায় ছিল বিচারপতি লতিফুর রহমানের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাজ হলো, রুটিন মাফিক কাজ চালিয়ে যাওয়া। নতুন কোনো চুক্তি করা বা নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার এখতিয়ার তাদের ছিল না। তবু তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাসত্বমূলক চুক্তিতে স্বাক্ষর করে মার্কিন-ন্যাটো বাহিনীকে বাংলাদেশের মাটি, সমুদ্র ও আকাশ ব্যবহারের সুবিধা দিয়েছিল। সেই সুবিধা এখনও বলবৎ আছে। পরবর্তী সময়ে খালেদা জিয়ার সরকার ও শেখ হাসিনার সরকার একই চুক্তি বহাল রেখেছে। জাতীয় সার্বভৌমত্বকে বিসর্জন দিয়ে আগ্রাসী মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পদলেহী কর্মকাণ্ড যারা করতে পারে, তাদের কি আর দেশপ্রেমিক বলা যায়? যতই তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা অথবা বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের কথা বলে চিৎকার করুক না কেন, বাস্তব ঘটনা প্রমাণ করে যে তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করে না। এবং তারা জাতীয়তাবাদীও নয়। এ কথা আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
২ এপ্রিল বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নগ্ন হস্তক্ষেপের বিষয়ে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করেছিল। ওই সভায় সিপিবির সভাপতি কমরেড মনজুরুল আহসান খান একটি তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, সাম্রাজ্যবাদ তার সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করার জন্য ইরাক, লিবিয়াসহ বিভিন্ন দেশে আক্রমণ চালিয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশে আক্রমণ করার দরকার হয় না। কারণ তারা শসকগোষ্ঠীর আমন্ত্রণেই এই দেশে আসে। মনজুরুল আহসান খানের ভাষায়, 'সাম্রাজ্যবাদ কোথাও করে আক্রমণ আর কোথাও হয় আমন্ত্রিত।' দুর্ভাগ্যক্রমে বাংলাদেশে সাম্রাজ্যবাদ আমন্ত্রিত হয়েই আসে। মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে বীরের মতো লড়াই করে সাময়িকভাবে পরাজিত হওয়ার মধ্যেও গৌরব আছে। ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া প্রভৃতি দেশে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যে অসম সাহসী যুদ্ধ হচ্ছে অথবা ফিলিস্তিনি জনগণ যে কয়েক দশক ধরে সংগ্রাম করে যাচ্ছে, তা এখনও বিজয়ী না হতে পারলেও তার মধ্যে গৌরব আছে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে একদা নেতাজি সুভাষ বসু কিংবা সূর্যসেন যে সশস্ত্র যুদ্ধ করেছিলেন, তা তাৎক্ষণিকভাবে বিজয়ী না হতে পারলেও, জাতি হিসেবে আমাদের কত মহান করে তুলেছিল। এখনো যে ইরান অথবা উত্তর কোরিয়া মার্কিন হুমকি ও সামরিক উসকানিকে তোয়াক্কা না করে স্বাধীন জাতির মর্যাদা নিয়ে দাঁড়াতে পেরেছে, সেটা কি কম বড় কথা? আর আমাদের দেশের শাসকবর্গ, খালেদা জিয়া অথবা শেখ হাসিনা, বিএনপি বা আওয়ামী লীগ সামান্য ব্যক্তিস্বার্থ বা শ্রেণীস্বার্থে যেভাবে মার্কিন সেনাদের ডেকে আনেন, আফগানিস্তানে যুদ্ধের জন্য বাংলাদেশের ভূখণ্ডকে ব্যবহার করতে দেন অথবা টিফা চুক্তি করার জন্য তৎপর হন, তা জাতি হিসেবে আমাদের অনেক ছোট করে তোলে।
মোট কথা, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক- সব দিক দিয়ে এখন সাম্রাজ্যবাদের নগ্ন হস্তক্ষেপ চলছে বাংলাদেশে। এর বিরুদ্ধে সব জনগণকে রুখে দাঁড়াতে হবে। আমাদের সংবিধানে বলা আছে যে সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা হবে রাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এ যাবৎ সব শাসকই সংবিধান লঙ্ঘন করে সাম্রাজ্যবাদের পদলেহন করে আসছে। ব্যতিক্রম শুধু বামপন্থী দলগুলো এবং স্বল্পসংখ্যক বুদ্ধিজীবী। তাঁরা ধারাবাহিকভাবে সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করে আসছেন। সংখ্যায় কম হলেও দেশের ভরসা তাঁরাই। আর সবচেয়ে বড় ভরসার জায়গা হলো জনগণ, যে জনগণ সাম্রাজ্যবাদের হস্তক্ষেপ কখনো মেনে নেয়নি, নেবেও না। সব জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এবং সাম্রাজ্যবাদের দেশীয় সহযোগীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সময় এখনই। কেননা আমাদের জাতীয় সার্বভৌমত্বই এখন সংকটের মুখে পড়েছে।
লেখক : রাজনীতিক ও কলামিস্ট
কারণ হয়তো এটা হতে পারে যে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংক ইস্যুকে কেন্দ্র করে মার্কিন প্রশাসন যে বাংলাদেশ সরকারের ওপর বেশ চটেছে এবং যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে, সেটাকে কমিয়ে আনার জন্য এবং মার্কিন সরকারকে তুষ্ট করার জন্যই বর্তমানের মহাজোট সরকারের পক্ষ থেকে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। গ্রামীণ ব্যাংকের নতুন প্রশাসনের বিষয়ে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে সার্চ কমিটি গঠন করার জন্য আমেরিকার তরফ থেকে নতুন করে একটা চাপ এসেছিল। বাংলাদেশ সরকার সম্মত হয়নি। তবে আমেরিকাকে সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করার মতো হিম্মত, দেশপ্রেমিক বা তেজ বর্তমান সরকারের নেই। তাই একটা চাপকে অস্বীকার করতে গিয়ে আরেকটা চাপের কাছে নতিস্বীকার করতে হয়েছে। কারণ আওয়ামী লীগ বা বিএনপি- দুটি দলের যে শ্রেণীভিত্তি, তাতে তারা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে পারে না। ক্ষমতায় যাওয়া বা ক্ষমতায় আসার জন্য তারা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কৃপা ভিক্ষা করে থাকে। তাই দেখা যায়, মার্কিন প্রশাসনের নিম্নপদস্থ কোনো ব্যক্তির আমন্ত্রণ পেলেও এই দলের বড় বড় নেতারা যেন হুমড়ি খেয়ে পড়েন। দুটি দলের মধ্যে ক্ষমতার ঝগড়া থাকলেও সাম্রাজ্যবাদের প্রশ্নে এদের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই।
স্বল্প সময়ের ব্যবধানে বেশ কয়েকটা আতঙ্কজনক খবর এসেছে। ৩১ মার্চের এই খবরের আগেও একই মাসের পহেলা তারিখের আরেকটি খবর আমাদের চমকে দিয়েছিল এবং বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। মার্কিন সেনাবাহিনীর প্যাসিফিক কমান্ডের প্রধান অ্যাডমিরাল রবার্ট উইলার্ড মার্কিন কংগ্রেসের সামনে শুনানি প্রদানকালে এই ভয়ংকর খবরটি ফাঁস করে দিয়েছিলেন। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার পাঁচটি দেশে মার্কিন বিশেষ বাহিনীর দল মোতায়েন রয়েছে। মার্কিন বাহিনীর প্রশান্ত মহাসাগরীয় কমান্ড তাদের নিয়োগ করেছে। তারা নাকি সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রমে আমাদের সক্ষমতা বাড়াতে এবং বিশেষ করে সমুদ্রসীমার নিরাপত্তা জোরদার করতে এখানে এসেছে। হায়রে! পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সন্ত্রাসী মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ নাকি আমাদের দেশে সন্ত্রাসবিরোধী কাজে সহায়তা করবে। আর সমুদ্রসীমার নিরাপত্তা। মার্কিন সেনাদের কাছ থেকে কি নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পাওয়া যায়? এ যেন শিয়ালের কাছে মুরগি রাখার মতো। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে এই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদই কিন্তু ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর পাঠিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত তারা নৌবহর কাজে লাগাতে পারেনি। কারণ, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারত দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছিল আমাদের স্বাধীনতার সপক্ষে। সেই সোভিয়েত ইউনিয়ন অবশ্য এখন আর নেই। কিন্তু সেদিনের সেই ভারত, ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন ভারত কি এতটাই বদলে গেছে যে মার্কিন সেনাবহর এখন ভারতেও অবস্থান করছে। হায়রে! এ যে বড় দুর্ভাগ্যের কথা।
গত ৫ মার্চ কালের কণ্ঠে প্রকাশিত হয়েছে পেন্টাগনের এক সামরিক কর্মকর্তা লে. কর্নেল গ্রেগরির বক্তব্য। তিনি বলেছেন, 'রুটিন মাফিক নানা কাজেই ইউএস স্পেশাল ফোর্সের সদস্যরা বাংলাদেশে যান। এ ছাড়া বাংলাদেশ সরকারও আমন্ত্রণ জানায় স্পেশাল ফোর্সকে।' এ কথা এখন জানা গেছে যে মার্কিন সৈন্যরা নিয়মিত বাংলাদেশে যাতায়াত করেন। আমাদের বেশ কিছু স্পর্শকাতর জায়গায় তাঁরা অফিস করে বসে আছেন বলেও শোনা যায়। সিআইএ, এফবিআই ইত্যাদির কাজকর্মও চলে বাংলাদেশে। বাংলাদেশে যে মার্কিন সৈন্যরা যাতায়াত করেন, তাঁদের নিয়ন্ত্রণ করে মার্কিন সেনা দপ্তর। আমাদের সরকার নয়। ১৯৯৮ সালে, শেখ হাসিনার প্রথমবারের প্রধানমন্ত্রিত্বের আমলেই বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যে SOFA চুক্তি (Status of Forces Agreement) স্বাক্ষর করেছিল, তাতে তখন থেকেই আমরা সার্বভৌমত্ব হারিয়েছি। যদিও আমাদের সংবিধানের ১৪৫(ক) ধারা অনুযায়ী বিদেশের সঙ্গে সম্পাদিত সব চুক্তি পার্লামেন্ট দ্বারা অনুমোদিত হতে হবে, তবু এই SOFA চুক্তি সংসদে পেশ করা হয়নি। এভাবে গোপন করাও হচ্ছে সংবিধান লঙ্ঘন করা। বস্তুত বিদেশি রাষ্ট্র বা বিদেশি কম্পানির সঙ্গে সম্পাদিত কোনো চুক্তিই আজ পর্যন্ত সংসদে পেশ করা হয়নি।
SOFA চুক্তির বলে মার্কিন সেনারা যেকোনো সময় বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারবেন। বাংলাদেশ সরকারের অনুমতির কোনো প্রয়োজন নেই। ভিসারও দরকার নেই। কাস্টমস চেকও হবে না। তাঁরা সশস্ত্রভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ ও যেকোনো জায়গায় যেতে পারবেন। সর্বোপরি মার্কিন সৈন্যরা যদি বাংলাদেশে খুন বা ধর্ষণের মতো অপরাধও করেন, তাহলেও বাংলাদেশের কোনো আদালতে তার বিচার করা চলবে না। বড়জোর আমরা মার্কিন সরকারের কাছে নালিশ জানাতে পারব। ছি! ছি! এ ধরনের দাসত্বমূলক চুক্তি যাঁরা করতে পারেন, তাঁরা আর যা-ই হোক দেশপ্রেমিক নন। সাধারণত কোনো দ্বিপাক্ষিক চুক্তিতে উভয় পক্ষের সমান অধিকার থাকে। কিন্তু SOFA চুক্তিতে একতরফাভাবে মার্কিনিদের যে সুবিধা দেওয়া হচ্ছে, বাংলাদেশ কি একই ধরনের সুবিধা পাবে? অর্থাৎ বাংলাদেশের সৈন্যরা কি বিনা ভিসা ও বিনা কাস্টমস চেকিংয়ে সশস্ত্রভাবে মার্কিন দেশে প্রবেশ করতে পারবেন এবং কোনো অপরাধ করলেও মার্কিন আদালত বিচার করতে পারবেন না? এমন দাবিকে অবাস্তব বলে উড়িয়ে দেওয়া হবে। অথচ মার্কিন সরকার ও সেনাবাহিনীকে একতরফাভাবে এমন অধিকার দেওয়া হচ্ছে বাংলাদেশে। একেই বলে নয়া পদ্ধতিতে উপনিবেশবাদ।
যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে তারা আফগানিস্তানে সামরিক হামলা চালাবে ২০০১ সালে। সেই সময় বাংলাদেশের ক্ষমতায় ছিল বিচারপতি লতিফুর রহমানের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাজ হলো, রুটিন মাফিক কাজ চালিয়ে যাওয়া। নতুন কোনো চুক্তি করা বা নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার এখতিয়ার তাদের ছিল না। তবু তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাসত্বমূলক চুক্তিতে স্বাক্ষর করে মার্কিন-ন্যাটো বাহিনীকে বাংলাদেশের মাটি, সমুদ্র ও আকাশ ব্যবহারের সুবিধা দিয়েছিল। সেই সুবিধা এখনও বলবৎ আছে। পরবর্তী সময়ে খালেদা জিয়ার সরকার ও শেখ হাসিনার সরকার একই চুক্তি বহাল রেখেছে। জাতীয় সার্বভৌমত্বকে বিসর্জন দিয়ে আগ্রাসী মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পদলেহী কর্মকাণ্ড যারা করতে পারে, তাদের কি আর দেশপ্রেমিক বলা যায়? যতই তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা অথবা বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের কথা বলে চিৎকার করুক না কেন, বাস্তব ঘটনা প্রমাণ করে যে তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করে না। এবং তারা জাতীয়তাবাদীও নয়। এ কথা আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
২ এপ্রিল বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নগ্ন হস্তক্ষেপের বিষয়ে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করেছিল। ওই সভায় সিপিবির সভাপতি কমরেড মনজুরুল আহসান খান একটি তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, সাম্রাজ্যবাদ তার সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করার জন্য ইরাক, লিবিয়াসহ বিভিন্ন দেশে আক্রমণ চালিয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশে আক্রমণ করার দরকার হয় না। কারণ তারা শসকগোষ্ঠীর আমন্ত্রণেই এই দেশে আসে। মনজুরুল আহসান খানের ভাষায়, 'সাম্রাজ্যবাদ কোথাও করে আক্রমণ আর কোথাও হয় আমন্ত্রিত।' দুর্ভাগ্যক্রমে বাংলাদেশে সাম্রাজ্যবাদ আমন্ত্রিত হয়েই আসে। মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে বীরের মতো লড়াই করে সাময়িকভাবে পরাজিত হওয়ার মধ্যেও গৌরব আছে। ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া প্রভৃতি দেশে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যে অসম সাহসী যুদ্ধ হচ্ছে অথবা ফিলিস্তিনি জনগণ যে কয়েক দশক ধরে সংগ্রাম করে যাচ্ছে, তা এখনও বিজয়ী না হতে পারলেও তার মধ্যে গৌরব আছে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে একদা নেতাজি সুভাষ বসু কিংবা সূর্যসেন যে সশস্ত্র যুদ্ধ করেছিলেন, তা তাৎক্ষণিকভাবে বিজয়ী না হতে পারলেও, জাতি হিসেবে আমাদের কত মহান করে তুলেছিল। এখনো যে ইরান অথবা উত্তর কোরিয়া মার্কিন হুমকি ও সামরিক উসকানিকে তোয়াক্কা না করে স্বাধীন জাতির মর্যাদা নিয়ে দাঁড়াতে পেরেছে, সেটা কি কম বড় কথা? আর আমাদের দেশের শাসকবর্গ, খালেদা জিয়া অথবা শেখ হাসিনা, বিএনপি বা আওয়ামী লীগ সামান্য ব্যক্তিস্বার্থ বা শ্রেণীস্বার্থে যেভাবে মার্কিন সেনাদের ডেকে আনেন, আফগানিস্তানে যুদ্ধের জন্য বাংলাদেশের ভূখণ্ডকে ব্যবহার করতে দেন অথবা টিফা চুক্তি করার জন্য তৎপর হন, তা জাতি হিসেবে আমাদের অনেক ছোট করে তোলে।
মোট কথা, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক- সব দিক দিয়ে এখন সাম্রাজ্যবাদের নগ্ন হস্তক্ষেপ চলছে বাংলাদেশে। এর বিরুদ্ধে সব জনগণকে রুখে দাঁড়াতে হবে। আমাদের সংবিধানে বলা আছে যে সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা হবে রাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এ যাবৎ সব শাসকই সংবিধান লঙ্ঘন করে সাম্রাজ্যবাদের পদলেহন করে আসছে। ব্যতিক্রম শুধু বামপন্থী দলগুলো এবং স্বল্পসংখ্যক বুদ্ধিজীবী। তাঁরা ধারাবাহিকভাবে সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করে আসছেন। সংখ্যায় কম হলেও দেশের ভরসা তাঁরাই। আর সবচেয়ে বড় ভরসার জায়গা হলো জনগণ, যে জনগণ সাম্রাজ্যবাদের হস্তক্ষেপ কখনো মেনে নেয়নি, নেবেও না। সব জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এবং সাম্রাজ্যবাদের দেশীয় সহযোগীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সময় এখনই। কেননা আমাদের জাতীয় সার্বভৌমত্বই এখন সংকটের মুখে পড়েছে।
লেখক : রাজনীতিক ও কলামিস্ট
No comments