এসো নীপবনে-টি-পার্টি by আবুল হায়াত
চায়ের নেশাটা আমি পেয়েছি মায়ের কাছ থেকে। দিনে দশ থেকে পনেরো কাপ চা পান করি। এ থেকে পাই বিরতিহীন কাজ করার প্রাণশক্তি। ছোটবেলায় মাকে দেখতাম, কাঁসার এক জামবাটিতে করে চা খেতেন। তাও আবার ভীষণ গরম হতে হবে। শাড়ির আঁচলটা দিয়ে ধরে অতি সাবধানে মুখে দিতেন চা।
তাতে ছিটিয়ে দিতেন এক-দু মুঠো মচমচে মুড়ি। বাড়িতে যখন দুধের কমতি হতো, মা দুধ ছাড়া চা-ই খেতেন কিন্তু তাতে এক-দুফোঁটা ঘি দিয়ে নিতেন। আবার কখনো দেখেছি, এক চিমটি লবণ দিচ্ছেন চায়ে। সব রকমেই অভ্যস্ত হয়েছিলাম আমি। তবে সবচেয়ে পছন্দ ছিল ঘন চায়ে গরুর দুধ, ওপরে ভাসমান সর।
চায়ের নেশা প্রবল হওয়ার পেছনে আমার পেশারও আছে অবদান। নির্মাণকাজের দায়িত্বে থাকার সময় রাত-দিনের বিভিন্ন সময় ব্যস্ত থাকতে হতো কাজে, সেখানে চা-ই ছিল সতেজ থাকার প্রধান উপাদান। অভিনয়-পেশায় এসেও সেই একই ব্যাপার। তবে সময়ের আবর্তে পড়ে দুধ-চা, লেবু-চা, মসলা-চা অতিক্রম করে এখন ঠেকেছি এসে দুধ-চিনিবিহীন চায়ে। কখনো বা সবুজ চা। সবচেয়ে অপছন্দের চা হলো সুগন্ধি চা।
চা সম্পর্কে কিছু জ্ঞানও আহরণ করতে পেরেছি এ সময়ের মধ্যে। যেমন—চা বানাতে হবে একেবারে ফুটন্ত পানিতে—নইলে চা-পাতা তার রং-রস ছাড়বে না। পানিতে পাতা ছাড়ার পর জ্বাল দেওয়া চলবে না। আর হ্যাঁ, বেশি গরম চা কখনো খাওয়া যাবে না, তা শরীরের জন্য ক্ষতিকর। চায়ের প্রকৃত স্বাদ আসবে কেবল হালকা-উষ্ণ চায়ে।
ও হ্যাঁ, রং-চা খাওয়া শুরু করেছিলাম লিবিয়ায় গিয়ে। ওরা দুধছাড়া খায়। তবে খুবই কড়া। ঘন ঘন খায়। যেমন কড়া, তেমনি মিষ্টি। আবার ইউরোপীয়রা দেখুন খুবই হালকা চা পছন্দ করে। পানসে চায়ে আবার একগাদা দুধ ঢালবে। জানি না, কী স্বাদ পায় ওরা। তবে ওরাই কিন্তু চা-শিল্পের আজকের রবরবা অবস্থার জন্য দায়ী। আর যে চীনারা চায়ের জনক, আমাদের মতো কালো চায়ের ধারেকাছেই যাবে না। ওরা পান করে সবুজ চা। সারা দিন ওটাই ওদের একমাত্র পানীয়। ফ্লাস্কে ভরে দিনভর হাতের কাছে থাকবে। কিছুক্ষণ পরপরই এক-দুই চুমুক, তাতেই সতেজ। ওদের গায়ের চামড়ার মসৃণতার রহস্যও নাকি এই সবুজ চা। অ্যান্টি-অক্সিডেন্টে ভরা এই চা।
চায়ের জন্মকাহিনিটা জানা আছে কি? তবু বলি একটু। চীনের এক সম্রাট, তাঁর নাম শেন নুং (Shen Nung)। সেই ২৭৩৭ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ব্যাপার। তিনি শুধু সম্রাটই ছিলেন না, ছিলেন বিজ্ঞানী। নানান হারবাল ব্যাপার নিয়ে চলত তাঁর গবেষণা। তিনি আবিষ্কার করেন, পানীয় জল ফুটিয়ে খাওয়াটা অবশ্য কর্তব্য। এতে মানুষ রোগবালাই থেকে মুক্ত থাকতে পারে। নির্দেশ দিলেন প্রজাকুলকে। নিজেও পালন করতে লাগলেন তা। একবার হলো কি, সৈন্য-সামন্ত, লটবহর নিয়ে চললেন ভ্রমণে। রাত্রিবাসের জন্য তাঁবু খাটালেন গভীর জঙ্গলে। ভৃত্য সম্রাটের ব্যবহারের জন্য জল গরম করতে লাগল বিশাল পাত্রে, খোলা আকাশের নিচে। দেখা গেল ফুটন্ত পানি লাল রং ধারণ করে ফেলেছে। পড়ে গেল হইচই। কীভাবে সম্ভব? পানিতে কয়েকটি পাতা পড়ে থাকতে লক্ষ করলেন সম্রাট। তারপর লক্ষ করলেন পাশেই প্রায় ২০-২৫ ফুট লম্বা এক গাছ। তারই পাতা এই পানিতে। তিনি তাঁর লোকজনদের স্বাদ নিতে বলতেই সবাই পিছিয়ে গেল। সম্রাট তখন নিজেই পান করেন সেই পানীয়। সতেজ ভাব আসে তাঁর শরীরে। তখন থেকে তাঁর নির্দেশে এই পানীয় চীনারা পান করে, তিনি নিজে তো অবশ্যই করতেন। পরবর্তী সময় ক্যামেল নামের এক উদ্ভিদবিদের নামানুসারে এই গাছের নাম হয় ক্যামেলিয়া। আরও পরে চায়নিজ শব্দ সিনেসিস যোগ হয় তাতে। নাম হয় কামেলিয়া সিনেসিস। এতে ফুল হয় সাদা রঙের। চমৎকার সুবাসও ছড়ায়। লক্ষণীয় হলো, বিশ-ত্রিশ ফুটের গাছগুলোকে আমরা বামন করে রেখে আমাদের নেশার পাতা সংগ্রহ করে চলেছি।
চা একসময় বুড্ডিস্ট মংদের সহায়তায় চীন থেকে যায় জাপানে। তারপর গোটা বিশ্বে ছড়ায়। চা ব্যবসায় প্রথমে জড়ায় ওলোন্দাজরা। তারপর ব্রিটিশ। আমেরিকান কলোনিতে চা রপ্তানি করে পাউন্ডের পাহাড় গড়ে ব্রিটেন। অতিলোভের কারণে ১৭৭৩ সালে আমেরিকার কলোনিতে চায়ের ওপর ব্রিটেন বসায় অযৌক্তিক কর। তারই প্রতিরোধে বোস্টনে সেখানকার অধিবাসীরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জাহাজে উঠে পেটি ধরে ধরে বন্দরের জলে ফেলে দেয় চা। সমুদ্রের জল হয় চায়ে চা-ময়। এটা পৃথিবীর জন্য বিখ্যাত টি-পার্টি হিসেবে বিখ্যাত। এখান থেকেই আমেরিকার স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু হয়েছিল বলেই সবার বিশ্বাস।
তা হলে দেখছি, চা শুধু সতেজ রাখার পানীয়ই নয়, বিভিন্নভাবে শক্তিশালী নিয়ামক। চায়ের নেশায় ডুবে থাকা লিবীয়রা আজ মুক্তির সংগ্রামে পড়েছে ঝাঁপিয়ে। আর আমাদের দেশেই কদিন আগে দেখলাম, টিআইবি ও বিচার বিভাগের ঠান্ডাযুদ্ধ কী সুন্দরভাবে সমাধা হলো কেবল টি-পার্টির মাধ্যমে।
চা আমাদের জাতীয় উৎপাদিত রপ্তানি পণ্য। একে ব্যবহার করি না কেন কঠিন জাতীয় সমস্যা সমাধানে, জনকল্যাণে? তার জন্য প্রয়োজন সরকারের তরফ থেকে তার তাবৎ বিরোধীকে নিয়ে টি-পার্টি। কোনো ‘তলব নয়’, কারণ চা নাকি সাময়িক উত্তেজনা উপশমেও অব্যর্থ।
ঢাকা, ২১ এপ্রিল ২০১১
আবুল হায়াত: নাট্যব্যক্তিত্ব।
চায়ের নেশা প্রবল হওয়ার পেছনে আমার পেশারও আছে অবদান। নির্মাণকাজের দায়িত্বে থাকার সময় রাত-দিনের বিভিন্ন সময় ব্যস্ত থাকতে হতো কাজে, সেখানে চা-ই ছিল সতেজ থাকার প্রধান উপাদান। অভিনয়-পেশায় এসেও সেই একই ব্যাপার। তবে সময়ের আবর্তে পড়ে দুধ-চা, লেবু-চা, মসলা-চা অতিক্রম করে এখন ঠেকেছি এসে দুধ-চিনিবিহীন চায়ে। কখনো বা সবুজ চা। সবচেয়ে অপছন্দের চা হলো সুগন্ধি চা।
চা সম্পর্কে কিছু জ্ঞানও আহরণ করতে পেরেছি এ সময়ের মধ্যে। যেমন—চা বানাতে হবে একেবারে ফুটন্ত পানিতে—নইলে চা-পাতা তার রং-রস ছাড়বে না। পানিতে পাতা ছাড়ার পর জ্বাল দেওয়া চলবে না। আর হ্যাঁ, বেশি গরম চা কখনো খাওয়া যাবে না, তা শরীরের জন্য ক্ষতিকর। চায়ের প্রকৃত স্বাদ আসবে কেবল হালকা-উষ্ণ চায়ে।
ও হ্যাঁ, রং-চা খাওয়া শুরু করেছিলাম লিবিয়ায় গিয়ে। ওরা দুধছাড়া খায়। তবে খুবই কড়া। ঘন ঘন খায়। যেমন কড়া, তেমনি মিষ্টি। আবার ইউরোপীয়রা দেখুন খুবই হালকা চা পছন্দ করে। পানসে চায়ে আবার একগাদা দুধ ঢালবে। জানি না, কী স্বাদ পায় ওরা। তবে ওরাই কিন্তু চা-শিল্পের আজকের রবরবা অবস্থার জন্য দায়ী। আর যে চীনারা চায়ের জনক, আমাদের মতো কালো চায়ের ধারেকাছেই যাবে না। ওরা পান করে সবুজ চা। সারা দিন ওটাই ওদের একমাত্র পানীয়। ফ্লাস্কে ভরে দিনভর হাতের কাছে থাকবে। কিছুক্ষণ পরপরই এক-দুই চুমুক, তাতেই সতেজ। ওদের গায়ের চামড়ার মসৃণতার রহস্যও নাকি এই সবুজ চা। অ্যান্টি-অক্সিডেন্টে ভরা এই চা।
চায়ের জন্মকাহিনিটা জানা আছে কি? তবু বলি একটু। চীনের এক সম্রাট, তাঁর নাম শেন নুং (Shen Nung)। সেই ২৭৩৭ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ব্যাপার। তিনি শুধু সম্রাটই ছিলেন না, ছিলেন বিজ্ঞানী। নানান হারবাল ব্যাপার নিয়ে চলত তাঁর গবেষণা। তিনি আবিষ্কার করেন, পানীয় জল ফুটিয়ে খাওয়াটা অবশ্য কর্তব্য। এতে মানুষ রোগবালাই থেকে মুক্ত থাকতে পারে। নির্দেশ দিলেন প্রজাকুলকে। নিজেও পালন করতে লাগলেন তা। একবার হলো কি, সৈন্য-সামন্ত, লটবহর নিয়ে চললেন ভ্রমণে। রাত্রিবাসের জন্য তাঁবু খাটালেন গভীর জঙ্গলে। ভৃত্য সম্রাটের ব্যবহারের জন্য জল গরম করতে লাগল বিশাল পাত্রে, খোলা আকাশের নিচে। দেখা গেল ফুটন্ত পানি লাল রং ধারণ করে ফেলেছে। পড়ে গেল হইচই। কীভাবে সম্ভব? পানিতে কয়েকটি পাতা পড়ে থাকতে লক্ষ করলেন সম্রাট। তারপর লক্ষ করলেন পাশেই প্রায় ২০-২৫ ফুট লম্বা এক গাছ। তারই পাতা এই পানিতে। তিনি তাঁর লোকজনদের স্বাদ নিতে বলতেই সবাই পিছিয়ে গেল। সম্রাট তখন নিজেই পান করেন সেই পানীয়। সতেজ ভাব আসে তাঁর শরীরে। তখন থেকে তাঁর নির্দেশে এই পানীয় চীনারা পান করে, তিনি নিজে তো অবশ্যই করতেন। পরবর্তী সময় ক্যামেল নামের এক উদ্ভিদবিদের নামানুসারে এই গাছের নাম হয় ক্যামেলিয়া। আরও পরে চায়নিজ শব্দ সিনেসিস যোগ হয় তাতে। নাম হয় কামেলিয়া সিনেসিস। এতে ফুল হয় সাদা রঙের। চমৎকার সুবাসও ছড়ায়। লক্ষণীয় হলো, বিশ-ত্রিশ ফুটের গাছগুলোকে আমরা বামন করে রেখে আমাদের নেশার পাতা সংগ্রহ করে চলেছি।
চা একসময় বুড্ডিস্ট মংদের সহায়তায় চীন থেকে যায় জাপানে। তারপর গোটা বিশ্বে ছড়ায়। চা ব্যবসায় প্রথমে জড়ায় ওলোন্দাজরা। তারপর ব্রিটিশ। আমেরিকান কলোনিতে চা রপ্তানি করে পাউন্ডের পাহাড় গড়ে ব্রিটেন। অতিলোভের কারণে ১৭৭৩ সালে আমেরিকার কলোনিতে চায়ের ওপর ব্রিটেন বসায় অযৌক্তিক কর। তারই প্রতিরোধে বোস্টনে সেখানকার অধিবাসীরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জাহাজে উঠে পেটি ধরে ধরে বন্দরের জলে ফেলে দেয় চা। সমুদ্রের জল হয় চায়ে চা-ময়। এটা পৃথিবীর জন্য বিখ্যাত টি-পার্টি হিসেবে বিখ্যাত। এখান থেকেই আমেরিকার স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু হয়েছিল বলেই সবার বিশ্বাস।
তা হলে দেখছি, চা শুধু সতেজ রাখার পানীয়ই নয়, বিভিন্নভাবে শক্তিশালী নিয়ামক। চায়ের নেশায় ডুবে থাকা লিবীয়রা আজ মুক্তির সংগ্রামে পড়েছে ঝাঁপিয়ে। আর আমাদের দেশেই কদিন আগে দেখলাম, টিআইবি ও বিচার বিভাগের ঠান্ডাযুদ্ধ কী সুন্দরভাবে সমাধা হলো কেবল টি-পার্টির মাধ্যমে।
চা আমাদের জাতীয় উৎপাদিত রপ্তানি পণ্য। একে ব্যবহার করি না কেন কঠিন জাতীয় সমস্যা সমাধানে, জনকল্যাণে? তার জন্য প্রয়োজন সরকারের তরফ থেকে তার তাবৎ বিরোধীকে নিয়ে টি-পার্টি। কোনো ‘তলব নয়’, কারণ চা নাকি সাময়িক উত্তেজনা উপশমেও অব্যর্থ।
ঢাকা, ২১ এপ্রিল ২০১১
আবুল হায়াত: নাট্যব্যক্তিত্ব।
No comments