কল্পকথার গল্প-ম্যাটার লাইক ছেলের হাতের মোয়া by আলী হাবিব

অনুকরণ কি করতে পারি আমরা? পারলে কতটুকুই বা পারি? অন্যের অনুকরণে সিনেমা বানাই, ফ্যাশন করি। কবিতা? তা-ও লিখছি আজকাল। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন, 'তেত্রিশ বছর কাটল, কেউ কথা রাখেনি।' এমন তো আমরাও লিখতে পারি, 'চল্লিশ বছর কেটে গেল কারও নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়িত হলো না।'


বছর বছর এটার নতুন নতুন সংস্করণ হবে। গিরগিটির রং বদলের মতো দলবদলে দড় রাজনীতিকদের কথাও থাকবে সেখানে। শক্তি চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, 'যেতে পারি কিন্তু কেন যাব?' আমাদেরও শক্তি কম কিসে? আমরা লিখব, 'দিতে পারি কিন্তু কেন দেব?' যোগ্যতা ইজ দ্য ম্যাটার। অযোগ্যদের নিয়ে ভাবব না।
ফ্যাক্টর হচ্ছে, যোগ্যতা ও অযোগ্যতা। আমরা যে যার মতো নিজেদের যোগ্যতা নিয়ে কথা বলি। অন্যের অযোগ্যতা তুলে ধরতেও আমাদের কার্পণ্য নেই। আমরা কখনো দিচ্ছি, কখনো নিচ্ছি। নিচ্ছি মানে তুলে নিচ্ছি। আমি আমার প্রতিবেশীর ঘরে চাল দেওয়ার জন্য টিন দিয়েছিলাম। বর্ষাকালে সেটা তুলে নিলাম। বেচারা খুব বিপদে পড়ে গেল। এই দেওয়া-নেওয়ার ব্যাপারটা এমনই যেন। দেওয়ার সময় ভাবিনি, কেন দিলাম? নেওয়ার সময়ও ভাবলাম না, কেন নিলাম? মুখের কথাতেই যখন দেওয়া ও নেওয়া- তখন দিতেই বা অসুবিধা কোথায়, নিতেই বা অসুবিধা কোথায়! এই মুখের কথা আমাদের কোথায় নিয়ে যেতে পারে, তা আমরা কখনো কি ভেবে দেখেছি? ভেবে দেখতে গেলে দেখা যাবে ব্যাপারটা সহজ নয়। দিস ইজ নট আ ম্যাটার লাইক ছেলের হাতের মোয়া। অবশ্যি ছেলের হাতের মোয়াও এখন অতোটা সহজ নয়। মোয়া ছেলের হাতে দেওয়ার আগে ভেবে দেখতে হবে, সেটা হাইজিনিক কি না। কেন মোয়া, কী মোয়া, কোথাকার মোয়া- এসব এখন একটু ভেবে দেখতে হয়। জয়নগরের মোয়ার মতো এখানে কোনো মোয়া বোধহয় এখনো ব্র্যান্ডেড হয়নি। তা সে ব্র্যান্ড আইটেম হোক বা না হোক, ভেবে দেখার বিকল্প নেই। কাজেই দেওয়ার আগে ভেবে দেখতে হবে। নেওয়ার আগে তো বটেই। দেওয়ার আগে ভাবতে হবে, কী দিচ্ছি, কেন দিচ্ছি? নেওয়ার আগে ভেবে দেখতে হবে কেন নিচ্ছি? 'যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই'- সব কিছু স্বর্ণজনিত ছাই মনে করার কোনো কারণ নেই। কোনো কোনো ছাইয়ের নিচে চাপা আগুন থাকতে পারে। উড়িয়ে দেখার জন্য হাত দিলে হাত পুড়ে যাওয়ার, নিদেনপক্ষে ছ্যাঁকা লেগে ফোস্কা পড়ার আশঙ্কাই বেশি। অন্যদিকে পরিবেশ বলে একটা ব্যাপার আছে। ব্যাপারটা আজকাল আর কোনো দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এটা এখন গ্লোবাল ইস্যু। সুতরাং ছাই উড়িয়ে দেখার মতো, কথা বাতাসে ভাসিয়ে দেওয়ার আগে পরিবেশ রক্ষার ব্যাপারটি নিয়ে ভাবতে হবে। অন্যথায় পরিবেশ দূষণের দায় এড়ানো কঠিন হয়ে যাবে। কারণ পরিবেশ আজকাল আর কেবলই ছাইয়ের ওপর নির্ভর করে না। কে, কিভাবে, কখন, কোথায় পরিবেশ দূষণের দায়ে দায়ী হবেন- সেটা আবার সময়ের ওপর নির্ভর করে। এক দেশের বুলি যেমন অন্য দেশের গালি, তেমনই এক সময়ে যে কথা শুনতে ভালো লাগে, অন্য সময় সে কথাটাই বিষময় মনে হয়। কিন্তু মুখের কথায় যখন দেওয়া ও নেওয়া চলছে, তখন যে যার মতো দিচ্ছি আর তুলে নিচ্ছি। জানি, আমাদের প্রত্যেকের একটা ব্যক্তিগত জীবন আছে। আমরা আমাদের সেই জীবন উৎসর্গ করে দিয়েছি আরেকজনের হাতে। যাচ্ছেতাই ঘটনা ঘটছে তাতে। কেচ্ছা ছড়াতে কোনো বাধা নেই। ছড়াচ্ছি। ছড়াতে আমাদের বিকল্প পাওয়া মুশকিল। জাতি কোথায় ওপরের দিকে উঠবে, তা না; গাছে তুলে মই কেড়ে নেওয়ার জোগাড়। মুখ দেখাদেখি বন্ধ। তাহলে সুখের দেখা মিলবে কী করে? মুখেই তো সুখের রেখা সবার আগে ফুটে ওঠে। মুখই যদি না দেখলাম তো সুখ দেখব কী করে? না, মুখ আমাদের দেখার কিংবা দেখানোর জন্য নয়। মুখ দিয়েছেন যিনি, বলতে শিখিয়েছেন তিনি। আমরা বলে যাচ্ছি।
কথা হচ্ছিল কথা নিয়ে। না ভেবে কথা বলার বিপদ নিয়ে একটা গল্প বলা যাক। এ গল্পের নায়ক নচিকেতা। না, আজকের দিনের গায়ক নচিকেতা ইনি নন। এটা মহাভারতের গল্প। কাজেই অনেক অ-নে-ক দিন আগের কথা বলে শুরু করা যেতে পারে। তো, সেই প্রাচীনকালে এক ছিলেন ঋষি। ঋষি উদ্দানকি। তাঁর একমাত্র পুত্রের নাম নচিকেতা। ঋষি থাকেন তাঁর আশ্রমে। সেখানেই তাঁর পুত্রের বেড়ে ওঠা। এক দিন সকালে ঋষি গেছেন নদীতে স্নান করতে। স্নানশেষে নিজের মনেই ফিরে এসেছেন আশ্রমে। আনতে ভুলে গেছেন পূজার উপকরণ। আশ্রমে ফিরে সে কথা মনে হতেই পুত্র নচিকেতাকে বললেন নদীর ঘাট থেকে ফল-ফুল ও পূজার উপকরণ নিয়ে আসতে। ওদিকে বেলা অনেক গড়িয়ে গিয়েছিল। তিনি ছিলেন ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় কাতর। কিন্তু পূজা না করে তো আর আহার করতে পারেন না! পুত্র নচিকেতা নদীর ঘাটে গিয়ে দেখতে পেলেন, পূজার উপকরণ, ফুল-ফল সব নদীতে ভেসে গেছে। তিনি ফিরে এলেন আশ্রমে। বাবাকে বললেন, নদীর ঘাটে তিনি কিছুই পাননি। সব নদীর পানিতে ভেসে গেছে। এই শুনে ভীষণ ক্রুদ্ধ হলেন ঋষি উদ্দানকি। তাঁর মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, তোমার সঙ্গে যমের দেখা হোক। অমনি ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে গেল নচিকেতার শরীর। তিনি লুটিয়ে পড়লেন। ঋষি উদ্দানকি ততক্ষণে বুঝতে পেরেছেন, তিনি কী সর্বনাশা বাক্য উচ্চারণ করে ফেলেছেন। ছেলের অচেতন দেহ কোলে নিয়ে তিনি হা-হুতাশ শুরু করলেন। তাঁর চোখের পানিতে মুখ ভেসে যেতে থাকল। অন্যদিকে নচিকেতা চলে গেছেন যমপুরীতে, সেখানে গিয়ে তিনি দেখতে পেলেন যমরাজ স্বর্ণখচিত সিংহাসনে বসে বিচার করছেন। স্বর্গের চিরস্থায়ী অ্যাকাউন্টেন্ট চিত্রগুপ্তও নিশ্চয় সেখানে ছিলেন। গল্পে তাঁর কোনো বিবরণ নেই। যমের এজলাসে নচিকেতা গিয়ে দাঁড়াতেই যম মহাসমাদরে তাঁকে আহ্বান করলেন। জানালেন, ব্যাপারটা নিতান্তই একটা ভুল। তাঁকে খুব তাড়াতাড়িই মর্ত্যে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু স্বর্গে পূণ্যত্মারা কোথায় কী অবস্থায় থাকেন, সেটা দেখে তবেই মর্ত্যে যেতে চাইলেন নচিকেতা। যমরাজের নির্দেশে তাঁকে সেটা দেখাতে নিয়ে যাওয়া হলো। নচিকেতা দেখলেন, বাড়িঘর চন্দ্র, সূর্যের মতো উজ্জ্বল। তাতে ঘরের কাজও চলে আবার গাড়ির কাজও চলে। বেলুনের মতো উড়ে যাওয়া যায়। আহা, এমন বাড়ি যদি আমাদের হতো! বাড়িভাড়া দেওয়ার চিন্তা থাকত না। থাকত না লোডশেডিং নিয়ে মাথাব্যথা। যানজটকে একেবারেই কেয়ার করতাম না। নচিকেতা দেখলেন, স্বর্গে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে মিষ্টান্নের পর্বত, বইছে দুধের নদী। আর ঘৃতের হ্রদও আছে এক পাশে। আহা, এসব যদি আমাদের দেশে থাকত! বাজারে যা দাম, কিনে খাওয়ার সামর্থ্য তো অনেকেরই নেই। আরো কী দেখা গেল? দেখা গেল সেখানে গাছে গাছে ঝুলছে হরেক রকম ফল। হাত বাড়ালেই পাওয়া যায়। আহা, এসব যদি থাকত আমাদের দেশে! আমাদের তাহলে আর কার্বাইড দিয়ে পাকানো ফল খেতে হতো না। এসব দেখে নচিকেতা যখন আহ্লাদিত, তখনই তাঁর ফিরে যাওয়ার নির্দেশ হলো। সত্য-মিথ্যা হুট করে বলা তো সম্ভব নয়। বইয়ে পড়া গল্প।
আজকাল বউয়ের অত্যাচারে অনেকের বই পড়া হয়ে ওঠে না। বাজার করার মুরোদ নেই আবার বই কেনা! সে আমলে বইতে ভালো ভালো কথা লেখা থাকত- 'ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না।' সে আমলের এসব উপদেশমূলক কথা ঘুরিয়ে আজকাল নাকি নতুন নতুন বাক্য গঠন করা হচ্ছে। এমনই এক নতুন বাক্য শুনিয়ে গেলেন এক বন্ধু- 'ভাবিয়া বলিও কথা, বলিয়া ভাবিও না।' বন্ধুবরকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। শোনা কথা তিনি শুনিয়ে যেতেই পারেন। এসব তো অনেকটাই বিনা মূল্যে বিতরণের মতো। কিন্তু সেদিন সন্ধ্যায় শুনি এক নতুন গান। পাড়ার ছোকরারা নতুন ব্যান্ড গড়েছে। প্র্যাকটিস প্যাডে গিটার বাজিয়ে ড্রামস পিটিয়ে বেশ গান করে তারা। সেদিন সন্ধ্যায় কান পাততেই শুনি সমস্বরে তারা গাইছে-
আমরা যা খুশি তাই বলি,
এবং যে যার মতো চলি
আমরা যখন তখন খাচ্ছি হোঁচট
গাড্ডা ও গর্তে
তবু, ঠায় দাঁড়িয়ে থাকব দুজন
যে যারই শর্তে
আমরা সবাই...
কঠিন জিনিস। নট আ ম্যাটার লাইক ছেলের হাতের মোয়া ব্রাদার।
লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.