জারদারির ভারত সফর-অনেক খারাপ খবরের পর ভালো সংবাদ by জেসন বুরকি

পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারির ভারত সফর শুধু দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রেই নয়, দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোতেও প্রভাব ফেলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিশ্বের সংবাদপত্র ও টেলিভিশনের নজর ছিল এই সফরকে ঘিরে।


এখানে লন্ডনের গার্ডিয়ান ও পাকিস্তানের নেশন পত্রিকা থেকে দুটি লেখার অনুবাদ প্রকাশ করা হলো। ভাষান্তর করেছেন সুভাষ সাহা

পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারি রোববার মুসলিম সাধক খাজা মঈনুদ্দিন চিশতির দরগায় গিয়েছেন। সেখানে তার সঙ্গে ছেলে ২৩ বছরের বিলাওয়াল ও বিরাট সফরসঙ্গী দল ছিল। দিলি্লর ২৫০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত রাজস্থানের মরু শহর আজমিরে ১২ শতকের এই সাধকের দরগায় তিনি এক ঘণ্টার মতো সময় অতিবাহিত করেন।
এর ঘণ্টাখানেক আগে তার সম্মানে নয়াদিলি্লতে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের দেওয়া মধ্যাহ্নভোজের সময় মি. সিং তাকে দরগায় গিয়ে দু'দেশের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য মোনাজাত করতে অনুরোধ করেন। যদিও এই আলোচনায় ভালো ভালো কথাবার্তা ছাড়া কিছুই সুনির্দিষ্টভাবে সমাধান হয়ে যায়নি, তবুও পশ্চিমা কূটনীতিকরা জারদারির এই ভারত সফরকে 'অনেক খারাপ খবরের পর ভালো সংবাদ' হিসেবে বর্ণনা করে বলেছেন, এই আলোচনা দু'দেশের সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রে সত্যিকার সাফল্যের সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ওয়াশিংটন ও ইউরোপীয় দেশগুলো ভারত ও পাকিস্তানকে তাদের বিরোধ মিটিয়ে ফেলার জন্য বারবার চাপ দিয়ে আসছিল। এ অঞ্চলে বিশেষ করে আফগানিস্তানে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার জন্য ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কোন্নয়নের গুরুত্ব তারা উপলব্ধি করেছিল।
পাকিস্তানের নিরাপত্তা এস্টাবলিশমেন্ট বিভিন্ন নামের আধাসামরিক জঙ্গি গ্রুপগুলোকে রক্ষা ও সহায়তা দিয়ে আসছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল প্রচলিত অস্ত্রশক্তিতে পাকিস্তানের চেয়ে অনেকদূর অগ্রসর ভারতের বিরোধী শক্তি হিসেবে এদের ব্যবহার করা এবং আফগানিস্তানে দিলি্লর প্রভাবের বিরুদ্ধেও এদের কাজে লাগানো। এ জন্য পাকিস্তানের নিরাপত্তা এস্টাবলিশমেন্ট আফগানিসন্তানে ন্যাটো বাহিনীর বিরুদ্ধে জঙ্গিদের সহায়তা দিয়ে আসছে বলে সন্দেহ করা হয়। তারা এই জঙ্গিদের মাধ্যমে আফগানিস্তানে নিজেদের প্রভাব নিরঙ্কুশ করতে চায়। অন্যদিকে ন্যাটো ২০১৪ সালে আফগানিস্তান ত্যাগের আগে সেখানকার পরিস্থিতি স্থিতিশীল করার জন্য ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার বিরোধের অবসান চায়। সে কারণেই পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে ভারত-পাকিস্তান সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা জরুরি অগ্রাধিকারের বিষয়। এক কূটনীতিকের মতে, এটা আসলে এতদিন আশার ছলনা হয়েই ছিল। অনেক চেষ্টার পরও দুটি দেশ কখনও ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে আবদ্ধ হয়নি। তবে এবারের প্রচেষ্টা সত্যিকার ইতিবাচক ফল দেবে_ এমন আশা আমরা করতে পারি। দিলি্লর নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সাংবাদিক মনোজ যোশী মনে করেন, জারদারির এই সফরটা প্রতীকীর চেয়েও বেশি কিছু। দুই নেতাই শান্তি কর্মসূচির ব্যাপারে ভীষণভাবে আগ্রহী এবং এ ধরনের অনানুষ্ঠানিক বৈঠক প্রমাণ করে, তাদের ওপর আনুষ্ঠানিক বৈঠকের যে ধরনের চাপ থাকে সে ধরনের কোনো চাপ ছিল না। তারা নিরুদ্বেগের সঙ্গেই তাদের মধ্যকার প্রয়োজনীয় আলোচনা সারতে পেরেছেন। যোশীর মতে, জারদারির এই সফরটা মূলত তার খাজা মঈনুদ্দিন চিশতির দরবার শরিফে যাওয়ার মধ্যেই প্রথমদিকে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু দ্রুতই এটা একপ্রকার রাষ্ট্রীয় সফরে রূপ নেয়। দিলি্লতে পেঁৗছেই জারদারি প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে একান্ত অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে মিলিত হওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে যান।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি আশা করেন, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়ে আসবে। তিনি পাকিস্তান সফরে যাওয়ার জন্য জারদারির আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। জারদারিও বলেন, তিনি ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের সুসম্পর্ক আশা করেন।
এর আগে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বার প্রতিষ্ঠাতা হাফিজ সাঈদকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য এক কোটি ডলারের পুরস্কার ঘোষণা করলে এই সফরের ওপর তার আংশিক ছায়া পড়ে। এই সংগঠন ও এর নেতা ২০০৮ সালে মুম্বাই হামলার সঙ্গে জড়িত বলে প্রমাণ রয়েছে এবং ভারতও তাদের কাছে হস্তান্তরের জন্য তাকে পাকিস্তানের কাছে চেয়ে আসছিল।
পাকিস্তান এতদিন অকাট্য প্রমাণে নেই উল্লেখ করে প্রবীণ জঙ্গি নেতা হাফিজ সাঈদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছিল। তবে ভারতের কর্মকর্তারা বলেন, এই জঙ্গি নেতার বিরুদ্ধে যথেষ্ট সাক্ষ্য-প্রমাণ পাকিস্তানকে দেওয়া দলিলপত্রে সনি্নবেশ করা আছে। ভোজসভায় জারদারি এ ব্যাপারে মনমোহন সিংকে বলেছেন, এই জঙ্গি নেতাকে বারবার গ্রেফতার করা হলেও তার শাস্তি হয়নি। দুই নেতার মধ্যে আলোচনায় দু'দেশের শীতল সম্পর্কের অন্যতম কারণ কাশ্মীর প্রসঙ্গও উঠে আসে। কাশ্মীরের সিয়াচেন হিমবাহের কাছে চাপাপড়া শতাধিক পাকিস্তানি সৈন্য উদ্ধারে ভারতীয় সাহায্যের প্রস্তাব দেন মনমোহন সিং। ওই হিমবাহটিতে দুই দেশের সৈন্যরা মুখোমুখি অবস্থান করে।
তবে উভয় নেতার আলোচনায় ঘুরেফিরে কম বিরোধাত্মক বিষয় যেমন_ বাণিজ্য বৃদ্ধি, ভিসা ব্যবস্থা সহজ করা ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের বিষয় প্রাধান্য পায়। ধারণা করা হচ্ছে, এ বছরের শেষ দিকে পাকিস্তান ভারতকে সর্বাধিক বাণিজ্য সুবিধাপ্রাপ্ত দেশের (এমএফএম) মর্যাদা দেবে।
তার স্ত্রী বেনজির ভুট্টো ২০০৮ সালে আততাতীয় গুলিতে নিহত হওয়ার পর ক্ষমতায় বসে বারবার জারদারি ভারতের সঙ্গে তার দেশের উন্নত সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। তবে তার এই আকাঙ্ক্ষা বারবার তার সরকারের বাজে অর্থনৈতিক পারফরম্যান্স এবং নিরাপত্তা এস্টাবলিশমেন্টের কট্টরপন্থিদের কারণে বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
মৃদুভাষী অর্থনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংও অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছেন। তার সরকার অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার লড়াই, দুর্নীতি, জোট-রাজনীতির কারণে প্রায় অচল হয়ে পড়েছে।
যোশীর মতে, তারপরও দু'দেশের সম্পর্কোন্নয়ন নিয়ে যথেষ্ট আলোচনা হচ্ছে। ব্যাক-চ্যানেল যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে। মাঝপথে এসব প্রচেষ্টা মুম্বাই হামলার কারণে থমকে যায়। তবে অনেক সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতা সত্ত্বেও জারদারি দু'দেশের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও সম্পর্কোন্নয়নের ব্যাপারে যে আগ্রহী তাতে কোনো সন্দেহ নেই। মনমোহন সিংয়ের বেলায় একই কথা খাটে।
প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে মধ্যাহ্নভোজে দক্ষিণাঞ্চলীয়, পশ্চিমাঞ্চলীয় ও উত্তর ভারতের ডিশের মিশেল ছিল। এর মধ্যে কাশ্মীরি বিশেষ পদও ছিল। হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টির নেত্রী ও লোকসভায় বিরোধীদলীয় নেত্রী সুষমা স্বরাজ বলেন, সব শেষে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টকে দু'দেশের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আজমিরে খাজা মঈনুদ্দিন চিশতির দরবারে মোনাজাত করার জন্য অনুরোধ করলে প্রেসিডেন্ট তাতে সম্মতি জানান।

স লন্ডন থেকে প্রকাশিত গার্ডিয়ান পত্রিকা থেকে অনূদিত

No comments

Powered by Blogger.