চারদিক-রাজধানীতে বৈশাখী মেলা by মিজানুর রহমান
নববর্ষের আগমনে বৈশাখী মেলা—এ যেন বাংলা নববর্ষকে উৎসবে, বরণে বাঙালির বিরাট আনন্দমাধ্যম ছাড়াও সুপ্রাচীন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। সেই ছেলেবেলায় নববর্ষে বৈশাখী মেলা আগমনের প্রত্যাশায় থেকেছি আমরা অধীর আগ্রহে। ব্রহ্মপুত্রের শাখা নদী নরসুন্দার তীরে মেলা বসবে। কতই-না আমাদের আনন্দ।
মা-বাবার কাছে মেলায় কেনাকাটার জন্য টাকাপয়সার আবদার। অনেকের জীবনে হয়তো তা ঘটেছে বহুবার। মেলায় হাজারো পণ্যের পসরা সাজাত দোকানিরা। ছিল পুতুলনাচ, সার্কাস, বায়স্কোপের বাক্স, মাটির পুতুল, গরু ও ঘোড়া, বিভিন্ন রকমের ফল, হাঁড়ি-পাতিল, রঙিন বেলুন, নানা রকমের ঘুড়ি, খেলনা ইত্যাদি। মেলার মন্ডা-মিঠাই, জিলিপি ও শরবতের অনুপম স্বাদ মনে হয় এখনো ওষ্ঠে লেগে আছে। মেলার সবকিছুতেই যেন আলাদা আকর্ষণ।
রাজধানীতে নববর্ষ উৎসবে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প করপোরেশনের (বিসিক) বৈশাখী মেলার শুরু ১৩৮৫ বঙ্গাব্দে। বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে হয়েছিল সে মেলা। শিল্পী পটুয়া কামরুল হাসান ও ভাষাসৈনিক শিল্পী ইমদাদ হোসেনসহ আরও অনেকে গ্রামীণ আবহ মিশিয়ে এ মেলার আয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। বিগত দিনে দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধানেরাও উদ্বোধন করেছেন বৈশাখী মেলার। এবার ৩৪ বছর পূর্ণ করল বিসিকের বৈশাখী মেলা। বাংলা একাডেমীতে শুরু হলেও পরে বাংলাদেশ শিশু একাডেমী, ধানমন্ডি ক্লাব মাঠ, আজিমপুর বালিকা বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী ও শেরেবাংলা নগর আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার মাঠ হয়ে বৈশাখী মেলা আবার ফিরে এসেছে শুরু হওয়া প্রাঙ্গণে।
প্রাচীন মেলার চালচিত্র যেন আজ বহু ক্ষেত্রেই অনেক বদলে গেছে। সেই সুদীর্ঘকাল থেকে এ দেশের মানুষের আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনধারায় মেলা ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে রেখেছিল। কিন্তু আজ আর তেমনটি নেই। অনেক ক্ষেত্রেই মেলার আদি রূপ ও মেলা আয়োজনের মূল উদ্দেশ্যই যেন হারিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মেলা যেন এখন শুধু অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশে বাড়ছে মানুষ। বদলে যাচ্ছে মানুষের চালচলন, পথঘাট এবং শিক্ষা-দীক্ষাসহ আরও অনেক কিছু। বদলে যাচ্ছে আমাদের ঐতিহ্যবাহী মেলার চালচিত্র।
এ দেশে সারা বছরই বিভিন্ন পালা-পার্বণ উপলক্ষে মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। অন্যান্য বছরের মতো এবারও পয়লা বৈশাখ থেকে বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে বৈশাখী মেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। মেলা হচ্ছে বিসিক ও বাংলা একাডেমীর যৌথ উদ্যোগে। মেলা চলবে ১০ দিনব্যাপী ১ থেকে ১০ বৈশাখ পর্যন্ত। আজ মেলার শেষ দিন।
বৈশাখী মেলায় দেশের বিভিন্ন এলাকার কুটির, হস্ত ও কারুশিল্পীদের উৎপাদিত পণ্যের ঘটেছে বিপুল সমাহার। হাতের তৈরি বাঁশ ও বেতের পণ্য, মৃৎশিল্প, পাটপণ্য, নকশিকাঁথা, শতরঞ্জি, বাঁশের বাঁশি, কাঠজাত পণ্য, গৃহের সাজসজ্জার পণ্য, গয়না, রকমারি চুড়ি, পুঁতির মালা, ঝিনুকের পণ্য, জামদানি ও তাঁতের শাড়ি, প্লাস্টিকের পণ্য, বই ছাড়াও বহুবিধ পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছে দোকানিরা। আছে নানা রকম কদমা-বাতাসা, মন্ডা-মিঠাই। মেলায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কর্মরত কারুশিল্পীরা তাঁদের বিভিন্ন হস্ত ও কারুশিল্প পণ্য তৈরি প্রক্রিয়া প্রদর্শন ও বিক্রি করছেন। পয়লা বৈশাখ মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ছিল বিশেষ সাংস্কৃতিক ও নৃত্যানুষ্ঠান। মেলা চলাকালে প্রতিদিন সন্ধ্যায় থাকছে আমাদের গর্বের ধন লোকসংস্কৃতির নানা অনুষ্ঠান। এতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী লোকসংগীতসহ অন্যান্য গান পরিবেশিত হচ্ছে। মহানগরের ব্যস্ততম মানুষ ক্ষণিকের জন্য হলেও হারিয়ে যাচ্ছে এক নির্মল বিনোদন ও আনন্দের মাঝে। খুঁজে ফিরছে অতীত দিনের স্মৃতি ও আপন ভুবন।
বাংলা নববর্ষকে উৎসবে বরণ বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। বর্ষবরণ উপলক্ষে মেলার আয়োজনও উৎসবেরই অংশ। বাংলা নববর্ষ উদ্যাপনের বিশেষ দিক হলো এর সর্বজনীন রূপ। বৈশাখী মেলাও যেন সবার—সব মানুষের। মেলায় সবাই যেন এক ও অভিন্ন। ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায়, পেশা, গোষ্ঠীর দেয়াল এখানে কাউকে আলাদা করতে পারে না। এ যেন বাঙালির চিরচেনা অসাম্প্রদায়িক চেতনারই বহিঃপ্রকাশ।
দেশের ক্ষুদ্র, কুটির ও হস্তশিল্প খাতের উদ্যোক্তাদের উৎপাদিত পণ্যসামগ্রীর বাজার সৃষ্টিতে সহায়তা প্রদান, শহুরে ও বিদেশিদের সামনে গ্রামীণ পণ্যের পরিচিতি ঘটানো এবং নতুন নতুন নকশা ও নমুনার সঙ্গে কারুশিল্পীদের পরিচিত করাসহ গ্রামীণ সংস্কৃতির সঙ্গে শহুরে মানুষকে সম্পৃক্ত করার উদ্দেশ্য সামনে রেখে বিসিক বৈশাখী মেলা শুরু করে। বৈশাখী মেলা আজ রাজধানীবাসীর অন্যতম আকর্ষণে পরিণত হয়েছে। হস্ত ও কুটির- শিল্পজাত সামগ্রী কেনাবেচা ছাড়াও এ মেলা আমাদের গ্রামবাংলার সুপ্রাচীন ঐতিহ্যের ব্যাপক প্রকাশ ঘটাচ্ছে নগরের ব্যস্ততম মানুষজনের মধ্যে। শহুরে মেলায় গ্রামীণ পণ্যসামগ্রীর সমারোহ ও সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রকাশ ঘটাচ্ছে এ মেলা, তা ইতিমধ্যে আমাদের ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। বাংলা একাডেমীর প্রাঙ্গণের বৈশাখী মেলা সেই ছেলেবেলার মেলার স্মৃতি হয়তো বা আমার মতো আরও অনেককেই আলোড়িত করছে।
মিজানুর রহমান
রাজধানীতে নববর্ষ উৎসবে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প করপোরেশনের (বিসিক) বৈশাখী মেলার শুরু ১৩৮৫ বঙ্গাব্দে। বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে হয়েছিল সে মেলা। শিল্পী পটুয়া কামরুল হাসান ও ভাষাসৈনিক শিল্পী ইমদাদ হোসেনসহ আরও অনেকে গ্রামীণ আবহ মিশিয়ে এ মেলার আয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। বিগত দিনে দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধানেরাও উদ্বোধন করেছেন বৈশাখী মেলার। এবার ৩৪ বছর পূর্ণ করল বিসিকের বৈশাখী মেলা। বাংলা একাডেমীতে শুরু হলেও পরে বাংলাদেশ শিশু একাডেমী, ধানমন্ডি ক্লাব মাঠ, আজিমপুর বালিকা বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী ও শেরেবাংলা নগর আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার মাঠ হয়ে বৈশাখী মেলা আবার ফিরে এসেছে শুরু হওয়া প্রাঙ্গণে।
প্রাচীন মেলার চালচিত্র যেন আজ বহু ক্ষেত্রেই অনেক বদলে গেছে। সেই সুদীর্ঘকাল থেকে এ দেশের মানুষের আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনধারায় মেলা ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে রেখেছিল। কিন্তু আজ আর তেমনটি নেই। অনেক ক্ষেত্রেই মেলার আদি রূপ ও মেলা আয়োজনের মূল উদ্দেশ্যই যেন হারিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মেলা যেন এখন শুধু অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশে বাড়ছে মানুষ। বদলে যাচ্ছে মানুষের চালচলন, পথঘাট এবং শিক্ষা-দীক্ষাসহ আরও অনেক কিছু। বদলে যাচ্ছে আমাদের ঐতিহ্যবাহী মেলার চালচিত্র।
এ দেশে সারা বছরই বিভিন্ন পালা-পার্বণ উপলক্ষে মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। অন্যান্য বছরের মতো এবারও পয়লা বৈশাখ থেকে বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে বৈশাখী মেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। মেলা হচ্ছে বিসিক ও বাংলা একাডেমীর যৌথ উদ্যোগে। মেলা চলবে ১০ দিনব্যাপী ১ থেকে ১০ বৈশাখ পর্যন্ত। আজ মেলার শেষ দিন।
বৈশাখী মেলায় দেশের বিভিন্ন এলাকার কুটির, হস্ত ও কারুশিল্পীদের উৎপাদিত পণ্যের ঘটেছে বিপুল সমাহার। হাতের তৈরি বাঁশ ও বেতের পণ্য, মৃৎশিল্প, পাটপণ্য, নকশিকাঁথা, শতরঞ্জি, বাঁশের বাঁশি, কাঠজাত পণ্য, গৃহের সাজসজ্জার পণ্য, গয়না, রকমারি চুড়ি, পুঁতির মালা, ঝিনুকের পণ্য, জামদানি ও তাঁতের শাড়ি, প্লাস্টিকের পণ্য, বই ছাড়াও বহুবিধ পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছে দোকানিরা। আছে নানা রকম কদমা-বাতাসা, মন্ডা-মিঠাই। মেলায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কর্মরত কারুশিল্পীরা তাঁদের বিভিন্ন হস্ত ও কারুশিল্প পণ্য তৈরি প্রক্রিয়া প্রদর্শন ও বিক্রি করছেন। পয়লা বৈশাখ মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ছিল বিশেষ সাংস্কৃতিক ও নৃত্যানুষ্ঠান। মেলা চলাকালে প্রতিদিন সন্ধ্যায় থাকছে আমাদের গর্বের ধন লোকসংস্কৃতির নানা অনুষ্ঠান। এতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী লোকসংগীতসহ অন্যান্য গান পরিবেশিত হচ্ছে। মহানগরের ব্যস্ততম মানুষ ক্ষণিকের জন্য হলেও হারিয়ে যাচ্ছে এক নির্মল বিনোদন ও আনন্দের মাঝে। খুঁজে ফিরছে অতীত দিনের স্মৃতি ও আপন ভুবন।
বাংলা নববর্ষকে উৎসবে বরণ বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। বর্ষবরণ উপলক্ষে মেলার আয়োজনও উৎসবেরই অংশ। বাংলা নববর্ষ উদ্যাপনের বিশেষ দিক হলো এর সর্বজনীন রূপ। বৈশাখী মেলাও যেন সবার—সব মানুষের। মেলায় সবাই যেন এক ও অভিন্ন। ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায়, পেশা, গোষ্ঠীর দেয়াল এখানে কাউকে আলাদা করতে পারে না। এ যেন বাঙালির চিরচেনা অসাম্প্রদায়িক চেতনারই বহিঃপ্রকাশ।
দেশের ক্ষুদ্র, কুটির ও হস্তশিল্প খাতের উদ্যোক্তাদের উৎপাদিত পণ্যসামগ্রীর বাজার সৃষ্টিতে সহায়তা প্রদান, শহুরে ও বিদেশিদের সামনে গ্রামীণ পণ্যের পরিচিতি ঘটানো এবং নতুন নতুন নকশা ও নমুনার সঙ্গে কারুশিল্পীদের পরিচিত করাসহ গ্রামীণ সংস্কৃতির সঙ্গে শহুরে মানুষকে সম্পৃক্ত করার উদ্দেশ্য সামনে রেখে বিসিক বৈশাখী মেলা শুরু করে। বৈশাখী মেলা আজ রাজধানীবাসীর অন্যতম আকর্ষণে পরিণত হয়েছে। হস্ত ও কুটির- শিল্পজাত সামগ্রী কেনাবেচা ছাড়াও এ মেলা আমাদের গ্রামবাংলার সুপ্রাচীন ঐতিহ্যের ব্যাপক প্রকাশ ঘটাচ্ছে নগরের ব্যস্ততম মানুষজনের মধ্যে। শহুরে মেলায় গ্রামীণ পণ্যসামগ্রীর সমারোহ ও সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রকাশ ঘটাচ্ছে এ মেলা, তা ইতিমধ্যে আমাদের ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। বাংলা একাডেমীর প্রাঙ্গণের বৈশাখী মেলা সেই ছেলেবেলার মেলার স্মৃতি হয়তো বা আমার মতো আরও অনেককেই আলোড়িত করছে।
মিজানুর রহমান
No comments