জারদারির ভারত সফর-চীন-ভারত মডেলই আদর্শ! by মনীষ চাঁদ

পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারির ভারত সফর শুধু দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রেই নয়, দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোতেও প্রভাব ফেলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিশ্বের সংবাদপত্র ও টেলিভিশনের নজর ছিল এই সফরকে ঘিরে। এখানে লন্ডনের গার্ডিয়ান ও পাকিস্তানের নেশন পত্রিকা থেকে দুটি লেখার অনুবাদ প্রকাশ করা হলো।


ভাষান্তর করেছেন সুভাষ সাহা

ভারতের সঙ্গে পাকিস্তান তার স্পর্শকাতর সম্পর্কোন্নয়নে 'ভারত-চীন' মডেল অনুসরণে সম্মত হওয়ায় দুই বৈরী দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে সম্ভাব্য গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। চীন ও ভারত তাদের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় সংবেদনশীল বিরোধের বিষয়গুলো ধাপে ধাপে সমাধান প্রচেষ্টার পাশাপাশি দু'দেশের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক জোরদার করার নীতি নিয়েছে। রোববার ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে মনমোহন-জারদারি ৪০ মিনিট একান্ত আলোচনার পর উভয় পক্ষের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে দুই শীর্ষ নেতা মধ্যাহ্নভোজে মিলিত হন।
মধ্যাহ্নভোজের সময় জারদারি মনমোহন সিংকে বলেন, ভারত ও চীনের মধ্যে অনেক বিষয়ে মতপার্থক্য থাকার পরও তাদের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার হচ্ছে। এভাবে জারদারি ভারত-চীন মডেল অনুসরণ করে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে সম্পর্কোন্নয়ন সম্ভব বলে ইঙ্গিত দেন। তাদের আলোচনা মধ্যাহ্নভোজের সময়ও চলে। সে সময় আলোচনায় সিং ও জারদারি দু'দেশের বাণিজ্য উদারীকরণের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদারে ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যাপারে সম্মত হন। এখানে উল্লেখ করা যায়, দীর্ঘদিন ধরেই ভারতীয় আলোচকরা পাকিস্তানি আলোচকদের কাছে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ভারত-চীন মডেল অনুসরণের জন্য পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন। কিন্তু পাকিস্তানিদের তরফে এতদিন এ ব্যাপারে ইতিবাচক সাড়া মেলেনি বলে তা কার্যকর করা যায়নি। তখন পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃত্ব কাশ্মীর ইস্যুকেই মূল ইস্যু বলে গণ্য করে আসছিল এবং সে ব্যাপারে কোনো ইতিবাচক ফল লাভ ছাড়া অন্যান্য ব্যাপারে সহযোগিতা সম্প্রসারণে অনীহ ছিল। দু'দেশের মধ্যে বাণিজ্য স্বাভাবিকীকরণ প্রক্রিয়াও ওখানেই বাঁধা পড়েছিল।
কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে পাকিস্তান ভারতকে বিশেষ বাণিজ্য সুবিধাভোগী দেশের মর্যাদা দেওয়ার পক্ষে অবস্থান নিচ্ছিল। এতে সর্বাগ্রে কাশ্মীর সমস্যার সমাধান ছাড়া ভারতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন সম্ভব নয়_ এই নীতি থেকে পাকিস্তানের সরে আসার ইঙ্গিত মেলে। কাশ্মীরসহ অন্য বিরোধাত্মক বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা চলার পাশাপাশি দু'দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্কোন্নয়নের দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে ইসলামাবাদ।
চীন-ভারত মডেল অনুসরণ পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের দুর্ঘটনাপ্রবণ সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিরাট পরিবর্তন সূচনা করবে বলে ধরে নেওয়া যায়। এই গঠনমূলক দৃষ্টিভঙ্গি নেওয়ার ফলে কাশ্মীরসহ দু'দেশের মধ্যে বিরাজমান জটিল বিরোধাত্মক বিষয়গুলোর সমাধানের পথে যেমন অগ্রসর হওয়া যাবে, তেমনি দু'দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদারের মাধ্যমে উভয় পক্ষ পরস্পরের আরও বাছাকাছি আসার সুযোগ পাবে। এভাবে বিরোধাত্মক বিষয়গুলো সমাধানেরও পথ মিলবে।
নিজেদের মধ্যে দশকের পর দশক ধরে চলা সীমান্ত বিরোধ সত্ত্বেও ভারত ও চীন দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ চলতি বছরেই ৭ হাজার কোটি ডলারে উন্নীত করেছে এবং ২০১৫ সালের মধ্যে এটা বেড়ে ১০ হাজার কোটি ডলারে উন্নীত হবে বলে আশা করছে। এই তুলনায় ভারত-পাকিস্তান বাণিজ্যের পরিমাণ মাত্র ২৭০ কোটি ডলার। আবার এই বাণিজ্যিক ভারসাম্য ভারতেরই অনুকূলে। কনফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রিজ বলেছে, বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাধাগুলো তুলে নেওয়া হলে ২০১৫ সালের মধ্যে এর পরিমাণ এক হাজার কোটি ডলারে উন্নীত করা সম্ভব হবে।
জারদারির সঙ্গে আলোচনার পর এই বাস্তববাদী স্পিরিটের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে মনমোহন সিং বলেছেন, দু'দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে যেসব বিষয় প্রতিবন্ধক হয়ে রয়েছে সেগুলোর প্রায়োগিক ও কার্যসিদ্ধিমূলক সমাধান খুঁজে বের করার ব্যাপারে তারা আগ্রহী এবং এই বার্তাটিই তারা দু'জন সবার কাছে পেঁৗছে দিতে চান।
জারদারির সঙ্গে আলোচনায় মনমোহন সিং প্রত্যেক ইস্যুতে ধাপে ধাপে সমাধানে এগিয়ে যাওয়ায় দু'দেশের স্বার্থ জড়িত রয়েছে বলে উল্লেখ করেন। জারদারি সিংয়ের এই দৃষ্টিভঙ্গিকে স্বাগত জানান।
অথচ ২০১০ সালে ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত বৈঠকে পাকিস্তানের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মোহাম্মদ কোরেশী অবাস্তবভাবে কাশ্মীর, স্যারক্রিক ও সিয়াচেনের মতো বিরোধাত্মক বিষয়গুলোর সমাধান এবং এ ব্যাপারে সময়সীমা নির্ধারণের জন্য চাপ দিলে মন্ত্রী পর্যায়ের আলোচনায় অচলাবস্থা দেখা দেয় এবং একপর্যায়ে তা ভেঙে যায়। পাকিস্তানের বর্তমান অবস্থান আগেকার অবস্থানের পুরোপুরি বিপরীত।
ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কোন্নয়নের জন্য মনমোহন সিং যথেষ্ট চেষ্টা নিয়েছেন। তিনি দু'দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্কোন্নয়ন এবং উভয় দেশের জনগণের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধির মাধ্যমে দু'দেশের রাজনৈতিক সীমান্তকে অপ্রয়োজনীয় করে তোলা সম্ভব বলেও বিশ্বাস করেন।
দীর্ঘদিন ধরে আলোচনার পর এবার দু'দেশের স্বরাষ্ট্র সচিবদের বৈঠকে দু'দেশের মানুষের চলাচলে বাধা অপসারণের জন্য ভিসা ব্যবস্থা সহজ করার চুক্তি হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

স পাকিস্তানের 'দি নেশন' পত্রিকা থেকে অনূদিত

No comments

Powered by Blogger.