সহজিয়া কড়চা-সংবিধান সংশোধন: বিষয়বস্তু ও প্রক্রিয়া by সৈয়দ আবুল মকসুদ
আমাদের সামনে যখন যে বিষয়ই এসে উপস্থিত হোক না কেন, তা নিয়ে কিছুক্ষণ ভেবে কথা বলা আমাদের স্বভাব নয়। সঙ্গে সঙ্গে অযাচিতভাবে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করা এবং যার যার মতো একটি চূড়ান্ত রায় দিয়ে দেওয়াই এখন রেওয়াজ। কোনো জিনিস সম্পর্কে একজন যদি বলেন, ওটি কালো, সঙ্গে সঙ্গে আরেকজন বলবেন—ধূসর।
আরেকজন বলবেন, বাদামি। আরেকজন তড়াক করে উঠে বলবেন, কালচে সবুজ। তার কাছে জানতে চাওয়া হোক বা না হোক। বুদ্ধিজীবীগোছের একজন দাঁড়িয়ে হাত তুলবেন: ওটা কালো নয়, আবলুস রং। তিনি রবীন্দ্রনাথকে খুঁজবেন সাক্ষী মানতে। দেখবেন রবীন্দ্রনাথ কালো ও আবলুস রঙের মধ্যে তফাত সম্পর্কে কোথাও কিছু বলেছেন কি না। শেষ পর্যন্ত বস্তুটির কথা মানুষ ভুলে যাবে এবং তার রংটি কী, তাই নিয়ে হবে মারামারি। এবং তা থেকে একটি মাত্র রংই পাওয়া যাবে, যে রংটির কথা আগে কেউ বলেনি, তা হলো লাল। অর্থাৎ রক্ত। দু-চারজনের ফাটা মাথা থেকে কল কল করে প্রবাহিত হওয়া রক্ত।
সামাজিক জীবনেও প্রতিটি ব্যাপারে মতপার্থক্যের শেষ নেই। রাজনৈতিক ক্ষেত্রের অবস্থা আরও শোচনীয়। বিএনপি যদি বলে যে আমটি গোপালভোগ। আওয়ামী লীগ বলে বসবে, ওটি তো আলবত আলফান্সো। ১০ গজ দূরে দাঁড়িয়ে উদ্ভিদবিজ্ঞানী দেখবেন, আমটি আলফান্সোও নয়, গোপালভোগও নয়, স্রেফ চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফজলি। উদ্ভিদবিজ্ঞানী যদি আওয়ামীপন্থী হন, তাহলে তাঁর অধীত বিদ্যা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে বলে দেবেন, আমটি আলফান্সোর মতোই মনে হয়, তবে আকারটা মুম্বাইয়ের আলফান্সোর চেয়ে বড়, এই যা! বিএনপির বোটানিস্ট বলবেন, ওটা গোপালভোগই। কারণ, পঁচাত্তরের পর থেকে ৭০-৮০ গ্রাম ওজনের গোপালভোগ রাজশাহী-দিনাজপুর এলাকায় হচ্ছে।
আগে আমাদের স্কুল-কলেজে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার দিনে একটি আইটেম থাকত—কাছি (মোটা দড়ি) টানাটানি। একটি লম্বা কাছির দুই প্রান্ত থেকে দুই দল টানতে থাকত। ওই খেলাটিতে আমি লক্ষ করেছি, যে দল জেতে, বস্তুত তারাই পরাজিত হয়। যারা জেতে অর্থাৎ যাদের জোর বেশি, তাদের অনেকেই টানতে গিয়ে চিৎপটাং হয়ে পড়ে যায়। বিশেষ করে যারা হারবে বলে মনে করছে, তারা যদি ইচ্ছা করেই দড়িটি ছেড়ে দেয়, বিজয়ীদের ধরাশায়ী হওয়া অনিবার্য। তার পরও তাদের সান্ত্বনা এখানে যে, তারা জয়ী তো হয়েছে। সংবিধান সংশোধন নিয়ে কিছুদিন যাবৎ কাছি টানাটানি শুরু হয়েছে। এই টানাটানিতে যে পক্ষই বিজয়ী হোক না কেন, তাদের পক্ষে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হবে না। বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্টরা এতই ব্যস্ত যে কাজটির পরিণতি ফল শেষ পর্যন্ত কী হতে পারে, তা নিয়ে আগাম ভাবার অবকাশ কারও নেই। তার কোনো প্রয়োজন আছে বলেও তাঁরা মনে করছেন না।
সংসদীয় রাজনীতি যদি কাছি টানাটানি বা চাটগাঁয়ের জব্বারের বলীখেলায় পরিণত হয়, তার পরিণতি অশুভ।
বলীখেলা কুস্তিতে ধস্তাধস্তি করে অন্তত একজন বিজয়ী হন। গণতান্ত্রিক রাজনীতির যে বলীখেলা শুরু হয়েছে, তাতে শেষ পর্যন্ত কারোরই জেতার সম্ভাবনা নেই। বলী প্রতিযোগীদের কাছ থেকে যদি আমাদের রাজনীতিকেরা শিক্ষা নিতেন, পরাজয় মেনে নেওয়ার উদারতা শিখতেন, তাহলে আমাদের রাজনীতির কুস্তিক্ষেত্রটি জনগণের কাছে উপভোগ্য হতো। বলীখেলা দর্শক উপভোগ করে, আমাদের রাজনীতির বলীখেলা দূর থেকে দেখে জনগণ আতঙ্কিত হয়।
কোনো গুরুতর বিষয় নিয়ে বিতর্কমূলক আলোচনা হওয়া ভালো। বিতর্ক বলতে আমি বোঝাতে চাইছি ইংরেজিতে যাকে বলে ডিসকোর্স। কলহ করা বা অর্থহীন বাকিবতণ্ডা করা আর বিতর্ক এক জিনিস নয়। যুক্তিপূর্ণ বিতর্কে দুই বা ততোধিক পক্ষ সর্বসম্মত না হলেও মোটের ওপর গ্রহণযোগ্য একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছা যায়। কূটতর্কের দ্বারা তা সম্ভব নয়। বরং প্রতিপক্ষগুলোর মধ্যে বৈরিতা বাড়তে থাকে। সংবিধান সংশোধন নিয়ে কয়েক মাস যাবৎ যা হচ্ছে, তা সমস্যা সমাধানের লক্ষণ নয়—সমস্যাকে ঘনীভূত করার ব্যাপক আয়োজন।
সংবিধানের ছোটখাটো সংশোধন হরহামেশা অনেক গণতান্ত্রিক দেশেই হয়ে থাকে। কিন্তু সংবিধানের আমূল পরিবর্তন, সংযোজন-বিয়োজন—জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতেই হয়ে থাকে, ক্ষমতাসীন দলের খুশিমতো নয়। শুধু সংশোধন নয়, এই মুহূর্তে পৃথিবীর কোনো কোনো দেশে নতুন সংবিধান রচনার কাজও চলছে। যেমন, আমাদের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী নেপালে। কিন্তু সেখানেও আমাদের মতোই অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সেখানে আন্তর্জাতিক প্রভাব অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এত বেশি যে দরিদ্র দেশটির রাজনীতিকেরা তা সামাল দিতে পারছেন না। সেখানে দেশের জনগণের ইচ্ছার চেয়ে বৈদেশিক শক্তিগুলোর ইচ্ছার মূল্য বেশি। তাই তিন বছরেও সেখানে নতুন সংবিধান রচনা করা সম্ভব হয়নি।
নেপাল প্রজাতন্ত্রের সংবিধান রচনায় দেরি হওয়া এবং সে দেশের সংকট আর বাংলাদেশের সংবিধান বিষয়ে ডেকে আনা সমস্যা এক রকম নয়। কাটা-ছেঁড়া বা বিকলাঙ্গ যা-ই হোক, একটা সংবিধান দিয়ে আমাদের কাজ চলছিল। অসাম্প্রদায়িক ও বামবলয়ের রাজনৈতিক গোত্রগুলো থেকে সংবিধান সংশোধনের দাবি ছিল। সে দাবিটি হলো, বাহাত্তরের সংবিধানের কাছাকাছি যাওয়া। মূল শাসনতন্ত্রে সামরিক শাসকেরা যে মাতব্বরি করেছেন, তা সংশোধন করে বাহাত্তরের চেতনায় ফিরে যাওয়া। তবু গত নির্বাচনটি সংবিধান সংশোধনের ম্যান্ডেটের নির্বাচন ছিল না। তবে ধরে নেওয়া হয়েছিল এবং সে আভাস দেওয়াও হয়েছিল যে মহাজোট ক্ষমতায় গেলে সংবিধানের সময়-উপযোগী সংশোধন হবে।
জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনের সময় একটি সিনেমা হলের মালিকানাসংক্রান্ত মামলায় সাজাপ্রাপ্ত এক ব্যক্তি উচ্চ আদালতে আপিল করেছিলেন। ওই আপিলের রায়ে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ ঘোষিত হয়। সুপ্রিম কোর্টও সেই রায় বহাল রাখেন, তবে যেহেতু ঘটে গেছে, তাই পঞ্চম সংশোধনীর কিছু কিছু কাজ মার্জনা করা হয়।
বিএনপি ও তাদের জোট ছাড়া প্রায় সব দলের নেতারাই পঞ্চম সংশোধনী বাতিলকে স্বাগত জানান। কোনো কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির স্বাগত জানানোর ভাষা ছিল খুবই উচ্ছ্বসিত ও আবেগপ্রবণ। সংবিধানের প্রশ্নে অতটা আবেগ শোভনীয় নয়। কেউ কেউ এ কথাও বলেছেন, সংবিধান সংশোধন হয়েই গেছে, শুধু এখন পঞ্চম সংশোধনী-পূর্ব সংবিধানটি নতুন করে ছেপে দিলেই হলো। এসব আবেগাপ্লুত কথায় সরকারও জোর পায় এবং নেতারা একই ভাষায় কথা বলতে থাকেন। সরকারের এ প্রত্যয় দৃঢ়তর হয় যে, ব্যাপারটা অতি সামান্য, একটা কিছু করে দিলেই ল্যাটা চুকে গেল। বাইরে থেকে প্রবল চাপের মুখে সংবিধান ছাপতে দেওয়া হয়, যা অত তাড়াহুড়ো না করে সংসদে বিস্তারিত আলোচনার পর করাই বাঞ্ছনীয় ছিল।
আমাদের মতো সাধারণ নাগরিকের মনে যে প্রশ্ন জাগে তা হলো: যদি মুন সিনেমা নিয়ে মামলা না হতো তাহলে কী হতো। অথবা আদালতে যদি পঞ্চম সংশোধনীর প্রশ্নটি না উঠত। পঞ্চম, অষ্টম সংশোধনীসহ যে সংবিধান তার অধীনেই খালেদা জিয়ার দুবার, শেখ হাসিনার দুবার সরকার গঠন করে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করার সৌভাগ্য হয়। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ, বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান এবং বিচারপতি লতিফুর রহমান তিনটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব পালন করেন। এই সাতটি সরকারই সাংবিধানিক, অসাংবিধানিক নয়। ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারও ছিল সাংবিধানিক কিন্তু বিতর্কিত। তিনোদ্দীনের ‘দুই’ বছরি সরকারটির সাংবিধানিক ভিত্তি কী ছিল, তা তাঁরাই বলতে পারবেন। ১৯৯৬ সালে খালেদা জিয়ার যে ক্ষণস্থায়ী সরকার, তা-ও ছিল সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার প্রয়োজনেই এবং ওই বিতর্কিত সংসদেই বিরোধী দলের চাপে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়।
আমাদের সংবিধানের অবস্থা বর্তমানে শোচনীয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও তা দাঁড়িয়ে আছে বাহাত্তরের সংবিধানের ভিত্তি ও অবকাঠামোর ওপর। বাহাত্তরের সংবিধানকে সম্পূর্ণ নাকচ করার স্পর্ধা কোনো সামরিক শাসকের হয়নি। এখন ‘আদালতের রায়ের আলোকে’ বাহাত্তরে ফিরে যাওয়ার আয়োজন হচ্ছে।
বাহাত্তরের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ছিল। তা গ্রহণ করা অপেক্ষাকৃত সহজ এবং করাই উচিত একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে। সেখানে সমাজতন্ত্রও ছিল। এখন সমাজতন্ত্রও ফিরে আসবে। ১০ কোটি, ৫০ কোটি বা ১০০ কোটির বেশি টাকা মূলধনের শিল্প-কারখানা-ব্যাংক-বিমা যদি সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত করে—আমাদের শিল্পোদ্যোক্তাদের চুপ করে সহ্য করা ছাড়া কিছুই করার থাকবে না। অন্যদিকে সংবিধানে কথাটা থাকল, কিন্তু দেশে চালু থাকল ভয়াবহ পুঁজিবাদী ব্যবস্থা, তাহলে তা হবে মানবজাতির ইতিহাসে জনগণের সঙ্গে সবচেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতকতা ও প্রতারণা।
প্রগলভ প্রবীণ নেতাদের অনেকেই বাহাত্তরের ধারেকাছেই আছেন। বাহাত্তরে পাওয়া যত সোজা, বাহাত্তরে যাওয়া তত সহজ নয়। বাহাত্তরের সরকারের কাছ থেকে মহাজোট সরকার কিছু শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। সেই সরকারও একই সংবিধান রচনা করেছিল। বিরোধী দলের সঙ্গে পরামর্শ করেনি। তবে সংবিধান গ্রহণ করার এক মাস আগে একটি খসড়া জনগণের মতামত নেওয়ার জন্য ছেপে প্রকাশ করেছিল। ড. কামাল হোসেন রচিত খসড়ায় ‘বাংলাদেশের নাগরিকগণ বাঙালি বলিয়া পরিচিত হইবেন’ কথাটি ছিল না। কথাটি শেষ মুহূর্তে অন্য কেউ যোগ করেন। দেশের অন্যান্য জাতিসত্তা তাদের স্বীকৃতি হারাল। এ ব্যাপারে পরে লিখব। যা বলতে চাই তা হলো, সরকার কী কী সংশোধন করে নতুন সংবিধান রচনা করছে, তা খসড়া আকারে ছেপে নাগরিকদের মধ্যে বিতরণ করতে পারে মতামতের জন্য।
সংবিধান সংশোধনে বিশেষ সংসদীয় কমিটি গঠিত হয়েছে। তার কি কোনো প্রয়োজন ছিল? এ গুরুতর বিষয়টির সংসদেই বিস্তারিত আলোচনা হতে পারত। তখন আর বিরোধী দলের নেতাকে চিঠি দেওয়ার প্রয়োজন হতো না। তাঁরও সে চিঠি প্রত্যাখ্যানের প্রশ্ন উঠত না। কমিটিতে আলোচনা না করে সংসদে মুক্ত আলোচনা হলে সরকার অনেক প্রশ্নের জবাবদিহি করা থেকে বেঁচে যেত। সেখানে জামায়াত বা ওই জাতীয় ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক দলও অংশ নিতে পারত। এখন তারা জনগণ ও বিদেশি সহকর্মীদের বলবে, সার্বভৌম সংসদে আমাদের প্রতিনিধিত্ব আছে, অথচ সংবিধান নিয়ে আলোচনায় আমরা দাওয়াত পাইনি। ওপার থেকে ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্টরা এসে বলবেন: ব্যাপারটি গণতন্ত্রসম্মত হলো না। সংবিধান সংশোধন কোনো নেতার বিয়ে অনুষ্ঠান নয় যে, কাউকে দাওয়াত দিয়ে আনতে হবে। বিরোধী দলের নেতাদের নিজের গরজে এবং জনগণের স্বার্থেই আলোচনায় অংশ নেওয়া উচিত।
সংখ্যায় যাঁরা বেশি, তাঁদের বাহুতে জোর বেশি। তবে তাঁদের বুদ্ধিও বেশি তার কোনো গ্যারান্টি নেই। কাঁচাবুদ্ধিসম্পন্ন বিপুলসংখ্যক মাথা যোগ দিলে একটা প্রকাণ্ড বুদ্ধির সমাবেশ ঘটে না। আমার মতো কোটি কোটি লোকের মাথা যোগ দিলেও একটি আইনস্টাইন বা নিউটনের মাথা হবে না।
সংবিধানে কী কী বিষয় সংশোধন ও সংযোজন করা হলো, তা একটি ব্যাপার। সবকিছুর সঙ্গে সবাই একমত হতে পারে না। কিন্তু কোন প্রক্রিয়ায় সংবিধান সংশোধিত হলো, তা মানুষ লক্ষ করবে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত মহাজোটের একজন অক্ষম হিতার্থী হিসেবে শুধু এইটুকু বলব, কিছু ত্যাগ স্বীকার করে হলেও একটি ভালো গণতান্ত্রিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করুন। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপন করলে জনগণের তো ক্ষতি হবেই, আওয়ামী লীগের জন্য তা হবে আত্মঘাতী।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
সামাজিক জীবনেও প্রতিটি ব্যাপারে মতপার্থক্যের শেষ নেই। রাজনৈতিক ক্ষেত্রের অবস্থা আরও শোচনীয়। বিএনপি যদি বলে যে আমটি গোপালভোগ। আওয়ামী লীগ বলে বসবে, ওটি তো আলবত আলফান্সো। ১০ গজ দূরে দাঁড়িয়ে উদ্ভিদবিজ্ঞানী দেখবেন, আমটি আলফান্সোও নয়, গোপালভোগও নয়, স্রেফ চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফজলি। উদ্ভিদবিজ্ঞানী যদি আওয়ামীপন্থী হন, তাহলে তাঁর অধীত বিদ্যা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে বলে দেবেন, আমটি আলফান্সোর মতোই মনে হয়, তবে আকারটা মুম্বাইয়ের আলফান্সোর চেয়ে বড়, এই যা! বিএনপির বোটানিস্ট বলবেন, ওটা গোপালভোগই। কারণ, পঁচাত্তরের পর থেকে ৭০-৮০ গ্রাম ওজনের গোপালভোগ রাজশাহী-দিনাজপুর এলাকায় হচ্ছে।
আগে আমাদের স্কুল-কলেজে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার দিনে একটি আইটেম থাকত—কাছি (মোটা দড়ি) টানাটানি। একটি লম্বা কাছির দুই প্রান্ত থেকে দুই দল টানতে থাকত। ওই খেলাটিতে আমি লক্ষ করেছি, যে দল জেতে, বস্তুত তারাই পরাজিত হয়। যারা জেতে অর্থাৎ যাদের জোর বেশি, তাদের অনেকেই টানতে গিয়ে চিৎপটাং হয়ে পড়ে যায়। বিশেষ করে যারা হারবে বলে মনে করছে, তারা যদি ইচ্ছা করেই দড়িটি ছেড়ে দেয়, বিজয়ীদের ধরাশায়ী হওয়া অনিবার্য। তার পরও তাদের সান্ত্বনা এখানে যে, তারা জয়ী তো হয়েছে। সংবিধান সংশোধন নিয়ে কিছুদিন যাবৎ কাছি টানাটানি শুরু হয়েছে। এই টানাটানিতে যে পক্ষই বিজয়ী হোক না কেন, তাদের পক্ষে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হবে না। বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্টরা এতই ব্যস্ত যে কাজটির পরিণতি ফল শেষ পর্যন্ত কী হতে পারে, তা নিয়ে আগাম ভাবার অবকাশ কারও নেই। তার কোনো প্রয়োজন আছে বলেও তাঁরা মনে করছেন না।
সংসদীয় রাজনীতি যদি কাছি টানাটানি বা চাটগাঁয়ের জব্বারের বলীখেলায় পরিণত হয়, তার পরিণতি অশুভ।
বলীখেলা কুস্তিতে ধস্তাধস্তি করে অন্তত একজন বিজয়ী হন। গণতান্ত্রিক রাজনীতির যে বলীখেলা শুরু হয়েছে, তাতে শেষ পর্যন্ত কারোরই জেতার সম্ভাবনা নেই। বলী প্রতিযোগীদের কাছ থেকে যদি আমাদের রাজনীতিকেরা শিক্ষা নিতেন, পরাজয় মেনে নেওয়ার উদারতা শিখতেন, তাহলে আমাদের রাজনীতির কুস্তিক্ষেত্রটি জনগণের কাছে উপভোগ্য হতো। বলীখেলা দর্শক উপভোগ করে, আমাদের রাজনীতির বলীখেলা দূর থেকে দেখে জনগণ আতঙ্কিত হয়।
কোনো গুরুতর বিষয় নিয়ে বিতর্কমূলক আলোচনা হওয়া ভালো। বিতর্ক বলতে আমি বোঝাতে চাইছি ইংরেজিতে যাকে বলে ডিসকোর্স। কলহ করা বা অর্থহীন বাকিবতণ্ডা করা আর বিতর্ক এক জিনিস নয়। যুক্তিপূর্ণ বিতর্কে দুই বা ততোধিক পক্ষ সর্বসম্মত না হলেও মোটের ওপর গ্রহণযোগ্য একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছা যায়। কূটতর্কের দ্বারা তা সম্ভব নয়। বরং প্রতিপক্ষগুলোর মধ্যে বৈরিতা বাড়তে থাকে। সংবিধান সংশোধন নিয়ে কয়েক মাস যাবৎ যা হচ্ছে, তা সমস্যা সমাধানের লক্ষণ নয়—সমস্যাকে ঘনীভূত করার ব্যাপক আয়োজন।
সংবিধানের ছোটখাটো সংশোধন হরহামেশা অনেক গণতান্ত্রিক দেশেই হয়ে থাকে। কিন্তু সংবিধানের আমূল পরিবর্তন, সংযোজন-বিয়োজন—জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতেই হয়ে থাকে, ক্ষমতাসীন দলের খুশিমতো নয়। শুধু সংশোধন নয়, এই মুহূর্তে পৃথিবীর কোনো কোনো দেশে নতুন সংবিধান রচনার কাজও চলছে। যেমন, আমাদের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী নেপালে। কিন্তু সেখানেও আমাদের মতোই অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সেখানে আন্তর্জাতিক প্রভাব অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এত বেশি যে দরিদ্র দেশটির রাজনীতিকেরা তা সামাল দিতে পারছেন না। সেখানে দেশের জনগণের ইচ্ছার চেয়ে বৈদেশিক শক্তিগুলোর ইচ্ছার মূল্য বেশি। তাই তিন বছরেও সেখানে নতুন সংবিধান রচনা করা সম্ভব হয়নি।
নেপাল প্রজাতন্ত্রের সংবিধান রচনায় দেরি হওয়া এবং সে দেশের সংকট আর বাংলাদেশের সংবিধান বিষয়ে ডেকে আনা সমস্যা এক রকম নয়। কাটা-ছেঁড়া বা বিকলাঙ্গ যা-ই হোক, একটা সংবিধান দিয়ে আমাদের কাজ চলছিল। অসাম্প্রদায়িক ও বামবলয়ের রাজনৈতিক গোত্রগুলো থেকে সংবিধান সংশোধনের দাবি ছিল। সে দাবিটি হলো, বাহাত্তরের সংবিধানের কাছাকাছি যাওয়া। মূল শাসনতন্ত্রে সামরিক শাসকেরা যে মাতব্বরি করেছেন, তা সংশোধন করে বাহাত্তরের চেতনায় ফিরে যাওয়া। তবু গত নির্বাচনটি সংবিধান সংশোধনের ম্যান্ডেটের নির্বাচন ছিল না। তবে ধরে নেওয়া হয়েছিল এবং সে আভাস দেওয়াও হয়েছিল যে মহাজোট ক্ষমতায় গেলে সংবিধানের সময়-উপযোগী সংশোধন হবে।
জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনের সময় একটি সিনেমা হলের মালিকানাসংক্রান্ত মামলায় সাজাপ্রাপ্ত এক ব্যক্তি উচ্চ আদালতে আপিল করেছিলেন। ওই আপিলের রায়ে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ ঘোষিত হয়। সুপ্রিম কোর্টও সেই রায় বহাল রাখেন, তবে যেহেতু ঘটে গেছে, তাই পঞ্চম সংশোধনীর কিছু কিছু কাজ মার্জনা করা হয়।
বিএনপি ও তাদের জোট ছাড়া প্রায় সব দলের নেতারাই পঞ্চম সংশোধনী বাতিলকে স্বাগত জানান। কোনো কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির স্বাগত জানানোর ভাষা ছিল খুবই উচ্ছ্বসিত ও আবেগপ্রবণ। সংবিধানের প্রশ্নে অতটা আবেগ শোভনীয় নয়। কেউ কেউ এ কথাও বলেছেন, সংবিধান সংশোধন হয়েই গেছে, শুধু এখন পঞ্চম সংশোধনী-পূর্ব সংবিধানটি নতুন করে ছেপে দিলেই হলো। এসব আবেগাপ্লুত কথায় সরকারও জোর পায় এবং নেতারা একই ভাষায় কথা বলতে থাকেন। সরকারের এ প্রত্যয় দৃঢ়তর হয় যে, ব্যাপারটা অতি সামান্য, একটা কিছু করে দিলেই ল্যাটা চুকে গেল। বাইরে থেকে প্রবল চাপের মুখে সংবিধান ছাপতে দেওয়া হয়, যা অত তাড়াহুড়ো না করে সংসদে বিস্তারিত আলোচনার পর করাই বাঞ্ছনীয় ছিল।
আমাদের মতো সাধারণ নাগরিকের মনে যে প্রশ্ন জাগে তা হলো: যদি মুন সিনেমা নিয়ে মামলা না হতো তাহলে কী হতো। অথবা আদালতে যদি পঞ্চম সংশোধনীর প্রশ্নটি না উঠত। পঞ্চম, অষ্টম সংশোধনীসহ যে সংবিধান তার অধীনেই খালেদা জিয়ার দুবার, শেখ হাসিনার দুবার সরকার গঠন করে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করার সৌভাগ্য হয়। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ, বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান এবং বিচারপতি লতিফুর রহমান তিনটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব পালন করেন। এই সাতটি সরকারই সাংবিধানিক, অসাংবিধানিক নয়। ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারও ছিল সাংবিধানিক কিন্তু বিতর্কিত। তিনোদ্দীনের ‘দুই’ বছরি সরকারটির সাংবিধানিক ভিত্তি কী ছিল, তা তাঁরাই বলতে পারবেন। ১৯৯৬ সালে খালেদা জিয়ার যে ক্ষণস্থায়ী সরকার, তা-ও ছিল সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার প্রয়োজনেই এবং ওই বিতর্কিত সংসদেই বিরোধী দলের চাপে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়।
আমাদের সংবিধানের অবস্থা বর্তমানে শোচনীয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও তা দাঁড়িয়ে আছে বাহাত্তরের সংবিধানের ভিত্তি ও অবকাঠামোর ওপর। বাহাত্তরের সংবিধানকে সম্পূর্ণ নাকচ করার স্পর্ধা কোনো সামরিক শাসকের হয়নি। এখন ‘আদালতের রায়ের আলোকে’ বাহাত্তরে ফিরে যাওয়ার আয়োজন হচ্ছে।
বাহাত্তরের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ছিল। তা গ্রহণ করা অপেক্ষাকৃত সহজ এবং করাই উচিত একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে। সেখানে সমাজতন্ত্রও ছিল। এখন সমাজতন্ত্রও ফিরে আসবে। ১০ কোটি, ৫০ কোটি বা ১০০ কোটির বেশি টাকা মূলধনের শিল্প-কারখানা-ব্যাংক-বিমা যদি সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত করে—আমাদের শিল্পোদ্যোক্তাদের চুপ করে সহ্য করা ছাড়া কিছুই করার থাকবে না। অন্যদিকে সংবিধানে কথাটা থাকল, কিন্তু দেশে চালু থাকল ভয়াবহ পুঁজিবাদী ব্যবস্থা, তাহলে তা হবে মানবজাতির ইতিহাসে জনগণের সঙ্গে সবচেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতকতা ও প্রতারণা।
প্রগলভ প্রবীণ নেতাদের অনেকেই বাহাত্তরের ধারেকাছেই আছেন। বাহাত্তরে পাওয়া যত সোজা, বাহাত্তরে যাওয়া তত সহজ নয়। বাহাত্তরের সরকারের কাছ থেকে মহাজোট সরকার কিছু শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। সেই সরকারও একই সংবিধান রচনা করেছিল। বিরোধী দলের সঙ্গে পরামর্শ করেনি। তবে সংবিধান গ্রহণ করার এক মাস আগে একটি খসড়া জনগণের মতামত নেওয়ার জন্য ছেপে প্রকাশ করেছিল। ড. কামাল হোসেন রচিত খসড়ায় ‘বাংলাদেশের নাগরিকগণ বাঙালি বলিয়া পরিচিত হইবেন’ কথাটি ছিল না। কথাটি শেষ মুহূর্তে অন্য কেউ যোগ করেন। দেশের অন্যান্য জাতিসত্তা তাদের স্বীকৃতি হারাল। এ ব্যাপারে পরে লিখব। যা বলতে চাই তা হলো, সরকার কী কী সংশোধন করে নতুন সংবিধান রচনা করছে, তা খসড়া আকারে ছেপে নাগরিকদের মধ্যে বিতরণ করতে পারে মতামতের জন্য।
সংবিধান সংশোধনে বিশেষ সংসদীয় কমিটি গঠিত হয়েছে। তার কি কোনো প্রয়োজন ছিল? এ গুরুতর বিষয়টির সংসদেই বিস্তারিত আলোচনা হতে পারত। তখন আর বিরোধী দলের নেতাকে চিঠি দেওয়ার প্রয়োজন হতো না। তাঁরও সে চিঠি প্রত্যাখ্যানের প্রশ্ন উঠত না। কমিটিতে আলোচনা না করে সংসদে মুক্ত আলোচনা হলে সরকার অনেক প্রশ্নের জবাবদিহি করা থেকে বেঁচে যেত। সেখানে জামায়াত বা ওই জাতীয় ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক দলও অংশ নিতে পারত। এখন তারা জনগণ ও বিদেশি সহকর্মীদের বলবে, সার্বভৌম সংসদে আমাদের প্রতিনিধিত্ব আছে, অথচ সংবিধান নিয়ে আলোচনায় আমরা দাওয়াত পাইনি। ওপার থেকে ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্টরা এসে বলবেন: ব্যাপারটি গণতন্ত্রসম্মত হলো না। সংবিধান সংশোধন কোনো নেতার বিয়ে অনুষ্ঠান নয় যে, কাউকে দাওয়াত দিয়ে আনতে হবে। বিরোধী দলের নেতাদের নিজের গরজে এবং জনগণের স্বার্থেই আলোচনায় অংশ নেওয়া উচিত।
সংখ্যায় যাঁরা বেশি, তাঁদের বাহুতে জোর বেশি। তবে তাঁদের বুদ্ধিও বেশি তার কোনো গ্যারান্টি নেই। কাঁচাবুদ্ধিসম্পন্ন বিপুলসংখ্যক মাথা যোগ দিলে একটা প্রকাণ্ড বুদ্ধির সমাবেশ ঘটে না। আমার মতো কোটি কোটি লোকের মাথা যোগ দিলেও একটি আইনস্টাইন বা নিউটনের মাথা হবে না।
সংবিধানে কী কী বিষয় সংশোধন ও সংযোজন করা হলো, তা একটি ব্যাপার। সবকিছুর সঙ্গে সবাই একমত হতে পারে না। কিন্তু কোন প্রক্রিয়ায় সংবিধান সংশোধিত হলো, তা মানুষ লক্ষ করবে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত মহাজোটের একজন অক্ষম হিতার্থী হিসেবে শুধু এইটুকু বলব, কিছু ত্যাগ স্বীকার করে হলেও একটি ভালো গণতান্ত্রিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করুন। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপন করলে জনগণের তো ক্ষতি হবেই, আওয়ামী লীগের জন্য তা হবে আত্মঘাতী।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments