প্রতিক্রিয়া-দেবতুল্য দাদা ও পাহাড়চুড়োর বাড়িটি by ফারজিন কাদের চৌধুরী
১২ এপ্রিল প্রথম আলোয় বিশ্বজিৎ চৌধুরীর লেখা ‘দেবতুল্য দাদা ও পাহাড়চুড়োর বাড়িটি’ শীর্ষক নিবন্ধটি পড়লাম, কিছুটা উপভোগও করলাম। আমি তো জানি এবং সজাগ মহলও এটা জানে যে, কাদের চৌধুরী পরিবারের কোনো সদস্য কোনো কিছু বললে আপনাদের মতো গুটিকয়েক কলমসৈনিক শশব্যস্ত হয়ে তেড়ে আসেন কলম উঁচিয়ে।
আমি আমার দাদার পরিবারের চতুর্থ প্রজন্মের প্রতিনিধিত্বকারী। বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তান অংশের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতিতে ফজলুল কাদের চৌধুরী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় না থেকেও আদর্শিক কারণে মুসলিম লীগের সভাপতি থাকায় যুদ্ধকালীন ঘটনাপ্রবাহের দায়ভার তাঁর ওপর চাপানো হচ্ছে এবং এর জন্য তাঁর পরবর্তী প্রজন্মকে ভুগতে হচ্ছে, ভোগানো হচ্ছে।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী চিরাচরিত ভঙ্গিতে আমার দাদার বিরুদ্ধে ১৯৭১-এ সাংবাদিক নিজাম উদ্দিন ও অধ্যাপক সালেহউদ্দিনকে নির্যাতনের অভিযোগ এনেছেন। তখন আমার জন্ম হয়নি। সেসব ঘটনার সত্য উদ্ঘাটনে আমি সেকালের সাক্ষী আমার নিকটাত্মীয় এবং ওয়াকিবহাল মহল থেকে যা জানতে পারি, তা জানানোর প্রয়োজন বলে মনে করি। তৎকালীন মুসলিম লীগের অঙ্গসংগঠন এনএসএফ বা ছাত্র পরিষদ অফিস চট্টগ্রামের হাজারী লেন থেকে মদ্যপায়ী অবস্থায় এবং কিছু অশ্লীল ছবিসহ নিজাম উদ্দিনকে ধরে আনে। চৌধুরী সাহেব তা জানতে পেরে তাঁকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে তুলে দিতে বলেন। আপনারা হয়তো জানেন না, ২০ বছর আগে নিজাম উদ্দিন সাহেব একটি সাংবাদিক প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আমাদের পারিবারিক খরচে ও ব্যবস্থাপনায় ইউরোপ সফর করে আসেন। এটা কোনো প্রতিদান ছিল না, এ প্রজন্মের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উদ্দেশ্যে শুভেচ্ছা সফর মাত্র।
অধ্যাপক সালেহউদ্দিন তখন হাটহাজারীর বুড়িশ্চর গ্রামের এক বাড়িতে থেকে লেখাপড়া করতেন। স্থানীয় বুড়িশ্চর (শিকারপুর নয়) ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাকে জানান, চৌধুরী সাহেবকে হত্যার উদ্দেশ্যে সালেহউদ্দিন কিছু তরুণ নিয়ে অপারেশন করার জন্য গোপন মিটিং করছিলেন। তাঁকে গ্রেপ্তারের কথা চৌধুরী সাহেব জানতে পেরে তাঁর কাছে আনতে বললেন। সে সুযোগে সালেহউদ্দিন সাহেব চৌধুরী সাহেবকে জানান, ওই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের মেয়েকে বিবাহ করতে রাজি না হওয়ায় তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ এনে নির্যাতন চালানো হয়। প্রকৃত সত্য জানতে পেরে চৌধুরী সাহেব সালেহউদ্দিন সাহেবকে পুত্রসম সম্বোধন করে দুঃখজনক ঘটনার জন্য ক্ষমা চান এবং তাঁকে ছেড়ে দেন। সালেহউদ্দিন সাহেব এখনো বেঁচে আছেন।
একাত্তরের যুদ্ধকালীন প্রবহমান ঘটনার সব দায়ভার আমার দাদার ওপর চাপিয়ে আপনারা কি অন্যদের দায়মুক্ত করতে চান? ওই যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে অনেকে ব্যক্তিগত শত্রুতা হাসিল করে অনেক অপকর্ম করেন, যার বদনাম তাঁর ওপর চাপানো হচ্ছে। অথচ আপনারা কখনো বলেন না যে আমার দাদা সে সময় ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিকে আপনার কথিত ‘পাহাড়চুড়োর বাড়িটি’তে সপরিবারে নিরাপদে আশ্রয় দিয়েছিলেন।
পাকিস্তানি সেনা কর্তৃক রাউজানের কুণ্ডেশ্বরীর নূতনচন্দ্র সিংহকে হত্যার দায়ভারও আমার দাদা ও বাবার ওপর চাপানো হচ্ছে। অথচ কুণ্ডেশ্বরী পরিবারের সঙ্গে তখন আমাদের পরিবারের সম্পর্ক ছিল উষ্ণ এবং হূদ্যতাপূর্ণ। কুণ্ডেশ্বরীতে অবস্থানকারী একজন স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব নূতনচন্দ্র সিংহকে কেন আমার দাদা বা বাবার চিনিয়ে দিতে হয়, তা এ প্রজন্মের অনুসন্ধিৎসু মনের কাছে জিজ্ঞাসা থেকে যায়। একাত্তরে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউস থেকে অনেককে চৌধুরী সাহেব পাকিস্তানি সেনাদের কবল থেকে উদ্ধার করেন, জীবন বাঁচান।
একটি মহল চৌধুরী সাহেবকে সাম্প্রদায়িক বলে আখ্যা দেন। তিনি ও তাঁর পরিবারের সঙ্গে হিন্দু, বৌদ্ধদের ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব ও সম্পর্ক সর্বজনবিদিত।
ফারজিন কাদের চৌধুরী: সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মেয়ে।
লেখকের বক্তব্য: ফারজিন কাদের চৌধুরী লিখেছেন, কাদের চৌধুরী পরিবারের কোনো সদস্য কিছু বললে গুটি কয়েক কলমসৈনিক শশব্যস্ত হয়ে তেড়ে আসেন কলম উঁচিয়ে। এই মন্তব্যে একদিকে ‘গুটি কয়েক’ সাংবাদিকের প্রতি যেমন বিদ্রূপ আছে, তেমনি তাঁর বাবার মতোই পারিবারিক অহমিকাবোধ ও আত্মশ্লাঘারও পরিচয় পাওয়া যায়। ফারজিন অতীত নিয়ে বাড়াবাড়ি না করে ভবিষ্যতের দিকে তাকানোর উপদেশ দিয়েছেন। কিন্তু তিনি নিজে তাঁর ‘মহান’ দাদার গৌরবময় অতীত তুলে ধরতে ভোলেননি।
ফারজিন বলতে চান, আদর্শিক কারণে মুসলিম লীগের নেতৃত্বে থাকার ফলে যুদ্ধকালীন ঘটনাপ্রবাহের দায়ভার ফজলুল কাদের চৌধুরীর ওপর চাপানো হচ্ছে। কিন্তু আমরা এ অঞ্চলের অনেক মুসলিম লীগ ও পাকিস্তানপন্থী নেতাকে চিনি, যাঁরা স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় ভ্রাতৃঘাতী সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। যেমন তৎকালীন পিডিপি নেতা মাহমুদুন্নবী চৌধুরী (বর্তমান বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদের বাবা) প্রকাশ্যে ছিলেন শান্তি বাহিনীর নেতা, গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়দাতা। মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা করতে গিয়ে নেজামে ইসলামী দলের কর্মী আবদুস সাত্তার শহীদ হয়েছেন (তথ্যসূত্র: মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম, ডা. মাহফুজুর রহমান, পৃ: ৩৭২-৩৭৩)।
সাংবাদিক নিজাম উদ্দিনকে মাতাল অবস্থায় অশ্লীল কিছু ছবিসহ এনএসএফের সদস্যরা ধরে এনেছিল বলে উল্লেখ করেছেন ফারজিন। এ কথা যদি সত্য ধরেও নিই, তবু প্রশ্ন জাগে, দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব এনএসএফ সদস্যদের হাতে তুলে দিয়েছিল কে? এবং অপরাধীকে জেলহাজতে না পাঠিয়ে পাহাড়চুড়োর বাড়িটিতেই বা ধরে আনা হলো কেন? ২০ বছর আগে তাঁদের পারিবারিক খরচ ও ব্যবস্থাপনায় নিজামকে ইউরোপে পাঠানোর কথা জানিয়েছেন ফারজিন। এও বলেছেন, এটা ছিল ‘শুভেচ্ছার’ নিদর্শন। আমরা কি প্রশ্ন করতে পারি, একজন ‘মাতাল ও চরিত্রহীন’কে এত টাকা ব্যয় করে শুভেচ্ছা সফরে পাঠানোর কারণটা কী?
ড. সালেহউদ্দিনকে ধরে আনার কারণ ভুল বোঝাবুঝি বলে উল্লেখ করেছেন ফারজিন। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠতেই পারে, কাউকে নিজের বাড়িতে ধরে আনা, নির্যাতন করা ও পরে ‘প্রকৃত সত্য’ জানতে পেরে ‘পুত্রসম’ সম্বোধন করে ক্ষমা চেয়ে ছেড়ে দেওয়ার অধিকার ও ক্ষমতা তাঁর দাদাকে কে দিয়েছিল?
ফজলুল কাদেরকে অসাম্প্রদায়িক প্রমাণের জন্য হিন্দু ও বৌদ্ধদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতার কথা, তাঁদের কাউকে বিপদে আশ্রয় দেওয়া বা অন্য সুবিধাদি দেওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন ফারজিন। ভিন্নধর্মাবলম্বীর প্রতি সদয় হওয়া বা করুণা দেখানোর দু-একটি উদাহরণ কোনো ব্যক্তিকে অসাম্প্রদায়িক প্রমাণ করে না। এ প্রসঙ্গে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নেতা লালকৃষ্ণ আদভানির রথযাত্রার কথা মনে পড়ছে। তাঁর রথের সারথি (চালক) ছিলেন সেলিম নামের এক মুসলিম যুবক। একাত্তরের ইতিহাস জানতে হলে তাঁকে তখনকার পত্রপত্রিকা, প্রামাণ্য দলিল ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গ্রন্থাদি পাঠ করতে হবে। ‘নিকটাত্মীয় ও ওয়াকিবহাল মহল’ থেকে যেসব তথ্য পাওয়া যাবে, তা পক্ষপাতদুষ্ট হওয়ার আশঙ্কাই বেশি।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী চিরাচরিত ভঙ্গিতে আমার দাদার বিরুদ্ধে ১৯৭১-এ সাংবাদিক নিজাম উদ্দিন ও অধ্যাপক সালেহউদ্দিনকে নির্যাতনের অভিযোগ এনেছেন। তখন আমার জন্ম হয়নি। সেসব ঘটনার সত্য উদ্ঘাটনে আমি সেকালের সাক্ষী আমার নিকটাত্মীয় এবং ওয়াকিবহাল মহল থেকে যা জানতে পারি, তা জানানোর প্রয়োজন বলে মনে করি। তৎকালীন মুসলিম লীগের অঙ্গসংগঠন এনএসএফ বা ছাত্র পরিষদ অফিস চট্টগ্রামের হাজারী লেন থেকে মদ্যপায়ী অবস্থায় এবং কিছু অশ্লীল ছবিসহ নিজাম উদ্দিনকে ধরে আনে। চৌধুরী সাহেব তা জানতে পেরে তাঁকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে তুলে দিতে বলেন। আপনারা হয়তো জানেন না, ২০ বছর আগে নিজাম উদ্দিন সাহেব একটি সাংবাদিক প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আমাদের পারিবারিক খরচে ও ব্যবস্থাপনায় ইউরোপ সফর করে আসেন। এটা কোনো প্রতিদান ছিল না, এ প্রজন্মের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উদ্দেশ্যে শুভেচ্ছা সফর মাত্র।
অধ্যাপক সালেহউদ্দিন তখন হাটহাজারীর বুড়িশ্চর গ্রামের এক বাড়িতে থেকে লেখাপড়া করতেন। স্থানীয় বুড়িশ্চর (শিকারপুর নয়) ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাকে জানান, চৌধুরী সাহেবকে হত্যার উদ্দেশ্যে সালেহউদ্দিন কিছু তরুণ নিয়ে অপারেশন করার জন্য গোপন মিটিং করছিলেন। তাঁকে গ্রেপ্তারের কথা চৌধুরী সাহেব জানতে পেরে তাঁর কাছে আনতে বললেন। সে সুযোগে সালেহউদ্দিন সাহেব চৌধুরী সাহেবকে জানান, ওই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের মেয়েকে বিবাহ করতে রাজি না হওয়ায় তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ এনে নির্যাতন চালানো হয়। প্রকৃত সত্য জানতে পেরে চৌধুরী সাহেব সালেহউদ্দিন সাহেবকে পুত্রসম সম্বোধন করে দুঃখজনক ঘটনার জন্য ক্ষমা চান এবং তাঁকে ছেড়ে দেন। সালেহউদ্দিন সাহেব এখনো বেঁচে আছেন।
একাত্তরের যুদ্ধকালীন প্রবহমান ঘটনার সব দায়ভার আমার দাদার ওপর চাপিয়ে আপনারা কি অন্যদের দায়মুক্ত করতে চান? ওই যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে অনেকে ব্যক্তিগত শত্রুতা হাসিল করে অনেক অপকর্ম করেন, যার বদনাম তাঁর ওপর চাপানো হচ্ছে। অথচ আপনারা কখনো বলেন না যে আমার দাদা সে সময় ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিকে আপনার কথিত ‘পাহাড়চুড়োর বাড়িটি’তে সপরিবারে নিরাপদে আশ্রয় দিয়েছিলেন।
পাকিস্তানি সেনা কর্তৃক রাউজানের কুণ্ডেশ্বরীর নূতনচন্দ্র সিংহকে হত্যার দায়ভারও আমার দাদা ও বাবার ওপর চাপানো হচ্ছে। অথচ কুণ্ডেশ্বরী পরিবারের সঙ্গে তখন আমাদের পরিবারের সম্পর্ক ছিল উষ্ণ এবং হূদ্যতাপূর্ণ। কুণ্ডেশ্বরীতে অবস্থানকারী একজন স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব নূতনচন্দ্র সিংহকে কেন আমার দাদা বা বাবার চিনিয়ে দিতে হয়, তা এ প্রজন্মের অনুসন্ধিৎসু মনের কাছে জিজ্ঞাসা থেকে যায়। একাত্তরে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউস থেকে অনেককে চৌধুরী সাহেব পাকিস্তানি সেনাদের কবল থেকে উদ্ধার করেন, জীবন বাঁচান।
একটি মহল চৌধুরী সাহেবকে সাম্প্রদায়িক বলে আখ্যা দেন। তিনি ও তাঁর পরিবারের সঙ্গে হিন্দু, বৌদ্ধদের ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব ও সম্পর্ক সর্বজনবিদিত।
ফারজিন কাদের চৌধুরী: সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মেয়ে।
লেখকের বক্তব্য: ফারজিন কাদের চৌধুরী লিখেছেন, কাদের চৌধুরী পরিবারের কোনো সদস্য কিছু বললে গুটি কয়েক কলমসৈনিক শশব্যস্ত হয়ে তেড়ে আসেন কলম উঁচিয়ে। এই মন্তব্যে একদিকে ‘গুটি কয়েক’ সাংবাদিকের প্রতি যেমন বিদ্রূপ আছে, তেমনি তাঁর বাবার মতোই পারিবারিক অহমিকাবোধ ও আত্মশ্লাঘারও পরিচয় পাওয়া যায়। ফারজিন অতীত নিয়ে বাড়াবাড়ি না করে ভবিষ্যতের দিকে তাকানোর উপদেশ দিয়েছেন। কিন্তু তিনি নিজে তাঁর ‘মহান’ দাদার গৌরবময় অতীত তুলে ধরতে ভোলেননি।
ফারজিন বলতে চান, আদর্শিক কারণে মুসলিম লীগের নেতৃত্বে থাকার ফলে যুদ্ধকালীন ঘটনাপ্রবাহের দায়ভার ফজলুল কাদের চৌধুরীর ওপর চাপানো হচ্ছে। কিন্তু আমরা এ অঞ্চলের অনেক মুসলিম লীগ ও পাকিস্তানপন্থী নেতাকে চিনি, যাঁরা স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় ভ্রাতৃঘাতী সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। যেমন তৎকালীন পিডিপি নেতা মাহমুদুন্নবী চৌধুরী (বর্তমান বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদের বাবা) প্রকাশ্যে ছিলেন শান্তি বাহিনীর নেতা, গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়দাতা। মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা করতে গিয়ে নেজামে ইসলামী দলের কর্মী আবদুস সাত্তার শহীদ হয়েছেন (তথ্যসূত্র: মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম, ডা. মাহফুজুর রহমান, পৃ: ৩৭২-৩৭৩)।
সাংবাদিক নিজাম উদ্দিনকে মাতাল অবস্থায় অশ্লীল কিছু ছবিসহ এনএসএফের সদস্যরা ধরে এনেছিল বলে উল্লেখ করেছেন ফারজিন। এ কথা যদি সত্য ধরেও নিই, তবু প্রশ্ন জাগে, দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব এনএসএফ সদস্যদের হাতে তুলে দিয়েছিল কে? এবং অপরাধীকে জেলহাজতে না পাঠিয়ে পাহাড়চুড়োর বাড়িটিতেই বা ধরে আনা হলো কেন? ২০ বছর আগে তাঁদের পারিবারিক খরচ ও ব্যবস্থাপনায় নিজামকে ইউরোপে পাঠানোর কথা জানিয়েছেন ফারজিন। এও বলেছেন, এটা ছিল ‘শুভেচ্ছার’ নিদর্শন। আমরা কি প্রশ্ন করতে পারি, একজন ‘মাতাল ও চরিত্রহীন’কে এত টাকা ব্যয় করে শুভেচ্ছা সফরে পাঠানোর কারণটা কী?
ড. সালেহউদ্দিনকে ধরে আনার কারণ ভুল বোঝাবুঝি বলে উল্লেখ করেছেন ফারজিন। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠতেই পারে, কাউকে নিজের বাড়িতে ধরে আনা, নির্যাতন করা ও পরে ‘প্রকৃত সত্য’ জানতে পেরে ‘পুত্রসম’ সম্বোধন করে ক্ষমা চেয়ে ছেড়ে দেওয়ার অধিকার ও ক্ষমতা তাঁর দাদাকে কে দিয়েছিল?
ফজলুল কাদেরকে অসাম্প্রদায়িক প্রমাণের জন্য হিন্দু ও বৌদ্ধদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতার কথা, তাঁদের কাউকে বিপদে আশ্রয় দেওয়া বা অন্য সুবিধাদি দেওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন ফারজিন। ভিন্নধর্মাবলম্বীর প্রতি সদয় হওয়া বা করুণা দেখানোর দু-একটি উদাহরণ কোনো ব্যক্তিকে অসাম্প্রদায়িক প্রমাণ করে না। এ প্রসঙ্গে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নেতা লালকৃষ্ণ আদভানির রথযাত্রার কথা মনে পড়ছে। তাঁর রথের সারথি (চালক) ছিলেন সেলিম নামের এক মুসলিম যুবক। একাত্তরের ইতিহাস জানতে হলে তাঁকে তখনকার পত্রপত্রিকা, প্রামাণ্য দলিল ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গ্রন্থাদি পাঠ করতে হবে। ‘নিকটাত্মীয় ও ওয়াকিবহাল মহল’ থেকে যেসব তথ্য পাওয়া যাবে, তা পক্ষপাতদুষ্ট হওয়ার আশঙ্কাই বেশি।
No comments