সাদাকালো-দারিদ্র্য বিমোচন ও ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থার সমস্যা by আহমদ রফিক

দারিদ্র্য বিমোচন, ক্ষুদ্রঋণ সহায়তা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে বেশ কিছুদিন থেকে লেখালেখি চলছে। অর্থনীতিবিদ বা সমাজবিজ্ঞানীরা নিজ নিজ অবস্থান থেকে বিশেষজ্ঞ মতামত দিচ্ছেন। পক্ষে-বিপক্ষে নানা কথা নানা মত। বিষয়টা এমন যে এর ভালোমন্দ সমাজমনস্ক মানুষমাত্রই বুঝে নিতে পারেন এবং তা অর্থনীতির গভীরে না গিয়েও।


রবীন্দ্রনাথ অর্থনীতিবিদ ছিলেন না, কিন্তু নিছক মানবিক বোধের তাগিদে দারিদ্র্য বিমোচনের এদিকটাতে এগিয়ে এসেছিলেন। লক্ষ্য ছিল দারিদ্র্য বিমোচনের পাশাপাশি দরিদ্র গ্রামবাসীকে মহাজনি ঋণের ফাঁস থেকে রক্ষা করা। এ কাজ তিনি সফলভাবেই সম্পন্ন করেছিলেন।
ভূমিকায় তত্ত্বকথা নয়, তত্ত্বের ধারঘেঁষা একটা কথা বলি। ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থা (মাইক্রোক্রেডিট সিস্টেম) সম্পর্কে বলতে গিয়ে আমরা সবাই, এমনকি ডাকসাইটে অর্থনীতিবিদরাও দারিদ্র্য বিমোচনের কথা বলে থাকেন। শব্দটা ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত। কিন্তু বিমোচন কথাটার আভিধানিক অর্থ মুক্তি। তাহলে বিষয়টা দাঁড়ায় ক্ষুদ্রঋণ সহায়তায় দারিদ্র্য থেকে মুক্তি, যা আদৌ ঠিক নয়। যেটুকু ঘটে এবং ক্ষেত্রবিশেষে ঘটে তা হলো দারিদ্র্য হ্রাস। কিন্তু এর আগাপাছতলা খতিয়ে দেখলে সেখানেও প্রশ্ন উঠে আসে। জরিপে নিশ্চিত হওয়া দরকার, কত শতাংশের দারিদ্র্য কমেছে!
সম্প্রতি পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান, অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক খলীকুজ্জমান আহমদ এক মতবিনিময় সভায় মন্তব্য করেছেন, বাস্তব অবস্থার তাগিদে ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। এ মতবিনিময় সভায় উপস্থিত না থাকার কারণে কাগজে প্রকাশিত প্রতিবেদন পড়ে যা বুঝেছি, তা হলো প্রথমত, যাঁরা ঋণ নিচ্ছেন তাঁদের মতো ঋণদাতার আর্থিক অবস্থানগত ভিতটা মজবুত থাকা দরকার। তা না হলে ঋণের সরবরাহ কমে যাবে। এটা মাথায় রেখে নীতিমালায় পরিবর্তন আনতে হবে। যুক্তিসংগত কথা।
দেড়-দুই দশক আগে ভূমিহীন সমিতির কল্যাণে মাটিঘেঁষা দু'-একটি ক্ষুদ্রঋণবিষয়ক মতবিনিময় সভায় উপস্থিত থাকার সুযোগ হয়েছিল। সেই সঙ্গে দুটো বড়সড় আন্তর্জাতিক সেমিনারেও যোগ দিয়েছিলাম। ছোট হলেও প্রথমটির গুরুত্ব ছিল অনেক বেশি। কারণ সেখানে খোদ ঋণগ্রহীতা কয়েকজন গ্রামীণ নারী-পুরুষ উপস্থিত ছিলেন। ঋণদানের নিয়মকানুন ও সুদ আদায়ের পদ্ধতি নিয়ে তাঁদের তুলে ধরা ছবি আমাদের জন্য ছিল খুবই অস্বস্তিকর। তাঁদের মূল দাবি ছিল, সাপ্তাহিক সুদ আদায় এবং সুদের কিস্তি শোধের অপারগতায় অমানবিক আচরণ সম্পর্কে ঋণদাতাদের রীতিনীতির পরিবর্তন। সুদ আদায় করতে গিয়ে দরিদ্র পরিবারটির সহায়সম্বল গরু-ছাগল-হাঁস-মুরগি বা ঘরের চাল থেকে টিন খুলে নেওয়া হলে গরিবের আর থাকে কী?
ভবিষ্যতে তিনি কোনো দিনই ওই ঋণ শোধ করতে পারবেন না, সুদ তো নয়ই। তাঁদের এ বিষয়ে বক্তব্য ছিল, দুই হাজার, পাঁচ হাজার টাকার ঋণ নিয়ে এমন ব্যবসা করা যায় না, যাতে সপ্তাহে সপ্তাহে সুদের কিস্তি শোধ করা যায়। তবে সে ক্ষেত্রে তাঁদের সবচেয়ে বড় দাবি ছিল, ক্ষুদ্রঋণে সুদের হার ক্ষুদ্র স্তরে রাখা অর্থাৎ তা যেন কোনোমতেই ১৫ শতাংশের ঊধর্ে্বর্ না যায়। কিন্তু ঋণদাতা সংস্থাগুলোর সংখ্যা ও শক্তি এতই যে তাদের ওই দাবি ও কান্না গ্রামবাংলার নদীতে ভেসে গেছে। আমি ওই সমিতির কর্ণধার_ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো তরুণ সুবল-ফয়েজদের এখনো খুঁজে ফিরি (এত দিনে ওরা আর তরুণ নেই, স্বার্থবুদ্ধি তাদের গ্রাস করেছে কি না তাও জানি না)। জানতে ইচ্ছা হয়, তাদের নিঃস্বার্থ কর্মতৎপরতা জলে ভেসে গেল কেন? তাদের চেষ্টা সত্ত্বেও ক্ষুদ্রঋণের অস্বাভাবিক সুদের হারে এখনো কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। এ নিয়ে চলছে পক্ষ-প্রতিপক্ষের যুক্তিতর্কের কথকতা।
সুদের হার সম্পর্কে পূর্বোক্ত মতবিনিময় সভায় অধ্যাপক ড. খলীকুজ্জমান ক্ষুদ্রঋণ নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের সম্প্রতি বেঁধে দেওয়া ২৭ শতাংশ সুদের হার সঠিক বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন। কারণ এ ক্ষেত্রে 'সাতাশ মানে সাতাশ', এর সঙ্গে অন্য কোনো জটিলতা যুক্ত নেই। তাঁর মতে, সঞ্চয়ের নামে অগ্রিম ৫ শতাংশ টাকা কেটে রাখা বন্ধ করতে হবে। আর সুদের কিস্তি সপ্তাহের বদলে ১৫ দিনে নেওয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে।
যতদূর মনে পড়ে, পূর্বোক্ত মতবিনিময় সভায় উপস্থিত ঋণগ্রহীতা গ্রামীণ মহিলাদের দাবি ছিল, সুদের কিস্তি আদায়ে অন্তত এক মাস সময় দেওয়া। সে কথা যাক, সব কথার প্রথম কথা সুদের হার নিয়ে। ওই ঋণগ্রহীতাদের মতো আমাদেরও প্রশ্ন_২৭ শতাংশ হারে সুদের দাবি মিটিয়ে ওই দুই-চার হাজার টাকার কাজে কি আদৌ কোনো সঞ্চয় সম্ভব? তা যদি না হয়, তাহলে কিসের ক্ষুদ্রঋণ সহায়তা, কিসের দারিদ্র্য বিমোচন, তথা দারিদ্র্য হ্রাস। গোটা বিষয়ই হয়ে দাঁড়ায় পরিমার্জিত ভাষায় আধুনিক মহাজনি ব্যবসা, যেখানে ঋণের ফাঁসটা হয়তো অতীতের ভয়াবহ মহাজনি ঋণের তুলনায় একটু হালকা। একটু হালকাই বা বলি কিভাবে! হালকা হলে কি ক্ষুদ্রঋণের ফাঁসে আটক নারীদের আত্মহত্যা করতে হয়? বেশ কয়েকটি তেমন ঘটনা স্থানীয় দৈনিকে প্রকাশ পেয়েছিল। এ প্রসঙ্গে একটি নামি কাগজের সাংবাদিক প্রশ্ন রেখেছিলেন_ওই আত্মহত্যার ঘটনা সুবিধাপ্রাপ্তদের তুলনায় কত শতাংশ? জবাবে তাঁদের কথায়ই বলি, ঋণের ফাঁসে দারিদ্র্য বিমোচনের পরিবর্তে একটি প্রাণ নষ্ট হওয়াও কম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা নয়। প্রাণনাশের তো কোনো বিনিময়মূল্য নেই। হোক না তা ক্ষুদ্রঋণের ক্ষুদ্র শতাংশ।
বিশাল শিরিষগাছের ছায়াঢাকা বাড়ির বাসিন্দা আমার একান্ত এক নিকটজন এ প্রসঙ্গে সঠিকভাবে বলে থাকেন : 'ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থার একটা মাত্র ভালো দিক হলো কোনো ইক্যুইটি ছাড়া ঋণ দেওয়া হয়, যে জন্য বিশ্বজুড়ে এ ব্যবস্থার এতটা খ্যাতি; কিন্তু যে হারে সুদ নেওয়া হয় এবং বিশেষ করে যে অমানবিক পদ্ধতিতে সুদ আদায় করা হয় তা রীতিমতো আপত্তিকর। বিদেশিরা এসব জানে না বলেই ক্ষুদ্রঋণ সহায়তা নিয়ে তাদের এত মাতামাতি।' প্রসঙ্গত বলি, এ মন্তব্য এমন একজন মহিলার, যিনি প্রকৃত অর্থেই একজন সমাজসেবী।
তাঁর কথার সূত্র ধরেই বলি : ওই এক সুবিধার ফাঁদে পড়ে অসহায় গ্রামীণ নারীদের ছটফটানি কারো চোখে পড়ে না, যেমন_আমাদের অর্থনীতিবিদ বা সমাজবিজ্ঞানীর, তেমনি বিদেশি বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর। প্রসঙ্গত বলি, ক্ষুদ্রঋণ সহায়তা যদি সেবাব্রত না-ও হয়, এত লোভ-লাভের ব্যবসা নয় যে এতে মুনাফাবাজি প্রাধান্য পাবে। আর মুনাফাবাজি যদি নাইবা হবে, তাহলে এক সংস্থার আয়ে একাধিক শিল্প সংস্থা গড়ে তোলা কিভাবে সম্ভব?
এ প্রসঙ্গে ২৮ মার্চ একটি দৈনিকে প্রকাশিত চমকপ্রদ খবরের উদ্ধৃতি থেকে বোঝা যায়, ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থা আসলেই মুনাফানির্ভর ব্যবসা। এ ব্যবসার মুনাফা-মানসিকতার টানেই ভারতের এসকেএস নামের একটি ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান বেশি মুনাফার আশায় শেয়ারবাজারে অর্থ বিনিয়োগ করেছে। এ নিয়ে সেখানকার মানুষ ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমকে সন্দেহ করছে। লাতিন আমেরিকার কয়েকটি দেশেও এমন ঘটনা ঘটেছে (সূত্র : কালের কণ্ঠ)।
অধ্যাপক ড. খলীকুজ্জমান প্রসঙ্গত একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, শুধু ক্ষুদ্রঋণের টাকা দিয়েই দারিদ্র্য দূর করা যাবে না। ক্ষুদ্রঋণ যাতে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে ভূমিকা রাখে, সেদিকে গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ উৎপাদনশীলতা না বাড়লে সঞ্চয় বাড়বে না। তাঁর মতে, ক্ষুদ্রঋণকে ধীরে ধীরে স্বকর্মসংস্থান থেকে কর্মসংস্থান সৃষ্টির দিকে যেতে হবে। তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে আমাদের সংযোজন হচ্ছে নীতিগতভাবে ক্ষুদ্রঋণ দান যদি মুনাফাবাজির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে না আসে, টেকসই হওয়ার মতো মুনাফার হার অতিক্রম না করে, সুদের হার যদি কমিয়ে না আনে, তাহলে কথিত উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি কখনো সম্ভব হবে না। মুনাফার চাপে ওই ক্ষুদ্রঋণ আপসে আপ ঋণগ্রহীতার ক্ষুধা মেটানোর অত্যাবশ্যক প্রয়োজনে শেষ হয়ে যাবে। আয় বা সঞ্চয় কোনোটাই সম্ভব হবে না।
কিন্তু সুদের হার কমানোর প্রশ্নে কোনো কোনো অর্থনীতিবিদও দেখছি আগ্রহী নন। এ ক্ষেত্রে আমার একটি প্রশ্নের জবাব খুঁজে পাইনি। শতবর্ষ আগে পতিসরে 'কালিগ্রাম কৃষি ব্যাংক' স্থাপন করে রবীন্দ্রনাথ যদি দরিদ্র কৃষক-প্রজাদের ১২ শতাংশ হারে ঋণ দিয়ে ২০ বছর কৃষি ব্যাংক চালিয়ে যেতে পারেন, তাহলে আমাদের ক্ষুদ্রঋণ দান সংস্থাগুলো ১৫ শতাংশ সুদের হারে ঋণ দিয়ে তাদের সংস্থাগুলো 'টেকসই' করে তুলতে পারবে না কেন?
আমার কেন জানি মনে হয়, এ ক্ষেত্রে মুনাফার বিষয়টাই বড় সমস্যা। সমস্যা মানসিকতার। একালের ভোগবাদী সমাজে বিশ্ব করপোরেট পুঁজি ও মুনাফার প্রভাব এতটাই বিশ্বময় ছড়িয়ে আছে যে দারিদ্র্য বিমোচনের চেষ্টায়ও মুনাফা তার বিশাল কালোছায়া ফেলে আছে। মানসিকতার পরিবর্তন ছাড়া অন্য কোনো পথে লক্ষ্যভেদী পরিবর্তন আনা বোধ হয় সম্ভব নয়। লোভের-লাভের তথা মুনাফার মাত্রাটাকে মানবিক পর্যায়ে বেঁধে দিতে হবে, না হলে মুক্তি মিলবে না। কথাটা অর্থনীতিবিদরা ভেবে দেখতে পারেন। ভেবে দেখতে পারেন কিভাবে মুনাফাকে সীমিত হারে বেঁধে কার্যসিদ্ধি অর্থাৎ লক্ষ্য অর্জন সম্ভব করে তোলা যায়।

লেখক : ভাষাসংগ্রামী, কবি, গবেষক, প্রাবন্ধিক

No comments

Powered by Blogger.