বাঘা তেঁতুল-হেমিংওয়ের বিড়াল by সৈয়দ আবুল মকসুদ

আর্নেস্ট হেমিংওয়ে আমেরিকার একজন বড় লেখক। তাঁর গল্প ও উপন্যাস সহজ ভাষায় লেখা, কিন্তু অসাধারণ। ছিলেন রোমাঞ্চাভিলাষী। দুঃসাহসী ও বিপৎসংকুল কাজকর্ম করতে পছন্দ করতেন। যেমন সমুদ্রে ছোট নৌকা নিয়ে মাছ ধরা, গহন অরণ্যে শিকার, ষাঁড়ের সঙ্গে লড়াইয়ে অংশ নেওয়া,


যা তিনি রপ্ত করেছিলেন গৃহযুদ্ধের সময় স্পেনে অবস্থানকালে। তাঁর গল্প-উপন্যাসে তাঁর রোমাঞ্চকর জীবনের ছাপ রয়েছে।
হেমিংওয়ে ছিলেন কাজী নজরুল ইসলামের চেয়ে ৫৬ দিনের ছোট। প্রথম মহাযুদ্ধে ছিলেন অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার। যুদ্ধক্ষেত্রে আহত হয়েছিলেন। সুস্থ হওয়ার পর শুরু করেন সাংবাদিকতা ও লেখালেখি। প্যারিসে টরন্টো স্টার-এর সংবাদদাতা ছিলেন অনেক দিন। স্পেনেও ছিলেন কয়েক বছর। তারপর নিজের দেশে না থেকে কিউবায় বসবাস করতে থাকেন। চার বিয়ে করে আলোচিত হয়েছিলেন। তাঁর একটি পোষা বিড়ালের নাম ছিল ‘আঙ্কেল উইলি’।
এক সড়ক দুর্ঘটনায় আঙ্কেল উইলি আহত হয়। তার দুটি পা পঙ্গু হয়ে যায়। সে কাতরাতে কাতরাতে চলাফেরা করত। তখন হেমিংওয়ে কিউবায়। চে গুয়েভারা ও ফিদেল কাস্ত্রোদের বিপ্লবের আগের ঘটনা। প্রিয় বিড়ালের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে একদিন তিনি ওকে ক্রসফায়ারে দেন। অর্থাৎ আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে গুলি করে হত্যা করেন।
যেদিন তিনি বিড়ালকে ক্রসফায়ার করেন, সেদিনই তাঁর বাগানবাড়িতে সময় কাটাতে যান তাঁর কয়েকজন বন্ধু। তাঁরা গিয়ে দেখেন হেমিংওয়ে কাঁদছেন। বন্দুক হাতে তিনি বন্ধুদের সামনে উপস্থিত হয়ে বলেন, ‘তেমরা খুব একটা খারাপ সময়ে এসেছ। প্লিজ, দোহাই তোমাদের, আজ চলে যাও। আমাকে একটু একা থাকতে দাও।’
১৯৫০ সালের ওই দিন হেমিংওয়ে তাঁর এক ইতালীয় বন্ধুকে লিখেছিলেন, ‘আমি অনেককে গুলি করেছি, তবে কখনোই এমন কাউকে হত্যা করিনি, যাকে আমি ১১ বছর ধরে চিনতাম ও ভালোবাসতাম।’
কিউবায় কাস্ত্রোর কমিউনিস্ট বিপ্লবী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর হেমিংওয়ে দেশে ফিরে যান। একধরনের হতাশা ও বিষণ্নতা দেখা দেয় তাঁর মধ্যে। ১৯৬১ সালে তিনি নিজেকে নিজে ক্রসফায়ারে দেন। অর্থাৎ বন্দুক মাথায় ঠেকিয়ে আত্মহত্যা করেন।
তাঁর জীবনী লেখকদের ধারণা ছিল বিষণ্নতায় আক্রান্ত হয়ে হেমিংওয়ে আত্মহত্যা করেন। এতকাল পরে গত হপ্তাহে তাঁর কিছু ব্যক্তিগত চিঠি প্রকাশিত হওয়ার পর জানা গেল, তাঁর বিষণ্নতার কারণ তাঁর বিড়ালের সড়ক দুর্ঘটনায় দুটি পা হারানো এবং তাকে ক্রসফায়ারে হত্যা করা। আঙ্কেল উইলিকে ক্রসফায়ারে হত্যা করার পর থেকেই হেমিংওয়ে বিষণ্নতায় ভুগতে থাকেন।
ক্রসফায়ারে বিড়াল নিহত হওয়ার পর, কথাশিল্পীর নিজের বিবেকের সঙ্গে এনকাউন্টার হয়। তিনি বিবেকের মুখোমুখি হন। তিনি উপলব্ধি করেন বিড়ালকে এনকাউন্টারে হত্যা করা এবং একটি নিরস্ত্র প্রাণীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে জয়ী হওয়া মনুষ্যজনোচিত কাজ হয়নি। তার প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে তিনি বন্দুকযুদ্ধে নিজেকে নিজে হত্যা করেন।
বাংলাদেশে আজ সড়ক দুর্ঘটনা এবং ক্রসফায়ার ও বন্দুকযুদ্ধ প্রতি বেলার উচ্চারিত শব্দ। বিড়ালের পা চারটি। তার মধ্যে আঙ্কেল উইলির দুটি পা পঙ্গু হয়েছিল। চার পাসহ আস্ত বিড়ালটি মারা যায়নি। মানুষের পা-ই মাত্র দুটি। একটা হোক, দেড়টা হোক, দুটো হোক—বাংলাদেশে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় পা হারাচ্ছে শ খানেক মানুষ। মারা যাচ্ছে গড়ে ১৮ জন। ওদিকে ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধে বছরে মারা যাচ্ছে কয়েক ডজন। এ নিয়ে যদি আমাদের মধ্যে বিষণ্নতা বা হতাশা দেখা দিত, তাহলে, হেমিংওয়ের নীতি অনুসরণ করলে, মৃতের সংখ্যা হতো দ্বিগুণ। ক্রসফায়ারে জীবন যেত দুজনের: একজনের খেতের মধ্যে আর একজনের নিজের ঘরের মধ্যে। কিন্তু সোনার বাংলার মাটিতে ক্রসফায়ার ও বন্দুকযুদ্ধ হবে শুধু ধানখেত কিংবা শিম, বরবটি, পটোল ও করলার খেতে।
ধান বা সবজিখেতের মধ্যে নিরস্ত্র মানুষকে দাঁড় করিয়ে যারা ক্রসফায়ার করে, রাষ্ট্র তাদের জামাই আদরে প্রতিপালন করলেও তাদের ও তাদের পরিবার-পরিজনদের উচিত নিজেদের বিবেকের সঙ্গে এনকাউন্টার করা। একটি বুড়ো বিড়ালের হত্যাকাণ্ড হেমিংওয়ের বিবেককে নাড়া দিয়েছিল। মানুষের অপঘাতে মৃত্যু বা হত্যা কি মানুষের ঘুমন্ত বিবেককে জাগিয়ে তুলতে পারে না? প্রাণী হিসেবে এখনো আমরা মানুষ নামেই পরিচিত। নরপশু নামে পরিচিতি পেলে তা বেশি সম্মানজনক হবে না।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.