সমকালীন প্রসঙ্গ-পশ্চিমবঙ্গে মমতা ব্যানার্জির ফ্যাসিস্ট শাসন by বদরুদ্দীন উমর
কয়েকদিন আগে মমতা ব্যানার্জি এক হুকুম জারি করেছেন, পশ্চিমবঙ্গের সরকারি ও সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত পাঠাগারগুলোতে কোনো সরকারবিরোধী সংবাদপত্র রাখা যাবে না। যারা সরকার-বিরোধিতা করবে, তাদের নাম পাঠাগারের সংবাদপত্র তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হবে।
এ ধরনের অদ্ভুত হুকুম সিপিএম নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সরকার তাদের ৩৪ বছরের শাসনামলে করেনি এবং এ ধরনের কোনো কথাও বলেনি। অথচ মমতা ব্যানার্জি এখন তা করলেন। এ কাজ যে ফ্যাসিবাদের কাজ এতে আর কারও সন্দেহ থাকতে পারে?
২০১১ সালের নির্বাচনের পর থেকে এক বছরের মধ্যেই পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে বেশ উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। মহাধুমধাড়াক্কা করে, কাড়ানাকাড়া বাজিয়ে, তৃণমূল কংগ্রেস নির্বাচনে জয়লাভ করে ক্ষমতা দখলের পর পশ্চিমবঙ্গের জনগণ এখন উপলব্ধি করতে শুরু করেছেন যে, বিগত নির্বাচনে উত্তপ্ত কড়াই থেকে তারা আগুনে ঝাঁপ দিয়েছিলেন, ইংরেজিতে যাকে বলে ঋৎড়স ভৎুরহম ঢ়ধহ ঃড় ভরৎব.
তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা ব্যানার্জি পশ্চিমবঙ্গর মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে ঘোষণা করে যাচ্ছেন যে, বিগত বামফ্রন্ট সরকারের নানা দুষ্কৃতির কারণে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতি থেকে নিয়ে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির যে অবনতি ঘটেছিল তা তিনি তার দশ মাসের শাসনে উল্লেখযোগ্যভাবে রোধ করেছেন এবং রাজ্যকে শিগগিরই একটি স্বর্গরাজ্যে পরিণত করবেন। একই কথা তার মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা ধুয়োর মতো করে বলছেন। তারা তার সহকর্মী হিসেবে নয়, চাকর-বাকরের মতো তার কথায় ওঠবস করেন এবং কারণে-অকারণে তার গুণগান করে সরকারের নানাবিধ অর্জনের কথা বলেন। দেখা যায় যে, কোনো মন্ত্রী বা দলীয় নেতা কোনো বিষয়ে কথা বলতে গেলেই তাদের নেত্রী মমতা ব্যানার্জির কথা না বলে ছাড়েন না। তাদের কথা হলো, মমতা ব্যানার্জির নির্দেশমতোই তারা সবধরনের জনহিতকর কাজ করছেন, যার মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গ অল্পদিনের মধ্যেই তাদের কথিত স্বর্ণরাজ্যে পরিণত হবে।
এদিকে মমতা ব্যানার্জির সরকারের দশ মাসের মাথায় নির্বাচনের সময়ে তার সমর্থক 'বামপন্থি' বুদ্ধিজীবীদের অবস্থা এখন অন্য রকম। যারা নির্বাচনের সময়ে তাকে গণতন্ত্রের মানসকন্যা, সিপিএম নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্টের হাত থেকে পশ্চিমবঙ্গের পরিত্রাতা হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন, তারা এখন সভা ডেকে তাকে ফ্যাসিস্ট আখ্যায় ভূষিত করছেন! এর মধ্যে এককালীন প্রগতিশীল লেখিকা মহাশ্বেতা দেবীর অবস্থাই সব থেকে করুণ। ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের হুলস্থূলের সময় তিনি মমতা ব্যানার্জির গুণকীর্তন করতে গিয়ে বলেছিলেন, যার কোলে মাথা রেখে গরিব নির্যাতিত মেয়েরা কাঁদতে পারে তার থেকে উপযুক্ত শাসক আর কে হতে পারে? এখন মমতা ব্যানার্জির সরকার এক বছর পার করার আগেই তিনি তাকে আখ্যায়িত করছেন ফ্যাসিস্ট হিসেবে! বাস্তবত পশ্চিমবঙ্গের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে নির্বাচনের সময় তার মধ্যেই মমতা ব্যানার্জির জন্য দেখা গিয়েছিল সব থেকে গদগদ ভাব। আবার কয়েক মাস হলো সকলের আগে তিনিই তাকে আখ্যায়িত করেছিলেন ফ্যাসিস্ট হিসেবে। এখন আবার নতুন উদ্যমে আরও কিছুসংখ্যক লেখক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে তিনি ফ্যাসিস্ট মমতা ব্যানার্জির বিরুদ্ধে সমালোচনায় মুখর হয়েছেন!
এ কথা ঠিক যে, সিপিএম ও তার নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সরকার তাদের শাসনামলে কিছু ভালো কাজের সঙ্গে বেশ কিছু খারাপ কাজ করেছিল। বিশেষত তাদের শাসনকালের শেষ দিকে তাদের ঔদ্ধত্য, নীতিগত অনেক ভ্রান্তি ও জনবিরোধী কাজ এবং মাঝারি পর্যায়ের নেতাদের অনেকের দুর্নীতি পশ্চিমবঙ্গে একটা আধা-নৈরাজ্যিক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল এবং জনগণ তার পরিবর্তন চাইছিলেন। সেই সুযোগে পরিবর্তনের আওয়াজ তুলে মমতা ব্যানার্জি ২০১১ সালের নির্বাচন করেছিলেন।
প্রকৃতপক্ষে তার কোনো সংগঠন নেই। পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস শাসন উচ্ছেদের পর থেকে বিরোধী শিবিরে যে শূন্যতা বিরাজ করছিল, সেই শূন্যতা দূর করতে তিনি কংগ্রেস থেকে বের হয়ে গঠন করেছিলেন তৃণমূল কংগ্রেস। কিন্তু তার তৃণমূল কংগ্রেসের সংগঠন বলে বিশেষ কিছু তিনি দাঁড় করাতে পারেননি। কিছু লোকজন নিজের চারদিকে জড়ো করে তিনি বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। এভাবে দাঁড়িয়ে তিনি বিরোধী রাজনীতির একটা শূন্যতা পূরণ করেছিলেন। লোকজন নিয়ে তিনি নির্বাচনী লড়াইয়ে নেমেছিলেন এবং দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ কাজে লাগিয়ে শেষ পর্যন্ত ২০১১ সালের নির্বাচনে জয়লাভও করেছিলেন। কিন্তু নির্বাচনের সময় তার প্রতি যারা সমর্থন জানিয়েছিলেন তারা যে আলগা লোক ছিলেন এটা এরই মধ্যে স্পষ্ট হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের বুদ্ধিজীবীরা, বিশেষত কলকাতাকেন্দ্রিক বাম বুদ্ধিজীবীরাই তার একটা প্রমাণ।
শুধু কলকাতাকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবীরাই নয়, সাধারণভাবে কলকাতাই এখন মমতা ব্যানার্জির থেকে মুখ ফেরাতে শুরু করেছে। এটা তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ নির্বাচনের সময় কলকাতাই ছিল মমতা ব্যানার্জির প্রধান ঘাঁটি। তবে শুধু কলকাতাই নয়, পশ্চিম মেদিনীপুরে জঙ্গলমহল, উত্তর বাংলার গুর্খা অধ্যুষিত অঞ্চল থেকে নিয়ে, মুর্শিদাবাদসহ অন্যান্য জেলাতে তৃণমূল কংগ্রেসের আগের অবস্থা যে আছে এমন বলা যাবে না। সিপিএম নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্টের ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ, যাকে ইংরেজিতে বলে ধহঃর-রহপঁসনবহপু ভধপঃড়ৎ, কাজ করেছিল। কিন্তু বামফ্রন্টের ৩৪ বছর শাসনের পর যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছিল সেই ক্ষোভ এখন তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে ধূমায়িত হতে শুরু করেছে তাদের সরকারের বছর ঘোরার আগেই।
জঙ্গলমহলে মাওবাদীদের সিপিএম দমন-পীড়ন করছিল। তার বিরুদ্ধে মমতা ব্যানার্জর্ি আওয়াজ তুলেছিলেন। এখন তিনি নিজেই সে অঞ্চলে যা করছেন তার সঙ্গে বামফ্রন্ট সরকারের দমন-পীড়নের পার্থক্য নেই। পশ্চিমবঙ্গে এখন অরাজকতা যেভাবে ছড়িয়ে পড়ছে, বিরুদ্ধ রাজনৈতিক দল বিশেষত সিপিএমসহ বামপন্থি দল, এমনকি তাদের সরকারের অংশীদার কংগ্রেসের কর্মীদের বিরুদ্ধেও তৃণমূল কংগ্রেস সরকার অফিস ভাংচুর থেকে নিয়ে খুন-খারাবি পর্যন্ত যেভাবে করছে, তাতে কলকাতার বাইরে মমতা ব্যানার্জির শাসন ব্যবস্থা ও জনপ্রিয়তার দ্রুত অবনতি ঘটছে। 'মা, মাটি, মানুষ' নামে এক সস্তা অথচ দুর্বোধ্য স্লোগান তুলে তিনি পশ্চিমবঙ্গে যে পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তার ধারেকাছেও তারা যেতে পারেননি। তারা বলেছিলেন, তারা পরিবর্তন চান; কিন্তু প্রতিহিংসা তাদের লক্ষ্য নয়। 'বদলা নয়, বদল'_ এই ছিল তাদের নির্বাচনের আওয়াজ। কিন্তু এখন পশ্চিমবঙ্গে বিরোধীদের ওপর যেভাবে তারা প্রতিহিংসা চরিতার্থ করছেন তাতে তাদের আওয়াজের অর্থ পরিবর্তিত হয়ে দাঁড়িয়েছে 'বদল নয়, বদলা'। তাদের এই রাজনৈতিক উল্টো যাত্রার কারণে আগামী নির্বাচনে জনগণ যে তাদের তরী ডুবিয়ে দেবেন, এটা বোঝার কোনো অসুবিধা আর নেই। কয়েকদিন আগে কলকাতায় বুদ্ধিজীবীদের এক প্রতিবাদ সভায় মমতা ব্যানার্জির নির্বাচনকালীন এক বুদ্ধিজীবী সমর্থক আর্তনাদের মতো করে যেভাবে এ কথা বললেন তার মধ্যেই এই সম্ভাবনা স্পষ্টভাবে দেখা যায়। তাদের কথা হলো, মমতা ব্যানার্জি যে সিপিএমকে দরজা দেখিয়েছিলেন তারা ইতিমধ্যেই তার নানা অপকীর্তির ফলে আবার পশ্চিমবঙ্গের দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে। এখন শুধু পরবর্তী নির্বাচনে তাদের আবার গৃহপ্রবেশের অপেক্ষা!
কয়েকদিন আগে মমতা ব্যানার্জি এক হুকুম জারি করেছেন, পশ্চিমবঙ্গের সরকারি ও সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত পাঠাগারগুলোতে কোনো সরকারবিরোধী সংবাদপত্র রাখা যাবে না। যারা সরকার-বিরোধিতা করবে, তাদের নাম পাঠাগারের সংবাদপত্র তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হবে। এ ধরনের অদ্ভুত হুকুম সিপিএম নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সরকার তাদের ৩৪ বছরের শাসনামলে করেনি এবং এ ধরনের কোনো কথাও বলেনি। অথচ মমতা ব্যানার্জি এখন তা করলেন। এ কাজ যে ফ্যাসিবাদের কাজ এতে আর কারও সন্দেহ থাকতে পারে?
তৃণমূল কংগ্রেসের এক কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রমন্ত্রী এ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের বলেন যে, সরকারি ও সরকার সমর্থক পাঠাগারগুলোর সংখ্যা পশ্চিমবঙ্গে চারশ'র কিছু বেশি। সরকারি নিষেধাজ্ঞার ফলে পত্রিকাগুলোর চার-পাঁচশ' কপি বিক্রি কম হলে তাদের কী এমন ক্ষতি হয় যে, তারা এ নিয়ে এত হৈচৈ করছে! এই নির্বোধ বক্তব্য বিষয়ে কী আর বলা যায়? পাঠাগারে সংবাদপত্র যাওয়া কি শুধু সংশ্লিষ্ট সংবাদপত্রগুলোরই ব্যাপার? এর সঙ্গে কি পাঠকদের সম্পর্ক নেই? এর মধ্যে কি তাদের স্বার্থ নেই? যে জনগণের ট্যাক্সের টাকায় সরকার চলে সেই জনগণকে যে সরকারি পাঠাগারগুলোতে সংবাদপত্র পাঠের সুবিধা থেকে এর ফলে বঞ্চিত করা হয়, এটা কি তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা ব্যানার্জির বশংবদ মন্ত্রীর চিন্তায় একেবারেই নেই? নিশ্চয় নেই অথবা থাকলেও নেত্রীকে খুশি করার জন্য সে বিষয়ের উল্লেখ করে বিপদে পড়ার কোনো ইচ্ছা মন্ত্রীর নেই। মমতা ব্যানার্জির ব্যক্তিগত ইচ্ছার বাইরে গিয়ে কোনো কথা বললে বা সিদ্ধান্ত নিলে তার কী হয় সেটা তিনি ভারতের রেলমন্ত্রী দিনেশ ত্রিবেদির ক্ষেত্রে দেখিয়ে দিয়েছেন। অবাধ্যতার কারণে তার মন্ত্রিত্ব তিনি দিলি্লতে এক টেলিফোন কল দিয়েই শেষ করেছেন।
সরকারি পাঠাগারগুলোতে সরকার সমালোচক পত্রিকাগুলো নিষিদ্ধ করায় পাঠকদের স্বাধীনতার ওপর যে হামলা করা হয় সেদিকটি বিবেচনা করেই পশ্চিমবঙ্গে এককালীন তৃণমূল সমর্থক বাম বুদ্ধিজীবীরা এখন সোচ্চার হয়ে প্রতিবাদ করছেন, সংবাদপত্রগুলোর বিক্রি সংখ্যা চার-পাঁচশ' কমে যাবে, এ জন্য নয়। কিন্তু মন্ত্রী মহোদয়ের কথা থেকে মনে হয়, পত্রিকা নিষিদ্ধ করার ক্ষেত্রে এ ছাড়া বলার আর কিছু নেই! মমতা ব্যানার্জি ও তার সরকারের অবস্থা যে কত কাহিল, তারা যে কতখানি দেউলিয়া এর থেকে সেটা বোঝার অসুবিধা আর কী আছে?
৯.৪.২০১২
২০১১ সালের নির্বাচনের পর থেকে এক বছরের মধ্যেই পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে বেশ উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। মহাধুমধাড়াক্কা করে, কাড়ানাকাড়া বাজিয়ে, তৃণমূল কংগ্রেস নির্বাচনে জয়লাভ করে ক্ষমতা দখলের পর পশ্চিমবঙ্গের জনগণ এখন উপলব্ধি করতে শুরু করেছেন যে, বিগত নির্বাচনে উত্তপ্ত কড়াই থেকে তারা আগুনে ঝাঁপ দিয়েছিলেন, ইংরেজিতে যাকে বলে ঋৎড়স ভৎুরহম ঢ়ধহ ঃড় ভরৎব.
তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা ব্যানার্জি পশ্চিমবঙ্গর মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে ঘোষণা করে যাচ্ছেন যে, বিগত বামফ্রন্ট সরকারের নানা দুষ্কৃতির কারণে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতি থেকে নিয়ে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির যে অবনতি ঘটেছিল তা তিনি তার দশ মাসের শাসনে উল্লেখযোগ্যভাবে রোধ করেছেন এবং রাজ্যকে শিগগিরই একটি স্বর্গরাজ্যে পরিণত করবেন। একই কথা তার মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা ধুয়োর মতো করে বলছেন। তারা তার সহকর্মী হিসেবে নয়, চাকর-বাকরের মতো তার কথায় ওঠবস করেন এবং কারণে-অকারণে তার গুণগান করে সরকারের নানাবিধ অর্জনের কথা বলেন। দেখা যায় যে, কোনো মন্ত্রী বা দলীয় নেতা কোনো বিষয়ে কথা বলতে গেলেই তাদের নেত্রী মমতা ব্যানার্জির কথা না বলে ছাড়েন না। তাদের কথা হলো, মমতা ব্যানার্জির নির্দেশমতোই তারা সবধরনের জনহিতকর কাজ করছেন, যার মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গ অল্পদিনের মধ্যেই তাদের কথিত স্বর্ণরাজ্যে পরিণত হবে।
এদিকে মমতা ব্যানার্জির সরকারের দশ মাসের মাথায় নির্বাচনের সময়ে তার সমর্থক 'বামপন্থি' বুদ্ধিজীবীদের অবস্থা এখন অন্য রকম। যারা নির্বাচনের সময়ে তাকে গণতন্ত্রের মানসকন্যা, সিপিএম নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্টের হাত থেকে পশ্চিমবঙ্গের পরিত্রাতা হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন, তারা এখন সভা ডেকে তাকে ফ্যাসিস্ট আখ্যায় ভূষিত করছেন! এর মধ্যে এককালীন প্রগতিশীল লেখিকা মহাশ্বেতা দেবীর অবস্থাই সব থেকে করুণ। ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের হুলস্থূলের সময় তিনি মমতা ব্যানার্জির গুণকীর্তন করতে গিয়ে বলেছিলেন, যার কোলে মাথা রেখে গরিব নির্যাতিত মেয়েরা কাঁদতে পারে তার থেকে উপযুক্ত শাসক আর কে হতে পারে? এখন মমতা ব্যানার্জির সরকার এক বছর পার করার আগেই তিনি তাকে আখ্যায়িত করছেন ফ্যাসিস্ট হিসেবে! বাস্তবত পশ্চিমবঙ্গের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে নির্বাচনের সময় তার মধ্যেই মমতা ব্যানার্জির জন্য দেখা গিয়েছিল সব থেকে গদগদ ভাব। আবার কয়েক মাস হলো সকলের আগে তিনিই তাকে আখ্যায়িত করেছিলেন ফ্যাসিস্ট হিসেবে। এখন আবার নতুন উদ্যমে আরও কিছুসংখ্যক লেখক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে তিনি ফ্যাসিস্ট মমতা ব্যানার্জির বিরুদ্ধে সমালোচনায় মুখর হয়েছেন!
এ কথা ঠিক যে, সিপিএম ও তার নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সরকার তাদের শাসনামলে কিছু ভালো কাজের সঙ্গে বেশ কিছু খারাপ কাজ করেছিল। বিশেষত তাদের শাসনকালের শেষ দিকে তাদের ঔদ্ধত্য, নীতিগত অনেক ভ্রান্তি ও জনবিরোধী কাজ এবং মাঝারি পর্যায়ের নেতাদের অনেকের দুর্নীতি পশ্চিমবঙ্গে একটা আধা-নৈরাজ্যিক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল এবং জনগণ তার পরিবর্তন চাইছিলেন। সেই সুযোগে পরিবর্তনের আওয়াজ তুলে মমতা ব্যানার্জি ২০১১ সালের নির্বাচন করেছিলেন।
প্রকৃতপক্ষে তার কোনো সংগঠন নেই। পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস শাসন উচ্ছেদের পর থেকে বিরোধী শিবিরে যে শূন্যতা বিরাজ করছিল, সেই শূন্যতা দূর করতে তিনি কংগ্রেস থেকে বের হয়ে গঠন করেছিলেন তৃণমূল কংগ্রেস। কিন্তু তার তৃণমূল কংগ্রেসের সংগঠন বলে বিশেষ কিছু তিনি দাঁড় করাতে পারেননি। কিছু লোকজন নিজের চারদিকে জড়ো করে তিনি বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। এভাবে দাঁড়িয়ে তিনি বিরোধী রাজনীতির একটা শূন্যতা পূরণ করেছিলেন। লোকজন নিয়ে তিনি নির্বাচনী লড়াইয়ে নেমেছিলেন এবং দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ কাজে লাগিয়ে শেষ পর্যন্ত ২০১১ সালের নির্বাচনে জয়লাভও করেছিলেন। কিন্তু নির্বাচনের সময় তার প্রতি যারা সমর্থন জানিয়েছিলেন তারা যে আলগা লোক ছিলেন এটা এরই মধ্যে স্পষ্ট হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের বুদ্ধিজীবীরা, বিশেষত কলকাতাকেন্দ্রিক বাম বুদ্ধিজীবীরাই তার একটা প্রমাণ।
শুধু কলকাতাকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবীরাই নয়, সাধারণভাবে কলকাতাই এখন মমতা ব্যানার্জির থেকে মুখ ফেরাতে শুরু করেছে। এটা তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ নির্বাচনের সময় কলকাতাই ছিল মমতা ব্যানার্জির প্রধান ঘাঁটি। তবে শুধু কলকাতাই নয়, পশ্চিম মেদিনীপুরে জঙ্গলমহল, উত্তর বাংলার গুর্খা অধ্যুষিত অঞ্চল থেকে নিয়ে, মুর্শিদাবাদসহ অন্যান্য জেলাতে তৃণমূল কংগ্রেসের আগের অবস্থা যে আছে এমন বলা যাবে না। সিপিএম নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্টের ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ, যাকে ইংরেজিতে বলে ধহঃর-রহপঁসনবহপু ভধপঃড়ৎ, কাজ করেছিল। কিন্তু বামফ্রন্টের ৩৪ বছর শাসনের পর যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছিল সেই ক্ষোভ এখন তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে ধূমায়িত হতে শুরু করেছে তাদের সরকারের বছর ঘোরার আগেই।
জঙ্গলমহলে মাওবাদীদের সিপিএম দমন-পীড়ন করছিল। তার বিরুদ্ধে মমতা ব্যানার্জর্ি আওয়াজ তুলেছিলেন। এখন তিনি নিজেই সে অঞ্চলে যা করছেন তার সঙ্গে বামফ্রন্ট সরকারের দমন-পীড়নের পার্থক্য নেই। পশ্চিমবঙ্গে এখন অরাজকতা যেভাবে ছড়িয়ে পড়ছে, বিরুদ্ধ রাজনৈতিক দল বিশেষত সিপিএমসহ বামপন্থি দল, এমনকি তাদের সরকারের অংশীদার কংগ্রেসের কর্মীদের বিরুদ্ধেও তৃণমূল কংগ্রেস সরকার অফিস ভাংচুর থেকে নিয়ে খুন-খারাবি পর্যন্ত যেভাবে করছে, তাতে কলকাতার বাইরে মমতা ব্যানার্জির শাসন ব্যবস্থা ও জনপ্রিয়তার দ্রুত অবনতি ঘটছে। 'মা, মাটি, মানুষ' নামে এক সস্তা অথচ দুর্বোধ্য স্লোগান তুলে তিনি পশ্চিমবঙ্গে যে পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তার ধারেকাছেও তারা যেতে পারেননি। তারা বলেছিলেন, তারা পরিবর্তন চান; কিন্তু প্রতিহিংসা তাদের লক্ষ্য নয়। 'বদলা নয়, বদল'_ এই ছিল তাদের নির্বাচনের আওয়াজ। কিন্তু এখন পশ্চিমবঙ্গে বিরোধীদের ওপর যেভাবে তারা প্রতিহিংসা চরিতার্থ করছেন তাতে তাদের আওয়াজের অর্থ পরিবর্তিত হয়ে দাঁড়িয়েছে 'বদল নয়, বদলা'। তাদের এই রাজনৈতিক উল্টো যাত্রার কারণে আগামী নির্বাচনে জনগণ যে তাদের তরী ডুবিয়ে দেবেন, এটা বোঝার কোনো অসুবিধা আর নেই। কয়েকদিন আগে কলকাতায় বুদ্ধিজীবীদের এক প্রতিবাদ সভায় মমতা ব্যানার্জির নির্বাচনকালীন এক বুদ্ধিজীবী সমর্থক আর্তনাদের মতো করে যেভাবে এ কথা বললেন তার মধ্যেই এই সম্ভাবনা স্পষ্টভাবে দেখা যায়। তাদের কথা হলো, মমতা ব্যানার্জি যে সিপিএমকে দরজা দেখিয়েছিলেন তারা ইতিমধ্যেই তার নানা অপকীর্তির ফলে আবার পশ্চিমবঙ্গের দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে। এখন শুধু পরবর্তী নির্বাচনে তাদের আবার গৃহপ্রবেশের অপেক্ষা!
কয়েকদিন আগে মমতা ব্যানার্জি এক হুকুম জারি করেছেন, পশ্চিমবঙ্গের সরকারি ও সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত পাঠাগারগুলোতে কোনো সরকারবিরোধী সংবাদপত্র রাখা যাবে না। যারা সরকার-বিরোধিতা করবে, তাদের নাম পাঠাগারের সংবাদপত্র তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হবে। এ ধরনের অদ্ভুত হুকুম সিপিএম নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সরকার তাদের ৩৪ বছরের শাসনামলে করেনি এবং এ ধরনের কোনো কথাও বলেনি। অথচ মমতা ব্যানার্জি এখন তা করলেন। এ কাজ যে ফ্যাসিবাদের কাজ এতে আর কারও সন্দেহ থাকতে পারে?
তৃণমূল কংগ্রেসের এক কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রমন্ত্রী এ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের বলেন যে, সরকারি ও সরকার সমর্থক পাঠাগারগুলোর সংখ্যা পশ্চিমবঙ্গে চারশ'র কিছু বেশি। সরকারি নিষেধাজ্ঞার ফলে পত্রিকাগুলোর চার-পাঁচশ' কপি বিক্রি কম হলে তাদের কী এমন ক্ষতি হয় যে, তারা এ নিয়ে এত হৈচৈ করছে! এই নির্বোধ বক্তব্য বিষয়ে কী আর বলা যায়? পাঠাগারে সংবাদপত্র যাওয়া কি শুধু সংশ্লিষ্ট সংবাদপত্রগুলোরই ব্যাপার? এর সঙ্গে কি পাঠকদের সম্পর্ক নেই? এর মধ্যে কি তাদের স্বার্থ নেই? যে জনগণের ট্যাক্সের টাকায় সরকার চলে সেই জনগণকে যে সরকারি পাঠাগারগুলোতে সংবাদপত্র পাঠের সুবিধা থেকে এর ফলে বঞ্চিত করা হয়, এটা কি তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা ব্যানার্জির বশংবদ মন্ত্রীর চিন্তায় একেবারেই নেই? নিশ্চয় নেই অথবা থাকলেও নেত্রীকে খুশি করার জন্য সে বিষয়ের উল্লেখ করে বিপদে পড়ার কোনো ইচ্ছা মন্ত্রীর নেই। মমতা ব্যানার্জির ব্যক্তিগত ইচ্ছার বাইরে গিয়ে কোনো কথা বললে বা সিদ্ধান্ত নিলে তার কী হয় সেটা তিনি ভারতের রেলমন্ত্রী দিনেশ ত্রিবেদির ক্ষেত্রে দেখিয়ে দিয়েছেন। অবাধ্যতার কারণে তার মন্ত্রিত্ব তিনি দিলি্লতে এক টেলিফোন কল দিয়েই শেষ করেছেন।
সরকারি পাঠাগারগুলোতে সরকার সমালোচক পত্রিকাগুলো নিষিদ্ধ করায় পাঠকদের স্বাধীনতার ওপর যে হামলা করা হয় সেদিকটি বিবেচনা করেই পশ্চিমবঙ্গে এককালীন তৃণমূল সমর্থক বাম বুদ্ধিজীবীরা এখন সোচ্চার হয়ে প্রতিবাদ করছেন, সংবাদপত্রগুলোর বিক্রি সংখ্যা চার-পাঁচশ' কমে যাবে, এ জন্য নয়। কিন্তু মন্ত্রী মহোদয়ের কথা থেকে মনে হয়, পত্রিকা নিষিদ্ধ করার ক্ষেত্রে এ ছাড়া বলার আর কিছু নেই! মমতা ব্যানার্জি ও তার সরকারের অবস্থা যে কত কাহিল, তারা যে কতখানি দেউলিয়া এর থেকে সেটা বোঝার অসুবিধা আর কী আছে?
৯.৪.২০১২
No comments