অপরাধ-অরাজক খুনের হিড়িক by মোহীত উল আলম
রাজশাহীতে ডাক্তারি পাঠরত তথাকথিত ছাত্র জ্যোতির্ময় আর সাব্বির তাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু মাহাবুবকে নৃশংসভাবে খুন করার পর একটা বিষয় উদ্বেগের কারণ হয়েছে যে ব্যক্তিগত পর্যায়ে খুনের ঘটনা বেড়ে গেছে। এর মাত্র ১০ দিন আগে একই শহরে একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আমিনুল হককে নির্মমভাবে খুন করে তাঁর ব্যবসার সহযোগী এবং খানিকটা বন্ধু
সারোয়ার হোসেন। সাম্প্রতিক সময়ে ব্যক্তিগত পর্যায়ে ঘটে যাওয়া খুনের ঘটনা এ দুটি। সামনের দিনগুলোতে এ রকম খুন আরও ঘটতে পারে, সে শঙ্কা থেকে কেন এ রকম খুন বেড়ে গেল, কীভাবে তা নিবৃত্ত করা যায়, তার ওপর আলোকপাত করার জন্য বর্তমান লেখাটি।
পেশাদার খুনের সঙ্গে ব্যক্তি পর্যায়ের খুনের তফাত হলো, যে ব্যক্তি আগে খুন করেনি, সে নির্মমভাবে খুনের ঘটনা ঘটাচ্ছে। পেশাদার খুনের বেলায় একটি স্পষ্ট ষড়যন্ত্রের ছক কাজ করে। তৃতীয় পক্ষের সংযোগ থাকে। পেশাদার খুনির তালিকা কখনো কখনো থানার পুলিশের কাছেও থাকে। ব্যক্তি পর্যায়ের খুন দুভাবে হয়। বচসা থেকে ক্ষুব্ধ হয়ে একজন আরেকজনকে মেরে ফেলল, যা আচমকা এবং কিছুটা দুর্ঘটনার মতোও, এ খুনের সঙ্গে সমাজ পরিচিত। জ্যোতির্ময় ও সাব্বির বা সারোয়ার এদের খুনের পদ্ধতি ব্যক্তি পর্যায়ের হলেও আচমকা ছিল না, ছিল পরিকল্পনার ছাপ, যাকে সাধারণ ভাষায় ঠান্ডা মাথায় খুন বলা হয়।
যুুদ্ধ, দাঙ্গা বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সময় ঘটিত খুনগুলো ছাড়া ব্যক্তি পর্যায়ের খুনকে নিবৃত্ত করার জন্য কোনো সমাজ তৈরি থাকে না। অর্থাৎ খুব সুশাসিত পুলিশ-নিয়ন্ত্রিত সমাজেও বন্ধু বন্ধুকে মেরে ফেলতে পারে, স্বামী স্ত্রীকে বা স্ত্রী স্বামীকে। এ খুনগুলো না হওয়ার আগে পর্যন্ত পুলিশ জানতে পারবে না যে এগুলো হবে। যেমন—আজকের পত্রিকার (২৫ এপ্রিল) খবর অনুযায়ী, রায়েরবাজারে স্বামী শফিক স্ত্রী নাদিয়াকে মেরে ফেলল। এটা যে হবে পুলিশ আগে জানতে পারার কোনো উপায় ছিল না। তার পরও কিন্তু অপরাধ যে করবে, তার মনে আইন-পুলিশের ভয় থাকে। সে জন্য পুলিশ শক্তিশালী হলে, শক্ত আইনি ব্যবস্থা বজায় থাকলে খুন করতে মানুষ ভয় পাবে। শেকসপিয়ার তাঁর বিখ্যাত খুনি-নায়ক ম্যাকবেথের মুখ দিয়ে জানাচ্ছেন যে খুনের বিচার শুধু যে পারলৌকিক জগতে হয় তা নয়, এ জগতেও বিচার-ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে তা হয়। ফলে আইনি ব্যবস্থার শাস্তির মাধ্যমে অনেক সময় খুনিকে তার নিজের ঠোঁটে খুনের বিষ-পেয়ালা তুলে নিতে হয়। ম্যাকবেথ বলছেন, ইহলৌকিক জগতের বিচারব্যবস্থার প্রতি ভয় না থাকলে খুনের সংখ্যা এ পৃথিবীর বুকে অনেক বেড়ে যেত। রেনেসাঁ যুগের শেকসপিয়ারের অন্যতম সমসাময়িক ব্যক্তিত্ব ইংরেজ চিন্তাবিদ ফ্রান্সিস বেকন ফরাসি মনীষী মন্তেন বা মঁতের উদ্ধৃতি দিয়ে তাঁর ‘অব ট্রুথ’ রচনায় বলেছেন, অপরাধী ঈশ্বরকে ভয় না পেলেও মর্ত্যের পুলিশকে ভয় পায়। সে জন্য শক্তিশালী পুলিশ বাহিনী থাকলে অপরাধের হার কমত নিশ্চয়। তবে বাংলাদেশের পুলিশ দুর্বল—এ কথা বলে পার পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ সংসদে একজন মন্ত্রী পরিসংখ্যান দিয়ে বলেছেন যে অন্যতম শক্তিশালী পুলিশের দেশ আমেরিকায় খুনের হার বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। এটা যদি সত্যও হয়, আত্মসন্তুষ্টির কোনো কারণ হতে পারে না, যেমন—প্রতিদিন ঠকে, এ রকম একজন জুয়াড়ি যদি একদিন জুয়া না খেলে এবং মনে করে, যে টাকাটা সে সেদিন হারায়নি, সেটা তার লাভ হলো; সেটা যেমন আত্মপ্রবঞ্চনা হবে, তেমনি বাংলাদেশ যদি মনে করে, তারা আমেরিকার চেয়ে খুনের সংখ্যায় পিছিয়ে আছে, তাই তারা উন্নততর দেশ, সেটাও তেমন আত্মপ্রবঞ্চনা হবে। কারণ, যেসব কারণে খুন হয় যেমন অর্থ, যশ, পদ, প্রেম-পরকীয়া ও নিছক হিংসা—তার কোনোটার অবস্থা বাংলাদেশে আমেরিকার চেয়ে আশাব্যঞ্জক সূচকে নেই।
ধর্মে খুনের কারণে ইহলোকে ও পরকালে শাস্তির বিধান আছে। ধর্ম মানুষের বিবেককে জাগ্রত করে ও সৃষ্টিকর্তার শাস্তির কথা বলে মানুষের মনে খুন বা পাপ করার বিরুদ্ধে ভীতির সঞ্চার করে। কিন্তু খুনির মন মঁতে কথিত ওপরের উক্তি অনুযায়ী সৃষ্টিকর্তাকে যত-না ভয় পায়, তার চেয়ে বেশি ভয় পায় পুলিশকে। আবার ধর্মকে অপব্যাখ্যা করে মানুষ খুন করার ক্ষেত্রে ধর্মীয় যুক্তি ব্যবহার করে। এ ধরনের খুনিরা নিজেদের আজরাইলের ভূমিকায় অবতীর্ণ করায়। অনেক সময় স্বপ্নে দেখা পীরের আজ্ঞায় মাতা তার শিশুসন্তানকে হত্যা করছে, এমনও ঘটতে দেখি সমাজে। এটিও ধর্মীয় অপব্যাখ্যা এবং কুসংস্কারজাত হত্যাকাণ্ড।
একেকটা খুন একেকটা ঐকিক ঘটনা বা তুলনারহিত ঘটনা। যেমন—যে টাকার দেনার চাপে জ্যোতি ও সাব্বির খুন করল মাহাবুবকে, তার চেয়ে বহু বড় অঙ্কের টাকার বিসংবাদেও একজন আরেকজনকে খুন করে না। তাই একটা খুন হওয়া পরিস্থিতির সঙ্গে আরেকটা খুন না হওয়া পরিস্থিতির তুলনা চলে না। বড় কারণে যেমন, তেমনি সামান্য কারণেও হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হতে পারে।
মনে হয়, মানুষের অন্য সব প্রবৃত্তির মতো খুন করার প্রবৃত্তিও জিনগত। অর্থাৎ কোষ গঠনের কোনো বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে মানুষ খুনি প্রবৃত্তিসম্পন্ন হতে পারে। যেমন—আমিনুলের হত্যাকারী সারোয়ার খুন করতে পারে, সে রকম লোক নাকি ছিল না। কিন্তু সে তো খুন করল। খুনের প্রবৃত্তি তার হয়তো জিনগত বৈশিষ্ট্য ছিল। ছিল লুকোনো অবস্থায়। পাশ্চাত্যে হত্যাকাণ্ড নির্ণয় এবং অপরাধী শনাক্তকরণে জিনভিত্তিক অনুসন্ধান ব্যাপক কার্যকর বলে প্রমাণিত হচ্ছে। তবে এটাও বলা যায়, বাংলাদেশের পুলিশ (র্যাবসহ) বর্তমানে অপরাধী ধরার ব্যাপারে আগের চেয়ে বহুগুণ পারদর্শী হয়েছে। খুন করার পর খুনি ধরা পড়ছে না, এ রকম ঘটনা এখন অনেক কমে গেছে। জ্যোতি ধরা পড়লেও সাব্বির এখনো ধরা পড়েনি, কিন্তু পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে যে কিছুদিনের মধ্যে সেও ধরা পড়বে।
যা হোক, মাহাবুবকে খুন করা হয়েছে অর্থের লেনদেনের স্বার্থ থেকে। এ জন্য খুনের পেছনে অন্যতম কারণ বৈষয়িক, যেটা সমাজে আইনশৃঙ্খলার ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে। অর্থাৎ, প্রেম-পরকীয়াজনিত হত্যাকাণ্ডের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখা কঠিন হলেও বৈষয়িক জটিলতা থেকে সৃষ্ট হত্যাকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করা একেবারে অসম্ভব নয়। কারণ, অর্থনৈতিক লেনদেনের ক্রিয়া-প্রক্রিয়া থেকে সৃষ্ট হত্যাকাণ্ড প্রায়ই বেআইনি বা অবৈধ অর্থনৈতিক কর্মপদ্ধতির কার্যকারণ থেকে সৃষ্ট হয়ে থাকে, যার ওপর সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ের নিয়ন্ত্রণ থাকার কথা, কিন্তু যা আসলে থাকে না। জিনিসটা এ রকম: পুরো দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সংস্থাগুলোর কার্যকলাপ, অর্থ বিনিয়োগ পদ্ধতি, কর্মপরিচালনা, কর প্রদান ও গ্রহণ, ঋণ প্রদান ও গ্রহণ ইত্যাদি কাজে এত বেশি অনিয়ন্ত্রিত বেআইনি সূত্র কাজ করছে যে তারই একটি উদাহরণ হিসেবে জ্যোতির কঙ্কাল ব্যবসাকে দেখা যায় এবং সেখানে মাহাবুবের খুনটা এসেছে কার্যকারণের সূত্রে অনিবার্য পরিণতি হিসেবে মাত্র। অর্থাৎ অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলার সবগুলো সম্পর্কের পরিণতি হয়তো খুন হিসেবে আসছে না, কিন্তু খুন হওয়ার মতো আলামত তৈরি হচ্ছে। তারই একটা পরিণতি রাজশাহী মেডিকেল কলেজের হত্যাকাণ্ডটি।
খুন সম্পর্কে শেষ কথাটি হলো, খুন একটি অপরাধ হলেও এর মধ্যে অপরাধীর সক্রিয় সৃজনশীলতা থাকে, যদিও ইতর অর্থে। খুনিকে নৃশংস বলা যাবে, কিন্তু বোকা বলা যাবে না। সে জন্য পুলিশকে খুনির ক্রিয়াশীলতার চেয়ে আরও তৎপর হতে হবে তার (খুনির) ক্রিয়াশীলতা (বা সৃজনশীলতাকে) বিনষ্ট করার জন্য। আইনশৃঙ্খলা কর্তৃপক্ষ এদিকে অর্থাৎ পুলিশের মেধাশক্তি, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব ইত্যাদি বাড়ানোর দিকে নজর দিতে পারে।
খুনের চরিত্র নির্ধারিত হয় খুনির পেশা ও অভিজ্ঞতা দ্বারা। যেমন—জ্যোতি আর সাব্বির ডাক্তারি পড়ত বলে এবং কঙ্কাল নিয়ে ব্যবসা করত বলে তারা জানত যে লাশকে নয় টুকরা না করেও শুধু সিমেন্ট দিয়ে আবৃত করলে সে লাশের পচা গন্ধ বের হবে না। খুন তাই একটি সর্বজনীন মনোবৈকল্য হলেও এটির রূপ ও ঘটনপদ্ধতি খুনির পেশা, শিক্ষা ও অভিজ্ঞতানির্ভর।
পরিশেষে কামনা করি, আর যেন আমার এ দেশে কোনো খুন না হয়।
ড. মোহীত উল আলম: অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইংরেজি বিভাগ, ইউল্যাব, ঢাকা।
mohit_13_1952@yahoo.com
পেশাদার খুনের সঙ্গে ব্যক্তি পর্যায়ের খুনের তফাত হলো, যে ব্যক্তি আগে খুন করেনি, সে নির্মমভাবে খুনের ঘটনা ঘটাচ্ছে। পেশাদার খুনের বেলায় একটি স্পষ্ট ষড়যন্ত্রের ছক কাজ করে। তৃতীয় পক্ষের সংযোগ থাকে। পেশাদার খুনির তালিকা কখনো কখনো থানার পুলিশের কাছেও থাকে। ব্যক্তি পর্যায়ের খুন দুভাবে হয়। বচসা থেকে ক্ষুব্ধ হয়ে একজন আরেকজনকে মেরে ফেলল, যা আচমকা এবং কিছুটা দুর্ঘটনার মতোও, এ খুনের সঙ্গে সমাজ পরিচিত। জ্যোতির্ময় ও সাব্বির বা সারোয়ার এদের খুনের পদ্ধতি ব্যক্তি পর্যায়ের হলেও আচমকা ছিল না, ছিল পরিকল্পনার ছাপ, যাকে সাধারণ ভাষায় ঠান্ডা মাথায় খুন বলা হয়।
যুুদ্ধ, দাঙ্গা বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সময় ঘটিত খুনগুলো ছাড়া ব্যক্তি পর্যায়ের খুনকে নিবৃত্ত করার জন্য কোনো সমাজ তৈরি থাকে না। অর্থাৎ খুব সুশাসিত পুলিশ-নিয়ন্ত্রিত সমাজেও বন্ধু বন্ধুকে মেরে ফেলতে পারে, স্বামী স্ত্রীকে বা স্ত্রী স্বামীকে। এ খুনগুলো না হওয়ার আগে পর্যন্ত পুলিশ জানতে পারবে না যে এগুলো হবে। যেমন—আজকের পত্রিকার (২৫ এপ্রিল) খবর অনুযায়ী, রায়েরবাজারে স্বামী শফিক স্ত্রী নাদিয়াকে মেরে ফেলল। এটা যে হবে পুলিশ আগে জানতে পারার কোনো উপায় ছিল না। তার পরও কিন্তু অপরাধ যে করবে, তার মনে আইন-পুলিশের ভয় থাকে। সে জন্য পুলিশ শক্তিশালী হলে, শক্ত আইনি ব্যবস্থা বজায় থাকলে খুন করতে মানুষ ভয় পাবে। শেকসপিয়ার তাঁর বিখ্যাত খুনি-নায়ক ম্যাকবেথের মুখ দিয়ে জানাচ্ছেন যে খুনের বিচার শুধু যে পারলৌকিক জগতে হয় তা নয়, এ জগতেও বিচার-ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে তা হয়। ফলে আইনি ব্যবস্থার শাস্তির মাধ্যমে অনেক সময় খুনিকে তার নিজের ঠোঁটে খুনের বিষ-পেয়ালা তুলে নিতে হয়। ম্যাকবেথ বলছেন, ইহলৌকিক জগতের বিচারব্যবস্থার প্রতি ভয় না থাকলে খুনের সংখ্যা এ পৃথিবীর বুকে অনেক বেড়ে যেত। রেনেসাঁ যুগের শেকসপিয়ারের অন্যতম সমসাময়িক ব্যক্তিত্ব ইংরেজ চিন্তাবিদ ফ্রান্সিস বেকন ফরাসি মনীষী মন্তেন বা মঁতের উদ্ধৃতি দিয়ে তাঁর ‘অব ট্রুথ’ রচনায় বলেছেন, অপরাধী ঈশ্বরকে ভয় না পেলেও মর্ত্যের পুলিশকে ভয় পায়। সে জন্য শক্তিশালী পুলিশ বাহিনী থাকলে অপরাধের হার কমত নিশ্চয়। তবে বাংলাদেশের পুলিশ দুর্বল—এ কথা বলে পার পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ সংসদে একজন মন্ত্রী পরিসংখ্যান দিয়ে বলেছেন যে অন্যতম শক্তিশালী পুলিশের দেশ আমেরিকায় খুনের হার বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। এটা যদি সত্যও হয়, আত্মসন্তুষ্টির কোনো কারণ হতে পারে না, যেমন—প্রতিদিন ঠকে, এ রকম একজন জুয়াড়ি যদি একদিন জুয়া না খেলে এবং মনে করে, যে টাকাটা সে সেদিন হারায়নি, সেটা তার লাভ হলো; সেটা যেমন আত্মপ্রবঞ্চনা হবে, তেমনি বাংলাদেশ যদি মনে করে, তারা আমেরিকার চেয়ে খুনের সংখ্যায় পিছিয়ে আছে, তাই তারা উন্নততর দেশ, সেটাও তেমন আত্মপ্রবঞ্চনা হবে। কারণ, যেসব কারণে খুন হয় যেমন অর্থ, যশ, পদ, প্রেম-পরকীয়া ও নিছক হিংসা—তার কোনোটার অবস্থা বাংলাদেশে আমেরিকার চেয়ে আশাব্যঞ্জক সূচকে নেই।
ধর্মে খুনের কারণে ইহলোকে ও পরকালে শাস্তির বিধান আছে। ধর্ম মানুষের বিবেককে জাগ্রত করে ও সৃষ্টিকর্তার শাস্তির কথা বলে মানুষের মনে খুন বা পাপ করার বিরুদ্ধে ভীতির সঞ্চার করে। কিন্তু খুনির মন মঁতে কথিত ওপরের উক্তি অনুযায়ী সৃষ্টিকর্তাকে যত-না ভয় পায়, তার চেয়ে বেশি ভয় পায় পুলিশকে। আবার ধর্মকে অপব্যাখ্যা করে মানুষ খুন করার ক্ষেত্রে ধর্মীয় যুক্তি ব্যবহার করে। এ ধরনের খুনিরা নিজেদের আজরাইলের ভূমিকায় অবতীর্ণ করায়। অনেক সময় স্বপ্নে দেখা পীরের আজ্ঞায় মাতা তার শিশুসন্তানকে হত্যা করছে, এমনও ঘটতে দেখি সমাজে। এটিও ধর্মীয় অপব্যাখ্যা এবং কুসংস্কারজাত হত্যাকাণ্ড।
একেকটা খুন একেকটা ঐকিক ঘটনা বা তুলনারহিত ঘটনা। যেমন—যে টাকার দেনার চাপে জ্যোতি ও সাব্বির খুন করল মাহাবুবকে, তার চেয়ে বহু বড় অঙ্কের টাকার বিসংবাদেও একজন আরেকজনকে খুন করে না। তাই একটা খুন হওয়া পরিস্থিতির সঙ্গে আরেকটা খুন না হওয়া পরিস্থিতির তুলনা চলে না। বড় কারণে যেমন, তেমনি সামান্য কারণেও হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হতে পারে।
মনে হয়, মানুষের অন্য সব প্রবৃত্তির মতো খুন করার প্রবৃত্তিও জিনগত। অর্থাৎ কোষ গঠনের কোনো বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে মানুষ খুনি প্রবৃত্তিসম্পন্ন হতে পারে। যেমন—আমিনুলের হত্যাকারী সারোয়ার খুন করতে পারে, সে রকম লোক নাকি ছিল না। কিন্তু সে তো খুন করল। খুনের প্রবৃত্তি তার হয়তো জিনগত বৈশিষ্ট্য ছিল। ছিল লুকোনো অবস্থায়। পাশ্চাত্যে হত্যাকাণ্ড নির্ণয় এবং অপরাধী শনাক্তকরণে জিনভিত্তিক অনুসন্ধান ব্যাপক কার্যকর বলে প্রমাণিত হচ্ছে। তবে এটাও বলা যায়, বাংলাদেশের পুলিশ (র্যাবসহ) বর্তমানে অপরাধী ধরার ব্যাপারে আগের চেয়ে বহুগুণ পারদর্শী হয়েছে। খুন করার পর খুনি ধরা পড়ছে না, এ রকম ঘটনা এখন অনেক কমে গেছে। জ্যোতি ধরা পড়লেও সাব্বির এখনো ধরা পড়েনি, কিন্তু পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে যে কিছুদিনের মধ্যে সেও ধরা পড়বে।
যা হোক, মাহাবুবকে খুন করা হয়েছে অর্থের লেনদেনের স্বার্থ থেকে। এ জন্য খুনের পেছনে অন্যতম কারণ বৈষয়িক, যেটা সমাজে আইনশৃঙ্খলার ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে। অর্থাৎ, প্রেম-পরকীয়াজনিত হত্যাকাণ্ডের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখা কঠিন হলেও বৈষয়িক জটিলতা থেকে সৃষ্ট হত্যাকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করা একেবারে অসম্ভব নয়। কারণ, অর্থনৈতিক লেনদেনের ক্রিয়া-প্রক্রিয়া থেকে সৃষ্ট হত্যাকাণ্ড প্রায়ই বেআইনি বা অবৈধ অর্থনৈতিক কর্মপদ্ধতির কার্যকারণ থেকে সৃষ্ট হয়ে থাকে, যার ওপর সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ের নিয়ন্ত্রণ থাকার কথা, কিন্তু যা আসলে থাকে না। জিনিসটা এ রকম: পুরো দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সংস্থাগুলোর কার্যকলাপ, অর্থ বিনিয়োগ পদ্ধতি, কর্মপরিচালনা, কর প্রদান ও গ্রহণ, ঋণ প্রদান ও গ্রহণ ইত্যাদি কাজে এত বেশি অনিয়ন্ত্রিত বেআইনি সূত্র কাজ করছে যে তারই একটি উদাহরণ হিসেবে জ্যোতির কঙ্কাল ব্যবসাকে দেখা যায় এবং সেখানে মাহাবুবের খুনটা এসেছে কার্যকারণের সূত্রে অনিবার্য পরিণতি হিসেবে মাত্র। অর্থাৎ অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলার সবগুলো সম্পর্কের পরিণতি হয়তো খুন হিসেবে আসছে না, কিন্তু খুন হওয়ার মতো আলামত তৈরি হচ্ছে। তারই একটা পরিণতি রাজশাহী মেডিকেল কলেজের হত্যাকাণ্ডটি।
খুন সম্পর্কে শেষ কথাটি হলো, খুন একটি অপরাধ হলেও এর মধ্যে অপরাধীর সক্রিয় সৃজনশীলতা থাকে, যদিও ইতর অর্থে। খুনিকে নৃশংস বলা যাবে, কিন্তু বোকা বলা যাবে না। সে জন্য পুলিশকে খুনির ক্রিয়াশীলতার চেয়ে আরও তৎপর হতে হবে তার (খুনির) ক্রিয়াশীলতা (বা সৃজনশীলতাকে) বিনষ্ট করার জন্য। আইনশৃঙ্খলা কর্তৃপক্ষ এদিকে অর্থাৎ পুলিশের মেধাশক্তি, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব ইত্যাদি বাড়ানোর দিকে নজর দিতে পারে।
খুনের চরিত্র নির্ধারিত হয় খুনির পেশা ও অভিজ্ঞতা দ্বারা। যেমন—জ্যোতি আর সাব্বির ডাক্তারি পড়ত বলে এবং কঙ্কাল নিয়ে ব্যবসা করত বলে তারা জানত যে লাশকে নয় টুকরা না করেও শুধু সিমেন্ট দিয়ে আবৃত করলে সে লাশের পচা গন্ধ বের হবে না। খুন তাই একটি সর্বজনীন মনোবৈকল্য হলেও এটির রূপ ও ঘটনপদ্ধতি খুনির পেশা, শিক্ষা ও অভিজ্ঞতানির্ভর।
পরিশেষে কামনা করি, আর যেন আমার এ দেশে কোনো খুন না হয়।
ড. মোহীত উল আলম: অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইংরেজি বিভাগ, ইউল্যাব, ঢাকা।
mohit_13_1952@yahoo.com
No comments