পাকিস্তান-শাসকগোষ্ঠীর গণবিরোধী কর্মকাণ্ড by আই এ রেহমান
গরিব ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের বিরুদ্ধে শাসকগোষ্ঠী যে এককাট্টা, তা খুব ভালোভাবেই ধরা পড়ে এসব মানুষের প্রতিবাদ ও দাবির বিরুদ্ধে তাদের হিসাবি ঔদাসীন্য থেকে। অন্যদিকে সমাজের অবস্থাপন্ন ব্যক্তিদের খুশি রাখতে বড় মূল্য দিতেও সদা প্রস্তুত কর্তাব্যক্তিরা।
কায়েমি স্বার্থবাদীদের আশ্বস্ত রাখতে সরকারের উৎকণ্ঠা আসলে সুবিধাভোগী ব্যক্তিদের চাপের কাছে নতি স্বীকার করে পিছিয়ে আসার ঐতিহ্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। কায়েমি স্বার্থ এখন ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ঠেকাতে সচেষ্ট, অথচ এই বিকেন্দ্রীকরণের ওপরই নির্ভর করছে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ। একইভাবে ক্ষমতাবানদের কাছে নতি স্বীকারের ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত হলো সুবিধাবঞ্চিত মানুষের অনুনয়-বিনয়ের প্রতি অবজ্ঞা, এমনকি মিথস্ক্রিয়ার সুযোগ থেকেও তাদের বঞ্চিত করা। কয়েকটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে।
সংবিধানের ১৮তম সংশোধনী গ্রহণের আগেও শ্রমিক প্রতিনিধিরা সরকারের প্রতি শিল্প-সম্পর্ক ও ট্রেড ইউনিয়নবিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ এই আইন প্রণয়নের কাজটি ত্বরান্বিত করতে আহ্বান জানিয়েছিলেন। কেননা ২০০৮ সালের স্টপ-গ্যাপ আইনের মেয়াদ শেষ হতে যাচ্ছিল ২০১০ সালের এপ্রিল মাসে। এ দাবি কোনো পাত্তা পায়নি। এর একটা কারণ হয়তো ১৮তম সংশোধনী দেখিয়ে শ্রমের বিষয়টি প্রদেশগুলোর হাতে দিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত। সেই পরিবর্তন ঘটানোর ফলে যেসব সমস্যা তৈরি হলো, তা দূর করার দাবি এক বছরের অধিক কাল ধরে করে আসছিল পাকিস্তানের প্রধান প্রধান ট্রেড ইউনিয়ন। এমনকি তারা বিষয়টি সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিল।
প্রদেশের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরকে শ্রমিকেরা চ্যালেঞ্জ করেননি—বিকেন্দ্রীকরণের প্রক্রিয়াকে তাঁরা আসলেই সমর্থন করেন। তাঁরা শুধু আশ্বস্ত হতে চেয়েছিলেন যে জাতীয় পর্যায়ের ট্রেড ইউনিয়নগুলোকে আইনের অধীনে কীভাবে সুরক্ষা দেওয়া হবে, ন্যাশনাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিলেশনস কমিশনের কাজ কে চালাবে, আইএলও কনভেনশনের বাস্তবায়ন কে তদারক করবে, আর কীভাবে ছোট ছোট প্রদেশ সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ তহবিল থেকে ন্যায্য হিস্যা পাবে। অন্যদিকে নিজেদের অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা সংকোচনের ব্যাপারে শ্রমিকদের উদ্বেগ আরও বেড়েছে পাঞ্জাব সরকার কর্তৃক নতুন প্রাদেশিক আইনের অধীনে তাঁদের অধিকার কমিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্তে।
২৬৭ নম্বর বিধির আওতায় ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত পার্লামেন্টের ক্ষমতা ছিল একটি প্রস্তাবনার মাধ্যমে এসব বিষয়ের মীমাংসায় পৌঁছানো। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে গুরুত্ব কিংবা দেশের শ্রমিকদের প্রতি কতটা সজাগ ছিল, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। খুব সম্ভব কর্তৃপক্ষ উদ্বিগ্ন নয়। কেননা তারা মনে করে, শ্রমজীবী লোকজন সরকারের পতন ঘটাতে পারবে না। তাদের শ্রমিকবিরোধী অবস্থান স্পষ্ট।
পাঞ্জাবে তরুণ চিকিৎসকদের ধর্মঘটের কথাই ধরুন। শিশুসহ বহু রোগী চিকিৎসার অভাবে মারা যাওয়ার খবর প্রকাশিত হয়েছে। ঠিক কতজন মারা গেছে, সেই সংখ্যা বের করা সহজ নয়। গণমাধ্যমে যে সংখ্যার কথা বলা হয়েছে, সেখানে শুধু তাদেরই জায়গা হয়েছে, যারা হাসপাতালের রেকর্ড বইয়ে স্থান পেয়েছে। ধরে নেওয়া যায়, চিকিৎসকদের কর্মবিরতির খবর জানা থাকায় আরও অনেককে হাসপাতালে নিয়েই যাওয়া হয়নি।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, অসুস্থ মানুষের অবস্থা পাঞ্জাবের প্রাদেশিক সরকারকে একটুও আলোড়িত করেনি। আর তাই মীমাংসায় পৌঁছাতে এক মাসেরও বেশি সময় লেগেছে। তার আগে জনতার বিক্ষোভ দমনে ঔপনিবেশিক স্বৈরতান্ত্রিক তরিকার সব কৌশল বাজিয়ে দেখা হয়েছে, বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করা ও গ্রেপ্তার, আবশ্যকীয় সেবাসংক্রান্ত আইন, প্রতিবাদকারী নেতাদের চাকরিচ্যুতি, তাঁদের স্থলে অন্যদের নিয়োগ ইত্যাদি কৌশল কাজে লাগানো হয়েছে। এমন তো হতেই পারে যে চিকিৎসকদের দাবির পুরোটা ঠিক ছিল না, কিন্তু তাঁদের সঙ্গে আলোচনায় না গিয়ে এবং জনগণের কাছে বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ হয়ে সরকার তো সেই যুক্তি ব্যবহারের ন্যায্যতাও হারিয়েছে।
একপর্যায়ে বলা হয়েছিল, মুখ্যমন্ত্রী দেশের বাইরে থাকায় বিষয়টি মীমাংসা করা সম্ভব হবে না। যুক্তিসংগত কারণে প্রাদেশিক প্রধান নির্বাহীর সংক্ষিপ্ত বিদেশ সফরকে যুক্তি হিসেবে উপস্থাপিত করায় দুটি প্রশ্ন জাগে। প্রথমত, পাঞ্জাব তো কেবল একজনের দ্বারা শাসিত হওয়ার কথা নয়। যে ব্যবস্থা থাকার কথা, সেটার কী হলো? দ্বিতীয়ত, মুখ্যমন্ত্রী যেখানেই গিয়ে থাকুন না কেন, তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হবে না কেন, তাঁকে তো সব বিষয়ের খুঁটিনাটিও জানানোর কথা। কাউকে এ কথা গেলানো যাবে না যে মুখ্যমন্ত্রী দেশের বাইরে গেলে তাঁর জনগণের কোনো গুরুতর সমস্যার কথা তাঁকে জানিয়ে বিরক্ত করা যাবে না।
দুঃখজনক ব্যাপার হলো, চিকিৎসকের অভাবে জনগণকে যে কষ্ট করতে হলো, তা তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধি কিংবা সুশীল সমাজের সমর্থক কারোরই মনোযোগ কাড়তে পারল না। এর ব্যাখ্যা এভাবেই করা যায় যে অভিজাত ব্যক্তি ও তাঁদের পরগাছাদের গায়ে আঁচড় কাটতে পারেনি এই ধর্মঘট। কেননা তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা বেসরকারি ক্লিনিক স্বাভাবিকভাবেই চলছে। চিকিৎসকদের বিক্ষোভে ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন মূলত গরিব ও সুবিধাবঞ্চিত জনগণ, যাদের হাসপাতালে যাওয়ার সামর্থ্যই শুধু আছে।
অন্যদিকে খানেওয়াল জেলার একদল ভাগচাষি তাঁদের দাবিদাওয়া জানাতে লাহোরে যাওয়ার পথে তাঁদের আটকাতে বলপ্রয়োগ করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এর পরপরই সামরিক খামারে কাজ করা চাষিরা (ওকারা-রেনালা খুর্দ অঞ্চলের) তিন কৃষককর্মীর মৃত্যুবার্ষিকী পালন করেন এবং বিশাল জমায়েতের আয়োজন করেন। ওকারা ও খানেওয়ালের চাষিরা এক দশকের বেশি সময় অপেক্ষা করে আছেন। ভাগচাষিদের প্রতি শ্রদ্ধার ঘাটতি এবং দুই থেকে তিন প্রজন্ম ধরে যে জমিতে ভাগচাষিরা চাষ করে যাচ্ছেন, সেটির মালিকানা পাওয়ায় তাঁদের ন্যায্য চাওয়ার ব্যাপারে সরকার নিস্পৃহ থেকেছে। ভাগচাষিদের দাবির বিরোধিতা করতে যে যুক্তিরই অবতারণা করা হোক না কেন, সমতা ও প্রাকৃতিক ন্যায়ের নীতি তাঁদের দাবির পক্ষে যায়। কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকার ভাগচাষিদের প্রাপ্য অধিকার দিতে দেরি করার কোনো যুক্তিসংগত কারণ নেই।
গত কয়েক সপ্তাহে রাষ্ট্রযন্ত্রের সন্ত্রাস বা উদাসীনতার বলি হয়েছেন যাঁরা, তাঁদের মধ্যে আছেন কেরানি (দীর্ঘদিন ধরে তাঁরা বিক্ষোভ করছেন), স্কুলশিক্ষক ও নারী স্বাস্থ্যকর্মী; পর্যাপ্ত ত্রাণ না পাওয়ার প্রতিবাদ জানাচ্ছে বন্যা-আক্রান্ত মানুষও।
ভিন্নমতের প্রতি সহিষ্ণুতা দেখানোর ক্ষেত্রে কিছু অগ্রগতি ঘটেছে, সে কথা অস্বীকার করা যায় না। তবে যা সুবিধাবঞ্চিত মানুষের অধিকার হিসেবে গৃহীত হওয়ার দাবি রাখে, সে ব্যাপারে এখনো কিছুই শোনা যাচ্ছে না। ফলে সরকারি অবহেলার শিকার মানুষের মধ্যে নৈরাশ্যের বোধ ক্রমেই তাদের রাষ্ট্র থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে, আর যারা বিদ্যমান ব্যবস্থায় সুবিধা পাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে, তাদের প্রতি ঘৃণা জন্ম নিচ্ছে। এই ভয়াবহ প্রবণতার পরিণাম কী হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়।
রাষ্ট্রের এমন এক কনভেনশন গ্রহণ করা আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা রাষ্ট্রকে বাধ্য করবে বিক্ষুব্ধ জনগণের কথা শুনতে এবং যত শিগগিরই সম্ভব তাদের সঙ্গে বন্ধুসুলভ আলোচনায় যেতে। প্রশাসন কিংবা আদালত কর্তৃক শ্রমিক, কৃষক, নিম্ন মজুরির চাকুরে, পেশাজীবী, নারী ও সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর সদস্য—সবার প্রতি সবচেয়ে সুবিধাভোগী নাগরিকদের মতোই আচরণ না করলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে না। তাই গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের স্বার্থে এটা নিশ্চিত করাও জরুরি।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
আই এ রেহমান: পাকিস্তানি কলাম লেখক ও মানবাধিকারকর্মী।
সংবিধানের ১৮তম সংশোধনী গ্রহণের আগেও শ্রমিক প্রতিনিধিরা সরকারের প্রতি শিল্প-সম্পর্ক ও ট্রেড ইউনিয়নবিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ এই আইন প্রণয়নের কাজটি ত্বরান্বিত করতে আহ্বান জানিয়েছিলেন। কেননা ২০০৮ সালের স্টপ-গ্যাপ আইনের মেয়াদ শেষ হতে যাচ্ছিল ২০১০ সালের এপ্রিল মাসে। এ দাবি কোনো পাত্তা পায়নি। এর একটা কারণ হয়তো ১৮তম সংশোধনী দেখিয়ে শ্রমের বিষয়টি প্রদেশগুলোর হাতে দিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত। সেই পরিবর্তন ঘটানোর ফলে যেসব সমস্যা তৈরি হলো, তা দূর করার দাবি এক বছরের অধিক কাল ধরে করে আসছিল পাকিস্তানের প্রধান প্রধান ট্রেড ইউনিয়ন। এমনকি তারা বিষয়টি সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিল।
প্রদেশের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরকে শ্রমিকেরা চ্যালেঞ্জ করেননি—বিকেন্দ্রীকরণের প্রক্রিয়াকে তাঁরা আসলেই সমর্থন করেন। তাঁরা শুধু আশ্বস্ত হতে চেয়েছিলেন যে জাতীয় পর্যায়ের ট্রেড ইউনিয়নগুলোকে আইনের অধীনে কীভাবে সুরক্ষা দেওয়া হবে, ন্যাশনাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিলেশনস কমিশনের কাজ কে চালাবে, আইএলও কনভেনশনের বাস্তবায়ন কে তদারক করবে, আর কীভাবে ছোট ছোট প্রদেশ সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ তহবিল থেকে ন্যায্য হিস্যা পাবে। অন্যদিকে নিজেদের অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা সংকোচনের ব্যাপারে শ্রমিকদের উদ্বেগ আরও বেড়েছে পাঞ্জাব সরকার কর্তৃক নতুন প্রাদেশিক আইনের অধীনে তাঁদের অধিকার কমিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্তে।
২৬৭ নম্বর বিধির আওতায় ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত পার্লামেন্টের ক্ষমতা ছিল একটি প্রস্তাবনার মাধ্যমে এসব বিষয়ের মীমাংসায় পৌঁছানো। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে গুরুত্ব কিংবা দেশের শ্রমিকদের প্রতি কতটা সজাগ ছিল, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। খুব সম্ভব কর্তৃপক্ষ উদ্বিগ্ন নয়। কেননা তারা মনে করে, শ্রমজীবী লোকজন সরকারের পতন ঘটাতে পারবে না। তাদের শ্রমিকবিরোধী অবস্থান স্পষ্ট।
পাঞ্জাবে তরুণ চিকিৎসকদের ধর্মঘটের কথাই ধরুন। শিশুসহ বহু রোগী চিকিৎসার অভাবে মারা যাওয়ার খবর প্রকাশিত হয়েছে। ঠিক কতজন মারা গেছে, সেই সংখ্যা বের করা সহজ নয়। গণমাধ্যমে যে সংখ্যার কথা বলা হয়েছে, সেখানে শুধু তাদেরই জায়গা হয়েছে, যারা হাসপাতালের রেকর্ড বইয়ে স্থান পেয়েছে। ধরে নেওয়া যায়, চিকিৎসকদের কর্মবিরতির খবর জানা থাকায় আরও অনেককে হাসপাতালে নিয়েই যাওয়া হয়নি।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, অসুস্থ মানুষের অবস্থা পাঞ্জাবের প্রাদেশিক সরকারকে একটুও আলোড়িত করেনি। আর তাই মীমাংসায় পৌঁছাতে এক মাসেরও বেশি সময় লেগেছে। তার আগে জনতার বিক্ষোভ দমনে ঔপনিবেশিক স্বৈরতান্ত্রিক তরিকার সব কৌশল বাজিয়ে দেখা হয়েছে, বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করা ও গ্রেপ্তার, আবশ্যকীয় সেবাসংক্রান্ত আইন, প্রতিবাদকারী নেতাদের চাকরিচ্যুতি, তাঁদের স্থলে অন্যদের নিয়োগ ইত্যাদি কৌশল কাজে লাগানো হয়েছে। এমন তো হতেই পারে যে চিকিৎসকদের দাবির পুরোটা ঠিক ছিল না, কিন্তু তাঁদের সঙ্গে আলোচনায় না গিয়ে এবং জনগণের কাছে বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ হয়ে সরকার তো সেই যুক্তি ব্যবহারের ন্যায্যতাও হারিয়েছে।
একপর্যায়ে বলা হয়েছিল, মুখ্যমন্ত্রী দেশের বাইরে থাকায় বিষয়টি মীমাংসা করা সম্ভব হবে না। যুক্তিসংগত কারণে প্রাদেশিক প্রধান নির্বাহীর সংক্ষিপ্ত বিদেশ সফরকে যুক্তি হিসেবে উপস্থাপিত করায় দুটি প্রশ্ন জাগে। প্রথমত, পাঞ্জাব তো কেবল একজনের দ্বারা শাসিত হওয়ার কথা নয়। যে ব্যবস্থা থাকার কথা, সেটার কী হলো? দ্বিতীয়ত, মুখ্যমন্ত্রী যেখানেই গিয়ে থাকুন না কেন, তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হবে না কেন, তাঁকে তো সব বিষয়ের খুঁটিনাটিও জানানোর কথা। কাউকে এ কথা গেলানো যাবে না যে মুখ্যমন্ত্রী দেশের বাইরে গেলে তাঁর জনগণের কোনো গুরুতর সমস্যার কথা তাঁকে জানিয়ে বিরক্ত করা যাবে না।
দুঃখজনক ব্যাপার হলো, চিকিৎসকের অভাবে জনগণকে যে কষ্ট করতে হলো, তা তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধি কিংবা সুশীল সমাজের সমর্থক কারোরই মনোযোগ কাড়তে পারল না। এর ব্যাখ্যা এভাবেই করা যায় যে অভিজাত ব্যক্তি ও তাঁদের পরগাছাদের গায়ে আঁচড় কাটতে পারেনি এই ধর্মঘট। কেননা তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা বেসরকারি ক্লিনিক স্বাভাবিকভাবেই চলছে। চিকিৎসকদের বিক্ষোভে ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন মূলত গরিব ও সুবিধাবঞ্চিত জনগণ, যাদের হাসপাতালে যাওয়ার সামর্থ্যই শুধু আছে।
অন্যদিকে খানেওয়াল জেলার একদল ভাগচাষি তাঁদের দাবিদাওয়া জানাতে লাহোরে যাওয়ার পথে তাঁদের আটকাতে বলপ্রয়োগ করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এর পরপরই সামরিক খামারে কাজ করা চাষিরা (ওকারা-রেনালা খুর্দ অঞ্চলের) তিন কৃষককর্মীর মৃত্যুবার্ষিকী পালন করেন এবং বিশাল জমায়েতের আয়োজন করেন। ওকারা ও খানেওয়ালের চাষিরা এক দশকের বেশি সময় অপেক্ষা করে আছেন। ভাগচাষিদের প্রতি শ্রদ্ধার ঘাটতি এবং দুই থেকে তিন প্রজন্ম ধরে যে জমিতে ভাগচাষিরা চাষ করে যাচ্ছেন, সেটির মালিকানা পাওয়ায় তাঁদের ন্যায্য চাওয়ার ব্যাপারে সরকার নিস্পৃহ থেকেছে। ভাগচাষিদের দাবির বিরোধিতা করতে যে যুক্তিরই অবতারণা করা হোক না কেন, সমতা ও প্রাকৃতিক ন্যায়ের নীতি তাঁদের দাবির পক্ষে যায়। কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকার ভাগচাষিদের প্রাপ্য অধিকার দিতে দেরি করার কোনো যুক্তিসংগত কারণ নেই।
গত কয়েক সপ্তাহে রাষ্ট্রযন্ত্রের সন্ত্রাস বা উদাসীনতার বলি হয়েছেন যাঁরা, তাঁদের মধ্যে আছেন কেরানি (দীর্ঘদিন ধরে তাঁরা বিক্ষোভ করছেন), স্কুলশিক্ষক ও নারী স্বাস্থ্যকর্মী; পর্যাপ্ত ত্রাণ না পাওয়ার প্রতিবাদ জানাচ্ছে বন্যা-আক্রান্ত মানুষও।
ভিন্নমতের প্রতি সহিষ্ণুতা দেখানোর ক্ষেত্রে কিছু অগ্রগতি ঘটেছে, সে কথা অস্বীকার করা যায় না। তবে যা সুবিধাবঞ্চিত মানুষের অধিকার হিসেবে গৃহীত হওয়ার দাবি রাখে, সে ব্যাপারে এখনো কিছুই শোনা যাচ্ছে না। ফলে সরকারি অবহেলার শিকার মানুষের মধ্যে নৈরাশ্যের বোধ ক্রমেই তাদের রাষ্ট্র থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে, আর যারা বিদ্যমান ব্যবস্থায় সুবিধা পাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে, তাদের প্রতি ঘৃণা জন্ম নিচ্ছে। এই ভয়াবহ প্রবণতার পরিণাম কী হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়।
রাষ্ট্রের এমন এক কনভেনশন গ্রহণ করা আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা রাষ্ট্রকে বাধ্য করবে বিক্ষুব্ধ জনগণের কথা শুনতে এবং যত শিগগিরই সম্ভব তাদের সঙ্গে বন্ধুসুলভ আলোচনায় যেতে। প্রশাসন কিংবা আদালত কর্তৃক শ্রমিক, কৃষক, নিম্ন মজুরির চাকুরে, পেশাজীবী, নারী ও সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর সদস্য—সবার প্রতি সবচেয়ে সুবিধাভোগী নাগরিকদের মতোই আচরণ না করলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে না। তাই গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের স্বার্থে এটা নিশ্চিত করাও জরুরি।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
আই এ রেহমান: পাকিস্তানি কলাম লেখক ও মানবাধিকারকর্মী।
No comments