জনপ্রশাসন-সিভিল সার্ভিস আইনের খসড়া নিয়ে কিছু কথা by আলী ইমাম মজুমদার

বাংলাদেশ সংবিধানের ১৩৩ অনুচ্ছেদে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের নিয়োগ, কর্মসম্পাদন ও আনুষঙ্গিক বিষয়ে আইন প্রণয়নের তাগিদ রয়েছে। আর সে আইন না হওয়া পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রণীত বিধি অনুসারে এসব বিষয় পরিচালিত হওয়ার বিধান সংবিধানের সে অনুচ্ছেদেই উল্লিখিত আছে।


খণ্ডিত পরিসরের কয়েকটি আইন/অধ্যাদেশ (যেমন—১৯৭৪ সালের গণকর্মচারী অবসর আইন) ব্যতিরেকে এখন পর্যন্ত সিভিল সার্ভিস পরিচালনার প্রায় সব মৌলিক বিষয়ই বিধি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। তাই এসব বিষয় পরিচালনার জন্য একটি আইন প্রণয়নের উদ্যোগ প্রশংসার দাবি রাখে। দক্ষ ও যুগোপযোগী বিশ্বমানের জনপ্রশাসন গঠন, ক্ষমতার অপপ্রয়োগ রোধ, সরকারি কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা, কর্মকর্তাদের চাকরির আইনসম্মত নিরাপত্তা বিধান ইত্যাদি বিষয় এই আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্য বলে খসড়ার প্রস্তাবনায় উল্লেখ রয়েছে। এ উদ্দেশ্য নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়।
এখন দেখা যাক খসড়ায় উল্লিখিত বিধানগুলো এ লক্ষ্য অর্জনে কতটা সহায়ক হবে। খসড়ার ১৫ (২) ধারায় পদোন্নতির জন্য নির্ধারিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার আবশ্যকতা এবং সেই পরীক্ষা সরকারি কর্মকমিশন কর্তৃক পরিচালনার বিধান রয়েছে।
আবার এতে আউটসোর্সিংয়েরও ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। আউটসোর্সিং ব্যবস্থার গ্রহণযোগ্যতা সরকারি কর্মকমিশনের মানের হবে না, বরং হবে প্রশ্নবিদ্ধ। তাই এ বিকল্প পরিহার যথোচিত হবে। আইনের খসড়ার ৫(৪) ধারায় সুপিরিয়র স্তরের প্রথম ও দ্বিতীয় গ্রেডে পুরো চাকরিজীবনের কর্মদক্ষতা যাচাইয়ের ভিত্তিতে ‘নির্ধারিত’ পদ্ধতিতে পদোন্নতির মাধ্যমে প্রদানের বিধান করা হয়েছে। এ ‘নির্ধারিত’-এর সংজ্ঞা বিধি দ্বারা নির্ধারিত (খসড়ার ৩ (ঝ) ধারা। তাহলে মনে হয় প্রথম ও দ্বিতীয় গ্রেডে (সুপিরিয়র স্তর) পদোন্নতিতে সরকারি কর্মকমিশনের কোনো ভূমিকা বা কোনো পরীক্ষা থাকছে না। অবশ্য এখন পর্যন্ত সিনিয়র স্কেলে পদোন্নতির একটি পরীক্ষা ব্যতীত আর কোনো স্তরেই পরীক্ষার আবশ্যকতা ও সরকারি কর্মকমিশনের ভূমিকা নেই। খসড়া আইনটিকে অন্তত তৃতীয় গ্রেড পর্যন্ত পদোন্নতির জন্য প্রতি স্তরে সরকারি কর্মকমিশনের মাধ্যমে পরীক্ষার বিধান রাখা হয়েছে। এই স্তর পর্যন্ত কারও অনুরাগ বা বিরাগের ফলে উত্থান-পতনের ঝুঁকি হ্রাস পাবে। তবে আমরা আশা করব, নিকট অতীতের মতো সরকারি কর্মকমিশন আবার নিজেদেরই প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলবে না। প্রথম ও দ্বিতীয় গ্রেডে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ ১০ শতাংশে সীমিত করা হয়েছে। কারিগরি ও বিশেষায়িত পদে এর নিচের গ্রেডগুলোতেও চুক্তিভিত্তিতে নিয়োগ একই অনুপাতে সীমিত করা হয়েছে। এগুলো ইতিবাচক, এটা অনস্বীকার্য।
অবসর গ্রহণের বয়সসীমা ৫৮-তে উন্নীত করার প্রস্তাব রয়েছে। একজন অভিজ্ঞ ও সক্ষম লোককে ‘বার্ধক্যজনিত(?) কারণে’ ৫৭ বছরে অবসর প্রদান অবৈজ্ঞানিক ও দেশের অন্য বেশ কিছু চাকরির সঙ্গে বৈষম্যমূলক। ব্যবস্থাটি জনস্বার্থের প্রতিকূলও বটে। প্রতিবেশী দেশগুলোর দৃষ্টান্ত অনুসরণে এ বয়সসীমা ন্যূনপক্ষে ৬০ বছর হওয়া উচিত। সিভিল সার্ভিসে শীর্ষ পর্যায়ের পদগুলোতে উন্নীত হতে দীর্ঘ সময় আবশ্যক হয়।
তখনই থাকে দোরগোড়ায় অবসরের হাতছানি। অথচ তাদের অর্জিত অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা কাজে লাগানোর মোক্ষম সময়ে অবসর না দিয়ে সুপিরিয়র স্তরে উন্নীত ব্যক্তিদের এ বয়সসীমা আরও দুই বছর বৃদ্ধি করাও যৌক্তিক হবে। সে ক্ষেত্রে এ দুটি গ্রেডে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ অনধিক ৫ শতাংশে সীমিত করা যায়। সরকার কর্তৃক কোনো বিভাগীয় মামলা ছাড়া ২৫ বছর চাকরির পর যে কাউকে বাধ্যতামূলক অবসর প্রদানের বিধানটি অকার্যকর করে দেওয়ার প্রস্তাব যৌক্তিক ও কর্মকর্তাদের মনোবল বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। দায়িত্ব পালনজনিত কোনো ঘটনার জন্য ফৌজদারি মামলা দায়ের করতে সরকারের পূর্বানুমতি নেওয়ার বিধানও যথার্থ।
আইনটির প্রস্তাবনায় প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তাদের চাকরির আইনসম্মত নিরাপত্তার বিধান অন্যতম উদ্দেশ্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এর প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। কর্মকর্তারা আরোপিত দায়িত্ব পালনে ক্ষমতাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের (রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক সব সময়ে) অযাচিত হস্তক্ষেপে সুশাসন ব্যাহত হয়। অনেক ক্ষেত্রে কর্মকর্তারা শঙ্কা ও ভীতির কারণে সিদ্ধান্ত নিতে অক্ষম হন অথবা ন্যায়নীতি পরিপন্থী সিদ্ধান্ত নেন। ফলে জনপ্রশাসনের কার্যকারিতাই দিন দিন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ছে। একটি নিরপেক্ষ, প্রভাবমুক্ত ও দক্ষ জনপ্রশাসনের অনুপস্থিতিই অনেকটা ডেকে এনেছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা—এটা বললে অত্যুক্তিও হবে না।
সরকারের এ গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানটির অক্ষমতা বা যথার্থ আচরণের অসামর্থ্য সরকারকেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে। সরকারে যাঁরা থাকেন তাঁদের অনেকেই ক্ষুদ্র সাময়িক স্বার্থের কারণে এ সত্যটা উপলব্ধি করতে চাইছেন না। ফলে জনপ্রশাসন উত্তরোত্তর প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলেছে। অথচ প্রভাবমুক্ত ও শঙ্কাহীন পরিবেশে এ কর্মকর্তারাই দেশকে উপহার দিয়েছেন পর পর কয়েকটি গ্রহণযোগ্য জাতীয় সংসদ নির্বাচন।
দেখা যায়, প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তাদের দায়িত্ব সম্পাদনের আইনসম্মত নিরাপত্তা বিধানের কিছু প্রয়াস খসড়াটিতে থাকলেও অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কয়েকটি বিষয় উপেক্ষিত হয়েছে। দায়িত্ব সম্পাদনে চাপ মোকাবিলায় কর্মকর্তারা বদলি, ওএসডি কিংবা প্রত্যাহার করে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করার আতঙ্কে ভোগেন। এ আতঙ্ক যে অমূলক নয়, তা বারবার প্রমাণিত হচ্ছে। আইনটিতে এর প্রতিকারের কোনো উদ্যোগই না থাকায় এর উদ্দেশ্য সাধনের সাফল্য প্রশ্নবিদ্ধ। এর প্রতিকার না করতে পারলে আইনানুগ কর্তব্য সম্পাদনে নিরাপত্তা বিধান কীভাবে করা যাবে? কিছু স্পর্শকাতর পদ থেকে অকালীন বদলির প্রস্তাব স্তরভেদে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বা সংস্থাপনসচিব কিংবা একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে গঠিত কমিটিতে বিবেচিত হওয়ার একটি বিধান কিছুটা হলেও স্বস্তি আনতে পারে। আর গুরুতর কোনো অভিযোগ তদন্তাধীন থাকা, বিদেশে প্রশিক্ষণ ও পদোন্নতির পর পদায়নের জন্য অপেক্ষমাণ কর্মকর্তা ছাড়া আর কাউকে ওএসডি বা সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত না করার বিধান সংযোজন আইনটি উদ্দেশ্য সাধনে অন্যতম সহায়ক হবে। এগুলো করা না হলে কর্মকর্তাদের আইনসম্মত দায়িত্ব পালনে নিরাপত্তা বিধানের উদ্দেশ্য কতটা সফল হবে, তা সহজেই অনুমেয়।
বিগত কয়েক বছর নানামুখী টানাপোড়েনে আইনসম্মত দায়িত্ব পালনে সিভিল সার্ভিসের একটি বড় অংশ যে মনোবল হারিয়েছে, জনস্বার্থেই তা পুনরুদ্ধার আবশ্যক। বিবেচ্য আইনের খসড়া এ বিষয়টি সামনে রেখেই করা হয়েছে। তাই ঐতিহ্যগত যে নিরাপত্তাবলয়টি নানা ঘাত-প্রতিঘাতে আজ বিধ্বস্ত, আইনি সুরক্ষা সে বলয়টিতে আবারও দৃঢ়ভাবে পুনর্নির্মাণে সহায়ক হতে পারে। তবে সে ক্ষেত্রে আইনটিকে হতে হবে স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং উদ্দেশ্য সাধনে সক্ষম। তরী ভাসিয়ে মাঝ নদী পর্যন্ত গেলেই হবে না—তীরে ভেড়াতেও হবে।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।

No comments

Powered by Blogger.