চারদিক-তুলি আর ক্যামেরার যুগলবন্দী by খাদিজা ফাল্গুনী

আজ শেষ হয়ে যাবে প্রদর্শনী ‘অন্তহীন সময়’। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটি লেগেছিল একটু অন্য রকম। ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে’ গানটি গাইল উপস্থিত সবাই, সেটাই ছিল অনানুষ্ঠানিক উদ্বোধন। ছবিগুলো ছিল দেয়ালে। কিছু ছবি আঁকা, কিছু তোলা। অর্থাৎ চিত্রকর ও ফটোগ্রাফারের যুগলবন্দী।


যাঁদের এই কাজ, সেই তৌহীদ রেজা নূর আর আবু সালেহ টিটু এবারই কাজ করলেন একসঙ্গে। নামীদামি কেউ নন তাঁরা, কিন্তু ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে মন ভরে যাচ্ছিল। যেমনটা বললেন নাসির আলী মামুন। তৌহীদের তোলা একটি শিশু আর একটি গাছের পাতা নিয়ে তিনি বললেন, ছবি সবাই তুলতে পারে। কিন্তু কেউ কেউ ছবিতে ফুটিয়ে তুলতে পারেন প্রাণের স্পন্দন। তৌহীদের ছবিগুলো সে বিবেচনায় উত্তীর্ণ।
নানা বয়সের মানুষ এসেছিল এখানে। টিটুর আঁকা ছবিতে রঙের ব্যবহার নিয়ে কথা বলেছে। কথা বলেছে তৌহীদের ছবিগুলোর বৈচিত্র্য নিয়েও।
আমরা বরং দর্শকদের মন্তব্যগুলোর কয়েকটি পড়ে ফেলি। ‘হাতে আঁকা ও ক্যামেরায় আঁকা এই যৌথ প্রদর্শনীর আয়োজন করেছেন এই দুই প্রতিভাবান তরুণ, একজন চিত্রশিল্পী, অন্যজন আলোকচিত্রশিল্পী। আবু সালেহ টিটু ও তৌহীদ রেজা নূর, দুজনের এই যুগলবন্দী নিঃসন্দেহে মুগ্ধ হওয়ার মতো। এই ছবি ও রেখার প্রদর্শনী আসলে হাতে ও ক্যামেরায় আঁকা কবিতা, যেখানে বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে জীবন, প্রকৃতি ও চরাচর। গ্রথিত হয়েছে মানুষের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, প্রেম-বিরহের অপূর্ব উপাখ্যান। আমি এই তরুণ শিল্পীদ্বয়ের সাফল্য ও মঙ্গল কামনা করি।’ লিখেছেন কবি মহাদেব সাহা।
‘জীবনের চলমান এই প্রক্রিয়ার মাঝে বাঁধা আমরা প্রতিনিয়ত। সামান্য সুখ ছুঁয়ে দেবে, এমন অবসরও হয় না দৈনন্দিন প্রয়োজনে। খুব ভালো লেগেছে আপনাদের শিল্পীসত্তা।’ লিখেছেন তৃষা সরকার।
শিমুল জাহিদ লিখেছেন, ‘আলো পড়ে বলেই আমরা বস্তুকে নিরীক্ষণ করতে পারি। আলোর জন্য রং দেখা। আবার অনেক রঙিনের ভেতরও লুকিয়ে থাকে জীবনের চরম সত্য, যেখানে কোনো আস্তরই পড়েনি কখনো। এই প্রদর্শনী সেই আস্তরবিহীন জীবনের কথা বলেছে।’
‘ছবির সৌন্দর্য আমাকে বিমুগ্ধ করেছে, যা ছিল জীবনকে নতুন করে কিছু বুঝতে পারা।’ এ কথাই লিখেছেন শুভ নামের একজন।
‘চিত্রশিল্প আর আলোকচিত্র—দুটোর ভেতর পার্থক্য কি খুব বেশি? অদ্ভুত এক মিশ্রণ। ভালো লাগল। উপস্থাপনাটা ভালো। আরও এগিয়ে যান। অপেক্ষায় থাকলাম আবার আসব বলে।’ লিখেছেন মাধুরী।
দুটো শিল্পের যুগলবন্দী মনকে ভালো করে দিচ্ছে, মনে জাগিয়ে তুলছে আবার এখানে আসার তাড়না।
১৫ এপ্রিল শুরু হয়েছিল প্রদর্শনী। আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের লা গ্যালারিতে ঘুরে গেছেন অনেক দর্শক। শিল্পী দুজনও উপস্থিত ছিলেন কোনো কোনো দিন। স্বেচ্ছায় দর্শকদের সঙ্গে কথা বলেছেন তাঁরা। প্রদর্শনীতে আসা দর্শকদের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়েছেন।
আবু সালেহ টিটু আঁকা নিয়ে কোনো প্রথাগত শিক্ষা লাভ করেননি। মূলত তেলরং বা মিশ্র মাধ্যমে কাজ করেন। নিজের ভাবনাকেই রঙে-রেখায় ফুটিয়ে তোলেন। ১৯৯৪ সালে ঢাকা শেরাটন হোটেলে তাঁর প্রথম একক প্রদর্শনী হয়। দ্বিতীয়টি হয় ২০০১ সালে। হাসতে হাসতে বললেন, ‘প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বলতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে এমএ করা আছে আমার। কিন্তু ছবি আঁকাআঁকির হাতেখড়ি সেই ছোটবেলা থেকে, যখন সিলেট ক্যাডেট কলেজে পড়তাম, কলেজ প্রাঙ্গণে একবার আয়োজন করেছিলাম পেনসিল স্কেচ প্রদর্শনীর। সেটা ১৯৮৫ সালের কথা। সেই ভালোবাসারই পরিণতি আজকের এই আয়োজন।’
ফটোগ্রাফির জগতে নতুন পা রাখা তৌহীদ রেজা নূরের ফটোগ্রাফির জন্য ভালোবাসাটা অনেক পুরোনো। সেই স্কুলবেলা থেকেই খেলতে শুরু করেছিলেন ক্যামেরা নিয়ে। সেই খেলাটাই এখন দখল নিয়েছে তাঁর আবেগের জগৎ। ব্যক্তিগতভাবে কাজ করছেন একজন গবেষক হিসেবে। এরই সূত্রে ছবি তোলা হয়েছে নানা মানুষের, মুখের, জীবনের। তাই নিয়ে সাজিয়েছেন প্রদর্শনীর দেয়াল।
প্রদর্শনীর আজই শেষ দিন।
ব্যস্ত জীবনে নানা কাজের ফাঁকে এখনো কেউ কেউ তাঁদের স্বপ্নটাকে ধরে রাখতে পারছেন। প্রকাশও করছেন। শখকে শৈল্পিক রূপ দেওয়ার মানুষ যত বাড়বে, ততই জীবন হয়ে উঠবে সুন্দর। যাঁদের হাতে আছে ক্যামেরা, কিংবা যিনি তুলিটা তুলে রেখেছেন অযত্নে, তিনি আবারও ফিরে আসতে পারেন শিল্পের ভুবনে। জীবন আর শিল্প মিলেমিশেই তো তৈরি হয়ে যায় সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ।
আপনিও পা বাড়ান না সেই পথে!
খাদিজা ফাল্গুনী

No comments

Powered by Blogger.