আলোকের এই ঝরনাধারায় (পর্ব-১৯)-গেণ্ডারিয়ার মাস্টার মশাই by আলী যাকের
গেণ্ডারিয়ার ধূপখোলা মাঠকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হতো আমাদের জীবন। মাঠের পুব দিকে একটি অতি পুরনো পুকুর ছিল, যেটি এখনো আছে। এই পুকুরেই প্রতি রবিবার আমরা পাড়ার ছেলেমেয়েরা সারা দিন দাপাদাপি করতাম। পুকুরটি ঘিরে ছিল বেশ কিছু একতলা, দোতলা বাড়ি। ওই সব বাড়িতে ছিল আমাদের অবাধ যাতায়াত।
এখানেই আমার বড় ভাইয়ের বন্ধু, যেমন সিরাজ ভাই, হান্নান ভাই, কবির ভাই এঁদের তত্ত্বাবধানে আমি শিখেছি বিভিন্ন খেলা। ভুলুদা রাতের বেলায় ইস্টার্ন ক্লাবের পাশে আলো জ্বালিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলতেন এবং আমাদের খেলাতেন। এখান থেকে বেরিয়েছে অনেক চৌকস ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড়। সেই কৈশোর থেকেই আমাদের মন পড়ে থাকত ওই মাঠে, মাঠসংলগ্ন আমবাগান অথবা পুকুরে।
মাঝেমধ্যে আমরা, সমমনা দুই-চার কিশোর, সব কিছু ভুলে হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতাম গেণ্ডারিয়া রেল স্টেশনে এবং স্টেশন পেরিয়ে গ্রামের পথে। সে সময়, কি আরো আগে থেকে মফস্বল শহরের রেল স্টেশন বাংলা ছবির প্রায় অবিচ্ছেদ্য দৃশ্যপট ছিল। সুচিত্রা সেন, উত্তমকুমার অভিনীত অনেক ছবিতে এ ধরনের স্টেশন দেখা যেত। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এসব স্টেশনে অভিনীত হতো কোনো রোমান্টিক দৃশ্য। ওই সব ছবির ওই বিশেষ দৃশ্যগুলো এখনো মনে পড়লে কেমন একটা প্রেমাচ্ছন্ন অনুভূতিতে মন ভিজে আসে। খুব সুন্দর ছিল গেণ্ডারিয়া রেল স্টেশন। ছোট টিনশেড। ঘাসে মোড়া প্ল্যাটফর্ম। সেখানে পরপর এক সারি হাতলওয়ালা বেঞ্চ। পেছনে কৃষ্ণচূড়া গাছের দেয়াল। গ্রীষ্মকালে লাল, কমলা রঙে রঙিন হয়ে যেত গোটা এলাকা। রবিবারের ছুটির দিনে অলস দুপুরগুলোতে অনেক দিন একা একা হেঁটে পেঁৗছে গেছি স্টেশনে। বিকেল পর্যন্ত কাটিয়ে দিয়েছি বেঞ্চে বসে। এভাবে কেটে গেছে কত দুপুর, কত বিকেল! বেশির ভাগ সময় একেবারে একা। সেই কৈশোর থেকেই দিনের কিছু সময় অথবা সপ্তাহের কোনো কোনো দিন একেবারে একা হয়ে নিজের মধ্যেই হারিয়ে যেতে যে কী আনন্দ, তা কাউকে বোঝাতে পারব না। এই হারিয়ে যাওয়া সময়ে আমি কী ভাবতাম? কোনো গভীর কথা নিশ্চয়ই নয়। তাহলে এই বয়সেও নিশ্চয়ই মনে থাকত। ভুলে যেতাম না। তবে ছোটবেলা থেকেই আমি কল্পনাপ্রবণ ছিলাম, এটা নিশ্চিত। সে জন্যই বোধ হয় একেবারে বাল্যকাল থেকে রবীন্দ্রনাথের সেই অবিস্মরণীয় গান, 'কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা মনে মনে' আমার বড় প্রিয়। এই হারিয়ে যাওয়া নিয়ে নানা সময় নানা কথা শুনতে হয়েছে অনেকের কাছে। ছোটবেলায় আমার নাম ছিল অনেক। যেমন ভোম্বল, ভ্যাবলা, ভোলানাথ। এসবই বোধ হয় আমার ওই হারিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ততার ইঙ্গিতবাহী। আমার কল্পনাপ্রবণ মন সব সময়ই গল্প গাঁথে। আমি পুরনো কোনো জমিদারবাড়িকে কেন্দ্র করে যেমন স্বচ্ছন্দে গল্প বানাতে পারি, সেই রকম নদীর ধারে বসেও। আলবার্ট আইনস্টাইন একবার বলেছিলেন, 'ওসধমরহধঃরড়হ রং নবঃঃবৎ ঃযধহ ষড়মরপ'। কল্পনা যুক্তিবিদ্যার চেয়ে শ্রেয়। মনে হতে পারে, অঙ্ক ও পদার্থবিদ এই যুক্তিবাদী মানুষটি কেন এমন কথা বললেন? এ বিষয়ে তাঁর একটি ব্যাখ্যা আছে। তাঁর সেই বাক্যটি মনোযোগ দিয়ে পড়লেই আমরা বুঝতে পারব তাঁর এমন মন্তব্যের অর্থ। তিনি বলেছেন, 'তুমি যুক্তির দ্বারা এ থেকে বি-তে যেতে পারো। কিন্তু কল্পনা তোমাকে করতে পারে সর্বত্রগামী।' আমরা এও দেখেছি, মানুষের পাখি হওয়ার ইচ্ছে থেকেই এরোপ্লেনের আবিষ্কার। অর্থাৎ আজ যেটি নিরাবয়ব আকাশের মতো কল্পনা, কাল সেটিই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে কোনো যুক্তিগ্রাহ্য বৈজ্ঞানিক সত্য হিসেবে। কল্পনার পক্ষে অনেক গুণকীর্তন করলাম বৈকি। তবে যেমন আগেই বলেছি, এর জন্য আমি বিভিন্ন বয়সে বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে অনেক কথা শুনেছি। আমার কল্পনার গল্প শুনে মা বলতেন, 'স্বপ্নে যদি পোলাও রাঁধিসই তাহলে একটু বেশি করে ঘি ঢালতে অসুবিধা কোথায়?'_এ রকম আরো অনেক কিছু। তবে এতে আমার খোয়াব দেখায় কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি।
দীর্ঘদিন গেণ্ডারিয়ায় একজন মাস্টার মশাই আমাকে এবং আমার ছোট বোনকে প্রাইভেট পড়াতেন। তাঁর নাম ছিল গণেশ চন্দ্র দে। তিনি গেণ্ডারিয়া হাই স্কুলে প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক ক্লাসগুলোতে অঙ্ক পড়াতেন। আমাদের পড়াতেন সব বিষয়। তবে আমার ভোঁতা মাথায় অঙ্ক সহজে ঢুকতে চাইত না। একটা বিষয়ে অবশ্য গণেশ স্যার সাফল্য অর্জন করেছিলেন, আর তা হলো, আমাদের সন্ধ্যাকালীন পড়াশোনায় এক ধরনের শৃঙ্খলা নিয়ে আসা। এই আপাত-সামান্য সাফল্যই বা কজন মানুষ দুটি চপলমতি বালক-বালিকার মধ্যে সঞ্চার করতে পারেন? সাদা হাতা গোটানো ফুলশার্ট এবং ধুতি পরিহিত গণেশ স্যারের চেহারাটা এখনো স্পষ্ট মনে আছে। তখন আমাদের অতি প্রিয় কণ্ঠশিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ওই একই পোশাক পরতেন। কে জানে গণেশ স্যার হয়তোবা হেমন্তের দ্বারাই অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন! গণেশ স্যার থাকতেন মনীষাদি, মমতাদি ও অজয়দের দ্বিতল বাড়ির নিচের তলার একটি ঘরে। একেক সময় ভাবলে অবাক লাগে, তখনকার স্কুলশিক্ষকরা কী সাদামাটা জীবনযাপন করতেন! নিজের সুচিন্তিত সিদ্ধান্তে একটি জীবনধারাকে আদর্শ হিসেবে গণ্য করে সে পথেই চলতেন। একটুও বিচ্যুতি ঘটত না। ইংরেজিতে একটি কথা আছে, ঢ়ষধরহ ষরারহম ধহফ যরময ঃযরহশরহম। মোটামুটি এই ছিল তাঁদের জীবনের দর্শন। এখন যেমন জীবনের সর্বক্ষেত্রে কেবল অর্থের পেছনে ধাবমান; আমরা অতি অল্প বয়সেই বুড়িয়ে যাই, জীবনীশক্তি প্রায় নিঃশেষ হয়ে যায়_সে রকম ওঁদের জীবন ছিল না।
এই গণেশ স্যারকে আমি দেখেছি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন শ্বেতবস্ত্র পরিহিত একজন মানুষ, নিখুঁতভাবে দাড়ি কামানো, সুপারি চিবোতে চিবোতে যখন পড়াতেন, তখন মনে হতো তিনি সত্যিই পরিতৃপ্ত। এখন জানি যে একজন মানুষ গভীর চিন্তা করতে জানলে জাগতিক অনেক বাহুল্য চাওয়া থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারেন। (চলবে)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
মাঝেমধ্যে আমরা, সমমনা দুই-চার কিশোর, সব কিছু ভুলে হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতাম গেণ্ডারিয়া রেল স্টেশনে এবং স্টেশন পেরিয়ে গ্রামের পথে। সে সময়, কি আরো আগে থেকে মফস্বল শহরের রেল স্টেশন বাংলা ছবির প্রায় অবিচ্ছেদ্য দৃশ্যপট ছিল। সুচিত্রা সেন, উত্তমকুমার অভিনীত অনেক ছবিতে এ ধরনের স্টেশন দেখা যেত। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এসব স্টেশনে অভিনীত হতো কোনো রোমান্টিক দৃশ্য। ওই সব ছবির ওই বিশেষ দৃশ্যগুলো এখনো মনে পড়লে কেমন একটা প্রেমাচ্ছন্ন অনুভূতিতে মন ভিজে আসে। খুব সুন্দর ছিল গেণ্ডারিয়া রেল স্টেশন। ছোট টিনশেড। ঘাসে মোড়া প্ল্যাটফর্ম। সেখানে পরপর এক সারি হাতলওয়ালা বেঞ্চ। পেছনে কৃষ্ণচূড়া গাছের দেয়াল। গ্রীষ্মকালে লাল, কমলা রঙে রঙিন হয়ে যেত গোটা এলাকা। রবিবারের ছুটির দিনে অলস দুপুরগুলোতে অনেক দিন একা একা হেঁটে পেঁৗছে গেছি স্টেশনে। বিকেল পর্যন্ত কাটিয়ে দিয়েছি বেঞ্চে বসে। এভাবে কেটে গেছে কত দুপুর, কত বিকেল! বেশির ভাগ সময় একেবারে একা। সেই কৈশোর থেকেই দিনের কিছু সময় অথবা সপ্তাহের কোনো কোনো দিন একেবারে একা হয়ে নিজের মধ্যেই হারিয়ে যেতে যে কী আনন্দ, তা কাউকে বোঝাতে পারব না। এই হারিয়ে যাওয়া সময়ে আমি কী ভাবতাম? কোনো গভীর কথা নিশ্চয়ই নয়। তাহলে এই বয়সেও নিশ্চয়ই মনে থাকত। ভুলে যেতাম না। তবে ছোটবেলা থেকেই আমি কল্পনাপ্রবণ ছিলাম, এটা নিশ্চিত। সে জন্যই বোধ হয় একেবারে বাল্যকাল থেকে রবীন্দ্রনাথের সেই অবিস্মরণীয় গান, 'কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা মনে মনে' আমার বড় প্রিয়। এই হারিয়ে যাওয়া নিয়ে নানা সময় নানা কথা শুনতে হয়েছে অনেকের কাছে। ছোটবেলায় আমার নাম ছিল অনেক। যেমন ভোম্বল, ভ্যাবলা, ভোলানাথ। এসবই বোধ হয় আমার ওই হারিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ততার ইঙ্গিতবাহী। আমার কল্পনাপ্রবণ মন সব সময়ই গল্প গাঁথে। আমি পুরনো কোনো জমিদারবাড়িকে কেন্দ্র করে যেমন স্বচ্ছন্দে গল্প বানাতে পারি, সেই রকম নদীর ধারে বসেও। আলবার্ট আইনস্টাইন একবার বলেছিলেন, 'ওসধমরহধঃরড়হ রং নবঃঃবৎ ঃযধহ ষড়মরপ'। কল্পনা যুক্তিবিদ্যার চেয়ে শ্রেয়। মনে হতে পারে, অঙ্ক ও পদার্থবিদ এই যুক্তিবাদী মানুষটি কেন এমন কথা বললেন? এ বিষয়ে তাঁর একটি ব্যাখ্যা আছে। তাঁর সেই বাক্যটি মনোযোগ দিয়ে পড়লেই আমরা বুঝতে পারব তাঁর এমন মন্তব্যের অর্থ। তিনি বলেছেন, 'তুমি যুক্তির দ্বারা এ থেকে বি-তে যেতে পারো। কিন্তু কল্পনা তোমাকে করতে পারে সর্বত্রগামী।' আমরা এও দেখেছি, মানুষের পাখি হওয়ার ইচ্ছে থেকেই এরোপ্লেনের আবিষ্কার। অর্থাৎ আজ যেটি নিরাবয়ব আকাশের মতো কল্পনা, কাল সেটিই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে কোনো যুক্তিগ্রাহ্য বৈজ্ঞানিক সত্য হিসেবে। কল্পনার পক্ষে অনেক গুণকীর্তন করলাম বৈকি। তবে যেমন আগেই বলেছি, এর জন্য আমি বিভিন্ন বয়সে বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে অনেক কথা শুনেছি। আমার কল্পনার গল্প শুনে মা বলতেন, 'স্বপ্নে যদি পোলাও রাঁধিসই তাহলে একটু বেশি করে ঘি ঢালতে অসুবিধা কোথায়?'_এ রকম আরো অনেক কিছু। তবে এতে আমার খোয়াব দেখায় কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি।
দীর্ঘদিন গেণ্ডারিয়ায় একজন মাস্টার মশাই আমাকে এবং আমার ছোট বোনকে প্রাইভেট পড়াতেন। তাঁর নাম ছিল গণেশ চন্দ্র দে। তিনি গেণ্ডারিয়া হাই স্কুলে প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক ক্লাসগুলোতে অঙ্ক পড়াতেন। আমাদের পড়াতেন সব বিষয়। তবে আমার ভোঁতা মাথায় অঙ্ক সহজে ঢুকতে চাইত না। একটা বিষয়ে অবশ্য গণেশ স্যার সাফল্য অর্জন করেছিলেন, আর তা হলো, আমাদের সন্ধ্যাকালীন পড়াশোনায় এক ধরনের শৃঙ্খলা নিয়ে আসা। এই আপাত-সামান্য সাফল্যই বা কজন মানুষ দুটি চপলমতি বালক-বালিকার মধ্যে সঞ্চার করতে পারেন? সাদা হাতা গোটানো ফুলশার্ট এবং ধুতি পরিহিত গণেশ স্যারের চেহারাটা এখনো স্পষ্ট মনে আছে। তখন আমাদের অতি প্রিয় কণ্ঠশিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ওই একই পোশাক পরতেন। কে জানে গণেশ স্যার হয়তোবা হেমন্তের দ্বারাই অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন! গণেশ স্যার থাকতেন মনীষাদি, মমতাদি ও অজয়দের দ্বিতল বাড়ির নিচের তলার একটি ঘরে। একেক সময় ভাবলে অবাক লাগে, তখনকার স্কুলশিক্ষকরা কী সাদামাটা জীবনযাপন করতেন! নিজের সুচিন্তিত সিদ্ধান্তে একটি জীবনধারাকে আদর্শ হিসেবে গণ্য করে সে পথেই চলতেন। একটুও বিচ্যুতি ঘটত না। ইংরেজিতে একটি কথা আছে, ঢ়ষধরহ ষরারহম ধহফ যরময ঃযরহশরহম। মোটামুটি এই ছিল তাঁদের জীবনের দর্শন। এখন যেমন জীবনের সর্বক্ষেত্রে কেবল অর্থের পেছনে ধাবমান; আমরা অতি অল্প বয়সেই বুড়িয়ে যাই, জীবনীশক্তি প্রায় নিঃশেষ হয়ে যায়_সে রকম ওঁদের জীবন ছিল না।
এই গণেশ স্যারকে আমি দেখেছি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন শ্বেতবস্ত্র পরিহিত একজন মানুষ, নিখুঁতভাবে দাড়ি কামানো, সুপারি চিবোতে চিবোতে যখন পড়াতেন, তখন মনে হতো তিনি সত্যিই পরিতৃপ্ত। এখন জানি যে একজন মানুষ গভীর চিন্তা করতে জানলে জাগতিক অনেক বাহুল্য চাওয়া থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারেন। (চলবে)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments