গ্রন্থ ও গ্রন্থস্বত্ব দিবস-পাড়ায় পাড়ায় গড়ে উঠুক গ্রন্থাগার by মনজুরুর রহমান

আজকের এই যে দিনটি ইউনেসকো ঘোষিত আন্তর্জাতিক গ্রন্থ ও কপিরাইট দিবস। ১৯৯৬ সাল থেকে জাতিসংঘের অন্যতম সংস্থা ইউনেসকো, যারা সারা পৃথিবীর মানুষের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিয়ে কাজ করে, তারা শেকসপিয়ারসহ বেশ কজন স্বনামখ্যাত স্রষ্টার জন্ম-মৃত্যুর দিনটিকে ঘোষণা করেছে বিশেষ দিবস হিসেবে।


যেন এই দিন সারা পৃথিবীর মানুষ নতুন করে উদ্বুদ্ধ হয় পড়তে এবং অন্যকে পড়াতে। পড়তে পড়তেই যেন তারা আবিষ্কার করতে শেখে আনন্দের মৃত্যুহীন অভিযাত্রাকে। এই অভিযাত্রার প্রধান কান্ডারি বা নায়ক হচ্ছেন লেখক। পাঠকের রুচি, বোধ, মনন ও মেধা সৃষ্টিতে তিনি পালন করেন অসাধারণ ভূমিকা। তাঁদের হাতে সৃষ্টি হয় একেকটি কাল বা যুগ। যুগ-যুগান্তর ধরে তাঁরা পাঠকদের পথ দেখান আলো-অন্ধকারে। সমাজ বিনির্মাণের চড়াই-উতরাই পেরিয়ে নিজ দেশ ও কালের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেন।
অন্যদিকে পাঠাভ্যাস নামক কর্মটিকে ফুলে-ফলে পরিপূর্ণ রূপ দিতে পাঠকের গুরুত্ব অপরিসীম। দেশলাইয়ের একটি কাঠি যেমন লাখো-কোটি মোম প্রজ্বলনে সক্ষম, ঠিক তেমনি একজন প্রকৃত বোদ্ধা পাঠকও তাঁর রুচি, প্রজ্ঞা ও মনন চেতনা দিয়ে তাঁর নিকটজন, প্রতিবেশী, সমাজ এবং দেশকে নিয়ে যেতে পারেন আলোকিত পৃথিবীর পথে। সৃষ্টি করতে পারেন আলোকিত মানুষের স্বপ্ন-বাস্তবতার জগৎ। নিরবচ্ছিন্ন পাঠাভ্যাস এ-জাতীয় পাঠককে একদিন স্রষ্টা-পাঠকে পরিণত করে। তাঁর আত্মস্থ অধীত বিদ্যা তিনি নতুন নতুন মননশীল গ্রন্থের মাধ্যমে প্রকাশ করেন, উপকৃত করেন সমাজকে। বৈরী পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে রাষ্ট্রকে করেন সাহায্য। আমাদের জাতীয় জীবনের বহু ক্রান্তিলগ্নে আমরা এ-জাতীয় বোদ্ধা পাঠকদের স্মরণ করেছি, যাঁদের অবদান জাতি শ্রদ্ধার সঙ্গে দীর্ঘকাল স্মরণ করে। প্রাতিষ্ঠানিক কোনো সংস্থার চেয়ে অনেক বড় মাপের এই মানুষেরা নিজেরাই কাজ করেন একেকটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে। মনে রাখা প্রয়োজন, এ-জাতীয় পাঠকের সংখ্যা সব সমাজেই সংখ্যায় স্বল্প। রাষ্ট্রের দায়িত্ব ওই মাপের পাঠক সৃষ্টির অনুকূল পরিবেশ বিনির্মাণ এবং প্রণোদনামূলক কর্মকাণ্ড নিয়ে এগিয়ে আসা।
একসময় দেশের শহর ও গ্রামের অনেক জায়গায় স্কুল-কলেজে পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের উৎসাহ-উদ্দীপনায় পাড়ায় পাড়ায় গড়ে উঠত পাঠাগার বা গ্রন্থাগার। আজ বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র জাতীয় ভিত্তিতে যে কাজটি করার চেষ্টা করছে, একসময় পাড়ায় পাড়ায় গড়ে ওঠা সেই সব পাঠাগার বা লাইব্রেরি সীমিত সামর্থ্য নিয়ে সেই কাজ করে গেছে। চল্লিশ বছর আগের তুলনায় বর্তমান বাংলাদেশের প্রভূত অর্থনৈতিক উন্নতি অর্জিত হলেও নিজেদের মধ্যে ছোট পরিসরে পাঠচক্রের আয়োজন বা পাঠাগার স্থাপনের ঐতিহ্য থেকে আমরা এখন সরে এসেছি অনেক দূর। ফলে নিজেদের মধ্যে সৃষ্টিশীলতার সাধনায়ও যেন ভাটা পড়েছে গভীরতর। কেবলই সরকার বা অসরকারি প্রতিষ্ঠান অথবা অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে উঠছি আমরা।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সদাশয় সরকার বিষয়টি উপলব্ধি করতে পেরেছে গভীর প্রত্যয়ে। ফলে কেবল রাজধানী বা জেলা শহর নয়, উপজেলাসহ ইউনিয়নের প্রান্তসীমায়ও যেন গণগ্রন্থাগার সম্প্র্রসারণ করা সম্ভব হয়, তার চেষ্টা চলছে আন্তরিকভাবে। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে দেশের প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশুদের উপযোগী বই দিয়ে গ্রন্থাগার স্থাপনের উদ্যোগও গৃহীত হয়েছে।
আজকের এই গ্রন্থ দিবসের সঙ্গে ইউনেসকো কর্তৃপক্ষ কপিরাইটকে যুক্ত করে মানুষের সৃজনশীলতার মর্যাদাকেও মহিমান্বিত করেছে। দেশে-বিদেশে আজ সৃষ্টিশীল মানুষেরা ক্রমাগত বঞ্চিত হচ্ছেন তাঁদের বৈধ আর্থিক ও নৈতিক অধিকার থেকে। এই বঞ্চনার প্রধানতম কারণ সৃষ্টিশীল মানুষগুলোর অসচেতনতা ও তাঁদের অধিকারবোধ সম্পর্কে সম্মিলিত সাহসের অভাব। পাইরেসি নামের গভীরতর এক দুষ্টক্ষত আমাদের কেবলই অধঃপতনের গভীর চোরাবালিতে নামিয়ে এনেছে। চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্ত স্বল্প দামের মূল বই এবং গ্রন্থাগারের অভাবে অনেক অনিচ্ছুক পাঠক কেবলই উটপাখির মতো ধাবিত হচ্ছে পাইরেসি হাটের দিকে!
নেতিবাচক এই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পেতে হলে লেখক, পাঠক আর লেখকের মিলনকেন্দ্ররূপী প্রতিষ্ঠান গ্রন্থাগার উন্নয়নের বিকল্প নেই। গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা-সম্পর্কিত জ্ঞানে দক্ষ জনবলও সৃষ্টি করতে হবে। তা হলেই কেবল সম্ভব জ্ঞান, তথ্য ও প্রযুক্তিঋদ্ধ সভ্যতার সমান বয়সী বুড়ো পৃথিবীর আসল চিত্র আবিষ্কার করা। আসুন, সেই লক্ষ্যে এগিয়ে যাই।
মনজুরুর রহমান: কপিরাইট রেজিস্ট্রার, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়।

No comments

Powered by Blogger.