টাইম স্কেল বাতিল-বেসরকারি কলেজশিক্ষকের দিনলিপি by নাসিমা হক
সকালের নাশতায় তিনটে ডিম লাগছে এখন। কদিন আগেও দুটোতে হতো। সন্তানসম্ভবা হওয়ার কারণে এখন বাবা ও মেয়ের পাশাপাশি নিজেকেও খেতে হচ্ছে। যদিও খেতে ইচ্ছে হয় না। সংসারে দিন দিন চাহিদা শুধু বেড়েই চলেছে। নাশতার পাট চুকিয়ে মেয়েকে নিয়ে স্কুলে যাওয়া। আজ আবার ওদের স্কুলে বেতনের তারিখ।
পুনর্ভর্তি, নতুন বইখাতা, নতুন ড্রেস—এগুলোতে গত মাসেই অনেকগুলো টাকা লেগেছে। আজ বেতনটা দিতেই হবে—মেয়ের বায়না। ও তো বোঝে না, দুই মাস ধরে ওর বাবা-মায়ের বেতন বন্ধ হয়ে আছে।
রিমা (ছদ্মনাম) এবং ওর স্বামী দুজনই পঞ্চগড় জেলার একটি উপজেলায় দুটি বেসরকারি কলেজে শিক্ষকতা করেন।
কলেজ থেকে ফিরেই কর্তাকে বাজারের থলে এবং ফর্দ ধরিয়ে দেওয়া। যেদিন সকালে ক্লাস থাকে না সেদিনই বাজার করা হয় শুধু। বাজারের ফর্দ আর টাকার মধ্যে কোনো সামঞ্জস্য থাকে না কেনো দিন। প্রথমটির বাড় যেন বেড়েই চলেছে, অপরটি যেন এক জায়গায় থেমেই আছে। অনেকটা তাঁদের চাকরির মতো। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নেওয়ার পর সরকারি চাকরির সোনার হরিণ না পাওয়ায় বেসরকারি কলেজে প্রবেশ। তাঁদের একজনের চাকরির বয়সসীমা ১৫ বছর, অন্যজনের ১২ বছর। এক যুগ চাকরির পর অবশ্য বেতনটা শতভাগ হয়েছে। এর বাইরে যেন কিছুই পাওয়ার নেই তাঁদের। চাকরিজীবনে একটি মাত্র ইনক্রিমেন্ট—তাও মাত্র ১২৫ টাকা। ৫: ২ অনুপাতের ফাঁদে পড়ে রিমার নিজের সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি হলো না আর পেছনের সারিতে থাকায় রিমার স্বামীর তো সে আশাও নেই। তবু এই স্থির, থেমে থাকা জীবনে আশা জাগিয়েছে টাইম স্কেল প্রাপ্তি। নবম গ্রেড থেকে সপ্তম গ্রেডে প্রবেশ করার পাশাপাশি বেতনও ১১ হাজার টাকা থেকে ১৫ হাজার টাকায় উন্নীত হয়েছে।
বাজারে যাওয়া মানে যেন জ্বলন্ত আগুনের ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া। জিনিসপত্রের যা দাম, তার ওপর বাজারে বেশ কিছু পাওনাদার রয়েছে। এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ার সুবাদে মুদির দোকান, কাপড়ের দোকান, এমনকি মাছ-মাংসের দোকানেও টাকা বাকি রেখে কেনাকাটা করা যায়। দোকানিরাও জানে, বেসরকারি কলেজে বেতন আসার কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই। তাই আপাতত বাকি, পরে বেতন এলে টাকা শোধ হবে। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো একজন এসে একটা হালখাতার দাওয়াত দিয়ে গেল। আসলে পরপর দুই মাস বেতন না আসাতে এবার ধারদেনার পরিমাণ একটু বেশি।
কর্তার বাজারে যাওয়ার পর কলেজে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সবচেয়ে ব্যস্ত সময় কাটে রিমার। সংসারের কাজের ফাঁকে ফাঁকে মনে মনে হিসাবের অঙ্কটাও মেলাতে থাকেন তিনি। কাজের মহিলাটি বেতন বাড়িয়ে চেয়েছে; মেয়ের সংগীত, নৃত্য ও চিত্রাঙ্কন ক্লাসের বেতন, দুধের টাকা, মেয়ের ও নিজেদের যাতায়াত, আপ্যায়ন, সামাজিকতা রক্ষা—যেন একটা বৃত্তের ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছেন রিমা। তবু দুই মাসের বেতন একসঙ্গে পাওয়া যাবে, এ কথা ভেবে মনে স্বস্তি আসে। মনে মনে ভাবেন, সামনে তাঁর ডেলিভারির সময়ও ওই টাকা থেকে কিছু কাজে লাগানো যাবে।
বাজারে বের হওয়া চিন্তিত মুখের মধ্যে ক্ষোভ ও বেদনা নিয়ে রিমার স্বামী ঘরে ফিরলেন। হাতে ওই দিনের দৈনিক পত্রিকা। নজিরবিহীন ঘটনাটির বর্ণনা রিমাকে শোনালেন তাঁর স্বামী—বেসরকারি শিক্ষকদের টাইম স্কেল বাতিল করা হয়েছে, এমনকি তাঁদের গ্রেডও সপ্তম থেকে নবম গ্রেডে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে। কী লজ্জা! এ দেশে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রায় ছয় লাখ শিক্ষক কর্মরত আছেন। প্রায় ছয় বছর পর এবার ৩০ হাজারের মতো শিক্ষককে টাইম স্কেল দেওয়া হয়েছিল। যাঁরা অনুপাতের বাধায় কখনো পদোন্নতি পাবেন না, যাঁদের চাকরি ১৫-১৮ বছর হয়েছে, টাইম স্কেল তাঁদের একটা সম্মানজনক অবস্থানে নিয়ে গিয়েছিল। সেটিও আবার বন্ধ হয়ে গেল!
ছেলেবেলার একটা অনুভূতি মনে পড়ল রিমার। মা তাঁকে একটা নতুন জামা পরিয়ে দিয়েছিলেন। আনন্দে আত্মহারা রিমা, কিন্তু কিছুক্ষণ পর মা জামাটি খুলে নিয়েছিলেন। কারণ, জামাটি তাঁর জন্য কেনা হয়নি, হয়েছে এক আত্মীয়র জন্য। নতুন জামাটি পরিয়ে আবার খুলে নেওয়ার পর কষ্টে রিমার চোখ জলে ভরে গিয়েছিল। আজ আবার সেই অনুভূতিটাই হলো। মনে মনে অঙ্ক কষে রিমা বের করলেন, এই ৩০ হাজার শিক্ষকের বেতন বাবদ কত টাকা বেশি দিতে হয়েছিল সরকারকে? প্রায় ১০-১২ কোটি টাকা। এ দেশে মন্ত্রী-এমপিদের বাড়ি-গাড়িতেও তো এর চেয়ে বেশি টাকা খরচ হয়।
এ যুগে বাড়িভাড়া ১০০ টাকা আর চিকিৎসা ভাতা ১৫০ টাকা আর কারও আছে কি? বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা কি ছাত্রদের লেখাপড়া শেখান না? নামীদামি সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেসব ছাত্রছাত্রী ভর্তি হতে পারে না তাদের জন্যই তো গ্রামগঞ্জের এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এ কারণে মেধাবী মুখ রিমারা তেমন একটা পান না। নিজেদের বেতন-ভাতা টিকিয়ে রাখার তাগিদে এসব কম মেধাসম্পন্ন ছাত্রদের গলদঘর্ম হয়ে পড়িয়ে ভালো ফলাফল এনে দিতে হয় এসব বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের।
কিছুক্ষণ আগের দুই মাসের বেতন একত্রে পাওয়ার স্বপ্নের জালটি যেন বোনা না হতেই ছিঁড়ে গেল!
পরপর চারটে ক্লাসের ধকল সামলে বিকেলে বাড়ি ফিরে রিমার আবার সংসারে প্রবেশ। সংসার নামক চাদরটিকে জোড়াতালি, রিপু আর রঙিন সুতা দিয়ে টিকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা।
কলেজে সারা দিন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল আজ টাইম স্কেল বাতিল এবং অর্থ ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দ্বন্দ্ব। দ্বন্দ্ব রিমার মনেও। যে অনাগত সন্তানকে পৃথিবীর আলো-হাওয়ায় নিয়ে আসছেন, তাকে এবং যে আছে তাকে ঠিকমতো প্রতিপালন করতে পারবেন তো? শখ ও সাধ্যের টানাপোড়েনে তারা কি ভেসে যাবে নাকি শিক্ষক বাবা-মায়ের আদর্শে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে?
নাসিমা হক: সালমা সোবহান ফেলো, পঞ্চগড়।
রিমা (ছদ্মনাম) এবং ওর স্বামী দুজনই পঞ্চগড় জেলার একটি উপজেলায় দুটি বেসরকারি কলেজে শিক্ষকতা করেন।
কলেজ থেকে ফিরেই কর্তাকে বাজারের থলে এবং ফর্দ ধরিয়ে দেওয়া। যেদিন সকালে ক্লাস থাকে না সেদিনই বাজার করা হয় শুধু। বাজারের ফর্দ আর টাকার মধ্যে কোনো সামঞ্জস্য থাকে না কেনো দিন। প্রথমটির বাড় যেন বেড়েই চলেছে, অপরটি যেন এক জায়গায় থেমেই আছে। অনেকটা তাঁদের চাকরির মতো। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নেওয়ার পর সরকারি চাকরির সোনার হরিণ না পাওয়ায় বেসরকারি কলেজে প্রবেশ। তাঁদের একজনের চাকরির বয়সসীমা ১৫ বছর, অন্যজনের ১২ বছর। এক যুগ চাকরির পর অবশ্য বেতনটা শতভাগ হয়েছে। এর বাইরে যেন কিছুই পাওয়ার নেই তাঁদের। চাকরিজীবনে একটি মাত্র ইনক্রিমেন্ট—তাও মাত্র ১২৫ টাকা। ৫: ২ অনুপাতের ফাঁদে পড়ে রিমার নিজের সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি হলো না আর পেছনের সারিতে থাকায় রিমার স্বামীর তো সে আশাও নেই। তবু এই স্থির, থেমে থাকা জীবনে আশা জাগিয়েছে টাইম স্কেল প্রাপ্তি। নবম গ্রেড থেকে সপ্তম গ্রেডে প্রবেশ করার পাশাপাশি বেতনও ১১ হাজার টাকা থেকে ১৫ হাজার টাকায় উন্নীত হয়েছে।
বাজারে যাওয়া মানে যেন জ্বলন্ত আগুনের ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া। জিনিসপত্রের যা দাম, তার ওপর বাজারে বেশ কিছু পাওনাদার রয়েছে। এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ার সুবাদে মুদির দোকান, কাপড়ের দোকান, এমনকি মাছ-মাংসের দোকানেও টাকা বাকি রেখে কেনাকাটা করা যায়। দোকানিরাও জানে, বেসরকারি কলেজে বেতন আসার কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই। তাই আপাতত বাকি, পরে বেতন এলে টাকা শোধ হবে। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো একজন এসে একটা হালখাতার দাওয়াত দিয়ে গেল। আসলে পরপর দুই মাস বেতন না আসাতে এবার ধারদেনার পরিমাণ একটু বেশি।
কর্তার বাজারে যাওয়ার পর কলেজে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সবচেয়ে ব্যস্ত সময় কাটে রিমার। সংসারের কাজের ফাঁকে ফাঁকে মনে মনে হিসাবের অঙ্কটাও মেলাতে থাকেন তিনি। কাজের মহিলাটি বেতন বাড়িয়ে চেয়েছে; মেয়ের সংগীত, নৃত্য ও চিত্রাঙ্কন ক্লাসের বেতন, দুধের টাকা, মেয়ের ও নিজেদের যাতায়াত, আপ্যায়ন, সামাজিকতা রক্ষা—যেন একটা বৃত্তের ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছেন রিমা। তবু দুই মাসের বেতন একসঙ্গে পাওয়া যাবে, এ কথা ভেবে মনে স্বস্তি আসে। মনে মনে ভাবেন, সামনে তাঁর ডেলিভারির সময়ও ওই টাকা থেকে কিছু কাজে লাগানো যাবে।
বাজারে বের হওয়া চিন্তিত মুখের মধ্যে ক্ষোভ ও বেদনা নিয়ে রিমার স্বামী ঘরে ফিরলেন। হাতে ওই দিনের দৈনিক পত্রিকা। নজিরবিহীন ঘটনাটির বর্ণনা রিমাকে শোনালেন তাঁর স্বামী—বেসরকারি শিক্ষকদের টাইম স্কেল বাতিল করা হয়েছে, এমনকি তাঁদের গ্রেডও সপ্তম থেকে নবম গ্রেডে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে। কী লজ্জা! এ দেশে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রায় ছয় লাখ শিক্ষক কর্মরত আছেন। প্রায় ছয় বছর পর এবার ৩০ হাজারের মতো শিক্ষককে টাইম স্কেল দেওয়া হয়েছিল। যাঁরা অনুপাতের বাধায় কখনো পদোন্নতি পাবেন না, যাঁদের চাকরি ১৫-১৮ বছর হয়েছে, টাইম স্কেল তাঁদের একটা সম্মানজনক অবস্থানে নিয়ে গিয়েছিল। সেটিও আবার বন্ধ হয়ে গেল!
ছেলেবেলার একটা অনুভূতি মনে পড়ল রিমার। মা তাঁকে একটা নতুন জামা পরিয়ে দিয়েছিলেন। আনন্দে আত্মহারা রিমা, কিন্তু কিছুক্ষণ পর মা জামাটি খুলে নিয়েছিলেন। কারণ, জামাটি তাঁর জন্য কেনা হয়নি, হয়েছে এক আত্মীয়র জন্য। নতুন জামাটি পরিয়ে আবার খুলে নেওয়ার পর কষ্টে রিমার চোখ জলে ভরে গিয়েছিল। আজ আবার সেই অনুভূতিটাই হলো। মনে মনে অঙ্ক কষে রিমা বের করলেন, এই ৩০ হাজার শিক্ষকের বেতন বাবদ কত টাকা বেশি দিতে হয়েছিল সরকারকে? প্রায় ১০-১২ কোটি টাকা। এ দেশে মন্ত্রী-এমপিদের বাড়ি-গাড়িতেও তো এর চেয়ে বেশি টাকা খরচ হয়।
এ যুগে বাড়িভাড়া ১০০ টাকা আর চিকিৎসা ভাতা ১৫০ টাকা আর কারও আছে কি? বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা কি ছাত্রদের লেখাপড়া শেখান না? নামীদামি সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেসব ছাত্রছাত্রী ভর্তি হতে পারে না তাদের জন্যই তো গ্রামগঞ্জের এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এ কারণে মেধাবী মুখ রিমারা তেমন একটা পান না। নিজেদের বেতন-ভাতা টিকিয়ে রাখার তাগিদে এসব কম মেধাসম্পন্ন ছাত্রদের গলদঘর্ম হয়ে পড়িয়ে ভালো ফলাফল এনে দিতে হয় এসব বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের।
কিছুক্ষণ আগের দুই মাসের বেতন একত্রে পাওয়ার স্বপ্নের জালটি যেন বোনা না হতেই ছিঁড়ে গেল!
পরপর চারটে ক্লাসের ধকল সামলে বিকেলে বাড়ি ফিরে রিমার আবার সংসারে প্রবেশ। সংসার নামক চাদরটিকে জোড়াতালি, রিপু আর রঙিন সুতা দিয়ে টিকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা।
কলেজে সারা দিন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল আজ টাইম স্কেল বাতিল এবং অর্থ ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দ্বন্দ্ব। দ্বন্দ্ব রিমার মনেও। যে অনাগত সন্তানকে পৃথিবীর আলো-হাওয়ায় নিয়ে আসছেন, তাকে এবং যে আছে তাকে ঠিকমতো প্রতিপালন করতে পারবেন তো? শখ ও সাধ্যের টানাপোড়েনে তারা কি ভেসে যাবে নাকি শিক্ষক বাবা-মায়ের আদর্শে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে?
নাসিমা হক: সালমা সোবহান ফেলো, পঞ্চগড়।
No comments