কোচিংয়ের শিক্ষকরা কোটিপতি by অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য

ঢাকার শীর্ষস্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের গণিত ও বিজ্ঞানের শিক্ষক সুভাষ চন্দ্র পোদ্দার শুধু কোচিং ব্যবসা করেই রাজধানীর শাহজাহানপুরে দুই হাজার স্কয়ার ফিটের একটি ফ্ল্যাট কিনেছেন। এখন তিনি তাঁর ফ্ল্যাটেই গণিত ও বিজ্ঞান মিলিয়ে প্রায় ১০০ ছেলেমেয়েকে কোচিং করান।


সুভাষ পোদ্দার অবশ্য 'কোচিং'কে ব্যবসা বলতে নিষেধ করেছেন। একই প্রতিষ্ঠানের জীববিজ্ঞানের শিক্ষক গৌরাঙ্গ চন্দ্র দেবনাথ বাসায় ব্যাচ করে কোচিং ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। অনুসন্ধানে জানা যায়, রাজধানীতে কমপক্ষে ৬৫০ জন শিক্ষক রয়েছেন, যাঁরা এ দুজনের মতো পুরোদমে কোচিং ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। কোচিং নিয়ে সরকারের যে নির্দেশনা রয়েছে, শিক্ষকরা সেটি মানছেন না। গত জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এক নির্দেশনায় বলেছিল, এখন থেকে কোনো শিক্ষক নিজের স্কুলের শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট বা কোচিং করাতে পারবেন না। অন্য স্কুলের সর্বোচ্চ ১০ শিক্ষার্থীকে একসঙ্গে পড়ালে পড়াতে পারবেন। মন্ত্রণালয়ের দেওয়া এমন নির্দেশের দুই মাস পার হলেও কোচিং চলছে নির্বিঘ্নে।
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'কোচিং বন্ধে আমরা শুরু থেকেই কঠোর অবস্থান নিয়েছি। তবে রাতারাতি কোচিং বাণিজ্য দূর করতে পারব, এটা মনে করছি না। কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করার জন্য আমরা দীর্ঘমেয়াদি একটি প্রক্রিয়া শুরু করেছি।' এ জন্য পরিবেশ তৈরি করতে হবে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, 'ক্লাসরুমে পূর্ণ শিক্ষা পেলে শিক্ষার্থীরা আর কোচিংয়ে যাবে না। এ ছাড়া অনেক শিক্ষক আর্থিক অসচ্ছলতার কথা বলেও কোচিং করিয়ে থাকেন। আমরা ক্ষমতায় আসার পর শিক্ষকদের ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ বেতন বাড়িয়েছি। ভবিষ্যতে আরো বাড়ানোর চেষ্টা করব।' কোচিংয়ের সঙ্গে জড়িত শিক্ষকদের উদ্দেশে মন্ত্রী বলেন, 'আপনারা আদর্শ শিক্ষকদের অনুসরণ করুন। ক্লাসরুমে শিক্ষার্থীদের পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা দিন।'
জানা গেছে, প্রাথমিক ও অষ্টম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষা সামনে রেখে রাজধানীর স্কুলগুলোতে কোচিং ব্যবসা জমে উঠেছে। এ অবস্থায় মন্ত্রণালয়ও নড়ে বসেছে। গত ২৮ মার্চ শিক্ষা মন্ত্রণালয় কোচিং ব্যবসা বন্ধে নীতিমালা প্রণয়নের জন্য পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে দেয়। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক অধ্যাপক নোমান উর রশীদ এ কমিটির সভাপতি। অন্য সদস্যরা হলেন ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান, শিক্ষার মানোন্নয়নের প্রকল্প সেকায়েপ-এর পরিচালক, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (মাধ্যমিক) ও সিনিয়র সহকারী সচিব (শাখা-১১)। কমিটিকে জরুরিভাবে নীতিমালার খসড়া মন্ত্রণালয়ে জমা দিতে বলা হয়েছে।

এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (মাধ্যমিক) এ এস মাহমুদ কালের কণ্ঠকে বলেন, কোচিং নিয়ে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আগেই শিক্ষকদের একটি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এখন এই কোচিং বন্ধ করার জন্য নীতিমালা প্রণয়ন করা হচ্ছে। জানা গেছে, কোচিং বন্ধে নীতিমালা প্রণয়ন কমিটির প্রথম সভা গত সপ্তাহে মাউশিতে অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেই সভা থেকে তিন সদস্যের একটি উপকমিটি গঠন করা হয়।
মাউশি মহাপরিচালক অধ্যাপক নোমান উর রশীদ কালের কণ্ঠকে বলেন, কোচিং বন্ধে দ্রুত নীতিমালা প্রণয়নের জন্য মাউশির পরিচালক (মাধ্যমিক) অধ্যাপক শফিকুর রহমানকে প্রধান করে ওই উপকমিটি গঠন করা হয়েছে। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফাহিমা খাতুন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'কোচিং বন্ধে নীতিমালা প্রণয়নের কাজ শুরু হয়েছে। আমরা চাই কোচিং বন্ধ হোক। এ জন্য বন্ধের আদেশ এমনভাবে দেওয়া হবে যা প্রতিপালনযোগ্য।'
প্রাথমিক ও অষ্টম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষা সামনে রেখে রাজধানীর প্রতিটি স্কুলেই কোচিং ব্যবসা জমে উঠেছে। এ ছাড়া রয়েছে আগামী বছরের জন্য এসএসসির কোচিং। রাজধানীর মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণীর জন্য কোচিং ফি ৮০০ টাকা। অন্যান্য স্কুলেও ৮০০ থেকে এক হাজার ৪০০ টাকা পর্যন্ত আদায় করা হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
অভিভাবক ঐক্য ফোরামের নেতারা বলছেন, রাজধানীর শীর্ষস্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রায় ১৪ জন শিক্ষক শুধু কোচিং ব্যবসা করে জনপ্রতি মাসে লাখ টাকার ওপরে আয় করেন। সংগঠনটির সভাপতি জিয়াউল কবীর দুলু কালের কণ্ঠকে বলেন, ওই প্রতিষ্ঠানে পরিসংখ্যানের সহকারী অধ্যাপক মিজানুর রহমান, কম্পিউটারের সুরিয়া বেগম কোচিং করার জন্য শিক্ষার্থীদের বাধ্য করেন। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটির মুগদা শাখার সহকারী প্রধান শিক্ষক কাজল কান্তি বড়ুয়া প্রতি মাসে বিজ্ঞানের দুটি বিষয় পড়ানোর নামে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে তিন হাজার টাকা করে নেন। মতিঝিল আইডিয়ালের মূল শাখায় কোচিং ব্যবসা করেন দিবা শাখার দেলোয়ার হোসেন, আবুল কালাম আজাদ, রুকনুজ্জামান। রুকনুজামান বাংলা বিষয়ের শিক্ষক। কিন্তু তিনিও কোচিং ব্যবসা করেন। প্রভাতী শাখার নিজাম কামাল, রফিকুল ইসলামের নাম উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানের বনশ্রী শাখায় কলিম মোর্শেদ, মোয়াজ্জেম হোসেন, আবদুর রহীম উল্লেখযোগ্য।
কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করার বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে মাউশি থেকে একটি প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারি কর্মচারী বিধিমালা (আচরণ) ১৯৭৯-এর ১৭ বিধি অনুযায়ী কোনো সরকারি কর্মচারী সরকারের অনুমতি ছাড়া অন্য কোনো ব্যবসায় জড়িত হতে পারবে না। কোনো সরকারি কর্মচারী এর ব্যত্যয় ঘটালে আচরণ বিধিমালা লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত হবেন। একই সঙ্গে বেসরকারি শিক্ষকদের কোচিং বন্ধে আইন প্রণয়নের কথা বলা হয়েছে প্রতিবেদনে। কোচিংয়ের ক্ষেত্রে অভিভাবকদের নিরুৎসাহ করা, শিক্ষকদের পর্যাপ্ত বেতন-ভাতা দেওয়া এবং সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিতের কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত কমিয়ে ১ : ৩০ করার কথা বলা হয়েছে প্রতিবেদনে। শিক্ষার্থীর ফলাফল খারাপ হলে শ্রেণী শিক্ষককে জবাবদিহির আওতায় নিয়ে আসার কথাও বলা হয়েছে। কোচিং সেন্টারগুলোর ব্যানার, লিফলেট, সাইনবোর্ড অপসারণ ও প্রচার বন্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার কথাও বলা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.