মত দ্বিমত-সামগ্রিক বিবেচনায় ইতিবাচক by মইনুল ইসলাম

বাংলাদেশ-ভারত ট্রানজিট বা ট্রানশিপমেন্ট বিষয়ে সম্প্রতি উভয় দেশের সরকার এ বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে। একটি চুক্তিও সম্পাদিত হয়েছে। জাতীয় স্বার্থের বিবেচনায় বিষয়টির বিভিন্ন দিক নিয়ে এখনো বিতর্ক চলছে। এ প্রেক্ষাপটে ট্রানজিটের পক্ষে-বিপক্ষে দুটি লেখা প্রকাশ করা হলো।


বিষয়টা বাংলাদেশের জন্য উপকারী, এভাবে না বলে সামগ্রিকভাবে দেখা দরকার। ভারতের উত্তর-পূর্ব সাতটি রাজ্য এবং নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে সমুদ্রের যোগাযোগ ভারতের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এই বিচ্ছিন্নতা থেকে তাদের অর্থনৈতিক যোগাযোগ কীভাবে মুক্ত হতে পারে, সেটাই করা প্রয়োজন। আবার বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ভারতের ওই সাতটি রাজ্য যেভাবে মূল ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে, তা বাংলাদেশের ওপরে মুরগির গলার মতো ৫০ মাইলের সংকীর্ণ ভূখণ্ড দিয়ে পূরণ হচ্ছে না। তার ওপর ওই জায়গাটি খুবই দুর্গম। সুতরাং ট্রানজিট-ট্রানশিপমেন্টের প্রধান ফায়দাটা হলো পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতা দূর করা। সেদিক থেকে প্রধান উপকারটা ভারতের এই রাজ্যগুলোর এবং নেপাল ও ভুটানের। বাংলাদেশের প্রধান সুবিধা হলো, এই ট্রানজিট-ট্রানশিপমেন্ট থেকে অর্থনৈতিকভাবে সুবিধা নেওয়া। সড়ক-নৌ-রেল—তিনভাবে এই যোগাযোগের সুবিধা করে দিয়ে আমরা প্রভূত রাজস্ব আহরণ করতে পারব। অন্যদিকে ট্রান্সপোর্ট সার্ভিস রপ্তানি করে অর্থনৈতিক সুবিধাও আমরা পাব। প্রথমে বেশি না হলেও আশা করছি, দিনে দিনে বড় রকমের সুবিধা মিলবে। আবার এই যোগাযোগসেবা দেওয়ার মাধ্যমে আমাদের অবকাঠামোও গড়ে উঠবে। এদিক থেকে এটা একটা উইন উইন পরিস্থিতি, যেখানে ভারতও যেমন লাভবান হবে, তেমনি বাংলাদেশেরও ক্ষতি হবে না।
এর অন্য মাত্রা হলো, সমুদ্রপথের সঙ্গে এসব অঞ্চলের যোগাযোগ। আরেকটা মাত্রা হলো বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলের ভারতীয় রাজ্যগুলোর সঙ্গে পূর্ব দিকের ভারতীয় রাজ্যগুলোর মধ্যে যোগাযোগ সুগম হওয়া। বর্তমানে আমাদের সড়ক ও রেলপথের যে অবস্থা, তাতে আমরা এখনই সড়কপথে ট্রানজিট দেওয়ার অবস্থায় নেই। বর্তমান অবস্থায় ভারতের ভারী ট্রাকগুলো বহন করার মতো সড়ক-সেতু আমাদের নেই। সে জন্য যথাযথ উপযোগী সড়ক-সেতু-কালভার্ট যতক্ষণ না তৈরি করতে পারব, ততক্ষণ সড়কপথে ট্রানজিট কঠিন। সে জন্য এখন ট্রানশিপমেন্টের মাধ্যমে অথবা দুই দেশের মালিকানায় ট্রাক কোম্পানি গঠনের মাধ্যমে ট্রানজিট দেওয়ার ব্যবস্থা করার চিন্তাও আছে। দীর্ঘমেয়াদি যথাযথ হাইওয়ে ও সেতু তৈরির পরিকল্পনাও তাই নিতে হবে।
এখানে কথা উঠতে পারে যে, বাংলাদেশের সড়কব্যবস্থা যেখানে বর্তমানে নিজস্ব অর্থনীতির যোগাযোগ ও মালামাল পরিবহনের সুবিধা দিতে পারছে না, সেখানে অতিরিক্ত চাপ আমরা নিতে যাব কেন? সে জন্য যথাযথভাবে তাড়াতাড়ি সড়কপথ নির্মাণ করা দরকার। অন্যদিকে রেলপথের যে সংযোগ ১৯৬৫ সালের আগেও ছিল, সেটা পুনঃস্থাপন করে এবং যেখানে যেখানে ফাঁক আছে, সেটুকুতে রেলপথ বসিয়ে আমরা রেল-ট্রানজিট ব্যবহারের চিন্তা করতে পারি। তবে বর্তমানের যমুনা সেতু রেল বহনের উপযোগী নয়, সে জন্য আরেকটা যমুনা রেলসেতুর প্রয়োজন হবে।
ট্রানজিট মাশুলের বিষয়ে অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মসিউর রহমান অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি করলেন। এখানে শুল্কের কথা বলা হচ্ছে না, তবে যেসব বিভিন্ন সেবা দেব, সেগুলোর মাশুল নিতে অসুবিধা কী? পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে এ ধরনের ব্যবস্থা আছে। ভারতও মাশুল দিতে প্রস্তুত। ১৯৭২ সাল থেকে তারা নৌপথে মাশুল দিয়ে আসছে, এ ক্ষেত্রে সড়কপথে তা নিতে অসুবিধা থাকার কথা নয়। সেই মাশুলের পরিমাণ কত হবে, তা সরকারের বিভিন্ন কমিটি নির্ধারণ করছে। ট্রানজিট-ট্রানশিপমেন্টের মাধ্যমে ভারতের যদি বিশাল পরিমাণ সময় ও খরচ বেঁচে যায়, সেটা আমাদের সঙ্গে ন্যায্যভাবে বণ্টন করতে তাদেরও অসুবিধা হওয়ার কারণ নেই। অন্যদিকে এর জন্য আমাদেরও যে যে অসুবিধা হবে, তার মাশুল তো নেওয়াই যায়।
ট্রানজিটের বিষয়টা অতিমাত্রায় রাজনৈতিকীকৃত হয়ে গেছে। সবাইকে বুঝতে হবে, বাংলাদেশ তো তার প্রতিবেশী বেছে নিতে পারে না। প্রতিবেশীর একটা অসুবিধা যদি আমরা দূর করতে পারি, তার মাধ্যমে আমরাও যদি কিছু সুবিধা পাই, তাতে তো সমস্যা নেই। আর সেই প্রতিবেশী যখন বৃহৎ এক অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি, সেখানে লাভের পাল্লা যদি আমাদের কম হয়, তাতে রাজনৈতিকভাবে এটা সুফল বয়ে আনবে না। আমাদের দেশের রাজনীতির পারস্পরিক দোষারোপে রাজনৈতিক সংস্কৃতিও এর সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। এখানে আমার প্রস্তাব হলো, প্রতিবেশীদের মধ্যে যে রকম সমস্যা থাকে, আমাদের মধ্যেও সেটা আছে।
এখানে একটা মনোভাব আছে যে ভারত যত সুবিধা নিচ্ছে তার সামান্যও আমাদের দিতে কার্পণ্য করছে। সীমান্ত চুক্তিও আমরা যতটা পালন করি, তারা ততটা করেনি। অন্যদিকে ট্রানজিট-ট্রানশিপমেন্ট নিয়ে তাদের তাগিদ আমাদের থেকে বেশি। কিন্তু পানির ভাগাভাগির বেলায় আমরা ন্যায্য হিস্যা পাচ্ছি না। এসবের ব্যাপারে আমাদের প্রস্তাব হলো, শত্রুতার মাধ্যমে এই ন্যায্য হিস্যা আদায় করা যাবে না। অতীতের অভিজ্ঞতা সেটাই বলে। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মাধ্যমেই উপকার যা হওয়ার হবে। শত্রুতামূলক মনোভাবের মাধ্যমে ভারতকে কাবু করা যাবে না। তেমনিভাবে ভারতের কাঁটাতারের বেড়াকে আমরা অপমানজনক মনে করি। কিন্তু তাদের দিক থেকে অবৈধ অভিবাসীর সমস্যাও কম উদ্বেগজনক নয়।
উত্তর-পূর্ব ভারত আমাদের জন্য অসুবিধায় আছে, যোগাযোগের সুবিধা যদি তারা পায়, তাহলে তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে এবং তার সুফলও বাংলাদেশ পাবে। সিলেট-মেঘালয়ের পাহাড়জুড়ে চুনাপাথরের যে বিশাল খনি রয়েছে, ভৌগোলিক কারণে ভারত এই চুনাপাথর আহরণ করতে পারবে না। কিন্তু বাংলাদেশ ও ভারত এ ব্যাপারে যদি চুক্তিতে আসতে পারে, তাহলে উভয় দেশের যৌথ উদ্যোগে বিশাল সিমেন্টশিল্প গড়ে উঠতে পারে। আমরা এখন টিংকার আমদানি করে নিম্নমানের সিমেন্ট বানাচ্ছি, কিন্তু ভারতীয় চুনাপাথরের সুবিধা নিয়ে আমরা উন্নত মানের সিমেন্ট উৎপাদক হিসেবে আবির্ভূত হতে পারি। উত্তর-পূর্ব ভারতে বিশাল গ্যাসভান্ডার আছে। সুসম্পর্ক থাকলে এটার সুবিধাও আমরা পেতে পারি। চট্টগ্রাম বন্দর একসময় আসামও ব্যবহার করত। এটা ছিল আসাম রেলওয়ের সম্পত্তি।
আঞ্চলিক সহযোগিতার বিশাল সুযোগ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে, ট্রানজিট-ট্রানশিপমেন্ট দেওয়ার মাধ্যমে তার সূচনা হতে পারে। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিরাপত্তার বিষয়টাও সামাল দেওয়া সম্ভব; স্পর্শকাতর সামগ্রী যাতে আমাদের ভেতর দিয়ে পরিবাহিত হতে না পারে, তার তদারকি করা কঠিন কোনো কাজ নয়।
ড. মইনুল ইসলাম: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.