বৈদেশিক সম্পর্ক-কূটনৈতিক উত্তাপ প্রশমনে বিচক্ষণ পদক্ষেপ by আবুল হাসান চৌধুরী

উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোর অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য বাংলাদেশ কার্যকর সহায়তা দিতে পারে, ভারতের ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি মহলের পাশাপাশি নীতিনির্ধারক মহলেও সে বুঝ-বিবেচনা জোরালো হচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের রফতানি পণ্যের জন্য বিশেষ সুবিধা প্রদানে নয়াদিলি্লর কোনোভাবেই দ্বিধা করা উচিত নয়।


এ জন্য তাদের তরফে উদারতা দেখাতেই হবে। কিন্তু একই সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে যে, এ ধরনের পদক্ষেপে তাদের স্বার্থও যথেষ্ট


বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় কূটনৈতিক উত্তাপ দ্রুতই প্রশমিত হতে চলেছে বলে মনে হয়। এটা সম্ভবত জোর দিয়েই বলা যায় যে, দুই দেশের নেতৃত্ব রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টির পরিচয় দিয়েছেন। মনমোহন সিং সোমবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফোন করেছেন এবং জানিয়েছেন, 'পুরনো বন্ধুদের' সঙ্গে দেখা করতে তিনি উদগ্রীব। তিনি ঢাকা আসবেন ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এসএম কৃষ্ণ জানিয়েছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং খুবই আন্তরিক।
সত্যি বলতে কি, দুই প্রধানমন্ত্রীর টেলিফোন আলাপ এবং মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের তারিখ চূড়ান্ত করা কিংবা দুই দেশের বন্ধুত্বের বিষয়টিকে নতুন করে গুরুত্ব দিয়ে দু'তরফে কথা বলার ঘটনা আমার কাছে বিস্ময়ের কিছু মনে হয়নি। বরং বিস্ময় জেগেছিল ১ জুলাই মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সংক্রান্ত মন্তব্যে। বিজেপি নেতা অটল বিহারি বাজপেয়ি কিংবা এল কে আদভানি এমন মন্তব্য করলে সেটা স্বাভাবিক ছিল। তাদের যে রাজনৈতিক দর্শন ও দৃষ্টিভঙ্গি তেমন ঘরানার সঙ্গেই এটা খাটে। কিন্তু মনমোহন সিংকে যতটা জানি, ভারতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যম তাকে বিভিন্ন সময়ে যেভাবে তুলে ধরেছে তাতে 'বাংলাদেশের ২৫ শতাংশ মানুষ জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক, যারা অত্যন্ত ভারতবিদ্বেষী। দেশটিতে ছড়িয়ে রয়েছে আইএসআইর নানা রকম চক্রান্তের জাল। তাই যে কোনো সময় বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপট বদলে যেতে পারে'_ এমন মন্তব্য আশ্চর্য লেগেছে। তিনি বেশি শব্দ ব্যয় করেননি। কিন্তু অর্থপূর্ণ কথা বলেছেন, এমনটি বলাই যায়। আবার এ প্রশ্নও করা যায়, আদৌ কি তিনি কূটনীতির সূত্র অনুসরণ করে কথা বলেছেন? তার চেয়েও বড় প্রশ্ন, প্রতিবেশী একটি দেশ সম্পর্কে তার মূল্যায়ন কি যথার্থ হয়েছে? তিনি হঠাৎ করে এমন মন্তব্য করেছেন, সেটা বলা যাবে না। কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ সম্পাদকের সঙ্গে তার বৈঠকটি ছিল পূর্বনির্ধারিত এবং তিনি হোমওয়ার্ক করেই এসে থাকবেন। এ কারণেই বাংলাদেশ প্রসঙ্গে যা বলেছেন তা দুর্ভাগ্যজনক মনে হয়েছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ-ভারত এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে কিছুটা ওয়াকিবহাল থাকার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি যে, তাকে ভুল তথ্য-উপাত্ত জোগানোর কারণেই এমন বিপত্তি ঘটেছে। অনেকেই মনে করেন, দুই দেশের সম্পর্ক যে কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পেঁৗছাতে পারছে না, তার পথে অন্যতম প্রধান প্রতিবন্ধক সেখানের আমলাতন্ত্র, যারা যথেষ্ট শক্তিশালী বলে ধরে নেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে তারাই ক্রিয়াশীল ছিল তাতে সন্দেহ করা চলে না। মনমোহন সিংয়ের মতো বিজ্ঞ রাজনীতিক নিশ্চয়ই জানেন যে, একটি সার্বভৌম দেশ প্রসঙ্গে কী বলা যায় এবং কোথায় থেমে দাঁড়াতে হয়। বিভিন্ন দেশ সম্পর্কে ভারতের নিজস্ব মূল্যায়ন অবশ্যই রয়েছে। কোথায় তাদের সঙ্গে মিল এবং কোথায় দ্বিমত_ সে বিবেচনা তাদের। গত কয়েকদিনে ভারতের তরফে বিভিন্ন পদক্ষেপ থেকে স্পষ্ট যে, একটি ভুল যে হয়েছে সেটা দ্রুতই ধরে উঠতে পেরেছে এবং উত্তাপ প্রশমনে তৎপর হয়েছে।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক যেমন রয়েছে, তেমনি অমীমাংসিত সমস্যাও কম নয়। আমরা নিকট প্রতিবেশী। চিরকাল দুই দেশের সুসম্পর্ক বিরাজ করবে, এমন আদর্শ পরিস্থিতি বিরাজ করলে খুবই ভালো হয়। কিন্তু বাস্তবে তেমনটি নাও হতে পারে। দুই দেশের রয়েছে দীর্ঘ স্থল সীমানা। অর্ধশতাধিক নদ-নদী এবং বঙ্গোপসাগর নিয়েও সমস্যা রয়েছে। এসবের মতোই পুরনো হচ্ছে বাণিজ্য ঘাটতির ইস্যু। আমাদের সামান্য পরিমাণ পণ্যই ভারতে যায়, কিন্তু তাদের পণ্যে ভরপুর বাংলাদেশের এমনকি প্রত্যন্ত এলাকার বাজারও। তাই সম্পর্কে ওঠানামা থাকতেই পারে। তবে আকাঙ্ক্ষা থাকবে সুসম্পর্কের। এ কারণেই মাত্র ৬ কিলোমিটার সীমান্ত কেন যুগ যুগ ধরে অচিহ্নিত থাকবে, সে প্রশ্ন আমাকে বিব্রত করে। বঙ্গবন্ধুু হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি। একই সঙ্গে তিনি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গুরুত্ব উপলব্ধি করতেন। স্বাধীনতার পরপরই তিনি দুই দেশের সীমান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য উদার মনোভাবের পরিচয় দেন। ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে জননেত্রী শেখ হাসিনা যে গঙ্গা নদীর পানি বণ্টনের জন্য দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি সম্পাদনে সক্ষম হন, তার পেছনেও কাজ করেছে একই মনোভাব। মনমোহন সিংয়ের আসন্ন সফরের সময় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নদী তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়ে চুক্তি সই হবে বলে আশা করা যায়। সংবাদপত্রে যে খবর প্রকাশ হয়েছে তাতে ১৫ বছরের জন্য একটি সমঝোতা হওয়ার কথা। তবে আমার মনে হয়, এর মেয়াদ আরও বাড়ানো ভালো হবে। কিংবা এভাবেও হতে পারে যে, 'সমঝোতার ভিত্তিতে আরেকটি চুক্তি সই না হওয়া পর্যন্ত' তা বলবৎ থাকবে। সীমান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির পাশাপাশি 'ফালানি ইস্যু' চিরতরে বন্ধ হওয়াও গুরুত্বপূর্ণ। এ ধরনের নিষ্ঠুর ঘটনা এমনকি দুটি যুদ্ধরত দেশের মধ্যেও গ্রহণযোগ্য হয় না। আমরা যতই বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তুলতে সচেষ্ট হই না কেন, এ ধরনের একটি ঘটনাই তাতে পানি ঢেলে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। তাতে জনগণ ভুল বার্তা পায় এবং আস্থার সম্পর্ক সৃষ্টির যাবতীয় প্রচেষ্টা ভণ্ডুল হয়ে যেতে পারে।
বাণিজ্য ঘাটতির বিষয়টির সুরাহা দরকার। ভারতের অর্থনীতি এখন বিশ্ব অর্থনীতির সম্মুখসারির দেশগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে চলেছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির সম্ভাবনাও ভালো। আমরা এখন বার্ষিক ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে পারছি এবং তা অর্জন অসম্ভব মনে হয় না। উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোর অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য বাংলাদেশ কার্যকর সহায়তা দিতে পারে, ভারতের ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি মহলের পাশাপাশি নীতিনির্ধারক মহলেও সে বুঝ-বিবেচনা জোরালো হচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের রফতানি পণ্যের জন্য বিশেষ সুবিধা প্রদানে নয়াদিলি্লর কোনোভাবেই দ্বিধা করা উচিত নয়। এ জন্য তাদের তরফে উদারতা দেখাতেই হবে। কিন্তু একই সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে যে, এ ধরনের পদক্ষেপে তাদের স্বার্থও যথেষ্ট।
বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কে মাঝে মধ্যে টানাপড়েন সৃষ্টি হলেও এটা আমরা কখনোই বিস্মৃত হই না যে, এর সূচনা হয়েছে আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়ে। রক্তের অটুট বন্ধনে আমাদের সম্পর্ক বাঁধা পড়ে আছে, এ কথা বলিষ্ঠ কণ্ঠে উচ্চারণে দ্বিধা নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্পষ্ট ভাষায় কথা বলতে অভ্যস্ত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য ভারতের অবদান স্বীকার করতে তিনি কখনও দ্বিধা করেন না। মনমোহন সিংয়ের সফরের সময়ও এ কথা বলবেন। এ ক্ষেত্রে কোনো হীনমন্যতাবোধ নেই তার। জাতি হিসেবেও আমাদের তা থাকার অবকাশ নেই। এটা ঠিক যে, দেশের সঙ্গেই দেশের সম্পর্ক হয়, দলের সঙ্গে নয়। কিন্তু এটাও সত্য যে, একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিল আওয়ামী লীগ এবং সে সময়ে ভারতে ক্ষমতাসীন দল ছিল জাতীয় কংগ্রেস এবং এখনও তারাই নয়াদিলি্লতে কোয়ালিশন সরকারের নেতৃত্ব দিচ্ছে। এই দলের সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী মনমোহন সিংয়ের সফরের আগেই বাংলাদেশ আসছেন। বন্ধুত্ব জোরদারে এ সুযোগকে কাজে লাগাতেও উভয় পক্ষ সচেষ্ট হবে, এ প্রত্যাশা থাকবে। দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নে অনেক কিছুই করার রয়েছে। দুই দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব্ব তা সম্পাদনে নিশ্চয়ই পিছপা হবেন না। আমলাতন্ত্রের তরফে যেসব বাধা সৃষ্টি হয় তা দূর করার ক্ষেত্রে তাদের আন্তরিক উদ্যোগ বিশেষভাবে কার্যকর হতে পারে।

আবুল হাসান চৌধুরী : বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী
 

No comments

Powered by Blogger.