চালচিত্র-এই সড়ক অবরোধ, জনদুর্ভোগ, এই অস্থিরতা by শুভ রহমান
সমাজে অস্থিরতা জন্ম নিচ্ছে এখন প্রায় প্রতিমুহূর্তেই। বস্তি উচ্ছেদ হবে, বিপন্ন হাজারো মানুষ রাস্তায় নেমে এলো, শুয়ে পড়ল সড়ক অবরোধ করে। বন্ধ থাকল যানবাহন চলাচল ঘণ্টার পর ঘণ্টা। প্রশাসন অসহায়। জনদুর্ভোগ চরমে। সম্প্রতি রাজধানীর কড়াইল এলাকায় অবৈধ বসতি স্থাপনকারী বস্তিবাসীদের উচ্ছেদ করা নিয়ে এ অমানবিক
পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। আর যখন-তখন এখানে-সেখানে বিক্ষুব্ধ গার্মেন্ট শ্রমিকদের, হঠাৎ হঠাৎ অনেক রাস্তায় বিকল্প ব্যবস্থা না করেই রিকশা ও ভ্যান গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দেওয়া নিয়েও চলে সড়ক অবরোধ ও তুলকালাম কাণ্ড।
কদিন আগে সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলার শ্রীপুর ইউনিয়নে স্বাধীনতা দিবসে আবুল মনসুর আহমদের বিখ্যাত নাটক 'হুজুর কেবলা' মঞ্চস্থ করা নিয়ে সাম্প্রদায়িক অপশক্তি স্থানীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা চালায়, তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয় ও লুটপাট চালায়। স্থানীয় একটি পত্রিকায় ধর্মভিত্তিক দলগুলোর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত উগ্র সাম্প্রদায়িক প্রচারণা ও ইন্ধন এর পেছনে কাজ করে। রাজধানীর একটি পত্রিকা মারফত এ ঘটনার খবর জানতে পারলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এর প্রতিবাদে শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নেয় ও সড়ক অবরোধ করে। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, শাহবাগ থানা ও পুলিশের রমনা জোনের আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে দুই ঘণ্টা পর দুপুরে অবরোধ তুলে নেওয়া হয়। এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শিক্ষার্থীদের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে তাদের অবরোধ তুলে নিতে অনুরোধ করেন।
চার্লস ডিকেন্সের 'এ টেল অব টু সিটিজ'-এর চিত্ররূপ দেখেছিলাম গেল শতাব্দীর ষাটের দশকে। ঝড়ের গতিতে একটা অশ্বচালিত কোচ ছুটে যাচ্ছে, তার ভেতর থেকে গড়িয়ে পড়ে গেল রাস্তায় দুটো মদের পিপে, অমনি জীর্ণ পোশাকের ভিখারিসদৃশ একদল লোক রাস্তা থেকে হামলে পড়ে পিপে দুটো থেকে ফেটে বেরোনো মদ আঁজলা করে বুভুক্ষু-পিপাসার্তের মতো খেতে লাগল। সে মুহূর্তেই পর্দার ওপর বড় একটি শুধু প্রশ্নচিহ্ন আঁকা হয়ে গেল, সঙ্গে সাদা-কালোয় লেখা, 'হোয়াই'। এ রকম পর পর কয়েকটি সামাজিক বিশৃঙ্খল অবস্থার দৃশ্যপট ও সঙ্গে সেলুলয়েডে লেখা প্রশ্নচিহ্ন, 'হোয়াই' ফুটে উঠতে থাকার পর শুরু হলো চিত্রের আসল কাহিনী, যা গোটা সমাজবিপ্লবেই পরিণত রূপ নেয়। অত্যাচারী শাসকদের কজনের গিলোটিনে ফাঁসির মধ্য দিয়ে ছবির পরিসমাপ্তি ঘটে। আমাদের আজকের সামাজিক অস্থিরতার প্রতিটির সঙ্গেও যেন অদৃশ্য পর্দায় একই রকম 'হোয়াই' বা প্রশ্নবোধক 'কেন' ফুটে উঠছে। সময় এর জবাব চাইছে। তাৎক্ষণিকভাবে প্রশাসন বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপে একেকটা ঘটনার আপাত নিরসন ঘটতে দেখা গেলেও তা যে সাময়িক মাত্র, অচিরেই সমাজের অন্যত্র অন্য একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে একই ধরনের সড়ক অবরোধ, জনদুর্ভোগ আর সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়ে তা প্রমাণ করে দিচ্ছে। আসলে এ সমাজটাও একটা জীর্ণ পরিধেয়র মতোই বদলানোর অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে।
বস্তি উচ্ছেদের বহু আগেই অবৈধ বসতি স্থাপন কী করে হতে পারছে, গ্রাম থেকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, নদীভাঙন, অত্যাচারী গ্রাম্য-টাউট, জোতদার-মহাজনদের দৌরাত্ম্য উচ্ছেদ হয়ে দুমুঠো অন্ন আর আশ্রয়ের জন্য শহরে ছুটে আসা ছিন্নমূল মানুষের স্রোত কী করে ঠেকানো যায়, সে চিন্তা করাটা জরুরি হয়ে পড়েছে। নিঃসন্দেহে অনেক দেরি হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই- এই স্রোতকে রোখার এবং আবার গ্রামমুখী করার; কিন্তু উপায় কী, একে গ্রামমুখী না করে তো এখন আর কোনো বিকল্পই নেই। এখানে আসার পর নিরন্ন-নিরাশ্রয় মানুষগুলো স্ত্রী-পুত্র-পরিবার-পরিজন নিয়ে মরিয়া হয়ে, উপায়ান্তর না দেখে কোনো আইনের, কোনো ন্যায়নীতির ধার না ধেরে, ফাঁকা জায়গা পেলেই মাথা গোঁজার একটা ব্যবস্থা নিজেদের উদ্যোগেই করে ফেলেছে। তার পরও দীর্ঘ সময় চলে গেছে, নানা কায়েমি স্বার্থ তাদের প্রকারান্তরে অবৈধ বসতি গড়তে মদদই জুগিয়েছে। এখন অকস্মাৎ তাদের ওপর উচ্ছেদের বুলডোজার চালালে তারা মানবে কেন? এমনি দশাই বারবার হয়ে চলেছে এ সমাজে। প্রশাসন দেখেও দেখে না, জেনেও জানে না, অকস্মাৎ টনক নড়ে- শহর, জনপদ উন্নয়নের তাগিদে বুলডোজার চালাতে হবে ওই হতভাগ্যদের ওপরই। অথচ দীর্ঘ একটা সময় ধরেই সেই বসতিগুলোয় গড়ে উঠেছে মায়া-মমতা, সুখ-দুঃখ ও হাসি-কান্নার সংসার। মানব সন্তানেরই তো সংসার সেসব। মানব সভ্যতা যে কত অন্ধ, হৃদয়হীন তা চাপা পড়ে থাকছে মূক, বধির ও পাষাণের ইতিহাসের নিচে।
সাম্প্রদায়িকতার হিংস্র, অমানবিক অপশক্তি সব সময় একসঙ্গে সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। সাতক্ষীরার কালীগঞ্জের শ্রীপুর ইউনিয়নে নাটক মঞ্চায়নকে কেন্দ্র করে ফণা তুলেছে সে বিষধর। তাদের ছোবলের নীল দংশনে কত পরিবার নিষ্প্রাণ-নিথর হয়ে গেছে। সমাজে এই অপশক্তি মরেনি। ২০০১-এর নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতিতে বরিশাল, চট্টগ্রাম, ফরিদপুরে ক্ষতবিক্ষত করেছে, ভিটেমাটিছাড়া করে দেশত্যাগে বাধ্য করেছে কত শত অসহায় পরিবারকে। সে অপশক্তি মরেনি। এখনো সুযোগ পেলেই তাণ্ডব চালাচ্ছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে, কালীগঞ্জের শ্রীপুরে। এদের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকতে পারে না কোনো গণতান্ত্রিক সরকারই। শ্রীপুরের ঘটনা আবারও প্রমাণ করল, বিপুল গণম্যান্ডেটের অধিকারী হয়েও মহাজোট সরকার, কার্যত উপরসা শাসনই চালাচ্ছে, সমাজের গভীর থেকে, জড় গেড়ে বসা বিভিন্ন স্তর থেকে উগ্র, ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক শক্তিকে নির্মূল করার ব্যাপারে ক্ষমাহীন উদাসীনতাই প্রদর্শন করে চলেছে। তাদের অপরিণামদর্শিতায় আজ স্থবির, অচল হয়ে যাচ্ছে হঠাৎ হঠাৎ নগরীর প্রাণপ্রবাহ। কর্তৃপক্ষের ভুয়া আশ্বাস, স্তোকবাক্য নেহাত উপরসা একটা গোঁজামিল দিয়েই মাত্র তাৎক্ষণিকভাবে সমস্যার একটা আপাত সুরাহা করছে- মূল সমস্যা অনড়, প্রতিকারহীনই থেকে যাচ্ছে। এসব দৃশ্যপটেও যে অদৃশ্য পর্দায় একটা বিশাল প্রশ্নবোধক 'কেন' ফুটে উঠছে, তা দেখার মতো অন্তর্দৃষ্টি, অন্তর্ভেদী দৃষ্টি ক্ষমতাধরদের নেই।
তার পরও নিঃসন্দেহে উপায় আছে, উপায় একটা বের করতেই হবে। প্রকৃত গণতান্ত্রিক শক্তির হাতেই মাত্র সেই উপায় বের করার জাদুমন্ত্র রয়েছে, আর কারো হাতে নেই। তারা ব্যর্থ হলে তার সুযোগ নেবে নৈরাজ্যের শক্তি, ব্যর্থ করে দেবে চলমান গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে, ধ্বংস করে দেবে গণতন্ত্রকে। যে মহাজোট সরকার একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের, যুদ্ধাপরাধের বিচার করছে, সমাজকে অপরাধমুক্ত করার ব্রত নিয়ে সব নিন্দা-অপবাদের মোকাবিলা করে যাচ্ছে- তারা হাল ছাড়বে কেন! তাদের পারতেই হবে, সমাজের আপাত জটিল, অনেক দুর্লঙ্ঘ্য হয়ে ওঠা সব সমস্যাই দৃঢ়ভাবে মোকাবিলা করতে হবে, বস্তুনিষ্ঠভাবে ছিন্নমূল মানুষের পুনর্বাসনের স্থায়ী সমস্যা সমাধানে মনোনিবেশ করতেই হবে, সর্বস্তর থেকে সুযোগসন্ধানী হিংস্র সাম্প্রদায়িক ও নৈরাজ্যের শক্তির মূলোৎপাটনে গভীর দেশপ্রেম ও প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের সঙ্গে তৎপর হতে হবে। বিরোধী নেতিবাচক রাজনীতির হঠকারী অদেশপ্রেমমূলক, প্ররোচনামূলক বক্তব্য দেশকে, সমাজকে প্রকৃত মুক্তি এনে দিতে পারে না। সম্পূর্ণ গঠনমূলক, জনসম্পৃক্ত, গভীর মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক রাজনীতি দিয়েই মাত্র ধাত্রীর নতুন সন্তান ভূমিষ্ঠ করানোর মতোই প্রগাঢ়তম দায়িত্ববোধ ও মমতার সঙ্গে নতুন সমাজ গড়ার কাজটি করতে হবে। সমাজের খোলনলচে অবশ্যই পাল্টাতে হবে, তবে তা বিজ্ঞানসম্মতভাবেই, ধ্বংসাত্মক পন্থায় নয়।
০৭.৪.২০১২
কদিন আগে সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলার শ্রীপুর ইউনিয়নে স্বাধীনতা দিবসে আবুল মনসুর আহমদের বিখ্যাত নাটক 'হুজুর কেবলা' মঞ্চস্থ করা নিয়ে সাম্প্রদায়িক অপশক্তি স্থানীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা চালায়, তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয় ও লুটপাট চালায়। স্থানীয় একটি পত্রিকায় ধর্মভিত্তিক দলগুলোর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত উগ্র সাম্প্রদায়িক প্রচারণা ও ইন্ধন এর পেছনে কাজ করে। রাজধানীর একটি পত্রিকা মারফত এ ঘটনার খবর জানতে পারলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এর প্রতিবাদে শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নেয় ও সড়ক অবরোধ করে। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, শাহবাগ থানা ও পুলিশের রমনা জোনের আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে দুই ঘণ্টা পর দুপুরে অবরোধ তুলে নেওয়া হয়। এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শিক্ষার্থীদের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে তাদের অবরোধ তুলে নিতে অনুরোধ করেন।
চার্লস ডিকেন্সের 'এ টেল অব টু সিটিজ'-এর চিত্ররূপ দেখেছিলাম গেল শতাব্দীর ষাটের দশকে। ঝড়ের গতিতে একটা অশ্বচালিত কোচ ছুটে যাচ্ছে, তার ভেতর থেকে গড়িয়ে পড়ে গেল রাস্তায় দুটো মদের পিপে, অমনি জীর্ণ পোশাকের ভিখারিসদৃশ একদল লোক রাস্তা থেকে হামলে পড়ে পিপে দুটো থেকে ফেটে বেরোনো মদ আঁজলা করে বুভুক্ষু-পিপাসার্তের মতো খেতে লাগল। সে মুহূর্তেই পর্দার ওপর বড় একটি শুধু প্রশ্নচিহ্ন আঁকা হয়ে গেল, সঙ্গে সাদা-কালোয় লেখা, 'হোয়াই'। এ রকম পর পর কয়েকটি সামাজিক বিশৃঙ্খল অবস্থার দৃশ্যপট ও সঙ্গে সেলুলয়েডে লেখা প্রশ্নচিহ্ন, 'হোয়াই' ফুটে উঠতে থাকার পর শুরু হলো চিত্রের আসল কাহিনী, যা গোটা সমাজবিপ্লবেই পরিণত রূপ নেয়। অত্যাচারী শাসকদের কজনের গিলোটিনে ফাঁসির মধ্য দিয়ে ছবির পরিসমাপ্তি ঘটে। আমাদের আজকের সামাজিক অস্থিরতার প্রতিটির সঙ্গেও যেন অদৃশ্য পর্দায় একই রকম 'হোয়াই' বা প্রশ্নবোধক 'কেন' ফুটে উঠছে। সময় এর জবাব চাইছে। তাৎক্ষণিকভাবে প্রশাসন বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপে একেকটা ঘটনার আপাত নিরসন ঘটতে দেখা গেলেও তা যে সাময়িক মাত্র, অচিরেই সমাজের অন্যত্র অন্য একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে একই ধরনের সড়ক অবরোধ, জনদুর্ভোগ আর সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়ে তা প্রমাণ করে দিচ্ছে। আসলে এ সমাজটাও একটা জীর্ণ পরিধেয়র মতোই বদলানোর অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে।
বস্তি উচ্ছেদের বহু আগেই অবৈধ বসতি স্থাপন কী করে হতে পারছে, গ্রাম থেকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, নদীভাঙন, অত্যাচারী গ্রাম্য-টাউট, জোতদার-মহাজনদের দৌরাত্ম্য উচ্ছেদ হয়ে দুমুঠো অন্ন আর আশ্রয়ের জন্য শহরে ছুটে আসা ছিন্নমূল মানুষের স্রোত কী করে ঠেকানো যায়, সে চিন্তা করাটা জরুরি হয়ে পড়েছে। নিঃসন্দেহে অনেক দেরি হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই- এই স্রোতকে রোখার এবং আবার গ্রামমুখী করার; কিন্তু উপায় কী, একে গ্রামমুখী না করে তো এখন আর কোনো বিকল্পই নেই। এখানে আসার পর নিরন্ন-নিরাশ্রয় মানুষগুলো স্ত্রী-পুত্র-পরিবার-পরিজন নিয়ে মরিয়া হয়ে, উপায়ান্তর না দেখে কোনো আইনের, কোনো ন্যায়নীতির ধার না ধেরে, ফাঁকা জায়গা পেলেই মাথা গোঁজার একটা ব্যবস্থা নিজেদের উদ্যোগেই করে ফেলেছে। তার পরও দীর্ঘ সময় চলে গেছে, নানা কায়েমি স্বার্থ তাদের প্রকারান্তরে অবৈধ বসতি গড়তে মদদই জুগিয়েছে। এখন অকস্মাৎ তাদের ওপর উচ্ছেদের বুলডোজার চালালে তারা মানবে কেন? এমনি দশাই বারবার হয়ে চলেছে এ সমাজে। প্রশাসন দেখেও দেখে না, জেনেও জানে না, অকস্মাৎ টনক নড়ে- শহর, জনপদ উন্নয়নের তাগিদে বুলডোজার চালাতে হবে ওই হতভাগ্যদের ওপরই। অথচ দীর্ঘ একটা সময় ধরেই সেই বসতিগুলোয় গড়ে উঠেছে মায়া-মমতা, সুখ-দুঃখ ও হাসি-কান্নার সংসার। মানব সন্তানেরই তো সংসার সেসব। মানব সভ্যতা যে কত অন্ধ, হৃদয়হীন তা চাপা পড়ে থাকছে মূক, বধির ও পাষাণের ইতিহাসের নিচে।
সাম্প্রদায়িকতার হিংস্র, অমানবিক অপশক্তি সব সময় একসঙ্গে সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। সাতক্ষীরার কালীগঞ্জের শ্রীপুর ইউনিয়নে নাটক মঞ্চায়নকে কেন্দ্র করে ফণা তুলেছে সে বিষধর। তাদের ছোবলের নীল দংশনে কত পরিবার নিষ্প্রাণ-নিথর হয়ে গেছে। সমাজে এই অপশক্তি মরেনি। ২০০১-এর নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতিতে বরিশাল, চট্টগ্রাম, ফরিদপুরে ক্ষতবিক্ষত করেছে, ভিটেমাটিছাড়া করে দেশত্যাগে বাধ্য করেছে কত শত অসহায় পরিবারকে। সে অপশক্তি মরেনি। এখনো সুযোগ পেলেই তাণ্ডব চালাচ্ছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে, কালীগঞ্জের শ্রীপুরে। এদের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকতে পারে না কোনো গণতান্ত্রিক সরকারই। শ্রীপুরের ঘটনা আবারও প্রমাণ করল, বিপুল গণম্যান্ডেটের অধিকারী হয়েও মহাজোট সরকার, কার্যত উপরসা শাসনই চালাচ্ছে, সমাজের গভীর থেকে, জড় গেড়ে বসা বিভিন্ন স্তর থেকে উগ্র, ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক শক্তিকে নির্মূল করার ব্যাপারে ক্ষমাহীন উদাসীনতাই প্রদর্শন করে চলেছে। তাদের অপরিণামদর্শিতায় আজ স্থবির, অচল হয়ে যাচ্ছে হঠাৎ হঠাৎ নগরীর প্রাণপ্রবাহ। কর্তৃপক্ষের ভুয়া আশ্বাস, স্তোকবাক্য নেহাত উপরসা একটা গোঁজামিল দিয়েই মাত্র তাৎক্ষণিকভাবে সমস্যার একটা আপাত সুরাহা করছে- মূল সমস্যা অনড়, প্রতিকারহীনই থেকে যাচ্ছে। এসব দৃশ্যপটেও যে অদৃশ্য পর্দায় একটা বিশাল প্রশ্নবোধক 'কেন' ফুটে উঠছে, তা দেখার মতো অন্তর্দৃষ্টি, অন্তর্ভেদী দৃষ্টি ক্ষমতাধরদের নেই।
তার পরও নিঃসন্দেহে উপায় আছে, উপায় একটা বের করতেই হবে। প্রকৃত গণতান্ত্রিক শক্তির হাতেই মাত্র সেই উপায় বের করার জাদুমন্ত্র রয়েছে, আর কারো হাতে নেই। তারা ব্যর্থ হলে তার সুযোগ নেবে নৈরাজ্যের শক্তি, ব্যর্থ করে দেবে চলমান গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে, ধ্বংস করে দেবে গণতন্ত্রকে। যে মহাজোট সরকার একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের, যুদ্ধাপরাধের বিচার করছে, সমাজকে অপরাধমুক্ত করার ব্রত নিয়ে সব নিন্দা-অপবাদের মোকাবিলা করে যাচ্ছে- তারা হাল ছাড়বে কেন! তাদের পারতেই হবে, সমাজের আপাত জটিল, অনেক দুর্লঙ্ঘ্য হয়ে ওঠা সব সমস্যাই দৃঢ়ভাবে মোকাবিলা করতে হবে, বস্তুনিষ্ঠভাবে ছিন্নমূল মানুষের পুনর্বাসনের স্থায়ী সমস্যা সমাধানে মনোনিবেশ করতেই হবে, সর্বস্তর থেকে সুযোগসন্ধানী হিংস্র সাম্প্রদায়িক ও নৈরাজ্যের শক্তির মূলোৎপাটনে গভীর দেশপ্রেম ও প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের সঙ্গে তৎপর হতে হবে। বিরোধী নেতিবাচক রাজনীতির হঠকারী অদেশপ্রেমমূলক, প্ররোচনামূলক বক্তব্য দেশকে, সমাজকে প্রকৃত মুক্তি এনে দিতে পারে না। সম্পূর্ণ গঠনমূলক, জনসম্পৃক্ত, গভীর মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক রাজনীতি দিয়েই মাত্র ধাত্রীর নতুন সন্তান ভূমিষ্ঠ করানোর মতোই প্রগাঢ়তম দায়িত্ববোধ ও মমতার সঙ্গে নতুন সমাজ গড়ার কাজটি করতে হবে। সমাজের খোলনলচে অবশ্যই পাল্টাতে হবে, তবে তা বিজ্ঞানসম্মতভাবেই, ধ্বংসাত্মক পন্থায় নয়।
০৭.৪.২০১২
No comments