ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের মন্তব্য-দিলি্লর মানসিকতা বদলাতে হবে by মিহির এস শর্মার

নয়াদিলি্লতে অপর পাঞ্জাবের কবিরাও পূজিত হন এবং সীমান্তের ওপারে ফেলে আসা বাড়িঘরের স্মৃতিতে তারা এখনও এক ধরনের নস্টালজিয়ায় ভোগেন। আরেক অভিন্ন সংস্কৃতি তাদের কাছে প্রাসঙ্গিক হয়ে ধরা দেয় না। এই সংস্কৃতি সম্ভবত আরও সমৃদ্ধ এবং অনেক বেশিসংখ্যক ভারতীয় এটা শেয়ার করে।


এই সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তের এপার-ওপার বিস্তৃত


একশ' বছর আগে ব্রিটিশরা ভারতবর্ষের রাজধানী কলকাতা থেকে দিলি্লতে স্থানান্তর করে। বিপজ্জনক উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে সম্পর্কিত উত্তরাঞ্চলের তামাটে সমভূমির একটি শহরে কেন্দ্রীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মধ্য দিয়ে সূক্ষ্মভাবে ভারতের পররাষ্ট্রনীতিও সেই বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে পড়ে এবং আজকেও একই অবস্থা বিরাজ করছে। কখনও কখনও মনে হবে, দিলি্লর সবাই যেন পাকিস্তান বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। এমনকি যারা দক্ষিণে বেড়ে উঠেছেন তারাও ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের কবিতা আবৃত্তি করতে পারেন ও পাকিস্তানের হুদদ অধ্যাদেশ নিয়ে আলোচনা করতে পারেন। এই একই সময়ে প্রায় সমান গুরুত্বের ও অনেক বেশি বন্ধুভাবাপন্ন এক পূর্বাঞ্চলীয় প্রতিবেশীর দিকে দৃশ্যত নয়াদিলি্ল মুখ ঘুরিয়ে থাকে।
প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ২৫ শতাংশ বাংলাদেশিকে 'ভারতবিরোধী' হিসেবে চিত্রিত করার মধ্য দিয়ে বস্তুত নয়াদিলি্লর নীতিনির্ধারকদের কাছে তথ্য-উপাত্ত যারা জোগান দেন তাদের মধ্যে যে এখনও সেই পুরনো মানসিকতা চেপে বসে আছে তা ধরা পড়ে। মনমোহন তার বক্তব্যে যে জামায়াতে ইসলামীকে কেন্দ্রবিন্দু করেছেন তারা কখনও বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনে ৬ শতাংশের বেশি ভোট পায়নি। তদুপরি বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষ ক্ষেত্র হ্রাস পায়নি, বরং সম্প্রসারণমান। এর ইঙ্গিত মেলে গত বছর সুপ্রিম কোর্টের রায়ে সংবিধানের মৌলিক ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় বলে একটি সংবিধান সংশোধনীকে বাতিল করে দেওয়ার মাধ্যমে। বাংলাদেশের এই আত্মানুসন্ধানের লড়াই নতুন নয়। তবে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য থেকে মনে হয় নয়াদিলি্ল এখনও বাংলাদেশের গতিশীল বাস্তব পরিস্থিতি সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারেনি।
বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ৪০ বছর পরও এর প্রথম দিককার ক্ষতগুলো এখনও মিলিয়ে যায়নি। সুপ্রিম কোর্ট যে সংশোধনী বাতিল করে দেন সেটির মাধ্যমে জিয়াউর রহমানের রক্তস্নাত সামরিক একনায়কত্বকে বৈধতা দেওয়া হয়েছিল। শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের প্রায় সব সদস্য নৃশংসভাবে খুন হওয়ার পর জিয়ার ক্ষমতায় আরোহণ ঘটে। আর এখনকার বাস্তবতা হলো এই জিয়ারই বিধবা পত্নী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) মুজিবের কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে রাস্তার আন্দোলনে রয়েছে, হরতাল ডেকেছে। এদিকে মুজিব হত্যাকারীদের গত বছর ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড হামলা মামলায় বিতর্কিতভাবে অভিযুক্ত করা হয়েছে খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমানকে। দেশটি এখনও রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত হয়েই রয়েছে। এই বিভক্তি কতটা গভীর তা দু'পক্ষের লোকজনের পোশাক-পরিচ্ছদের দিকে তাকালেই ধরা পড়বে। আওয়ামী লীগাররা পরে নেহরু কোটের আদলে মুজিব কোট আর বিএনপির নেতাকর্মীরা পরে সাফারি। এই বিভক্তির প্রেক্ষাপটে দেশটির ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র, ভারতের দিকে তার ওরিয়েন্টেশন ও জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকা_ স্বাধীনতা যুদ্ধের সেই দিনগুলোতে তাদের কর্মকাণ্ড, মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পক্ষে তাদের অবস্থান গ্রহণ ঘৃণা কুড়িয়েছিল_ এসবই ধীরেসুস্থে সমাধানের চিন্তা করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ব্যবহৃত শব্দগুলো কেবল ত্রুটিপূর্ণই নয়, সেখানে পরিসংখ্যানও অতিরঞ্জিত করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপট যে কোনো সময় পাল্টে যেতে পারে। এটা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে একটি অনিশ্চিত অবস্থা তুলে ধরার শামিল। ভারতের নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধির স্বার্থেই বাংলাদেশের সঙ্গে সরকার নির্বিশেষে নয়াদিলি্লর উন্নত সম্পর্ক অবশ্যই গড়ে তুলতে হবে_ এ ধারণাটা নয়াদিলি্লর এখনও সম্ভবত উপলব্ধিতে নেই বলেই মনমোহন সিং এ ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন।
তবে এটা ঠিক যে, এবার আওয়ামী লীগের সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নয়াদিলি্লকে সম্পর্কোন্নয়নের সুযোগ গ্রহণে উৎসাহিত করে থাকতে পারে। প্রধানমন্ত্রী কি তার বক্তব্যের মধ্য দিয়ে দ্রুত সম্পর্কোন্নয়নের উদ্যোগের বার্তাটিই দিতে চেয়েছেন? অবশ্য গত বছর ভারতে শেখ হাসিনার যুগান্তকারী সফরের পর থেকে কথার ফুলঝুরি ছোটানো ছাড়া তেমন লক্ষণীয় কিছু অর্জিত হয়নি। ইসলামী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যৌথ সহযোগিতা ও বিদ্যুৎ জেনারেশনকে ফোকাস করে পাঁচটি চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে। সীমানা নির্ধারণ ও বাণিজ্য ট্রানজিট বিষয় সমাধানের কথা হয়।
এরপর ভারত এসব বিষয় দ্রুত নিষ্পত্তির পথ না ধরে এর উল্টোটাই করে। প্রত্যেক বিষয়ে বাংলাদেশকেই সহযোগিতা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ভিত্তি গড়ার উদ্যোগ নিতে দেখা যায়। তারা যেসব বিষয়ে উভয়পক্ষ সহমত হয়েছিল সেগুলো অর্জনের চেষ্টা চালায়। আর প্রত্যেকবারই দেখা যায় ভারত এ ব্যাপারে তার ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হচ্ছে। আর যাওবা করে তাও অনেক ঢিমেতালে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, হাসিনার সফরের পর প্রায় এক বছর চলে গেলেও ভারতের গড়িমসির কারণে সীমান্ত নিয়ে আলোচনা স্থবির হয়ে আছে।
বাণিজ্য ও ট্রানজিট বিষয়েও ভারতের ভূমিকা হতাশাজনক। ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রী আনন্দ শর্মার সঙ্গে আলোচনা অসমাপ্ত রেখেই কূটনৈতিক প্রটোকল ভেঙে যখন বাংলাদেশের বাণিজ্যমন্ত্রী বেরিয়ে পড়েন ও ত্রুক্রদ্ধস্বরে বলেন যে, ভারত যেটুকু ছাড় দিতে রাজি হয়েছে তা অপ্রতুল, তার অর্থ বুঝতে কষ্ট হয় না। শর্মা বাংলাদেশের টেক্সটাইল কোটা যৎসামান্য বাড়িয়েই ভাব করেন যে অনেক দেওয়া হয়েছে। অথচ এই ছাড়টা বাংলাদেশের প্রত্যাশার ভগ্নাংশ মাত্র। তামিলনাড়ূর টেক্সটাইল লবি, বিশেষ করে কোইমবাটোর ও সালিমভিত্তিক লবি বাংলাদেশি টেক্সটাইল আমদানির বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ ছিল। মনে হয়, এরাই ভারতের বাণিজ্য নীতি এবং পরিণতিতে পররাষ্ট্রনীতিকে চাপ দিয়ে বিকৃত করে। বিভিন্ন ধরনের শুল্ক ও অশুল্ক বাধা ভারতের সঙ্গে তার প্রতিবেশীদের আরও উন্মুক্ত বাণিজ্য গড়ে তোলার পথে বাধা হয়ে রয়েছে। এতে ধারণা তৈরি হয়েছে যে, ভারত এমনটাই চায়। কিন্তু এটা খুবই সংকীর্ণ ও অদূরদৃষ্টিসম্পন্ন এবং এটা আমাদের সবাইকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
দু'বছরের মাথায় শেখ হাসিনাকে আবার নির্বাচনের মুখোমুখি হতে হবে। তিনি প্রতিদান ছাড়া এই সম্পর্কোন্নয়নের ব্যাপারে অনির্দিষ্টকাল অপেক্ষা করে থেকে তার রাজনৈতিক অবস্থাকে খোয়াতে দিতে পারেন না। পশ্চিমাঞ্চলীয় সীমান্তে নয়াদিলি্ল এতটাই নিবিষ্ট হয়ে আছে যে, পূর্বদিকে তাকানোয় যে তার লাভ সেটা অব্যাহভাবেই সে বিস্মৃত হচ্ছে। প্রাকৃতিক গ্যাস মজুদের নাগাল প্রাপ্তি বা পূর্বাঞ্চলীয় ভারতের বিদ্যুৎ সংকট দূর করাই শুধু নয়, উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোকে বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে যুক্ত করার জন্য সড়ক ও নৌ ট্রানজিট অধিকারপ্রাপ্তি এই অঞ্চলের অর্থনীতিকে সম্পূর্ণরূপে রূপান্তর করে দেবে। তদুপরি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাজারের সঙ্গে বাদবাকি ভারতের সংযুক্তিও বাংলাদেশের সহযোগিতা না পেলে দীর্ঘকালে অর্জিত হবে না।
মনমোহন সিং আগামী সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ সফর করবেন বলে প্রধানমন্ত্রীর দফতর ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে অনেক কিছুই করতে হবে। নয়াদিলি্লর মানসিকতা অবশ্যই পরিবর্তন করতে হবে। ভারতকে কেবল তার নিজের স্বার্থ ভাবলেই চলবে না, তাকে আদান-প্রদানের ভিত্তিতে বাংলাদেশের সঙ্গে দাঁতাতের সম্পর্ক গড়তে হবে। এ জন্য ভারতকেই উদ্যোগী হতে হবে। বাংলাদেশের জন্য ভারতের বাজার সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। অতীত আশ্রয়ী চিন্তা থেকে ভারতের বাংলাদেশ নীতিকে মুক্ত করতে হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুত বিকশিত হচ্ছে; ভারতের মানব উন্নয়ন সূচকের চেয়ে বাংলাদেশের সূচক ভালো অবস্থায় রয়েছে, আর তাদের অর্থনৈতিক উন্নতির প্রকাশটা সাংস্কৃতিক প্রকাশের মাধ্যমেও ঘটছে।
তবে তারা আমাদের মতো ফয়েজ আহমেদকে বেশি করে উদ্ধৃত করতে পারে না। নয়াদিলি্লতে অপর পাঞ্জাবের কবিরাও পূজিত হন এবং সীমান্তের ওপারে ফেলে আসা বাড়িঘরের স্মৃতিতে তারা এখনও এক ধরনের নস্টালজিয়ায় ভোগেন। আর এসব প্রতিটি রাজনৈতিক কথোপকথনের সময় বিচিত্র রূপ নিয়ে উঠে আসে। আরেক অভিন্ন সংস্কৃতি তাদের কাছে প্রাসঙ্গিক হয়ে ধরা দেয় না। এই সংস্কৃতি সম্ভবত আরও সমৃদ্ধ এবং অনেক বেশিসংখ্যক ভারতীয় এটা শেয়ার করে। এই সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তের এপার-ওপার বিস্তৃত।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে প্রকাশিত মিহির এস শর্মার নিবন্ধ থেকে ভাষান্তর সুভাষ সাহা
 

No comments

Powered by Blogger.