গদ্যকার্টুন-অন্তত মঙ্গলবারে হাসুন by আনিসুল হক

প্রথম আলোর ছুটির দিনে সাময়িকী বের হয় শনিবারে। তাতে একটা পাতা আছে কৌতুকের—শিরোনাম: অন্তত শনিবারে হাসুন। শনি কথাটা বাংলায় সব সময় ইতিবাচকভাবে ব্যবহূত হয় না। শনির দশা মানে খুবই খারাপ সময়। জিয়াউর রহমানের আমলে যখন স্বনির্ভর আন্দোলন নামে একটা কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছিল, তখন লোকে সেটাকে


ঠাট্টা করে বলত শনির ভর। তবু, ছুটির দিনের বিজ্ঞ সম্পাদকেরা হতোদ্যম না হয়ে আমাদের শনিবারে হাসতে বলেছেন। আর আমার এই কলামটি, গদ্যকার্টুন, বেরোয় মঙ্গলবারে। এক মঙ্গলবারে রোদন করি, আরেক মঙ্গলবারে তাই হাসার চেষ্টা করি। হাসির পরে কান্না, বলে গেছেন বিনোদ খান্না। কান্নার পরে হাসি, বলে গেছেন বিনোদিনী দাসী। মঙ্গল কথাটার মধ্যেই আবার মঙ্গল নিহিত। হাসলে স্বাস্থ্য ভালো থাকে। কাজেই আসুন, সবাই হাসি এবং মঙ্গলমতো থাকি।
এ কারণেই বিভিন্ন দেশে লাফিং ক্লাব আছে। এই ক্লাবের সদস্যরা একত্র হয়ে হাসেন। আমাদের দেশেও ভোরবেলা রমনা বা ধানমন্ডি লেকের ধারে গেলে দেখতে পাবেন, লোকে লাইন করে হাসছে। দলনেতা বলছেন, হা হা; তাঁর পেছনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো স্বাস্থ্যসন্ধানীরাও জবাব দিচ্ছেন, হা হা। এই কৃত্রিম হাসিও স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। আমাকে একজন চিকিৎসক বলেছেন, হ্যাঁ, ভালো। আমাদের মস্তিষ্ক নাকি ধরতে পারে না কোন হাসিটা কৃত্রিম, কোনটা আসল। ফলে, আসল হাসি হাসার ফলে শরীরে যেসব উপকারী এনজাইম নিঃসরিত হয়, কৃত্রিম হাসির ফলেও সেসব নিঃসরিত হয়। শুনে আমি অট্টহাসিতে মেতে উঠি: ব্রেনের দেখা যাচ্ছে ব্রেন নেই, সে নিজেই বলে কৃত্রিমভাবে হাসো, আবার নিজেই ধরতে পারে না যে এটা কৃত্রিম। এর চেয়ে বোকা আর কে হতে পারে?
সিলেট অঞ্চলে একটা কৌতুক প্রচলিত আছে। একজন আরেকজনকে জিজ্ঞেস করছে, ভাই, সেদিন যে মারা গেল, সে আপনি না আপনার ভাই? দ্বিতীয়জন উত্তর দিলেন, আমার ভাই। প্রথমজন নিশ্চিত হওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, তা-ই হবে, তাই তো বলি, আপনাকে দেখি, তাকে কয়দিন দেখি না কেন!
একটা গ্রামে সবাই বোকা। কিন্তু তারা মানতে নারাজ যে তারা বোকা। তারা পাশের গ্রামের স্কুলে বলল, আমরা বোকা না। আমাদের মধ্যে একজন ডক্টরেট ডিগ্রি পেয়েছেন। তাঁকে পরীক্ষা করলেই বুঝতে পারবেন।
তখন একজন শিক্ষক পিএইচডিধারীকে প্রশ্ন করতে শুরু করলেন, বলুন তো কোন প্রাণী তিন পা নিয়ে পাহাড়ে যায়, আর ফিরে আসে চার পা নিয়ে?
ডক্টর জবাব দিলেন, গরু।
হয়নি।
গ্রামবাসী চিৎকার করে উঠল, তাঁকে আরেকটা চান্স দিন, তাঁকে আরেকটা চান্স দিন।
আচ্ছা, বলুন তো ফ্রান্সের রাজধানীর নাম কী?
লন্ডন।
হয়নি।
সবাই চিৎকার করে উঠল, তাকে আরেকটা চান্স দিন।
তখন মাস্টার মশাই জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, বলুন তো এক আর এক যোগ করলে কী হয়?
ডক্টর সাহেব জবাব দিলেন, দুই।
সবাই চিৎকার করে উঠল, তাঁকে আরেকটা চান্স দিন, তাঁকে আরেকটা চান্স দিন।
এটা হলো সম্মিলিত বোকামির গল্প। আমরা মাঝেমধ্যে এই রকমভাবে কিছু বুঝে ওঠার আগেই স্লোগান ধরে ফেলি এবং নিজেদের ক্ষতি করি বটে। আবার আছে সম্মিলিতভাবে ভুলে যাওয়ার গল্প। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের জাদুবাস্তবতার জগতে। যেখানে সবাই সবকিছু ভুলে যেতে পারে ভেবে বস্তুর গায়ে তার নাম আর কাজ লিখে রাখা হয়। যেমন, এটা হচ্ছে রুটি, এটা সকালে নাশতা হিসেবে খাওয়া হয়। আমাদের একটা সম্মিলিত ভুলভুলাইয়া রোগ আছে। এটা থেকে মুক্তির উপায়টা সম্প্রতি একদল গবেষক বের করেছেন। মাস্টার চোয়া কোক সুই লিখিত সুপারব্রেইন ইয়োগা বইয়ে বিষয়টা বিবৃত হয়েছে। ভুলে যাওয়া রোগের এই চিকিৎসাটা ভারতে অনেক আগে থেকেই প্রচলিত ছিল। ওষুধ লাগবে না। শুধু একটা ব্যায়ামের চর্চা করতে হবে। ব্যায়াম মানে হলো, ডান হাত দিয়ে বাঁ কান আর বাঁ হাত দিয়ে ডান কান ধরে ওঠবস করা। হ্যাঁ, আমাদের শিক্ষকেরা আমাদের ছোটবেলায় যা করাতেন, অনেকটা সেটাই। আমার ভুলে যাওয়া রোগ আছে। আমি ঠিক করেছি, রোজ সকালে ১০ বার কানে ধরে ওঠবস করব।
আমরা কত কি ভুলে যাই। আমরা ভুলে যাই যে আমাদের কথা দেওয়া হয়েছিল, দুর্নীতি দূর করা হবে, দুর্নীতি দমন কমিশনকে শক্তিশালী করা হবে, আমাদের কথা দেওয়া হয়েছিল যে দলীয়করণ করা হবে না, দক্ষতা-যোগ্যতা হবে নিয়োগ-পদোন্নতির একমাত্র মাপকাঠি। আমাদের কথা দেওয়া হয়েছিল যে মানবাধিকার রক্ষা করা হবে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা হবে। আমাদের বলা হয়েছিল, জিনিসপাতির দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা হবে। কেউ কথা রাখেনি, ৪০ বছর কাটল, কেউ কথা রাখে না।
সম্প্রতি ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের গবেষকেরা রক্ষণশীল আর উদারপন্থী, ডান আর বামদের মস্তিষ্কের আকার, ধরন ও গঠন নিয়ে গবেষণা করেছেন। ৭ এপ্রিল ২০১১ টেলিগ্রাফ পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, বৈজ্ঞানিকেরা দেখেছেন, কে কোন পন্থা সমর্থন করবেন, এটা তাঁদের ব্রেইনের আকারেই নিহিত আছে। রক্ষণশীলদের মগজের মধ্যে ভয় আর উদ্বেগের চেম্বারটা বড়। আর বামপন্থীদের যাঁরা শ্রমিক দলকে ভোট দেন, তাঁদের মগজের সামনের অংশটা বড়, যা সাধারণত জীবনের উজ্জ্বল দিক সম্পর্কে মানুষকে আগ্রহী ও সাহসী করে তোলে।
আর উভয়ের মগজের মধ্যেই এই বৈশিষ্ট্যটাও থাকে যে তারা পরস্পরের চোখের দিকে তাকাতে পারে না।
এখন আমরা বুঝছি, কেন আমাদের নেতারা পরস্পরের মুখ দেখাদেখি থেকেও বিরত থাকেন।
তপন রায়চৌধুরী রোমন্থন অথবা ভীমরতিপ্রাপ্তের পরচরিত চর্চা বইয়ে মুখ দেখা সমস্যার একটা সমাধান দিয়েছিলেন। শেরেবাংলা ফজলুল হককে কে যেন বলেছিল, তুমি মিয়া এমন কাজ করছ, তোমার জন্য তো মুখ দেখানোর উপায় নাই। ফজলুল হক তার উত্তরে বলেছিলেন...কী বলেছিলেন, সেটা আমি আর বলতে চাই না। বইটা পড়লে আপনারা জেনে যাবেন।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.