রাজনীতি-সাজানো যুদ্ধের আয়োজন? by আলতাফ পারভেজ
হাজারো সমস্যায় জর্জরিত বাংলাদেশে বিগত আশির দশক থেকে রাজনীতি আবর্তিত হচ্ছে 'নির্বাচন কীভাবে হবে'_ শুধু এই প্রশ্নকে ঘিরে। এ দেশের রাজনীতির প্রতি নজর রাখা বহির্বিশ্বের যে কারও মনে হতে পারে, নির্বাচনী ব্যবস্থাই বোধ হয় বাংলাদেশের একমাত্র সমস্যা।
জনজীবনের মৌলিক সমস্যাগুলো নিয়ে আলাপ-আলোচনা নেই
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যেন আবারও প্রকাশ্য বিদেশি হস্তক্ষেপের জন্য প্রস্তুত হয়ে উঠেছে। রাষ্ট্রদূতরা ইতিমধ্যে স্থানীয় রাজনীতি নিয়ে মন্তব্য করতে শুরু করেছেন। রাজনৈতিক উপলক্ষে ইউরোপীয় মন্ত্রীদের সফরও বেড়েছে। উত্তেজনা তীব্র হলে উত্তর আমেরিকা থেকেও গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীদের আগমন বাড়বে। ইতিমধ্যে বিএনপি-জামায়াত জোট তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে একের পর এক হরতাল দিয়ে যাচ্ছে। জবাবে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে সংবিধান সংশোধন করে ফেলেছে দ্রুত লয়ে। বিএনপি মনে করে, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাই একমাত্র রক্ষাকবচ। আর আওয়ামী লীগ বলছে, তাদের অধীনেই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে। দু' বছর পরে অনুষ্ঠিতব্য একটি নির্বাচন নিয়ে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীদের এই রূপ উপলব্ধি অতিসাম্প্র্রতিক। তবে উপলব্ধির পেছনে যে জিহাদি মনোভাব কাজ করছে তা পুরনো এবং তার কিছু পুরনো পটভূমিও রয়েছে। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য চারদিকে এত সিরিয়াসনেস দেখে বাংলাদেশের রাজনীতির যে কোনো নবীন পর্যবেক্ষকের কাছেই বিষয়টি বিস্ময়কর ঠেকতে পারে; উন্নয়নশীল বিশ্বে কম দেশেই রাজনৈতিক নেতৃত্বকে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে এতটা মরিয়া হয়ে উঠতে দেখা যায়! কিন্তু বাস্তবতা হলো, খুবই কৌশলে এবং চাতুরীর সঙ্গে এভাবে সুষ্ঠু নির্বাচনকে আবারও দেশের রাজনীতির প্রধান ও একমাত্র এজেন্ডায় পরিণত করে ফেলা হলো। এটা প্রকৃতই সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের জন্য রাজনীতিবিদদের আদর্শিক আন্তরিকতা নয়। বরং এ হলো এক ধরনের পাতানো যুদ্ধের আয়োজন, যা এ দেশে চলছে তিন দশক ধরে এবং নাটকে বিদেশি হস্তক্ষেপের অংশটুকুও পূর্বনির্ধারিত।
হাজারো সমস্যায় জর্জরিত বাংলাদেশে বিগত আশির দশক থেকে রাজনীতি আবর্তিত হচ্ছে 'নির্বাচন কীভাবে হবে'_ শুধু এই প্রশ্নকে ঘিরে। এ দেশের রাজনীতির প্রতি নজর রাখা বহির্বিশ্বের যে কারও মনে হতে পারে, নির্বাচনী ব্যবস্থাই বোধহয় বাংলাদেশের একমাত্র সমস্যা। জনজীবনের মৌলিক সমস্যাগুলো নিয়ে কোনো ধরনের আলাপ-আলোচনা-পর্যালোচনাতেই মনোযোগী বা আগ্রহী নন এখানকার প্রধান রাজনীতিবিদরা। এমনকি বারবার তথাকথিত সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য মায়াকান্না করা হলেও প্রধান সব দল সবসময় নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার কাজে নীরবে নিরুৎসাহ ব্যক্ত করে চলেছে। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনী সংস্কৃতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে দৃঢ়তার সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রমে কখনোই প্রকাশ্য সমর্থন দেয়নি তারা। যেমন, এ মুহূর্তে আরেকটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আন্দোলনরত বিএনপি প্রকাশ্যেই নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন ব্যবহারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। আবার সাম্প্র্রতিক কয়েকটি স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েনে নির্বাচন কমিশন আগ্রহী থাকলেও তাতে সায় ছিল না ক্ষমতাসীনদের। যে কারণে স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে এবার পেশিশক্তি ও অর্থশক্তির ব্যবহার ধারণাতীতভাবে বেড়ে গেছে। প্রধান দলগুলো 'অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন' চাইলেও নির্বাচনী ব্যবস্থাকে শক্তিশালী ও সবল করা নয়; তাদের গোপন লক্ষ্য থাকে নির্বাচনী প্রতিষ্ঠান, আইন ও মাঠ কার্যক্রমকে দুর্বল করে রাখা। কারণ এসব প্রতিষ্ঠান আইনগত ও পদ্ধতিগতভাবে যত দুর্বল থাকবে তত সহজে এবং ইচ্ছামতো তাকে ব্যবহার করা যাবে। স্মরণযোগ্য যে, বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে ভোট কার্যক্রমে সহায়তার লক্ষ্যে জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির যে সফল উদ্যোগ বাস্তবায়িত হয়, তাতেও প্রথম দিকে রাজনৈতিক দলগুলোর সায় ছিল না।
আজ বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে হরতাল ডেকেছে। অথচ তারাই ছিল এর ঘোর বিরোধী। অনুরূপভাবে তাদের আজকের প্রতিপক্ষরা এই ব্যবস্থা কায়েমে প্রায় একশ' দিন হরতাল করেছিল। কিন্তু এখন সেই 'অর্জন'কে ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলে দিতে মোটেই কুণ্ঠাবোধ করেনি।
গত তিন দশকে প্রতিটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা অনুরূপ ব্যবস্থায় হলেও প্রধান দলগুলো কখনোই সম্মিলিতভাবে সে নির্বাচনী ফল মেনে নেয়নি। জাতীয় সংসদকেও কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করতে দেয়নি তারা। 'সুষ্ঠু নির্বাচন' তাদের প্রয়োজন স্রেফ ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য, দেশের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করার জন্য নয়। বরং এসব প্রতিষ্ঠান যত দুর্বল থাকে ততই রাজতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতার চর্চা করা যায়।
বিগত প্রতিটি নির্বাচনের পরই প্রধান দলগুলো ধারাবাহিকভাবে সংসদ বর্জন করে 'সংসদীয় শাসনব্যবস্থা'র নামে দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা অপচয় করিয়েছে। '৯০-এ সংগ্রামী ছাত্রসমাজকেও তারা দিকভ্রান্ত করিয়েছিল তথাকথিত 'সংসদীয় শাসনব্যবস্থা'র মহিমা কীর্তন করে। বাস্তবে দেখা গেল 'সুষ্ঠু নির্বাচন'-এর মাধ্যমে 'সংসদীয় শাসনব্যবস্থা' তাদের আরাধ্য হলেও সুশাসনে তাদের পুরোপুরি অনীহা। উভয় দলের আগ্রহ রাজতন্ত্রে। কারণ সেখানে জবাবদিহিতার কোনো বালাই নেই। অর্থাৎ মোড়কটি থাকবে গণতন্ত্রের, কিন্তু ব্যবস্থাটি থাকবে রাজতান্ত্রিক এবং তার সাংস্কৃতিক প্রকাশ থাকবে সামন্ততান্ত্রিক। যে কারণে বাংলাদেশের 'সংসদীয় গণতন্ত্র' এখন কার্যত 'কয়েকটি পরিবারের ধনতন্ত্র'-এর পরিপূরক হয়ে উঠেছে।
উলেল্গখ্য, 'সুষ্ঠু নির্বাচন' নামক এই রাজনৈতিক মাদকের চাষাবাদ যখন শুরু হয়, সেই আশির দশকেই এ দেশে বাজার অর্থনীতি নামক আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার মহাসমারোহে যাত্রা। ১৬ কোটি মানুষের একটি বাজার আন্তর্জাতিক পুঁজির বিকাশের জন্য অতি উত্তম এক মৃগয়া ক্ষেত্র। অশিক্ষিত ও অসচেতন ক্রেতার এত বিশাল বাজারে পুঁজি ও মুনাফার নিরবচ্ছিন্ন বিকাশ নিশ্চিত করতে এবং ক্রেতা সমাজকে বাণিজ্যিক শোষণ সম্পর্কে অজ্ঞ ও অন্ধকারে রেখে দিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে অর্থহীন এক বৈরিতার ফাঁদে ঠেলে দেয় বণিকতন্ত্র। বিশ্বের অন্যত্র বণিকতন্ত্র রাজনীতিকে প্রভাবিত করে, কিন্তু বাংলাদেশে বণিকতন্ত্রের মুখ্য খেলোয়াড় সবাই সরাসরি রাজনীতিতে ঢুকে পড়েছেন। তাদের পরিকল্পনামতোই আওয়ামী লীগ যা বলবে এবং করবে, বিএনপি তার বিরোধিতা করবে এবং বিএনপি যা করবে ও বলবে, আওয়ামী লীগ তার বিরোধিতা করবে। পাঁচ বছর পরপর উভয়কে ক্ষমতার স্বাদ দেওয়া হচ্ছে। ফলে বণিকতন্ত্রের নির্ধারিত খেলার ছকে রাজনৈতিক কর্মীরা তৃপ্ত। খেলার শর্ত হিসেবে ব্যবসা-বাণিজ্যের শোষণ প্রক্রিয়া সম্পর্কে আওয়ামী লীগ-বিএনপির তরফ থেকে কখনোই কোনো প্রশ্ন তোলা হয় না। যে কারণে এ মুহূর্তে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, শেয়ার কেলেঙ্কারি, বিদেশি কোম্পানিগুলোকে খনিজসম্পদ দিয়ে দেওয়া, ট্রানজিট ইত্যাদি অতি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক প্রসঙ্গগুলো নিয়ে আওয়ামী লীগ যে সিদ্ধান্তই নিচ্ছে, বিএনপি তাতে খুব বেশি আপত্তি করছে না। কারণ এগুলো জনগণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় হলেও বিএনপির স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় হলো শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যু। কারণ সেখানে 'সুষ্ঠু নির্বাচন'-এর ম্যাজিক রয়েছে। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য বিএনপির সামনে এখন কেবল সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রশ্নটি জরুরি। একইভাবে ক্ষমতার পালাবদল ঠেকাতে আওয়ামী লীগের জন্য জরুরি 'সুষ্ঠু নির্বাচন'টি নিজেদের অধীনে করা। কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে তো এ মুহূর্তে এবং ভবিষ্যতেও 'সুষ্ঠু নির্বাচন'ই একমাত্র এজেন্ডা নয়। কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি সাগরবক্ষের গ্যাস সম্পদের মালিকানা পাচ্ছে, কীভাবে বিনা শুল্কে ভারত ট্রানজিট পাচ্ছে, কেন প্রতিদিন চাল-ডাল-তেলের দাম বাড়ছে, রাষ্ট্রীয় বাজেট বরাদ্দ কীভাবে ঠিকাদার ও রাজনৈতিক টাউটদের মাধ্যমে হরিলুট হচ্ছে_ সেব প্রশ্নের দিকেই মানুষের মনোযোগ। সুষ্ঠু নির্বাচন না হলেও এ দেশে শাসকের অভাব হয়নি, তেমনি তিন দশকের অভিজ্ঞতা বলছে, সুষ্ঠু নির্বাচন হলেও তারাই শাসক হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছেন, যাদের লুণ্ঠন ক্ষুধা অতলান্তিক।
সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে এ দেশে ক্ষমতার অর্থবহ পালাবদল ঘটবে না, ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক পরিচয় পাল্টাবে মাত্র। সাধারণের কাছে তাই সুষ্ঠু নির্বাচনের বিশেষ কোনো তাৎপর্য নেই। তাদের কাছে জরুরি হলো, নির্বাচিতদের রাষ্ট্রীয় লুণ্ঠন বন্ধ হবে কবে, রাষ্ট্রীয় সম্পদে জনগণের হিস্যা নিশ্চিত হবে কীভাবে এবং বণিকতন্ত্রকে সুশাসনের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবে কারা।
আলতাফ পারভেজ : লেখক ও গবেষক
altafparvez@yahoo.com
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যেন আবারও প্রকাশ্য বিদেশি হস্তক্ষেপের জন্য প্রস্তুত হয়ে উঠেছে। রাষ্ট্রদূতরা ইতিমধ্যে স্থানীয় রাজনীতি নিয়ে মন্তব্য করতে শুরু করেছেন। রাজনৈতিক উপলক্ষে ইউরোপীয় মন্ত্রীদের সফরও বেড়েছে। উত্তেজনা তীব্র হলে উত্তর আমেরিকা থেকেও গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীদের আগমন বাড়বে। ইতিমধ্যে বিএনপি-জামায়াত জোট তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে একের পর এক হরতাল দিয়ে যাচ্ছে। জবাবে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে সংবিধান সংশোধন করে ফেলেছে দ্রুত লয়ে। বিএনপি মনে করে, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাই একমাত্র রক্ষাকবচ। আর আওয়ামী লীগ বলছে, তাদের অধীনেই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে। দু' বছর পরে অনুষ্ঠিতব্য একটি নির্বাচন নিয়ে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীদের এই রূপ উপলব্ধি অতিসাম্প্র্রতিক। তবে উপলব্ধির পেছনে যে জিহাদি মনোভাব কাজ করছে তা পুরনো এবং তার কিছু পুরনো পটভূমিও রয়েছে। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য চারদিকে এত সিরিয়াসনেস দেখে বাংলাদেশের রাজনীতির যে কোনো নবীন পর্যবেক্ষকের কাছেই বিষয়টি বিস্ময়কর ঠেকতে পারে; উন্নয়নশীল বিশ্বে কম দেশেই রাজনৈতিক নেতৃত্বকে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে এতটা মরিয়া হয়ে উঠতে দেখা যায়! কিন্তু বাস্তবতা হলো, খুবই কৌশলে এবং চাতুরীর সঙ্গে এভাবে সুষ্ঠু নির্বাচনকে আবারও দেশের রাজনীতির প্রধান ও একমাত্র এজেন্ডায় পরিণত করে ফেলা হলো। এটা প্রকৃতই সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের জন্য রাজনীতিবিদদের আদর্শিক আন্তরিকতা নয়। বরং এ হলো এক ধরনের পাতানো যুদ্ধের আয়োজন, যা এ দেশে চলছে তিন দশক ধরে এবং নাটকে বিদেশি হস্তক্ষেপের অংশটুকুও পূর্বনির্ধারিত।
হাজারো সমস্যায় জর্জরিত বাংলাদেশে বিগত আশির দশক থেকে রাজনীতি আবর্তিত হচ্ছে 'নির্বাচন কীভাবে হবে'_ শুধু এই প্রশ্নকে ঘিরে। এ দেশের রাজনীতির প্রতি নজর রাখা বহির্বিশ্বের যে কারও মনে হতে পারে, নির্বাচনী ব্যবস্থাই বোধহয় বাংলাদেশের একমাত্র সমস্যা। জনজীবনের মৌলিক সমস্যাগুলো নিয়ে কোনো ধরনের আলাপ-আলোচনা-পর্যালোচনাতেই মনোযোগী বা আগ্রহী নন এখানকার প্রধান রাজনীতিবিদরা। এমনকি বারবার তথাকথিত সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য মায়াকান্না করা হলেও প্রধান সব দল সবসময় নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার কাজে নীরবে নিরুৎসাহ ব্যক্ত করে চলেছে। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনী সংস্কৃতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে দৃঢ়তার সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রমে কখনোই প্রকাশ্য সমর্থন দেয়নি তারা। যেমন, এ মুহূর্তে আরেকটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আন্দোলনরত বিএনপি প্রকাশ্যেই নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন ব্যবহারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। আবার সাম্প্র্রতিক কয়েকটি স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েনে নির্বাচন কমিশন আগ্রহী থাকলেও তাতে সায় ছিল না ক্ষমতাসীনদের। যে কারণে স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে এবার পেশিশক্তি ও অর্থশক্তির ব্যবহার ধারণাতীতভাবে বেড়ে গেছে। প্রধান দলগুলো 'অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন' চাইলেও নির্বাচনী ব্যবস্থাকে শক্তিশালী ও সবল করা নয়; তাদের গোপন লক্ষ্য থাকে নির্বাচনী প্রতিষ্ঠান, আইন ও মাঠ কার্যক্রমকে দুর্বল করে রাখা। কারণ এসব প্রতিষ্ঠান আইনগত ও পদ্ধতিগতভাবে যত দুর্বল থাকবে তত সহজে এবং ইচ্ছামতো তাকে ব্যবহার করা যাবে। স্মরণযোগ্য যে, বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে ভোট কার্যক্রমে সহায়তার লক্ষ্যে জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির যে সফল উদ্যোগ বাস্তবায়িত হয়, তাতেও প্রথম দিকে রাজনৈতিক দলগুলোর সায় ছিল না।
আজ বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে হরতাল ডেকেছে। অথচ তারাই ছিল এর ঘোর বিরোধী। অনুরূপভাবে তাদের আজকের প্রতিপক্ষরা এই ব্যবস্থা কায়েমে প্রায় একশ' দিন হরতাল করেছিল। কিন্তু এখন সেই 'অর্জন'কে ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলে দিতে মোটেই কুণ্ঠাবোধ করেনি।
গত তিন দশকে প্রতিটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা অনুরূপ ব্যবস্থায় হলেও প্রধান দলগুলো কখনোই সম্মিলিতভাবে সে নির্বাচনী ফল মেনে নেয়নি। জাতীয় সংসদকেও কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করতে দেয়নি তারা। 'সুষ্ঠু নির্বাচন' তাদের প্রয়োজন স্রেফ ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য, দেশের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করার জন্য নয়। বরং এসব প্রতিষ্ঠান যত দুর্বল থাকে ততই রাজতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতার চর্চা করা যায়।
বিগত প্রতিটি নির্বাচনের পরই প্রধান দলগুলো ধারাবাহিকভাবে সংসদ বর্জন করে 'সংসদীয় শাসনব্যবস্থা'র নামে দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা অপচয় করিয়েছে। '৯০-এ সংগ্রামী ছাত্রসমাজকেও তারা দিকভ্রান্ত করিয়েছিল তথাকথিত 'সংসদীয় শাসনব্যবস্থা'র মহিমা কীর্তন করে। বাস্তবে দেখা গেল 'সুষ্ঠু নির্বাচন'-এর মাধ্যমে 'সংসদীয় শাসনব্যবস্থা' তাদের আরাধ্য হলেও সুশাসনে তাদের পুরোপুরি অনীহা। উভয় দলের আগ্রহ রাজতন্ত্রে। কারণ সেখানে জবাবদিহিতার কোনো বালাই নেই। অর্থাৎ মোড়কটি থাকবে গণতন্ত্রের, কিন্তু ব্যবস্থাটি থাকবে রাজতান্ত্রিক এবং তার সাংস্কৃতিক প্রকাশ থাকবে সামন্ততান্ত্রিক। যে কারণে বাংলাদেশের 'সংসদীয় গণতন্ত্র' এখন কার্যত 'কয়েকটি পরিবারের ধনতন্ত্র'-এর পরিপূরক হয়ে উঠেছে।
উলেল্গখ্য, 'সুষ্ঠু নির্বাচন' নামক এই রাজনৈতিক মাদকের চাষাবাদ যখন শুরু হয়, সেই আশির দশকেই এ দেশে বাজার অর্থনীতি নামক আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার মহাসমারোহে যাত্রা। ১৬ কোটি মানুষের একটি বাজার আন্তর্জাতিক পুঁজির বিকাশের জন্য অতি উত্তম এক মৃগয়া ক্ষেত্র। অশিক্ষিত ও অসচেতন ক্রেতার এত বিশাল বাজারে পুঁজি ও মুনাফার নিরবচ্ছিন্ন বিকাশ নিশ্চিত করতে এবং ক্রেতা সমাজকে বাণিজ্যিক শোষণ সম্পর্কে অজ্ঞ ও অন্ধকারে রেখে দিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে অর্থহীন এক বৈরিতার ফাঁদে ঠেলে দেয় বণিকতন্ত্র। বিশ্বের অন্যত্র বণিকতন্ত্র রাজনীতিকে প্রভাবিত করে, কিন্তু বাংলাদেশে বণিকতন্ত্রের মুখ্য খেলোয়াড় সবাই সরাসরি রাজনীতিতে ঢুকে পড়েছেন। তাদের পরিকল্পনামতোই আওয়ামী লীগ যা বলবে এবং করবে, বিএনপি তার বিরোধিতা করবে এবং বিএনপি যা করবে ও বলবে, আওয়ামী লীগ তার বিরোধিতা করবে। পাঁচ বছর পরপর উভয়কে ক্ষমতার স্বাদ দেওয়া হচ্ছে। ফলে বণিকতন্ত্রের নির্ধারিত খেলার ছকে রাজনৈতিক কর্মীরা তৃপ্ত। খেলার শর্ত হিসেবে ব্যবসা-বাণিজ্যের শোষণ প্রক্রিয়া সম্পর্কে আওয়ামী লীগ-বিএনপির তরফ থেকে কখনোই কোনো প্রশ্ন তোলা হয় না। যে কারণে এ মুহূর্তে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, শেয়ার কেলেঙ্কারি, বিদেশি কোম্পানিগুলোকে খনিজসম্পদ দিয়ে দেওয়া, ট্রানজিট ইত্যাদি অতি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক প্রসঙ্গগুলো নিয়ে আওয়ামী লীগ যে সিদ্ধান্তই নিচ্ছে, বিএনপি তাতে খুব বেশি আপত্তি করছে না। কারণ এগুলো জনগণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় হলেও বিএনপির স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় হলো শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যু। কারণ সেখানে 'সুষ্ঠু নির্বাচন'-এর ম্যাজিক রয়েছে। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য বিএনপির সামনে এখন কেবল সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রশ্নটি জরুরি। একইভাবে ক্ষমতার পালাবদল ঠেকাতে আওয়ামী লীগের জন্য জরুরি 'সুষ্ঠু নির্বাচন'টি নিজেদের অধীনে করা। কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে তো এ মুহূর্তে এবং ভবিষ্যতেও 'সুষ্ঠু নির্বাচন'ই একমাত্র এজেন্ডা নয়। কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি সাগরবক্ষের গ্যাস সম্পদের মালিকানা পাচ্ছে, কীভাবে বিনা শুল্কে ভারত ট্রানজিট পাচ্ছে, কেন প্রতিদিন চাল-ডাল-তেলের দাম বাড়ছে, রাষ্ট্রীয় বাজেট বরাদ্দ কীভাবে ঠিকাদার ও রাজনৈতিক টাউটদের মাধ্যমে হরিলুট হচ্ছে_ সেব প্রশ্নের দিকেই মানুষের মনোযোগ। সুষ্ঠু নির্বাচন না হলেও এ দেশে শাসকের অভাব হয়নি, তেমনি তিন দশকের অভিজ্ঞতা বলছে, সুষ্ঠু নির্বাচন হলেও তারাই শাসক হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছেন, যাদের লুণ্ঠন ক্ষুধা অতলান্তিক।
সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে এ দেশে ক্ষমতার অর্থবহ পালাবদল ঘটবে না, ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক পরিচয় পাল্টাবে মাত্র। সাধারণের কাছে তাই সুষ্ঠু নির্বাচনের বিশেষ কোনো তাৎপর্য নেই। তাদের কাছে জরুরি হলো, নির্বাচিতদের রাষ্ট্রীয় লুণ্ঠন বন্ধ হবে কবে, রাষ্ট্রীয় সম্পদে জনগণের হিস্যা নিশ্চিত হবে কীভাবে এবং বণিকতন্ত্রকে সুশাসনের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবে কারা।
আলতাফ পারভেজ : লেখক ও গবেষক
altafparvez@yahoo.com
No comments